শিশুতোষ গল্প।। পাখিগাছ ও বুড়ো কাকের গল্প।। অদ্বৈত মারুত

ইয়াব্বড় কড়ইগাছ। বয়সও হয়েছে। এত্তো এত্তো ডালপালা। বুড়ো কড়ইয়ের ঝাঁপটানো ডালেই যেন পাখিদের সব সুখ! পাঙ্গাশী গ্রামের এ বুড়ো গাছের ডালে ডালে পাখি মনের সুখে ডাকে। গান গায়। ডালগুলো খুব মোটা। কারও বাসা লতাপাতা, খড়কুটো দিয়ে বানানো। কোনো কোনো পাখি গাছে কোটর বানিয়ে তার ভেতরে থাকে বাচ্চা-কাচ্চা নিয়ে। আবার কোনো কোনো পাখি তাল পাতা, নারিকেল পাতা কুড়িয়ে এনে বানিয়ে নিয়েছে সুন্দর ঘর। চিৎকার, চেঁচামেচিও হয় খুব। এর মধ্যে আবার রাজ্যের অনুষ্ঠান লেগেই থাকে। আজ টুনটুনির মেয়ের বিয়ে তো, কাল বকের ছেলের জন্মদিন। নয়তো ময়না, টিয়ে, শ্যামা কিংবা বুলবুলি বসিয়ে দিলো গানের আসর। আসর মানেই এলাহি কাণ্ড। দূর থেকে দলবেঁধে চলে আসে আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব। তারপর আসর রেখে দূরের পাখিদের সঙ্গে সবাই মেতে ওঠে গাল-গল্পে। গল্প শেষে পেটপুরে খাইয়ে তারপর বিদায়।

তবে আজকাল বুড়ো গাছে তেমন শান্তি নেই। ভর-দুপুরেও হইচই। চিল চেঁচানো চিৎকার। কথায় কথায় তারা ঝগড়া করে। গায়ে হাতও তোলে। উড়তে গিয়ে কাকের সঙ্গে মাছরাঙার আলতো গুঁতো লাগতেই বাধে ঝগড়া। চিলের ঠোঁট অমন কেন, এ নিয়েও হচ্ছে মারামারি। একবার ঝগড়া-মারামারি শুরু হলে আর রক্ষে নেই। গাছের পাখিরা দু’দলে ভাগ হয়ে যায়। কারও পাখা-পা না ভাঙা পর্যন্ত থামে না সেই মারামারি।

এবারও তাই হলো। গাঙচিলের সঙ্গে ঈগলের গান গাওয়া নিয়ে মারামারি বাধলো। শকুন অনেক বলে-টলেও মারামারি থামাতে পারলো না। কে শোনে কার কথা। গাছজুড়ে অশান্তি। এভাবে চলতে থাকলে হয়তো একদিন নিজেরাই হারিয়ে যাবে- এ ভাবনায় সব সময় ডুবে থাকে বুড়ো পাখিরা। এরই মধ্যে আকাশজুড়ে মেঘের ঘনঘটা। কালো মেঘ। একেবারে কালবৈশাখী যেন! এই কালো মেঘে ভর করে দূর থেকে এলো এক বুড়ো কাক। থুত্থুরে। চোখে ভালো দেখে না। হাত-পায়েও তেমন শক্তি নেই। খুব খিদে নিয়ে এসেছে। পানির পিপাসাও। খিদায় নড়তে পারছে না সে। কোনোভাবে এসে বসলো গাছের পুরনো ডালটায়। দুর্বল ডাল বুড়ো কাকের ভার সইতে পারলো না। অমনি ধপাস! পড়ে গেলো সে। তখন গাছে কেবল বাচ্চারাই ছিলো। বড়রা বিপদ দেখে নিরাপদ আশ্রয় খুঁজতে গেলো আশপাশে।

টুকুন তখন উকুনের সঙ্গে খেলছিলো। টুকুন শকুনের ছেলে। খুব ছোট। এখনও উড়তে শেখেনি। ধপাস করে ডাল থেকে কিছু পড়ার শব্দ পেয়ে চোখ বড় করে শব্দের খোঁজ করতে লাগলো। দেখলো, কালো কিছু একটা পড়ে আছে মাটিতে। ভয়ে নিজেকে আড়াল করে নিলো। অমনি মায়ের ডানা ঝাঁপটানোর শব্দ কানে এলো। ফের জানলা খুলে চোখ রাখলো বাইরে। মাকে দেখে তার ভয় কিছুটা কমলো। তবে মা শকুনও মাটিতে বুড়ো কাককে দাপাদাপি করতে দেখলো। খুব মায়া হলো। মাটি থেকে বুড়ো কাকটা তুলে আনলো ডালে। টুকুনও এগিয়ে এলো। মা তাকে পানি আনতে বললো। কিন্তু সে যে উড়তে পারে না। মায়ের সে কথা মাথায়ই ছিলো না। বিপদে পড়লে এমনই হয়। সব উলট-পালট হয়ে যায়। টুকুন মাকে বললো, তুমিই পানি নিয়ে আসো। আমি বরং তাকে পাহারা দিই। মা শকুন মুখ ভরে পানি এনে বুড়ো কাকটাকে পান করালো। পিট পিট করে তাকালো বুড়ো কাকটা। মাথায় লেগেছে খুব। টুকুনকে পাশে বসিয়ে মা শকুন গেলো ওষুধ আনতে। এর ভেতর কাকটার কী যেন মনে পড়লো। অমনি টুকুনকে ধন্যবাদ দিয়ে উড়াল দিলো। মা শকুন বাড়ি ফিরে কাকটাকে খুঁজে পেলো না। চলে গেছে। আকাশের দিকে তাকিয়ে তাকে খুঁজতে লাগলো। কিন্তু কোনো দেখা পেলো না। আকাশ তখনও ঢেকে আছে কালো মেঘে। ঝড় হবে মনে হয়। কিন্তু এমন কালো মেঘ আগে দেখেনি। খুব ভয় হলো। বুকে চেপে ধরল টুকুনকে।

কড়ইগাছের পাখিদের মধ্যে মিল না থাকলেও তারা শকুনের কথা শোনে। বিপদে পড়লে তার কাছে ছুটে আসে। অমন কালো মেঘ দেখে সব পাখি ভয়ে জড়োসড়ো। ছুটে আসে শকুনের কাছে। শকুন সবাইকে ধৈর্য ধরতে বলে। ঝগড়া-বিবাদ ভালো নয়, এ কথাও বোঝায়। বলে- গাছ কমে যাচ্ছে, আমাদের খাবার কমে যাচ্ছে। যাও-বা খাবার পাওয়া যাচ্ছে, তাও বিষে ভরা। ভেষজ গাছপালা কমে যাওয়ায় চিকিৎসা হচ্ছে না। অনেক পশুপাখি চিকিৎসা না পেয়ে মারা যাচ্ছে। এর মধ্যে নিজেরা ঝগড়া-বিবাদ, মারামারি করে হারিয়ে যাচ্ছে; এটা ঠিক নয়।

এক ফাঁকে কখন যে সেই বুড়ো কাক উড়ে এসে বসেছে ডালে, তা কেউ খেয়ালই করেনি। শকুনের কথায় সুর মেলালো সেও। বললো- শোনো, আমার বয়স হয়েছে। শরীরের শক্তিও কমে এসেছে। আজকাল চোখে ভালো দেখি না। তবে বুঝতে পারি, আমরা খুব বিপদেই দিন পার করছি। নিজেরা হানাহানি করে এভাবে বিপদ ডেকে আনা সুখের কথা নয়। একে অন্যের বিপদে এগিয়ে আসতে হবে। পাশে দাঁড়াতে হবে। খাবারের ভাগ দিতে হবে। বসবাস করতে হবে সুখে-শান্তিতে। তবেই ভালো থাকব সবাই। বুড়ো কাকের কথায় গাছের পাখিরা একমত হলো। তারা আর মারামারি করবে না। ঝগড়া-বিবাদও না। দল বেঁধে উড়বে, এক সঙ্গে ঘুরবে, খাবার জোগাড় করবে। কেউ বিপদে পড়লে সবাই তাকে উদ্ধার করবে।

পাখিরা আকাশের দিকে তাকায়। কালো মেঘটা ততোক্ষণ দূর সরে গেছে। অনেক দূরে। ঝলমলে রোদ এসে পড়েছে কড়ইয়ের ডালে, পাতায় পাতায়। পাখিদের গায়ে লাগে সোনালি রোদ। তারা নতুন করে স্বপ্ন দেখে বুড়ো কাক আর শকুনের কথায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *