কবি বীরেন মুখার্জীর জন্মদিনে কাব্যশীলনের পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা

কবির কিছু কবিতা নিন্মে দেয়া হলো

জেগে থাক এইসব রাত্রি

রাত্রির অন্তরে জেগে থাক সবটুকু ওলট-পালট
ভাঁজ হয়ে থাকা সময়ের কোলাহল ছুঁয়ে- একমনে!
যদি, নিবিষ্টতা নাচে যাজক পথের শর্তে
মুঠো খুলে দাও, আর নিষ্পলক তাকিয়ে দেখো-
এই অন্ধরাত, যেন বিশীর্ণ ঘোড়ার হাহাকারে
ঢেলে দিয়েছে রাষ্ট্রনীতির কূটিল ধারণা!

মানুষ কি লোভেই বাঁচে? এই প্রশ্ন বহু পুরাতন
তোলা আছে চূড়ান্ত আসরে; তবু যারা কোনও শর্ত
লঙ্ঘন করেনি, আলো কাঁধে সামনে হেঁটেছে আর
সাধনগ্রন্থের আবর্তন ভেঙে বেরিয়েছে পথে-
কৃষিসংহিতা খুলে তারাই আঁকে- নতুন সবুজ;

রাত্রির প্রশ্নশীল অন্তর, ওলট-পালট খুললেই
স্নানে ও সুগন্ধে আন্দোলিত হয়ে ওঠে বসন্ত বিভ্রাট!

দ্বিধার দরজা ভেঙে

অনন্ত দ্বন্দ্বের মধ্যে কী সুন্দর সুরেলা দুপুর- জীবনের প্রশস্তি গাইতে গাইতে অবিরাম, পৌঁছে যায় লক্ষণরেখায়; সুপরিকল্পিত সেই গমনের ভেতরও নতমুখী ব্যঞ্জনা ফুটে ওঠে, আর উপেক্ষিত ধ্বনির ভেতর কবেকার নষ্টচন্দ্র রাত জলপর্যটনের বিভোর স্বপ্নে খুঁচিয়ে তোলে আর্ত হাহাকার! হৃদচাঞ্চল্য ছাড়া কিছুই অবশিষ্ট নেই আমার; সমুদ্রকাতর ইচ্ছে নিয়ে পৃথিবীর সুপ্রাচীন রোদে হেঁটে যাওয়া ছাড়াও গত্যন্তর নেই-

এভাবেই- দৈনন্দিন বোধের ভেতর যন্ত্রণাসকল পাখা মেলে, আর আততায়ী প্রেমে খণ্ডিত হতে হতে, আকণ্ঠ ডুবে যাই জেদে; রঙমহল ছেড়ে যাওয়ার আগে নাড়িয়ে দিতে চেষ্টা করি প্রথাজর্জর মন আর বর্ণ-বনসাই ক্ষেত; ভাবি, হয়তো বা প্রবেশাধিকার মিলবে অপ্রচল কোনও পথে-

হে প্রাজ্ঞ বোধ- দ্বিধার দরজা ভেঙে যত খুশি প্রত্যাশা উড়াও-

মার্চের কবিতা

নতুন মূর্তির গল্প বলতে বলতে বহুদূরে
সরে যায় অজস্র যাপন, প্রলম্বিত প্রতিবিম্ব থেকে
যে দাসত্বের উদগীরণ সম্মোহিত করেছিল
নিখুঁত আয়নার মতো, তার প্রারম্ভবিন্দুতে দেখি
নাতিশীতোষ্ণ অন্ধকার; জীবনধর্মে সেই কি ঈশ্বর?

ঈশ্বরের গল্প বুনতে বুনতে ঈশ্বর হয়ে উঠি
সমগ্র দিনের বৃত্তে যার নাম ওঠে আর নামে
বিস্ফারিত চোখে সেই দৃশ্য চিত্রিত হয়ে থাকে;

প্রতিদিন ইতিহাস খুলি আর শত্রু-মিত্র দেখি
আলো-আঁধারি ফুঁড়ে জীবন সমগ্রে ঢুকে পড়ে
প্রিয় সেই নাম- বাংলাদেশ-

সারাৎসার

গন্তব্য পৃথক- ফলঘ্রাণে উদ্বেলিত জ্যৈষ্ঠের বাগিচা প্রতীক্ষা শেষে দূরে সরে গেছে, আর অস্তিত্বের ভেতর ক্রমে প্রসারিত হতে চাইছে বিগলিত মনোযোগ; যেখানে দেবীর বন্দনা নেই, অথচ- অসম বৃক্ষে নৈবেদ্য রেখেছে অচেনা কেউ! এ-দৃশ্য তাদের কাছে ক্লিশে নয়, যারা অকাতর দৌড়প্রবণ- অরণ্যানী ছেড়ে বিপর্যস্তু মানুষের দিকে হেঁটে আসে নিভৃতে।

পঁচিশ বসন্তে যে-দৃশ্যে ভেঙে যেত আটপৌরে ঘুম, পঞ্চাশেও সেই ভগ্নদশা ফলবান; যদিও কোনও কোনও রাতে রাইটার্স রিভিউয়ে তোমার নাম উঠে এলে যৌন-সংবেদনার কথা ভাবো পুনরায়; বিচ্ছেদমুহ‚র্ত থেকে যেদিন প্রত্যাবর্তন ঘটেছিল স্বীয়-সৌকর্যে, তার ঘনশ্যাম রূপ ও কুহকেও লেগে ছিল সংবেদনাময় এমন জোড়াঋতু, দেখতে পাওনি বলে দিকে দিকে এত অট্টহাসি আর তন্ত্রের ডামাডোল…

হতে পারে, দিন কিংবা রাতে; অজানায় বেরিয়ে পড়বে বলে সচেতন-ঘুমে বুদ হয়ে আছে কেউ, রক্তলোলুপ পৃথিবীর পথে হয়তো বা খুঁজে ফিরছে পাগলপারা জ্যৈষ্ঠনন্দন!

সংক্রান্তির দিনে

অগাধ তৃষ্ণায় ভেসে যেতে যেতে শোনা গিয়েছিল
বিপন্ন নদীর কাছে শুয়ে আছে নিখিলের স্বর
স্মরণিকা থেকে উঠে আসা সেই কল্পস্বর,
মিশে আছে চোখ ও নখে, কিছুটা ভ্রমণলীলায়-ও;
তবু তোমার নিষ্ফল গ্রীবা পৃথিবীসমান বোধে উদগ্র
ক্রমেই ঢুকে যাচ্ছে লজ্জার করুণ রসায়নে…

ফলত আবার দাঁড়াই যদি, দিন শেষে, তোমার অঞ্চলে
মাকাল ফলের মতো সন্ধ্যা ঘিরে নেমে এসো-

কবিতাগুলো কবির সর্বশেষ কবিতাগ্রন্থ ‘মায়া ও অশ্রুনিনাদ’ থেকে আহরিত

বীরেন মুখার্জী : পরিচিতি

জন্ম: ৪ মার্চ ১৯৬৯, মাগুরার শালিখা উপজেলার দরিশলই গ্রামে। তিনি ১৮ বছর মাগুরায় থেকে ‘দৈনিক ভোর’, ‘দৈনিক রানার’, ‘আজকের কাগজ’, ‘ভোরের কাগজ’, ‘বাংলাবাজার পত্রিকা’ এবং ‘আমার দেশ’ পত্রিকায় সাংবাদিকতা করেছেন। বর্তমানে তিনি ‘দৈনিক যায়যায়দিন’ পত্রিকার সম্পাদকীয় বিভাগে কর্মরত আছেন। বীরেন মুখার্জী নব্বইয়ের সময়পর্বের অন্যতম শক্তিশালী কবি ও স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাতা। কবিতা রচনার পাশাপাশি গল্প, প্রবন্ধ, উপন্যাস রাজনৈতিক কলাম লিখে থাকেন। তার আগ্রহের অন্যতম বিষয় ‘মুক্তিযুদ্ধ’ এবং ‘লোকঐতিহ্য’। এ বিষয়ে তার অনেক প্রবন্ধ জাতীয় দৈনিক এবং বিভিন্ন ছোটকাগজে প্রকাশিত হয়েছে এবং হচ্ছে। ২৫ বছর ধরে সম্পাদনা করছেন শিল্প-সাহিত্যের ছোটকাগজ ‘দৃষ্টি’। ইতিমধ্যে যার ১৯টি সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছে।

প্রকাশিত কবিতাগ্রন্থ
উদ্ভ্রান্ত সময় (১৯৯৮, কলকাতা)
প্রণয়ের চিহ্নপর্ব (২০০৯)
প্লানচেট ভোর কিংবা মাতাল বাতাস (২০১১)
নৈঃশব্দ্যের ঘ্রাণ (২০১২)
পালকের ঐশ্বর্য (২০১৩)
মৌনতা (দীর্ঘ কবিতা ২০১৩)
জলের কারুকাজ (২০১৪)
হেমন্তের অর্কেস্ট্রা (২০১৬)
গুচ্ছঘাসের অন্ধকার (২০১৭)
জতুগৃহের ভস্ম (২০২০)
মায়া ও অশ্রুনিনাদ (২০২০)

প্রকাশিত প্রবন্ধগ্রন্থ
কবির অন্তর্লোক ও অন্যান্য প্রবন্ধ (প্রবন্ধ ২০১২)
সাহিত্যের প্রতিপাঠ (প্রবন্ধ ২০১৪)
কবিতার শক্তি (২০১৮)

সম্পাদিত গ্রন্থ
বাংলা কবিতায় ঐতিহ্য (সম্পাদনা প্রবন্ধগ্রন্থ ২০১৪)
জলেশ্বরীর শুদ্ধ মনীষী (২০১৭)

গল্পগ্রন্থ
পাগলী ও বুড়ো বটগাছ (২০১৬)

গবেষণাগ্রন্থ
মুক্তিযুদ্ধের কিশোর ইতিহাস মাগুরা জেলা (২০১৬)

পুরস্কার
শ্রীপুর সাহিত্য পুরস্কার ২০১৯ (কবিতা)

স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র
ঘোর- দ্য ইনটেন্স অব লাইফ (২০১৮)

১৯৯৪ সাল থেকে সম্পাদনা করেন শিল্প-সাহিত্যের ছোটকাগজ ‘দৃষ্টি’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *