শিশুতোষ গল্প

ঈদসংখ্যার শিশুতোষ গল্প।। ক্ষুদে বাঁশিওয়ালা।। জোবায়ের মিলন

সে তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে। স্কুলের পড়ায় মনোযোগ কম। লেখাধুলায়ও মনোযোগ নেই। বাসার সবাই এ বেশ নিয়ে বেশ চিন্তিত। এ বাসায় কেউ বিএ এমএ পাশের নিচে পড়াশোনা করেনি। সবাই বড় বড় পদে চাকরি করে। দেশের গুরুত্বপূর্ণ কাজে নিয়োজিত তারা। কিন্তু পড়ার নাম শুনলেই সে মন ভার করে এক কোণে বসে থাকে। স্কুলের সময় হলে স্কুলে যেতে চায় না। জোর করেও নেওয়া যায় না। কী করা যায়! ভেবে পায় না বাবা, মা।
তার নাম নীলু। পাড়ার সবাই নীলুকে এক নামে চেনে। কাছের লোকেরাও নীলুর নাম শুনলে মাথা নাড়িয়ে চিনি মন্তব্য করে। অনেকে অনেক দূর থেকেও তাকে দেখতে আসে। বিকালে মাঠের একপাশে তাকে নিয়ে গোল করে বসে সবাই। নীলুকে একপ্রকার কাঁধে করেই রাখে। তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ থাকে আগতরা। তার কারণ, ওই বয়সে নীলু দারুণ বাঁশি বাজাতে পারে। নীলু যখন বাঁশি বাজাতে শুরু করে তখন চারপাশ নীরব হয়ে যায়। ছোট থেকে বড়, বড় থেকে ছোট কেউ কোনো কথা বলে না। কান পেতে থাকে এক খেয়ালে। এত সুন্দর করে নীলু বাঁশি বাজায় যে, গাছের পাখিরাও চুপ করে শোনে।কয়েক গাঁয়ের কারো ঠোঁটে এমন করে বাঁশির সুর কেউ শোনেনি আগে। বাঁশি বাজিয়ে যারা উপার্যন করে তারাও নীলুর বাঁশির সুর শুনে খুশি হয়ে যায়। নীলুকে তারা প্রশ্ন করে, কার কাছে সে বাঁশি বাজানোর এমন কৌশল শিখেছে। নীলু বলে, নিজে নিজেই শিখেছি। মোবাইল দেখে। বাঁশি বাজাতে আমার ভালো লাগে। নীলু পাঁচ টাকার কয়েন হাতের আঙুলের ফাঁকে শক্ত করে ধরে অদ্ভুতভাবে বাদ্যও বাজাতে পারে। লোকজন তাকে বাঁশি বাজানোর জন্য

নানান অনুষ্ঠানে নিয়ে যেতে চায় কিন্তু সে ভয়ে বাসায় বলতে পারে না। বাসা থেকেও তাকে দূরে কোথাও যেতে দেওয়া হয় না। শুধু পড়ার কথাই বলে।বাসার সবাই রাগ করে বলে সে বলতে পারে না যে, সে একজন বাঁশিবাঁধক হতে চায়। বাঁশি বাজিয়ে দেশে দেশে ঘুরতে চায়। মানুষের মন জয় করতে চায়। রবিন স্যার নীলুর এই গুণের কথা জানেন। তিনিও মাঝে মাঝে নীলুকে চুপিচুপি ডেকে বাঁশির সুর শুনেছেন কয়েকবার। এত কম বয়সী একজন শিশুর মাঝে এমন প্রতিভা দেখে তিনি মুগ্ধ হয়েছেন। বলেছেন, ‘এই চর্চাটা ধরে রাখলে তুমি একদিন অনেক বড় বাঁশিবাঁধক হবে। তোমার গুণে তোমার বাবা-মা,সমাজ, দেশ গর্বিত হবে। তিনি আরও বলেছেন, সবাই ডাক্টার, ইঞ্জিনিয়ার, প্রফেসার, ব্যবসায়ী হওয়ার স্বপ্ন দেখে কিন্তু কেউ শিল্পী হওয়ার স্বপ্ন দেখে না আমাদের দেশে। এই সমাজের জন্য শিল্পীরও দরকার আছে, মনের সুস্থতার জন্য শিল্পচর্চার গুরুত্ব অনেক বেশি।’ সেই থেকে নীলু রবিন স্যারকে পছন্দ করে। তার কথা শোনে। রবিন স্যারও নীলুকে ভালোবাসে।একদিন নীলুর দিদারবিন স্যারের কাছে নীলুর স্কুল অনিহা এবং পড়াশোনার প্রতি অমনোযোগিতার কথা জানান। কিছু করতে বলেন। দিদাবলেন, ‘প্রতিভাকে অনেক দূর এগিয়ে নেওয়ার জন্য পড়াশোনা দরকার। পড়াশোনা শুধু ভালো চাকরির জন্য না, ভালো ব্যবসার জন্য না। জ্ঞানের জন্য। এক দেশ থেকে আরেক দেশ, এক মানুষ থেকে আরেক মানুষ, এক ভাষা থেকে আরেক ভাষার সাথে যোগাযোগের জন্যও জরুরি। জীবনকে জানার জন্যও। পড়াশোনা প্রতিভাকে ছড়িয়ে দিতে সাহায্য করে। তাই নীলুকে ভালো বাঁশি বাজানোর সাথে সাথে পড়াশোনাও করতে হবে। তা আপনিই পারবেন। ওকে বুঝানোর দায়িত্ব আপনার।’রবিন স্যারএকমত প্রকাশ করলেনএবং নীলুকে বুঝালেন যে, ‘দেশ সেরা বাঁশিওয়ালা হতে হলে, বাঁশির সুর সবার প্রাণে ছড়িয়ে দিতে হলে পড়াশোনাও করতে হবে, না হলে বাঁশির সুর বেশি দূর যাবে না। সারা বিশ্বের মানুষকে বাঁশি শুনাতে হলে, নতুন নতুন সুরের সন্ধান আর সংযোগ করতে হলে পড়াশোনা করতে হবে। না হলে অনেক কিছুই জানতে, বুঝতে কষ্ট হবে।’রবিন স্যারের বুঝানোর দক্ষতায় নীলুর মন গলে গেল। সে বুঝতে চেষ্টা করল, শিল্পচর্চার সাথে যদি পড়াশোনা যোগ হয় তবে সে শিল্প অনেক দূর যেতে পারে। অনেক কিছুর সাথে সংযোগ করতে পারে নিজেকে। আচমকা পরিবর্তন দেখা দিল নীলুর মধ্যে। নীরবে বাঁশি বাজানোর চর্চার সাথে সাথে ক্রমে পড়াশোনায়ও মনোযোগী হয়ে উঠল সে। বাঁশি বাজানোর দক্ষতা তার আরও বেড়ে গেল। আন্ত:জেলা স্কুল বার্ষিক প্রতিযোগিতায়নীলু মঞ্চে উঠল বাঁশি বাজাতে। বাঁশিতে সুর তুলতেই মঞ্চের সামনের সবাই মুহূর্তে নিশ্পচু হয়ে গেল, এমন সুর, মুগ্ধ হয়ে শুনতে লাগল সবাই। নীলুর বাবা-মা আর পরিবারের সবাই অবাক হয়েনীলুর বাঁশির সুর শুনল। প্রতিযোগিতা শেষে বিচারকরা যখন ভালো ফলাফলের সাথে নীলুর নাম জেলার শ্রেষ্ঠ ‘ক্ষুদে বাঁশিওয়ালা’ বলে মাইকে উচ্চারণ করল তখনবিশাল মাঠজুড়ে করতালির পর করতালিনীলুর বাবা-মায়ের মন ভরিয়ে তুলল। নীলুর দিদা,বিজ্ঞানী কাকু, রবিন স্যারকাছে এসেনীলুকে জড়িয়ে ধরলো, নীলুও বাসাইকে জড়িয়ে ধরল আনন্দে।আর তার বন্ধুরা বলতে লাগল নীলু-নীলু-নীলু।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *