শিশুতোষ গল্প

শিশুতোষগল্প।। এমন যদি হতো।। জ্যোৎস্নালিপি

ফুল-পাখি, মেঘ-বৃষ্টি, পাহাড়-সাগর আরো কতো কী যে ভালো লাগে যারীণের! কিন্তু যারীণের কোথাও যাওয়া হয় না। মা তেমন কোথাও ওকে বেড়াতে নিয়ে যেতেও পারে না। কারণ, জন্ম থেকেই যারীণ হাঁটতে পারে না। কিন্তু সে সুন্দর ছবি আঁকতে পারে; গান গাইতে পারে; গল্প করতে পারে- এমনকি লিখতেও…।

যারীণ খুব ভালো কবিতা লিখে। ওর আঁকা ছবি নিয়মিত দেশের শীর্ষ দৈনিক পত্রিকাগুলোতে ছাপা হয়। তবুও যারীণের মন খারাপ হয় এইভেবে যে, কেন সে হাঁটতে পারে না? কেন সে সবার মতো দৌড়াতে বা পাড়া বেড়াতে পারে না; কেন পারে না পুকুরে সাঁতারও কাটতে যেতে?

যারীণ ছলছল চোখে তার হাত দুটো দিয়ে পায়ের পাতা ছুঁয়ে বলে, ‘আচ্ছা পা, তুমি কেন হাঁটতে পারো না? সবার পা হাঁটতে পারে, দৌড়াতে পারে, খেলতেও পারে; অথচ তুমি পারো না!’

মা ওর আক্ষেপ শোনে বলেন, ‘সবাই কী সবকিছু পারে? তুমি কতো ভালো ছবি আঁকো, ভালো গান করো- তা কি সবাই পারে? পারে না তো। তবে কেন আমার যারীণসোনা কষ্ট পায়!’

মা এমন কথা মা বললেও যারীণ মাকে ঠিকই একদিন লুকিয়ে কাঁদতে দেখেছে। বাবাও মনখারাপ করে পাশে বসে মাকে সান্ত্বনা দিয়েছেন। পড়শিদের মুখেও বলাবলি শুনেছে একদিন। তারা মাকে বলেছে, যারীণের আরেকটা ভাই বা বোন হোক। যারীণ তো হাঁটতে পারে না; ওকে দেখে রাখবে। যারীণের মা বলেছে, আমার যারীণসোনা খুব লক্ষ্মী। ওর আর কোনো ভাইবোনের দরকার নেই। কিন্তু মাকে সে আজ বলতে শুনেছে, ‘যারীণ তো বড় হচ্ছে আমরা যখন থাকবো না, তখন ওকে দেখবে কে?’

যারীণ মনেমনে খুব কষ্ট পায়! নতুন ভাইবোন এলে, মা তাকে আগের মতো ভালোবাসবে তো? মা তো বলে, যারীণসোনাই মা’র সব! তাহলে কেন নতুন ভাইবোন আসবে? ভেবে ভেবে খুব মনখারাপ হয় যারীণের।

যারীণকে মা জানালার ধারে বসিয়ে রেখে ডাক্তারের কাছে গেছেন। জানালা দিয়ে বহুদূর পর্যন্ত সবুজ ফসলে ঢাকা মাঠ দেখা যায়। মাঠের শেষ মাথায় আঁখের খেত। এপারে দুটো আমের, একটা আমড়ার আর একটা পেয়ারাগাছ। জানালার ধার ঘেঁষে একটা জবাগাছ। গাছে লাল টকটকে জবা ফোটে। জানালা দিয়ে হাত বাড়ালেই ফুল ছোঁয়া যায়। যারীণ তো আর বাইরে যেতে পারে না, তাই সে লাল টকটকে জবাটার দিকে ওর হাত বাড়িয়ে দেয়। মা বলেছেন, এগুলো ঝুমকো জবা। মায়ের কানের দুলের মতো। সে খেয়াল করেছে ঠিক জবার মতোই মা’র দুটো কানের দুল আছে। মা ওগুলো আলমিরাতে তুলে রাখেন। বিশেষ দিন এলে বা কোথাও বেড়াতে যাওয়ার সময় পরে নেন- যদিও যারীণের জন্য মা তেমন বেড়াতে যেতে চান না। মায়ের কথা ভেবে যারীণের ভীষণ কষ্ট হয়। তার কারণেই যে মাকেও ঘরবন্দি থাকতে হয়! কিন্তু মা বলেন, এতে তার কোনোও মনখারাপ হয় না। যারীণের কাছাকাছি থাকতেই বেশি ভালো লাগে তার। বেড়াতে গিয়ে যদি এরচেয়ে কম আনন্দ হয়, তাহলে এমন বেড়ানোয় লাভ কী?

হঠাৎ জবা বলে, ‘যারীণ, এতো কী ভাবছো?’

যারীণ চমকে গিয়ে বলে, ‘অনেক কিছু। কিন্তু ঝুমকো জবা, তোমায় আজ এতো মলিন লাগছে কেন? কাল দুপুরবেলায়ও তো কত মিষ্টি করে কথা বললে আমার সঙ্গে। আমি তো তোমার সব কথা বুঝি।’

‘শোনো গো মেয়ে, আমার পাশে যে আমগাছটা আছে না, ওতে আমাদের পড়শি শালিক পাখি বাসা বেঁধেছিল। দুটো বাচ্চাও হয়েছিল। সেই বাসাটা আজ সকালে দুষ্টু ছেলেরা ভেঙে নিয়ে গেছে! তাই মনটা ভালো নেই। মা শালিকটা কান্নাকাটি করছে। খুব মনখারাপ করে দেওয়ার মতো বিষয়, তাই না?’

‘শোনো ঝুমকো জবা, তোমার কথা শুনে আমারও তো মনটা কেমন কেমন করছে! আমি যদি হাঁটতে পারতাম, তাহলে শালিকের ছানা দুটোকে খুঁজে এনে দিতাম। কিন্তু কী করবো বলো!’

জবা আর যারীণ দুজনেই মন খারাপ করে বসে থাকে। তারপর একসময় চোখের কোণে জল নিয়েই ঘুমিয়ে পড়ে যারীণ।

মাঠ থেকে একটা প্রজাপতি জানালা দিয়ে ঢুকে যারীণের বিছানায় এসে বসে। যারীণকে সে বলে, ‘তোমার মনের সব কথা জানি আমি। তাইতো তোমার জন্য ডানা নিয়ে এলাম। চোখ খোলো, যারীণ।’

খানিকটা আলস্য নিয়ে চোখ খুলে যারীণ। এরপর বলে,
‘কে ডাকছো? কেন ডাকছো? এখন যে আমার চোখে ঘুম ভর করেছে!’

প্রজাপতি বলে, ‘চোখ খোলো তুমি। দেখো, তোমার জন্য একটা মজার বিষয় অপেক্ষা করছে।’

যারীণ চোখ খুলে বলে, ‘ও প্রজাপতি, তুমি! বলো, কী বলবে?’

‘আমি তোমার ইচ্ছেপূরণ করবো।’

‘ইচ্ছেপূরণ করবে? আমার ইচ্ছে কি তুমি জানো?’

‘খুব জানি’- এই বলে প্রজাপতি যারীণকে ডানা লাগিয়ে দিয়ে বললো, ‘এখন তুমি ইচ্ছেমতো ঘুরে বেড়াতে পারবে। তুমি তো এটাই চাও, তাই না!’ যারীণ মাথা নাড়ে। প্রজাপতি বলে, ‘এবার তুমি ইচ্ছেমতো যেখানে খুশি যেতে পারবে। উড়ে উড়ে ঘুরে ঘুরে বেড়াতেও পারবে।’

যারীণের চোখে খুশির ঝিলিক খেলে যায়। সে প্রজাপতির দেওয়া পাখায় ভর করে উড়ে চলে। ওর সাথে সাথে প্রজাপতিটাও উড়ে চলে আর বলে, ‘উড়তে খুব মজা, তাই না যারীণ?’

যারীণ বলে, ‘ঠিক তাই। পাখিরা যখন উড়ে উড়ে বেড়াতো, তখন আমার মনে হতো- আমি যদি পাখি হতে পারতাম! যখন তোমাকে দেখতাম, তখন মনে হতো- আমি যদি প্রজাপতি হতে পারতাম!’

উড়ে উড়ে গল্প করতে করতে প্রথমেই একটি পাহাড় চোখে পড়ে যারীণের। তখন পাহাড়টা মেঘের সঙ্গে গল্প করছিল। সে প্রজাপতিকে বলে, ‘দেখেছো, পাহাড় কী সুন্দর!’

প্রজাপতি বলে, ‘পাহাড়ের গায়ে বয়ে চলা ঝর্ণা আরোও সুন্দর। তুমি পাহাড়ের কাছে যাও, আমি একটু ঝর্ণার সঙ্গে গল্প করে আসি। সে আমার অনেক দিনের বন্ধু’- বলেই প্রজাপতি উড়ে যায় ঝর্ণার কাছে। আর যারীণ যায় পাহাড়ের কাছে। কারণ অনেকদিন থেকে তার পাহাড়ে যাওয়ার শখ ছিল।

যারীণকে দেখে মেঘের সঙ্গে গল্প থামিয়ে পাহাড় বলে, ‘তুমি এসেছো যারীণ! আমি তো বহুদিন ধরে তোমার অপেক্ষায় আছি। এসো, আমার কাছে বসো। দেখেছো তো, আমি কত সুন্দর; কিন্তু আমি এক জায়গাতেই বসে থাকি। কোথাও যেতে পারি না। আমার তো পা নেই! আসলে পাহাড়দের পা থাকে না। কিন্তু সুন্দর একটা মন থাকে। সেই মন দিয়েই সবকিছু জয় করি। আর সবার সবকিছু থাকতে হবে, তারও কোনো মানে নেই। তাই না! তবে সবাই আমাকে দেখতে আসে। আর সবাই আমার সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হয়। আমার কোনো দুঃখ নেই। আমি জানি, তোমার মনে অনেক দুঃখ যারীণ। কিন্তু তোমার কেন দুঃখ থাকবে? তুমি কোনো দুঃখ পেয়ো না। তোমার তো মনের চোখ আছে। তুমি বই পড়তে পারো। কল্পনায় যা খুশি করতে পারো। এটা কি সবাই পারে? পা তো সবারই থাকে…।’

যারীণ মুগ্ধ হয়ে পাহাড়ের কথা শোনে। আরো কত গল্প করে পাহাড় তার সঙ্গে। গল্প শেষে পাহাড়ের নিকট থেকে বিদায় নেয় যারীণ।

সে এবার উড়ে উড়ে একটা সাগরের তীরে গিয়ে নামে। রুপোর মতো ঝলমলে সাগরের বালুকাবেলা। যারীণ বালির ভেতর পা ডুবিয়ে হাঁটে। সাগরের অসাধারণ জলের ঢেউ তাকে মুগ্ধ করে। চোখ জুড়িয়ে যায় তার। সেই ঢেউ এসে যারীণকে ছুঁয়ে যায়। সাগরের জলে নেমে ঢেউয়ের সঙ্গে খেলা করে সে। সাগর বলে, ‘বাহ! তুমি আমায় ছুঁয়ে দিলে? আমি তো ধন্য হয়ে গেলাম! তোমার গল্প পাখিদের কাছে কতো শুনেছি। তুমি কতো ভালো ছবি আঁকো। একবার তো হুবহু আমায় এঁকে ফেলেছিলে তোমার ড্রয়িং খাতায়। কিন্তু তুমি তারপর সেটা ছিঁড়ে ফেললে। আমি শুনেছি সে কথা। তখন আমার খুব মন খারাপ হয়েছিল। এতো সুন্দর ছবি তুমি কেন ছিঁড়ে ফেলেছিলে?’

জবাবে যারীণ বলে, ‘তোমাকে আঁকার পর আমার খুব মনখারাপ হল। মনেহল, আমি তো তোমার জলে কখনো নামতে পারবো না! তোমার তীরে হেঁটে বেড়াতে পারবো না…!

এসব শোনে সমুদ্র বললো, ‘তাই বুঝি তোমার অনেক অভিমান হল?’

‘হ্যাঁ, তাই।’

জবাবে সাগর বললো, ‘দুঃখ পেতে নেই। সবার সবকিছু থাকে না, আর থাকতেও হয় না।’

যারীণ সাগরের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে পাখায় ভর করে উড়ে চললো। মেঘও তার সঙ্গে উড়ে উড়ে যায়। মেঘ বলে, ‘যারীণ, তুমি পাহাড় আর সাগর কাছে গেলে; এবার আমার সঙ্গে আমার দেশে চলো। তোমাকে আমি অনেক গল্প শোনাবো।’

যারীণ বললো, ‘তুমি আমার চোখে জল এনে দাও কেন? কেন আমার দুঃখ হয়?’

মেঘ বললো, ‘আমার বাড়িতে গিয়ে বসো, আমি তোমায় দুঃখ ভুলিয়ে দেবো।’

মেঘের সঙ্গে যারীণ মেঘেদের দেশে যায়। সাদা সাদা পেঁজাতুলো মেঘ দেখে যারীণ খুব খুশি হয়। মেঘ বলে, ‘আমাকে ছুঁয়ে দেখো।’ যারীণ মেঘের গায়ে আঙুল ছোঁয়ায়। মেঘ দুষ্টুমি করে একপশলা বৃষ্টি নামিয়ে ওকে ভিজিয়ে দেয়। যারীণ খুশি হয়। মেঘ বলে, ‘তোমার বৃষ্টিতে ভেজার খুব সাধ ছিলো, তাই না?’ যারীণ বলে, ‘হুম।’ এবার মেঘ, বৃষ্টি আর যারীণ হাত ধরে নাচে।

মেঘ গল্পে গল্পে যারীণকে বলেছে- ‘জীবনে ছোট ছোট বিষয় নিয়ে খুশি থাকতে হয়। তাহলেই জীবন আনন্দে ভরে ওঠে। ছোট্ট বিষয় নিয়ে মন খারাপ করতে নেই। তুমিও তোমার পা নিয়ে আর মনখারাপ করবে না, কেমন?’ এরপর মেঘের কাছ থেকেও বিদায় নেয় যারীণ।

বন-পাহাড়, সাগর আর মেঘেদের দেশে বেড়ানো শেষে যারীণ একটা গাছের ছায়ায় থামে। প্রজাপতি ঘুরেফিরে যারীণের কাছে আসে। যারীণ প্রজাপতিকে বলে, ‘চলো প্রজাপতি, আমরা এখন ইচ্ছেমতো ঘুরে বেড়াই।’ প্রজাপ্রতি খুশি হয়ে বলে, ‘চলো, তাই হোক। তবে মনে রেখো আমাদের ফেরার সময় হয়েছে।’ জবাবে যারীণ মাথা নাড়ে।

হঠাৎ মায়ের ডাকে ঘুম ভেঙে যায় যারীণের। তবে একটা মিষ্টি খুশির ঝিলিক লেগে থাকে ওর চোখেমুখে। সে মনেমনে ভাবে, ইশকুলে গিয়ে বন্ধুদের সাথে মেঘ, পাখি, পাহাড় আর সাগরের গল্প করবে। আর সেই প্রজাপতির গল্পটাও করবে। এদিকে জানালার ওপার থেকে জবা গাছটা বলে, ‘যারীণ, আমি জানি, আজ তুমি খুবখুশি। তাই না? যারীণ বলে, ‘হ্যাঁ, জবা। আমাদের পৃথিবীটা সত্যিই খুব সুন্দর। আর পৃথিবীর মানুষগুলোও।’

এখন শিলা, মিমি, সুরেলা, দিপু, দীপ্তরা আর যারীণকে অবহেলা করে না। এখন ওরা সবাই বন্ধু।

কারোর হাত-পা নয়তো শরীরের কোনো অঙ্গ ঠিকমতো কাজ না-ও করতে পারে! তাতে কী? এটা তো যেকোনো সময় হতে পারে। এমনটা ঘটে যেতে পারে যে কারোর সাথে। এই যে সুন্দর পৃথিবী, এখানে তো কতরকম প্রাণী আর গাছপালা আর পোকামাকড়। এরা সবাই সবাইকে ভালোবেসেই বেঁচে আছে। পৃথিবীতে ভালোবাসাই হল সবচেয়ে সুন্দর। আর দুঃখ জয় করে ভালো মানুষ হওয়াটাই আসল কথা- যারীণ এই কথাগুলো বন্ধুদের বলেছে। বন্ধুরাও খুব মনোযোগ দিয়ে ওরা কথাগুলো শুনেছে। আর এ-ও বলেছে যে, সে এসব সে শিখেছে ফুল-পাখি, পাহাড়-সাগর আর গাছেদের থেকে।

গল্প বলার ফাঁকে ইশকুলের জানালা দিয়ে বাইরে তাকায় যারীণ। যারীণের চোখ খুঁজে ফেরে ওর প্রজাপতি বন্ধুকে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *