শিশুতোষগল্প।। দাঁতভাঙ্গা শহর।। এনাম আনন্দ
অচিনপুর রাজ্য জুড়ে চলছে তিনদিন তিনরাতব্যাপী এক ভোজসভা। কারণ অচিনপুর রাজার একমাত্র পুত্র তৈমুরের আজ ১২ বছর পূর্ণ হয়েছে। এ ভোজসভায় বিভিন্ন রাজ্যের রাজা- বাদশা থেকে শুরু করে উজির-নাজির, ফকির-মিসকিন, জ্বীন-পরী, দেও-দানব এবং পশুপাখি সবাই এসেছে। এতদিন অচিন রাজার হাতিশালে হাতী, ঘোড়াশালে ঘোড়া, পুকুর ভরা মাছ, অসংখ্য দাস-দাসী, উজির নাজির, পাইক পেয়াদা, হিরা- মণি-মুক্তা দ্বারা রাজভাণ্ডার পরিপূর্ণ থাকলেও মনে কোন সুখ ছিলনা। কারণ রাজা ছিল নিঃসন্তান। দীর্ঘ ২০ বছর অপেক্ষার পর রাণিমার কোল জুড়ে আসে চাঁদমাখা মুখ রাজপুত্তর তৈমুর। রাজপুত্র তৈমুরের জন্মের সময়ও এমন ভোজসভার আয়োজন করা হয়েছিল।
ভোজ অনুষ্ঠান শেষে বিকেলবেলায় বারো বছর বয়সী তৈমুর ক্লান্তি দূর করতে সোনার পালংকে শুয়ে বিশ্রাম নিচ্ছিল। এমন সময় তাঁর পোষা ময়না পাখিটি বলতে লাগলো-
“ময়না পাখি কথা কয়
খেলাধুলা মন্দ নয়”।।
ময়না পাখির কথা শুনে রাজকুমার একটু চমকে উঠল এবং কক্ষ থেকে বের হয়ে ফুলের বাগানে গেল। বাগানে ফুটেছে রং-বেরঙের নানা ফুল। চারদিক থেকে পাখিরা নীড়ে ফিরছে এবং কিচিরমিচির করছে। পাখিদের এ কিচিরমিচির শুনতে রাজকুমারের খুব ভাল লাগছে। হঠাৎ রাজকুমার লক্ষ্য করল যে, বাগানের এক কোণে একটি খরগোশ ছানা দূর্বা ঘাস ও কচি পাতা খাচ্ছে। খরগোশ ছানাটি দেখে রাজকুমার খুব মুগ্ধ হলো । তাঁর এই খরগোশ ছানাটি চাই ই চাই। রাজকুমার যেই না খরগোশ ছানাটি ধরতে গেল অমনি ছানাটি দিল এক ভু-দৌড়। দৌড়াতে দৌড়াতে রাজগেট থেকে বের হয়ে সোজা ঢুকে গেলো বনের ভিতর। রাজকুমারও ছুটলো খরগোশ ছানার পিছন পিছন। অনেক চেষ্টা করেও রাজকুমার যখন ছানাটিকে ধরতে পারল না তখন চারদিকে তাকিয়ে দেখে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। এদিকে রাজকুমার রাজ দরবারে যাওয়ার রাস্তাও ভুলে গেছে! এখন উপায়? গহীন বনে একা একা রাজকুমার ভয়ে জড়সড় হয়ে যাচ্ছে আর ভাবছে কিভাবে বাড়ি ফেরা যায়।
এদিকে অচিন রাজা রাজকুমার তৈমুর কে খুঁজতে খুঁজতে পেরেশান, রাণিমা শয্যাশায়ী, রাজ্যজুড়ে চলছে শোকের আহাজারি।
বনের এক কোণায় গাছের নিচে বসে রাজকুমার চিন্তিত মনে বাড়ি ফেরার কথা ভাবছে। হঠাৎ আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখে খুব সুন্দর পূর্ণিমা চাঁদ উঠেছে। চাঁদ দেখতে দেখতে হঠাৎ খেয়াল করলো লাল গালিচায় চড়ে কি যেন একটা তার দিকে নেমে আসছে। রাজকুুমার ভয় পেতে লাগলো এটা আবার কি? কিছুক্ষণের মধ্যেই তাঁর সামনে এসে হাজির হলো ইয়া বড় একটি সুন্দর ফুল । ফুলের এমন মিষ্টি সুঘ্রাণ রাজকুমার আগে কখনো পায়নি। সাহস করে রাজকুমার ফুলটির পাপড়ি স্পর্শ করতেই ফুলটি মানুষে রুপান্তরিত হলো আর বলতে লাগলো-
“রাজকুমারের জয়
নেইতো কেনো ভয়”!!
এই কথা শুনে রাজকুমার তৈমুর একটু স্বস্তি পেলো। রাজকুমার জিজ্ঞেস করল- কে গো তুমি? জাবাবে বলে- আমি “ফুল দেবী” আমার ইশারায় পৃথিবীর সমস্ত ফুল ফুটে। এই কথাটি বলেই ফুল দেবী তাঁর হাত মুষ্টিবন্ধ করে কি যেন পড়ে একটি ফুঁ দিয়ে চোখ দিয়ে ইশারা করল। আশ্চর্য ব্যাপার! অমনি বনের যত গাছপালা ছিলো সব গাছে ফুল ফুটতে শুরু করলো। চারদিক ফুলের সৌরভে মৌ মৌ করতে লাগলো। ফুল দেবী রাজকুমারকে জিজ্ঞেস করল- রাজকুমার তুমি আমার সাথে যাবে? উত্তরে রাজকুমার বলল- যাবো তবে তুমি কোন রাজ্যে থাকো ফুলদেবী? ফুল দেবী জবাব দেয় -আমার রাজ্যের নাম হচ্ছে “মায়াজাল” আর রাজধানীর নাম হচ্ছে “দাঁতভাঙ্গা শহর”। রাজকুমারের মনে একটু কৌতূহল হলো ‘দাঁতভাঙ্গা শহর’! এমন আজব নাম তো কখনো শুনিনি! রাজকুমার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করল সে ফুল দেবীর সাথে দাঁতভাঙ্গা শহরে যাবে। ফুল দেবী আর রাজকুমার যাদুর গালিচায় উঠে বসল এবং রাজকুমারকে চোখ বন্ধ রাখতে বলল এবং আরো বলল যখন পিঠের উপর হাতের স্পর্শ অনুভব হবে তখন রাজকুমার যেনো চোখ খুলে। যাদুর গালিচায় চড়ে নিমিষেই অদৃশ্য হয়ে গেলো ফুল দেবী। কিছুক্ষণ পর পিঠের উপর হাতের স্পর্শ পেয়ে রাজকুমার চোখ খুলল। কি অদ্ভুদ কান্ড! তারা দাঁতভাঙ্গা শহরে চলে আসছে। দাঁতভাঙ্গা শহরের প্রচীর ঘিরে পাহাড়ায় রয়েছে একদল অসুর আর রাক্ষস। তাদের মুখে অনেকেরই দাঁত নেই আবার কারো কারো মুখে কিছু দাঁত আছে। সবাই এক জন আরেকজনের হাত ধরে করে লম্বালম্বিভাবে দৌড়াচ্ছে আর বলছে-
“শক্ত করে ধরো হাত
মিথ্যা কথায় ভাঙ্গলো দাঁত”
কি আজব ব্যাপার! গাছ গাছালিতে
যত পাখ-পাখালি আছে তাদের মধ্যে অনেক পাখির ঠোঁট ভাঙ্গা। রাজকুমার চিন্তায় পড়ে গেল। এ কোথায় আসলাম আমি? ফুল দেবী রাজকুমারের মনের ভাব বুঝতে পেরে জিজ্ঞেস করল- রাজকুমার তুমি কি চিন্তা করছো? রাজকুমার বলল- ফুল দেবী আমি দেখতে পাচ্ছি- অধিকাংশ অসুর, দেও,দানবের দাঁত ভাঙ্গা, পাখিগুলোর ঠোঁট ভাঙ্গা। এর কারণ কি ফুল দেবী? ফুল দেবী উত্তর দেয় -রাজকুমার তোমাকে আগেই বলেছি এই শহরটির নাম হচ্ছে “দাঁতভাঙ্গা শহর”। এখানে একটি মিথ্যা কথা বললে- একটি দাঁত ভেঙ্গে পড়ে যায়। যারা কথায় কথায় মিথ্যা বলে তাদের মুখে একটি দাঁতও নেই। তারপরও যদি কেউ মিথ্যা কথা বলে তাহলে তাদের মুখ বাঁকা হয়ে যাবে এবং এই মায়াজাল রাজ্যের এক কোণে গিয়ে রক্তবমি করতে করতে মারা যাবে। এটাই হলো দাঁতভাঙ্গা শহরের নিয়ম। রাজকুমার বলে -তা বুঝলাম কিন্তু পাখিগুলোর ঠোঁট ভাঙ্গা কেন ফুল দেবী? এবার ফুল দেবী হা- হা – করে হাসতে হাসতে জবাব দিলো- যে পাখিগুলো অন্যায়ভাবে জোর করে অপরের খাবার কেড়ে নিয়ে খায় তাদের ঠোঁট অদৃশ্য মায়াজালের মাধ্যমে ভেঙ্গে যায়। মায়াজাল রাজ্যে কোনো অন্যায়-অবিচার, অনিয়ম- দুর্নীতি, মিথ্যা- ছলচাতুরী এসব চলেনা। এখানে আমরা সবাই সমান। সবাইকে সত্য কথা বলতে হয়,সৎ পথে চলতে হয়,ন্যায় মানতে হয়।
ফুলদেবী তৈমুরকে বলল – আগামীকাল তোমাকে ‘জলকাদন শহরে’ নিয়ে যাব। রাজকুমার বলল- ফুল দেবী আমি আর কোথাও যেতে চাইনা। আমার মার কথা খুব মনে পড়ছে। আমি মার কাছে যেতে চাই। ফুল দেবী বলল- বেশ তো কখন যেতে চাও রাজকুমার? আমি এখনই যেতে চাই । ফুল দেবী চোখ দু’টি বন্ধ করে হাতটি সামনে দিকে বাড়িয়ে কি যেনো একটি মন্ত্র পড়লো। সাথে সাথে একটি তাবিজ এসে তাঁর হাতের মধ্যে হাজির হলো। ফুল দেবী তাবিজটি রাজকুমারের গলায় পড়িয়ে দিয়ে বললো- রাজকুমার তোমার যেখানে যেতে ইচ্ছে করবে তাবিজটি গলায় পড়ে তিনবার ফুলদেবী, ফুল দেবী ফুল দেবী বলে চোখ দু’টি বন্ধ করে রাখবে। যখন পিঠে একটি হাতের স্পর্শ অনুভব করবে চোখ খুলে দেখবে তুমি ঐ জায়গাতে পৌছে গিয়েছো। রাজকুমার ফুল দেবীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চোখ দুটি বন্ধ করে তিনবার ফুলদেবী ফুলদেবী,ফুলদেবী বললো- কিছুক্ষণ পর রাজকুমারের পিঠে হাতের স্পর্শ অনুভব হলো। চোখ খুলে দেখল রাজকুমার দেখে সে রাণিমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। এই খবরটি কিছুক্ষণের মধ্য সারা রাজ্যে ছড়িয়ে পড়ল। রাজকুমার কে পেয়ে অচিনপুর রাজ্যে আবার আনন্দের বন্যা বয়ে গেল। রাজকুমার সকল ঘটনা রাজা ও রাণিমাকে খুলে বললো। তারা খুবই অবাক হলেন! আর ভাবলেন সত্যিই তো এমন নিয়ম প্রতিটি রাজ্যে চালু থাকলে সকল অশুভ এ ধরণী থেকে দূর হয়ে যেত। পৃথিবীটাকে স্বর্গ মনে হতো!
মায়াজাল শহর থেকে আসার পর রাজকুমার তৈমুরের মনে শুধু “জলকাঁদন শহর” এর কথা মনে পড়তে লাগলো । ইশ, যদি ঐ রাজ্যটি ঘুরে আসতে পারতাম!! তাহলে কতইনা ভলো হতো। হয়তোবা রাজকুমার তৈমুর একদিন “জলকাঁদন শহরে”ও যাবে।
Pingback: Chat Online