শিশুতোষগল্প।। পাগলা গল্প।। আহমেদ রিয়াজ

এক যে আছে পাগলা গারদ।
একদিন একটা কুকুর পাগল হয়ে ঢুকে পড়ল ওই গারদে।
আরেকদিন একটা হাতি পাগল হয়ে চলে এল ওই গারদে।
তারপর পাগল হয়ে একটা ষাঁড়ও ওই গারদখানার বাসিন্দা হয়ে গেল।
কুকুরটা সারাদিন জিহ্বা বের করে দৌড়ে বেড়ায়। শীত-গরম, সবসময়ই। আর রাত হলে বুকের মধ্যে নাক ঠেকিয়ে ঘুমিয়ে থাকে।
হাতিটা তার শুঁড়খানা গিট্টু দিয়ে রাখে। যখন তখন। মাঝে মাঝে থপ থপ করে হাঁটে। পাগলা গারদটা তখন কেঁপে ওঠে।
আর ষাঁড়টা সারাদিন শিং দু’টো ধার দিতে থাকে। কেন যে কে জানে। মনে হয় এখান থেকে ছাড়া পেলেই কারুর সাথে লড়াই করতে নামবে। কেউ কিছু জানতে চাইলে চোখ দু’টো লাল করে তাকায়। ষাঁড়ের ওই লাল চোখ দেখলেই ভয় পেয়ে যায় সবাই। আর কিছু জিজ্ঞেস করার সাহস পায় না। এমনকি হাতিও।
একদিন হঠাৎ খবর এল, আরেকটা পাগলা পশু আসছে।
সারাদিন ধরে ভেবেছে ওরা, কে আসছে? পশু জগতে পাগল হয়, এমন আর কে আছে?
পরদিন সে এল। কে এল? একটা রাজকীয় বাংলাবাঘ। থাকত সুন্দরবনে। পাগল হয়ে যাওয়ার পর, অনেক কষ্টে ওকে ধরে নিয়ে আসা হয় এই পাগলা গারদে।
কিন্তু বাঘ কখনো পাগল হয় বলে তো ওরা শোনেনি!
গারদে ঢুকেই বাঘ প্রথমে হাতির দিকে তাকাল। হাতি তখন বাঘকে দেখে শুঁড়ের গিট্টু ছোটাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। আর কুকুরটা ওকে দেখে সামনে এগিয়ে এল। জানতে চাইল, ‘কেমন আছেন বাঘমামা?’
বাঘমামা মুচকি হাসলেন। আগের মতো গায়ের জোর থাকলে এক লাথিতে কোথায় উড়িয়ে দিতেন কুকুরটাকে? আবার জিহ্বাও বের করে রেখেছে বেয়াদবের মতো।
বাঘ বলল, ‘বেয়াদব কুকুর, জিহ্বা ঢোকা মুখের ভেতর।’
কুকুরটা সাথে সাথে মুখের ভিতর জিহ্বা ঢুকিয়ে ফেলল। কিন্তু ষাঁড়ের দিকে তাকাতেই চোখ দু’টো লাল করে ষাঁড় বলল, ‘আমার দিকে তাকিয়ে লাভ নেই বুড়ো বাঘ। আমার শিং দু’টো দেখেছিস? সুঁইয়ের মতো চোখা আর ছোরার মতো ধারাল। পেটের এপাশ দিয়ে ঢুকলে ও পাশ দিয়ে বেরিয়ে যাবে। আঁক করে শব্দ করারও সুযোগ পাবি না। মনে থাকে যেন।’
ষাঁড়ের কথা বড্ড গায়ে লাগল বাঘের। বুড়ো হয়েছে বলে এমন অপমান করবে? তা-ও আবার পাগলা একটা ষাঁড়! পাগলা মনে হতেই হঠাৎ চুমসে গেল বাঘ। পাগল হলে কত কিছুই না বলে? সে মানুষ হোক আর পশুই হোক। পাগর তো পাগলই।
বাঘ বলল, ‘আমি পশু খাই না।’
বলে কি বাঘ! পশু খায় না! তাহলে কী খেয়ে বাঁচে? বাঘটা বুড়ো জানার পর স্বস্তি পেল হাতি। যাক ধমক-ধামক দিয়ে কথা বলা যাবে। হাতি বলল, ‘তাহলে কী খেঁয়ে বেঁচেছিস এতদিন?’
বাঘ বলল, ‘মানুষ।’
মানুষ! চমকে ওঠল সবাই। এ তো দেখছি মানুষখেকো বাঘ!
কুকুর এবার জানতে চাইল, ‘কিন্তু পাগল হলে কেমন করে মামা?’
বাঘ বলল, ‘তুই পাগল হয়েছিস কেমন করে শুনি?’
কুকুর বলল, ‘মানুষ কামড়ে।’
তারপর হাতির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তুই কেমন করে পাগল হয়েছিস?’
হাতি বলল, ‘মানুষ পিষে।’

বাঘ এবার ষাঁড়ের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তুই পাগল হয়েছিস কেমন করে?’
ষাঁড় বলল, ‘আগে তোর কারণটা বল, তুই কেমন করে পাগল হয়েছিস?’
বাঘ বলল, ‘মানুষ খেয়ে।’
ষাঁড় বলল, ‘আমি পাগল হয়েছি মানুষ গুতিয়ে।’
হাতি বলল, ‘তাহলে আমাদের পাগল হওয়ার কারণ একটাই মানুষ।’
বাঘ বলল, ‘কিন্তু সবচেয়ে পাগলটাকে তো ওরা ধরতে পারেনি।’
হাতি বলল, ‘আমার চেয়ে পাগলা আর কে আছে? গ্রামের পর গ্রাম ঘরবাড়ি পিষে দিয়েছি। কত মানুষ যে আমার পায়ের তলায় পড়ে থেৎলে গেছে গুণে রাখিনি।’
কুকুর বলল, ‘পুরো একটা পাড়ার মানুষ আমি কামড়ে দিয়েছে।’
ষাঁড় বলল, ‘আমি কেবল দুটো মানুষকেই গুতোতে পেরেছি। আরো গুতোনোর ইচ্ছে ছিল, কিন্তু সুযোগ পাইনি। তার আগেই এখানে নিয়ে এল।’
বাঘ বলল, ‘তোরা তো কেবল গুতিয়ে, পিষে আর কামড়েই সারা। আমি তো খেয়েছি। খিদে পেয়েছে আর টপাটপ মানুষ খেয়েছি। তবে আমাদের চেয়েও কিন্তু বড় একটা পাগল আছে। আমি তাকে চিনি।’
হঠাৎ পাগলা গারদের মাইক বেজে উঠল ঘরর শব্দে। আর সবাই শুনতে লাগল ‘পাগলা গারদের বাসিন্দারা, অ্যাটেনশন! প্রাণিজগতের সবচেয়ে বড় পাগলটা কিছুক্ষণের মধ্যেই হাজির হয়ে যাবে। সাবধান!’
কিছুক্ষণ পর টগবগ করে সে এল। আর তাকে দেখে হাসতে শুরু করল সকল পাগল পশু। এ বুঝি সবচেয়ে ভয়ানক পাগল!
গারদে ঢুকেই কয়েকবার ফোঁস ফোঁস করল ও। নাক দিয়ে যেন আগুনের হলকা বেরুল। ওটা দেখে গারদের পুরনো পশুরা বুঝতে পারল, আসলেই ওদের চেয়েও বড় পাগল আছে। কিন্তু কেমন করে এত বড় পাগল হল ও?
ওর সাথে ভাব জমাতে বাঘটাই প্রথম এগিয়ে গেল। একটু কেশে গলাটা পরিস্কার করে বলল, ‘আমাদের মধ্যে সবচেয়ে বড় পাগল আপনি। কেমন করে পাগল হলেন বলতে পারবেন?’
কেশরখানা দুবার ঝাঁকিয়ে ও বলল, ‘কে বলেছে আমি পাগল!’
তাতেই চুমসে গেল বাংলাবাঘ। হাতি বলল, ‘বাতাসে শুনতে পাই।’
এবারও চেঁচিয়ে ওঠল ও, ‘কোন বাতাসে? বাতাসে খবর ছড়ায় কে? ওসব উড়ো খবর।’
ষাঁড়ও অবাক, ‘তাহলে?’
ও বলল, ‘আসলে আমি নিজে পাগল নই। আমি পাগল বানাই।’
বলেই গারদ কাঁপিয়ে হাসতে শুরু করল। ওর হাসির শব্দে গারদের ইট, চুন, সুড়কি এমনকি লোহার শিক পর্যন্ত কাঁপতে লাগল।
ওর হাসিতে একটু সাহস পেল বাংলাবাঘ। জানতে চাইল, ‘কিভাবে পাগল বানান আপনি?’
ও বলল, ‘খুব বেশি কষ্ট করতে হয় না। এই যেমন একবার পিঠের উপর পিঁয়াজের বস্তা নিয়ে ছুটলাম। ব্যস। অমনি পুরো দেশ পাগল হয়ে গেল। আরেকবার পিঠের উপর আলুর বস্তা নিয়ে দৌড় দিলাম। অবাক কাণ্ড! তাতেও পুরো দেশ পাগল হয়ে ওঠল। পত্রিকায় বিস্তর লেখালেখি হল। নিউজ, টক শো-সব জায়গার আলোচনায় আমি। আমার কার্টুনও ছাপা হল। কখনো তেলের পিপে, কখনো সবজি ডালা, কখনো চিনি, কখনো চাল যখন যা মন চায়, সেটাই পিঠে চাপিয়ে ছুটতে থাকি। তারপর আর দেখতে হয় না। পাগল হয়ে যায় দেশ। দেশের মানুষ। এমনকি দেশের রাজা-রানী, উজির-নাজিররা পর্যন্ত! শুনলে অবাক হবে, উজির নাজিররা আমার সাফাইও গায়।’
যতই শুনছে ততই মুগ্ধ হচ্ছে গারদের পাগল পশুরা। কী রোমাঞ্চকর জীবন ওর! পাগল নয়, অথচ সবাইকে পাগল বানিয়ে ছাড়ে। কী মজা! কী আনন্দ! মানুষ কামড়ে, মানুষ গুতিয়ে, মানুষ পিষে আর মানুষ খেয়েও তো এত মজা পাওয়া যায় না।
হাতি বলল, ‘কিন্তু আপনাকে এখানে আটকে রাখল কেন?’

ও বলল, ‘আমার কারণে পাগল হওয়া মানুষের সংখ্যা হঠাৎ করেই খুব বেড়ে গেছে। ওই পাগলরা একটু ঠান্ডা হলেই আবার বেরিয়ে পড়ব আমি।’
সত্যি সত্যি শুনি পরই ছাড়া পেয়ে গেল ও। নাচতে নাচতে বেরিয়ে গেল পশুদের পাগলা গারদ থেকে। পাগলা ঘোড়াকে আটকে রাখে এমন সাধ্যি আছে কোন গারদের!

One thought on “শিশুতোষগল্প।। পাগলা গল্প।। আহমেদ রিয়াজ

  • নভেম্বর ১২, ২০২০ at ১:৩৯ পূর্বাহ্ণ
    Permalink

    অসাধারণ।

    Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *