জয় বাংলা শিশুসাহিত্য উৎসব।। কুড়কুড়ির মুক্তিযুদ্ধ।। সেলিনা হোসেন

কুড়কুড়ি পাতা কুড়িয়ে সামান্য আয় করে। শুকনাে পাতা বেশিরভাগ দিন ওর মায়ের রান্নার কাজে লাগে। এক বস্তা বেশি কুড়াতে পারলে সে ও বস্তির খালাদের কাছে বিক্রি করে। মা বলে দিয়েছে, ওই কটা টাকা ও নিজের খুশিমত খরচ করতে পারবে। বাদাম, ঝালমুড়ি, আইসক্রিম, বিস্কুট- যা খুশি খেতে পারবে।

ও খুশিতে ডগমগ হয়ে মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে বলে, তুমি হলে এই বস্তির সেরা মা। রশিদের মায়ের মতাে থাপ্পড় দিয়ে টাকাগুলাে কেড়ে নাও না।

মা হেসে বলে, আমি চাই তুই টাকাগুলাে খরচ করতে শিখবি। এটাও লেখাপড়া।

লেখাপড়া মা? কুড়কুড়ি চোখ কপালে তােলে।

মা আবারও হাসতে হাসতে বলে, এই যে তুই মাঝে মাঝে বন্ধুদের জন্যে লেবেনচুষ কিনিস, তা আমার ভালাে লাগে।

কুড়কুড়ি খুশিতে লাফিয়ে উঠে বলে, সত্যি মা!

হ্যা রে মেয়ে সত্যি, মিলেমিশে থাকাটাও শিখতে হয়। এটাও লেখাপড়া।

মায়ের কথা শুনে কুড়কুড়ির খুশির সীমা থাকে না। মায়ের কোলে মাথা রেখে বলে, উহ, মা মাগাে, তুমি আমার সােনা।

মা ওর মাথায় হাত রাখে। চুলের জট ছাড়তে ছাড়তে বলে, তুই যে আমাদের জন্যে ডাল-পেঁয়াজ-আলু-পটল কিনিস এটাও টাকা খরচ করতে শেখ মা।

কুড়কুড়ি মাথা সােজা করে মায়ের দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বলে, এটা আমার ভালােবাসা মা।

হ্যা, ভালােবাসা, ভালােবাসা। আমার ময়না কুড়কুড়ির ভালােবাসা।

মা-মেয়ের উচ্ছ্বসিত হাসি বস্তির অন্যরা কান পেতে শোনে।

সবাই ভাবে, বাহু কী সুন্দর শব্দ।

কুড়কুড়ি বেশিরভাগ সময় পাতা কুড়ায় সােহরাওয়ার্দী উদ্যানের ভেতরে।

ওখানে অনেক গাছ, অনেক পাতা। কখনও টাকা জমিয়ে শিশুপার্কের ভেতরে ঢুকে পড়ে। উদ্যানে তার সবচেয়ে পছন্দের জায়গা বড় একটি গাছ। ঐ গাছের নিচে বসে খানিকক্ষণ দম নিতে ওর ভালাে লাগে। সে সময় ও তাকিয়ে থাকে সেইসব ছেলেমেয়ের দিকে যারা সামনের স্কুলবাড়িটায় ছবি আঁকা শিখতে আসে। কখনও ওরা গেটের সামনে ছবি এঁকে লাগিয়ে রাখে, কখনও স্কুলঘরের ভেতরটা ছবি দিয়ে সাজায়। অনেকে দেখতে আসে। ওর খুব ইচ্ছে হয় ওখানে যেতে। কিন্তু নােংরা জামা পরে যেতে ওর ভয় লাগে। এখনও সাহস করে ঢুকতে পারে নি। এ নিয়ে ও মন খারাপ করে। আবার মন ভালাে হয়ে যায় যখন অন্য ছেলেমেয়ের সঙ্গে ভাগাভাগি করে বাদাম খায়।

হালকা শীত পড়তে শুরু করেছে। পৌষ মাসের একদিন। পাতা কুড়াতে এসে কুড়কুড়ি দেখতে পায় এক বুড়াে ওর প্রিয় গাছটির নিচে বসে আছে। ও থমকে দাড়ায়। মনে মনে একটু রাগও হয়। তবু বুড়াের একমাথা সাদা চুল বাতাসে উড়তে দেখে ওর খুব ভালাে লাগে। ভাবে, যুদ্ধের সময় ওর নানু মরে না গিয়ে বেঁচে থাকলে এমনই দেখতে হতো।

ও কাছে গিয়ে বসে। হাত ধরে বলে, তুমি কে?

লােকটা হেসে বলে, এটা বুড়াে। দাঁতপড়া বুড়ো।

খিলখিল করে হাসে কুড়কুড়ি।

তাহলে তােমাকে আমি নানু ডাকি?

হা, ডাকতেই পার। তােমাদের মতাে ছোটদের নানু হাতে আমার খুব ইচ্ছে হয়।

তুমি আমাদের বাড়িতে যাবে?

কে আছে তােমার বাড়িতে?

আমি, নানি আর আমার মা। আমরা কিন্তু বস্তিতে থাকি।

তাতে কিছু আসে যায় না। দেশটাই তো একটা বস্তি। তার মধ্যে তােমাদের বস্তিটা খুবই ছােট্ট।

দেশটা বস্তি হবে কেন? আচ্ছা নানু, তুমি কি যুদ্ধ দেখেছ?

বুড়াে সরল হাসিতে মুখ ভাসিয়ে দিয়ে বলে, আমি যুদ্ধ করেছি নাতনি।

ওমা, তাই! আমার নানি বলে। যারা যুদ্ধ করেছে তারা মুক্তিযোদ্ধা।

প্রতিবছর আমি ৭ মার্চ আর বিজয় দিবসে এখানে এসে বসে থাকি। সারাদিন থাকি।

কী খেয়ে থাক?

বাদাম আর ঝালমুড়ি।

তাহলে এখন থেকে আমি আর আমার বন্ধুরাও তােমার সাথে এখানে এসে সারাদিন থাকব।

অবশ্যই থাকবে। আমি খুব খুশি হব। তােমাদেরকে আমি যুদ্ধদিনের গল্প বলব। যুদ্ধের সময় এই উদ্যানটাকে রেসকোর্স ময়দান বলা হত। তুমি যুদ্ধের কথা শুনেছ নাতনি?

হ্যা, মানির কাছে শুনেছি।

কী শুনেছ?

নানি বলেছে সেই বছর বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘােষণা করেছিলেন। রেসকোর্স ময়দানে তিনি বক্তৃতা করেছিলেন। লক্ষ লক্ষ মানুষ এসেছিল।

এইটাই সেই রেসকোর্স ময়দান নাতনি।

ওমা, তাই! আমি তাে এটার নাম দিয়েছি পাতা কুড়ানাের ময়দান।

হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ে কুড়কুড়ি। আর মুক্তিযােদ্ধা বুড়াের চোখ থেকে জল ঝরে টুপটুপ।

কুড়কুড়ি দুহাত দিয়ে চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে বলে , তােমার খিদে পেয়েছে নানু?

না আমার খিদে পায় নি। তােমার নানি তােমাকে আর কী বলেছে?

বঙ্গবন্ধুর ডাকে দেশের মানুষ স্বাধীনতাযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল।

তারপর?

পাকসেনারা যখন বাবুপুরা বস্তি পুড়িয়ে দিয়েছিল তখন আমার নানা আগুনে পুড়ে মারা যায়।

তারপর?

মিলিটারি আমার নানিকে ধরে নিয়ে যায়। নানি খুব সুন্দর ছিল। নানা নাকি বলত আমার নানির গায়ের রঙ ছিল জ্যোৎস্না-ধােওয়া। এটুকু বলে খুব করে হাসে কুড়কুড়ি। হেসেই বলে, আমি নানির মতাে হই নি। মায়ের মতােও না। আমি একটা কাউলা প্যাকাটি।

লােকটি অস্ফুট স্বরে আবার বলে, তারপর?

তারপর একদিন যুদ্ধ শেষ হয়ে গেল।

এটুকু বলে চুপ করে থাকে কুড়কুড়ি। ওর মনে হয় আর কিছু বলার নেই।

যুদ্ধ শেষ হয়ে গেলে তাে সবই শেষ হয়ে যায়।লােকটি ওর দিকে তাকিয়ে আবার বলে, তারপর তােমার নানির কী হলাে?

নানি কোথা থেকে যেন ফিরে এল। এসে বলল, যুদ্ধে গিয়েছিল। কয়েক মাস পরে আমার মায়ের জন্ম। মা বলে, যেদিন তার জন্ম হয়েছিল সেদিন বস্তির লোকেরা বলেছিল, আজ আকাশভরা জ্যোৎস্না। জ্যোৎস্লা নাকি সেদিন বস্তিটা ধুয়ে দিয়েছিল।

বাহ্, তুমি তাে দেখছি অনেককিছু মনে রাখতে পার। তা তোমার মা বলে নি। তোমার জন্মের সময় জ্যোৎস্না ছিল কি না?

হ্যা, ছিল, ছিল নানু। মা বলেছে, নানি বলেছে। ঐদিন নাকি গাঁয়ের লােকেরা বলেছিল, কী সুন্দর জ্যোৎস্না। মাগাে এমন জ্যোৎস্না আমরা দেখি নি। সেই জ্যোৎস্নায় নাকি বস্তির কাকগুলােকেও পরীর মতো সুন্দর দেখাচ্ছিল।

তাহলে তাে দেখছি তুমি একটি জ্যোৎস্না-মেয়ে।

ঠিক, ঠিক। লাফিয়ে ওঠে কুড়কুড়ি। ঠিক বলেছ।

আমি তােমাকে জ্যোৎসা-মেয়ে ডাকব।

আমার বাবা থাকলেও আমাকে এই নামেই ডাকত।

কোথায় তোমার বাবা?

মা বলেছে, আমার জন্মের আগেই বাবা নাকি কোথায় চলে গেছে। মাকে বলে যায় নি। মা জানে না বাবা এখন কোথায়।

বাবা নেই তাে কী হয়েছে। কত ছেলেমেয়ের বাবা থাকে না। তুমি তাে ভালােই আছ জ্যোৎস্না-মেয়ে।

কুড়কুড়ি একটুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে, তুমি আমাকে জ্যোৎস্না-মেয়ে ডেকো না নানু। আমার নাম কুড়কুড়ি।

বাহ, সুন্দর নাম।

তুমি কবে আসবে আমাদের ঘরে?

যেদিন তুমি বলবে।

আচ্ছা, আমি মাকে জিজ্ঞেস করে তােমাকে আসতে বলব। সেদিন মাকে বলব চিতই পিঠা বানাতে। তুমি চিতই পিঠা খাও তাে নানু?

খুব খাই। ভীষণ মজা লাগে খেতে। খেজুরের রসে ভিজিয়ে খেতে মজার শেষ নেই।

আমারও খুব মজা লাগে। কিন্তু মা সব সময় বানাতে পারে না। অন্যের বাড়িতে কাজ করে তাে! মা আমাকে বলে চিতই বানাতে শেখাও লেখাপড়া। বাহ্, তােমার মা তাে খুব সুন্দর কথা বলেছেন।আচ্ছা কুড়কুড়ি, তােমার নানি এখন কী করেন?

আমার নানি রাতদিন কাঁথায় ফুল ফোটায়। সুতার ফুল। যুদ্ধের ছবি ফোটায়। কাঁথাগুলাে বিক্রি করে। আমার নানি কি চাঁদের চরকা-বুড়ি নানু? তােমার নানি চরকা-বুড়ি না, সুই-বুড়ি। তােমার নানিকে বলবে একটা বড় কাঁথায় যুদ্ধের ছবি ফুটিয়ে আমাকে যেন দেয়।

তুমি কী করবে কাঁথা দিয়ে?

কাঁথা জড়িয়ে ঘুমাব।

ওমা, তাই। কী মজা। আমি যাই। নানিকে গিয়ে বলি যে, একজন মুক্তিযােদ্ধা তােমার কাছে একটি কাঁথা চেয়েছে।

বুড়াে খকখক করে কাশে। কাশতে কাশতে গাছের কাণ্ডে মাথা হেলিয়ে দেয়।

তুমি পানি খাবে?

বুড়াে কাশতে কাশতে বলে, না, পানি খাব না। তুমি বাড়ি যাও কুড়কুড়ি।

তােমাকে রেখে আমি বাড়ি যাব না।

আমি তাে সারাদিন এই গাছের নিচে শুয়ে থাকব। তুমি বাড়ি যাও। তােমার মা তােমার জন্যে চিন্তা করবে।

তােমার খিদে পাবে না?

আমি না খেয়ে থাকতে পারি। অভ্যাস হয়ে গেছে। তুমি যাও, আমি ঘুমাব। এই মাটি আর ঘাসে আমি লক্ষ লক্ষ মানুষের পায়ের শব্দ শুনতে পাই। আর আকাশ-বাতাস থেকে ভেসে আসে বঙ্গবন্ধুর বজ্রকণ্ঠ। আমি ঘুমের মধ্যে দেখতে পাই পাকিস্তান বাহিনী আত্মসমর্পণ করছে। ওরা এই মাটিতে অস্ত্র নামিয়ে রাখছে।

কথা বলতে বলতে ঘুমিয়ে পড়ে বুড়ো। তার গলায় কাশি নেই। গভীর ঘুমে নিঃসাড়।

মানুষটার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে কুড়কুড়ি। ও বিশ্বাসই করতে পারে না, যাকে ও নানু বলে ডেকেছে, সেই মানুষটি এক মুহূর্তে ঘুমিয়ে পড়তে পারে।

ও শব্দ না করে পাতার বস্তাটা মাথায় নিয়ে বস্তির খালাদের ঘরে যায়। পাতা বিক্রি করে খুশি হয়ে টাকাগুলাে কোমরে গুঁজে রাখে। এক দৌড়ে ফিরে আসে নিজেদের ঘরে। ঢুকেই নানির গলা জড়িয়ে ধরে বলে, নানি, তুমি আমাকে আজকে যুদ্ধের গল্প বলবে। অনেকদিন গল্প কর না।

নানি চোখে চশমা দিয়ে একটি কাঁথায় ফুল তুলছিল। কুড়কুড়ির দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে বলে, তুই এমন ঝলমল করছিস যে নাতনি!

আজ একজন মুক্তিযােদ্ধা নানুর দেখা পেয়েছি। তিনি বলেছেন, তুমি তােমার নানিকে বলবে মুক্তিযুদ্ধের নকশা করে আমার জন্যে যেন একটি কাঁথা সেলাই করে।

সত্যি তাই বলেছে? কুড়কুড়ির নানি তসলিমা খাতুন চোখ থেকে চশমা খুলে ওর দিকে তাকায়। বলে, নাতনি, দেখ, আমি একটি পাখির ঠোটে ফুল দিয়ে এই নকশাটি করছি। দেখ্, দেখ্…।

হঠাৎ করে তসলিমা খাতুনের চোখ পানিতে ভরে যায়। কুড়কুড়ি নিজের ওড়না দিয়ে নানির চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে বলে, পাখিটা তাে উড়ছে নানি।

ওর ডানাটা কী সুন্দর করে বুনেছ।

পাখিটা কোথায় যাবে জানিস?

কোথায় নানি?

এই যে কাঁথার এই কোণায় একজন শহীদ মুক্তিযােদ্ধার নকশা বুনব। পাখিটা উড়ে গিয়ে এই শহীদ মুক্তিযােদ্ধার পাশে ফুলটা রাখবে।

উহ্, নানি গাে… বলে কুড়কুড়ি গলা জড়িয়ে ধরে। বলে, আজকে আমি পাতা বিক্রি করে কয়েকটা টাকা পেয়েছি। যােদ্ধা-নানুর জন্যে আইসক্রিম কিনব। এই কাঁথাটি তুমি তাড়াতাড়ি শেষ করো। তুমি, মা আর আমি গিয়ে কাঁথাটা যােদ্ধা-নানুকে উপহার দেব। নানুর শরীরটা বেশি ভালাে মনে হয় নি আমার। খুব কাশছিল। মনে হচ্ছিল বুকের মধ্যে কফ জমে পাহাড় হয়ে আছে।

আহারে বেচারা—

কুড়কুড়ি নানির মুখে হাতচাপা দিয়ে বলে, বেচারা বলছ কেন নানি? যে যুদ্ধ করে সে তো বীর।

তসলিমা খাতুন অবাক হয়ে মেয়েটার মুখের দিকে তাকায়। তার বুদ্ধিদীপ্ত চোখ জোড়া অপূর্ব দেখায়।

মনে হয়, যেন যুদ্ধের সময়ের সেই মেয়েটি, যে জ্বলজ্বলে চোখে স্বাধীনতার জন্যে কাজ করেছিল।

ও, আমার সােনার জাদু রে, আমার বুকে আয়। কুড়কুড়ি নানির কোলে ঝাপিয়ে পড়লে চিৎকার করে কাঁদে তসলিমা খাতুন।

বস্তির আশপাশের ঘরের লােকেরা ওদের ঘরের সামনে ভিড় জমায়। সবারই একটা জিজ্ঞাসা, কী হয়েছে?

কাঁদছে কেন কুড়কুড়ির নানি?

চোখ মুছে তসলিমা খাতুন বলে, আনন্দে কাঁদছি।

আজ আমার খুশির দিন।

খুশি? কীসের খুশি আপনার?

আমার সামনে আজ আমি নতুন মুক্তিযােদ্ধা পেয়েছি।

তসলিমা খাতুন নাতনির হাত উঁচু করে ধরে। সবাই হাততালি দেয়। কুড়কুড়ি হাসিমুখে তাকিয়ে থাকে।

এরপর অনেকদিন যােদ্ধা-নানুর সঙ্গে দেখা হয় না কুড়কুড়ির। ও বন্ধুদের বলে, কোথায় যে হারিয়ে গেল যােদ্ধা মানুষটা! ওর খুব মন খারাপ হয়। তারপর ভাবে, নিশ্চয়ই মানুষটির সঙ্গে আবার দেখা হবে ওর। এখানে এসে একদিন ঠিকই বসে থাকবে। বলবে, জ্যোৎস্না-মেয়ে, তুমি কেমন আছ?

তােমার নানির কি কাঁথা সেলাই হয়েছে?

দেখতে দেখতে মাঘ মাস ফুরিয়ে যায়। চারদিকে ফাগুনের ছোঁয়া। ঝরে যাওয়া গাছের ডালে নতুন পাতা গজিয়েছে। নতুন ফুল ফুটতে শুরু করেছে। একদিন কয়েকটি অশােক ফুলের কুঁড়ি ছিড়ে বাড়ি ফেরার পথে কুড়কুড়ির দেখা হয় মুক্তিযােদ্ধার সঙ্গে। শীতে কাবু হয়ে গেছে। শুকনাে মুখে খোচা দাড়ি। কুড়কুড়ি দৌড়ে কাছে গিয়ে বলে কেমন আছ যােদ্ধা- নানু?

শরীরটা ভালাে নেই রে নাতনি।

আজ আমি আপনাকে ঝালমুড়ি খাওয়াব। আপনি এখানে বসুন। আমি নিয়ে আসছি।

কুড়কুড়ি একছুটে বড় রাস্তার ধারে গিয়ে ঝালমুড়ি কিনে আনে। সঙ্গে লজেন্স।

ফিরে এসে দেখতে পায়, যােদ্ধা-নানু কাশছে।কাশির চোটে মুখের শিরাগুলাে ফুলে উঠছে। ও গিয়ে হাত ধরে। মাথার চুলে হাত বুলিয়ে আদর করে। কাশি থামলে ঝালমুড়ির ঠোঙাটা এগিয়ে দিয়ে বলে, খাও। এই যে দেখাে ফুল, এগুলাে তােমার জন্যে রেখেছি। পৌষ মাসে আমি বকুলফুলের মালা গেঁথে তােমার জন্যে রেখেছিলাম। তােমার দেখা আর পাই নি। যােদ্ধা-নানু মৃদু হেসে বলে, পৌষ মাসে ছিল বিজয় দিবস। আমি আবার এই রেসকোর্সে এসেছি। সামনে একটি দিন আছে।

কী দিন নানু?

সাতই মার্চ।

এদিন তাে বঙ্গবন্ধু এখানে ভাষণ দিয়েছিলেন। আপনি কি সেদিন এখানে সারাদিন থাকবেন?

হ্যা, থাকব তাে। সেদিন বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠস্বর শুনতে পাব।

কবে সেই দিন আসবে?

আর একদিন পরে।

আগামী পরশু? কী মজা! নানির কথা সেলাই হয়ে গিয়েছে। পরশুদিন নানি, মা আর আমি বন্ধুদের নিয়ে আপনাকে কাঁথা দিয়ে যাব।

মুক্তিযুদ্ধের নকশা-করা কাঁথা। আমার নানি আপনাকে দেখতে চেয়েছেন।

ঠিক আছে। তােমরা এসাে। আমি এখানেই থাকব।

খুব ভালাে লাগল তােমার হাতে ঝালমুড়ি খেয়ে। তুমি এখন ঘরে যাও। কুড়কুড়ি ঘরে ফিরে মা আর নানিকে মুক্তিযােদ্ধার কথা বলে। পরশু দিনের জন্যে চিতই পিঠা বানানাের কথা বলে। কোমরে গুঁজে রাখা টাকা বের করে মাকে দেয় চালের গুঁড়াে আর গুড় কেনার জন্যে। ওর কেবলই মনে হয় পরদিন ওদের ঈদ। ভীষণ খুশির দিন।

পরদিন বিকেলে তিনজনে কথা আর পিঠা নিয়ে সােহরাওয়ার্দী উদ্যানে আসে। দূর থেকে কুড়কুড়ি নানি আর মাকে দেখায়, ঐ দেখাে, যােদ্ধ-নানু গাছের নিচে শুয়ে আছে। আমি যাই মা?

না, আমাদের সঙ্গে থাক।

তসলিমা খাতুন ওর হাত ধরে। কুড়কুড়ি দৌড় দেওয়ার জন্যে পা । বাড়িয়েও থমকে যায় । মা ও নানির হাত ধরে গাছের নিচে এসে দাঁড়ায় । চিৎ হয়ে শুয়ে আছে ওর যােদ্ধা – নানু । চোখ বােজা।

কুড়কুড়ি মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে, নানু তাে ঘুমিয়ে আছে। ডাকব মা? তসলিমা খাতুন আস্তে করে বলে, ডাকো।

কুড়কুড়ি গা ধরে ঝাকায়।

নানু, ও নানু ওঠো। আমরা এসেছি। আমার নানি তােমার জন্যে নকশি কথা এনেছে। মা এনেছে চিতই পিঠা। ও নানু…।

তসলিমা খাতুনের হাত থেকে কথাটা পড়ে যায়।

কুড়কুড়ি কেঁদে ফেলে।

নানু জাগছে না কেন মা? ও নানু, নানু—

তসলিমা খাতুন নাতনিকে টেনে তুলে বলে, তােমার যােদ্ধা-নানু বেঁচে নেই। আমি বুঝতে পারছি। তিনি শ্বাস ফেলছেন না।

কুড়কুড়ির মা বুকের ওপর কান পেতে বলে, হ্যা, ঠিকই। তিনি মারা গেছেন।

কুড়কুড়ি চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে বলে, কেন মরে গেল, আমার নানু। কেন? কেন? নানু তাে নকশি কাঁথাটা দেখতেও পেল না।

তুই না বলেছিলি নানুর শরীর খুব খারাপ। দেখ ঘাড়টা কাত হয়ে আছে।

কান্নাভরা কণ্ঠে কুড়কুড়ি বলে, আমরা এখন কী করব?

স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা তসলিমা খাতুন বলে, আমরা যুদ্ধের নকশা আঁকা এই কথাটা দিয়ে তােমার যােদ্ধা-নানুকে ঢেকে দেব। তারপর এই মাঠে। হাজার হাজার লােক আসবে তােমার নানুকে ঘাড়ে করে কবরস্থানে নিয়ে যাওয়ার জন্যে। সবাই মিলে কাঁথাটা ধরাে আমার সঙ্গে।

তিনজনে ডুকরে কাঁদতে থাকে। তিনজনে কাঁথা দিয়ে মুক্তিযােদ্ধার শরীর ঢেকে দিতে থাকে।

রেসকোর্স ময়দানটিকে যে মানুষ ভালােবাসত সেই ময়দানে সেই সাতই মার্চের সময় ফিরে আসতে থাকে।

কুড়কুড়ির মনে হয় চারদিক থেকে হাজার হাজার মানুষ ছুটে আসছে। মুক্তিযােদ্ধাকে দেখার জন্যে। চিৎকার করে লােকেরা বলছে, জাগাে মুক্তিযােদ্ধা, জাগাে। কান পেতে শোনাে বঙ্গবন্ধু ভাষণ দিচ্ছেন।

কুড়কুড়ি মাকে জড়িয়ে ধরে বলে, মা শােনাে, বঙ্গবন্ধু ভাষণ দিচ্ছেন। নানি, তুমি শুনতে পাচ্ছ না?

পাচ্ছি, পাচ্ছি সােনা, পাচ্ছি। সেদিন আমিও তাে এই রেসকোর্স ময়দানে বসে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনেছিলাম। তখন কুড়কুড়ির বন্ধুরা এসে জড়াে হয়। ও সব ছেলেমেয়ের দিকে তাকিয়ে বলে, আয় আমরা মুক্তিযােদ্ধাকে স্যালুট করি। মুক্তিযােদ্ধার কাছে আমার নানি দাঁড়িয়ে থাকবেন, আমরা তাঁকেও স্যালুট করব। আমার নানিও মুক্তিযােদ্ধা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *