ঈদসংখ্যার শিশুতোষ গল্প।। দাদার মুখে ঈদের কথা।। আহমাদ কাউসার
বাবা-মার সাথে গাঁয়ের বাড়িতে এসেছে তুয়ামণি।দুইদিন পরেই ঈদ।প্রতিবছর ঈদের একদিন আগে ওরা বাড়িতে আসে।এবার তিনদিন আগেই চলে এসেছে।দাদার জন্য পাঞ্জাবি আর দাদীর জন্য শাড়ি কিনে এনেছে।রাতে কার জন্য কি এনেছে ব্যাগ খুলে দেখাচ্ছে। দাদার হাতে পাঞ্জাবি দিয়ে তুয়ামণি জিজ্ঞেস করলো,’ দাদা তোমার পছন্দ হয়েছে’?
—হ্যা,খুব সুন্দর! আমার পছন্দ হয়েছে।
দাদীকে শাড়ি দিয়ে বললো, ‘দাদী তোমার শাড়িটা পছন্দ হয়েছে’?
—হ্যা,আমারও পছন্দ হয়েছে।
দাদা তুয়ামণিকে জিজ্ঞেস করলো, ‘তোমার জন্য কি কিনেছো’?
তুয়ামণি ব্যাগ থেকে তার জামাগুলো বের করে দাদা-দাদিকে দেখালো।দাদা-দাদি তুয়ামণির জামাগুলো দেখে বললো,’ তোমার জামাগুলোও সুন্দর হয়েছে’। জামা দেখার পালা শেষ করে সবাই রাতের খাবার খেতে গেল।খাবার শেষ করে তুয়া দাদা-দাদীর সাথে শোতে গেল।দাদার কাছে তুয়ামণির আবদার, দাদার মুখ থেকে দাদার ছোট বেলার ঈদের গল্প শুনবে।দাদা তুয়ামণিকে বলতে লাগলো, শুন তবে, আমাদের সময়ের ঈদ কেমন ছিলো।আমি যখন তোমার মতো ছোট ছিলাম তখন আমাদের গাঁয়ে এতো লোক ছিলনা,এতো বাড়ি ছিলনা।শিক্ষিত মানুষ কম ছিল, এতো স্কুলও ছিলনা। গরীবের সংখ্যাই বেশী ছিল।জমিতে চাষ করেই মানুষ বাঁচতো।বন্যায়,খরায় ফসল ঠিকমতো হতোনা ফলে সরা বছর অভাব লেগে থাকতো। এখনকার মতো আধুনিক চাষ পদ্ধতি মানুষ জানতো না ফলে ফসল উৎপাদন কম হতো। তাই তোমাদের মতো এতো সৌখিনতা মানুষ লালন করতো না।আর ঈদ এলে তোমাদের মতো এতো জামাকাপড় মানুষ কিনতে পারতোনা।তিনবেলা খেয়ে বাঁচাই কষ্ট ছিল।
—তাহলে,তুমি কী আমার মতো পাঞ্জাবি, শার্ট, পেন্ট, টুপি এসব কিনতে না?
—আমরা এসব পরতাম না,আমার বাবা ঈদ এলে আমাকে একটা লুঙ্গি আর কাগজের টুপি কিনে দিত।
—কাগজের টুপি আবার কেমন?
—কাগজের টুপি দেখতে রঙিন,বিভিন্ন নকশা আঁকা।
—তখন সুতোর টুপি ছিল না?
—ছিল, যাদের বেশী টাকা ছিল ওরাই সুতোর টুপি কিনতো।আমার বাবার তেমন টাকা ছিলনা, তাই দামী কাপড় কিনতে পারতো না।
—তোমরা ছোট বেলায় কী শুধু লুঙ্গি পরতে?
—হ্যা,লুঙ্গি পরেই ঈদগাহে যেতাম।আমরা স্কুলেও লুঙ্গি পরে যেতাম।তখন এখনকার মতো এতো ডিজাইনের শার্ট আর পেন্ট কম ছিল।ইউনিফর্ম ছিলনা।
—লুঙ্গি পরে স্কুলেও যেতে?
—হ্যাঁ!
—ঈদে এলে তখন সকলে সকলের খবর নিত।যার যার সামর্থ্য অনুযায়ী গরীব প্রতিবেশীকে জামাকাপড় কিনে দিতো।
তোমরা তো এসব কর না, প্রতিবেশীর খোঁজ রাখনা
—প্রতিবেশী কি?
—বাড়ির আশেপাশের লোকজনকে প্রতিবেশী বলা হয়।
—ওহ।
—আমরা ঈদের দিন সবাই মিলে প্রত্যেকের বাড়িতে গিয়ে খাবার খেতাম।সবাই সবার বাড়িতে যেত।বিকেল হলে গাঁয়ে দলবেধে ঘুরাফেরা করতাম।আর তোমারা ঘরে বসে টিভিতে সিরিয়াল দেখ, নাটক দেখ।
—এখন কেন আগের মতো সবাই সবার খোঁজ নেয় না?
—মানুষ এখন আত্মকেন্দ্রিক হয়ে পড়েছে।নিজেকে নিয়ে ব্যাস্ত হয়ে পড়েছে, তাই অন্যের খবর নেয় না।
—দাদা,এখন আমাদের প্রতিবেশী কয়জন হবে?
—আগে তো কম ছিল, এখন অনেক বাড়ি।প্রায় দুইশজন হবে।
—সবাই কি গরিব?
—না।
—আমি বাবাকে বললো,সব গরীবদের কাপড় কিনে দিতে।বাবার তো অনেক টাকা আছে।
—বলে দেখতে পার।
সকালে খুম থেকে উঠে তুয়ামণি তার বাবাকে বললো, ‘বাবা তোমার তো অনেক টাকা আছে তুমি তোমার গরীব প্রতিবেশীদের খোঁজ নাও, যারা টাকার অভাবে ঈদে ভালো খাবার খেতে পারে না তাদের সাহায্য কর, কাপড় কিনে দাও। তুয়ামণির কথা শুনে তুয়ার বাবার মন গলে গেল, মনে মনে ভাবতে লাগলো আসলে তো তুয়া ছোট্ট হয়েও ঈদের গুরুত্ব বুঝতে পেরেছে, আমাকে আল্লাহ অনেক টাকা দিয়েছে, আমিতো ইচ্ছে করলে প্রতিবেশিদের পাশে দাঁড়াতে পারি।
—ঠিক আছে আম্মু,আমি সবার খোঁজ নেব এবং সবাইকে খাবার ও জামা কিনে দেব।
বাবার আশ্বাস পেয়ে তুয়ামণি খুশি হল এবং দাদাকে বললো, ‘জানো দাদা বাবা বলেছে সব প্রতিবেশীর খোজ নিয়ে ওদের খাবার ও কাপড় কিনে দেবে।
—তাই?
—হ্যাঁ!
তুয়ার বাবা আজিম উদ্দীন তোয়ার দাদাকে নিয়ে অস্বচ্ছল গরীব প্রতিবেশীর তালিকা করলো। মোট ১০০ জনের তালিকা করে ওদের জন্য সেমাই, চিনি, দুধ ও কাপড় কিনে আনলো। তুয়ামণিকে নিয়ে তালিকাভূক্ত প্রতিবেশীর বাড়ি বাড়ি গিয়ে খাবার ও কাপড় দিয়ে আসলো। তুয়ামণির বাবার এমন উদারতা দেখে তুয়ামণি খুশি হলো। তুয়ার দাদা তুয়ামণিকে বুকে নিয়ে দোয়া করলো। তুয়ামণি এবারের ঈদের মতো আর কোন ঈদে এতো আনন্দ পায় নাই। সবাইকে নিয়ে মিলেমিশে ঈদ করার মজাই অন্যরকম।