কথাসাহিত্যিক প্রিন্স আশরাফ-এর মাটি উপন্যাসটি মাটি-মানুষের প্রতিচ্ছবি।। মনিরা মিতা

প্রিয় বাংলা পাণ্ডুলিপি পুরস্কার ‘২০ বিজয়ী বই ‘মাটি’ উপন্যাসের লেখক প্রিন্স আশরাফ।
বইটি প্রকাশ করেছে প্রিয় বাংলা প্রকাশন,
প্রকাশক এস এম জসিম ভূইয়া। প্রচ্ছদ এঁকেছেন -লিমন মেহদী।৭৯ পৃষ্ঠার বইটির মূল্য ২০০ টাকা। বইটি লেখক উৎসর্গ করেছেন তার “বাবা”কে।
বইটি খুললেই চোখে পড়ে প্রকৃতির অপূর্ব বর্ণনা।সবুজ রঙের অসম্ভব সুন্দর উপমা দিতে গিয়ে তিনি লিখেছেন ” হরেক রঙের সবুজ।কচি ধানের কাঁচা সবুজ,কৃষ্ণচূড়ার- রাধাচূড়ার কালচে সবুজ,কচুরিপানার গাঢ় সবুজ,শ্যাওলার সবুজ, আম- জাম- কাঁঠালের ঘন সবুজ, কচিবাঁশের সবুজ ডগা,ঘন বেতের সবুজ।”
‘এই গল্প মা-মাটি-মানুষের। এই গল্প একজন সরকারি চাকুরে চিকিৎসকের।এই গল্প একজন ভিটেমাটি হারানো হতভাগ্য মানুষের। এই গল্প অনিয়মের।এই গল্প নিজ জমি থেকে উচ্ছেদের গল্প।এই গল্প অধিকার ফিরে পাবার লড়াইয়ের গল্প। এই গল্প চাষের জমিতে সরকারি প্রকল্প রোধের গল্প। মাটির জন্য আন্দোলনের গল্প। যে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে পথ থেকে পথে…’
উপন্যাসের শুরুতেই লেখক সোঁদা
মাটির গন্ধের কথা বললেন। লেখক গল্পের মূল চরিত্রের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য বুঝানোর জন্য “মাটি” শব্দটি বার বার ব্যবহার করেছেন।কারন মানুষ মাটির তৈরি একদিন মাটিই হবে তার শেষ আশ্রয়।উপন্যাসের নায়ক চিকিৎসক সাইফুলের ” মুখ থেকে,তার গা থেকে,তার চলন-বলন থেকে,তার কথাবার্তা থেকে সে মাটির সোঁদা গন্ধ দূর করতে পারে না।” এ বনর্নার মাধ্যমে লেখক পাঠকদের মাটির কাছাকাছি নিয়ে যায়।
এই উপন্যাসে তিনি শুধু গ্রাম নয় ফুটিয়ে তুলেছেন শহুরে জীবন ও।দেখিয়েছেন একজন চিকিৎসকের মানবিক মূল্যবোধ,দায়িত্ববোধ।এ উপন্যাসে তিনি দেখিয়েছেন সমাজের অনিয়ম, অসঙ্গতি ও উৎপীড়নের চিত্র। চাষের জমিতে সরকারি প্রকল্প এবং সরকারী প্রতিনিধিদের চোখ রাঙানো দৃশ্য নিখুঁত ভাবে এঁকেছেন এখানে।এক অসহায় বৃদ্ধ রোগীর মৃত্যুর পূর্বকথা রাখতে গিয়ে লাশবাহী গাড়ি নিয়ে নিজের চেম্বার ফেলে সাইফুল ছুটে যান বৃদ্ধের গ্রামের বাড়ি। যাত্রাপথে ঘটে যায় নানা ঘটনা।পথিমধ্যে মারাত্মক দুর্ঘটনায় কবলিত দুই মহিলাকে চিকিৎসা সেবা দিতেও পিছু পা হয়নি সাইফুল।
অর্থ মানুষের জীবনে এক মোহ।” কাঁচা টাকার আলাদা একটা মোহ আছে।সেই মোহ থেকে সহজে বেরিয়ে আসা যায় না।”
এটা মানুষের জীবনের বাস্তবচিত্র। তবুও সাইফুল সে মোহ ভেদ করে মনুষ্যত্বের কারণে ছুটে চলে দূর অচেনা গ্রামে।
চেয়ায়ম্যানের কচি বৌয়ের লজ্জা রাঙা মুখটা জুলুজুলু নয়নে তাকিয়ে দেখে সাইফুল। ভালোলাগা – ভালোবাসা জীবনের অংশ।তবে ভালোবাসার ধরণ পরিবর্তন হয়,এক সময় যাকে হৃদয় খুব করে চায় সময়ের পরিবর্তনে তার আবেদন ফ্যাকাশে হয়ে যায়। তাইতো একসময় সাইফুল নিজের ছাত্রীকে মনে প্রাণে চাইলেও সময়ের সাথে সেই চাওয়া অনীহায় পরিবর্তন হয়।
বৃষ্টি মনেকে সতেজ করে তোলে।লেখকের ভাষায়” যেন বৃষ্টির তোড়ে মনের গ্লানি ভেসে যাচ্ছে”। সাইফুল বৃষ্টি দেখে, মনকে করে নেয় পবিত্র।
বাবার প্রতি সাইফুলের প্রচন্ড ভালোবাসার টানে সে মৃত বৃদ্ধকে থেকে থেকে নিজের বাবার মুখের সাথে ঘুলিয়ে ফেলে।বাবাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখে” স্বপ্নের মধ্যে বুড়োর লাশ হয়ে যায় তার বাবার লাশ।কবরের মাটি খুঁড়ে পাকাবাড়ির ভীত।সেখানে বিল্ডিং, তার নিচে চাপা পড়েছে বাবা।মৃত বাবা নয়,জীবিত বাবা।”
উপন্যাসের শেষে সাইফুল অসহায় বৃদ্ধের ছেলে হয়ে তার কর্তব্য সম্পূর্ণ করে।সেই সাথে নিজ বাবার প্রতি শেষ কর্তব্য না করতে পারার গ্লানিবোধটুকুর মুক্তি খোঁজে। অতঃপর,শহরের মোহ ছেড়ে বাবার কবরের কাছে, গ্রামের বাড়িতে রওনা দেয়। পিছনে ফেলে যায় হাসপাতাল, চাকরি, চেম্বার আর এক সময়ের ভালোবাসার ” নিশা” কে।
চমৎকার এই বইটি পাঠকপ্রিয়তা পাবে বলে আমার বিশ্বাস। পরিশেষে, লেখকের সার্বিক মঙ্গল কামনা করছি যেন ভবিষ্যতে পাঠকরা আরও ভালো বই পেতে পারেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *