শিশুতোষ গল্প।। গল্পটি জয় বাংলার।। শাম্মী তুলতুল

গত তিন দিন ধরে অরুণের মায়ের ভালো কাটেনি।বার বার মুক্তিযোদ্ধাদের কথায় ভাবছিলেন তিনি।ভাবতে ভাবতে তার নাভিশ্বাস ওঠার উপক্রম হয়েছিল।সিদ্ধান্ত নিতে হিমশিম খাচ্ছিল।
মায়ের পাশে শুয়ে ছিল অরুণ।তার ভাবুক ভাবুক চোখ দুটো মায়ের অবস্থা দেখে উদাস হয়ে যায়।মায়ের ছটফটানি দেখে জিজ্ঞেস করে কি হয়েছে মা?
কত কিছুই তো করার বাকী বাবা।কিছুই করতে পারছিনা।
অরুণ কিছু বুঝতে না পেরে মায়ের মুখের দিকে হা করে রইল।একটু পর মায়ের হাত ধরে বলে,বুঝিয়ে দাওনা মা।
মা অরুণের হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে বলে,আমাকে বসে থাকলে চলবে না বাবা।আমি উঠি।
কোথায় যাবে মা?
মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করতে।
কিন্তু মা?ওরা তো…
শত্রুর ভয়ে যদি লুকিয়ে থাকি যোদ্ধাদের সহযোগিতা করবে কে? কাউকে না কাউকে সামনে এগোতেই হবে।তা দেখে আর দশ জন এগোবে।এই বলে অরুণের মা বিছানা ছেড়ে উঠে গেলো।দরজা খুলতেই গোয়াল ঘরের ওপাশ থেকে লোকজনের কণ্ঠ শোনা গেলো।অরুণের মা হারিকেন নিয়ে গোয়াল ঘরের পেছনে যেতেই দেখে দশ,বার জন যুবক চাদর বিছিয়ে বসে আছে।সবার মুখ রুমাল দিয়ে ঢাকা।
অরুণের মাকে দেখে চমকে গেলো তারা,ইতস্তত হয়ে বলল, আমাদের একটু সুযোগ দিন ।আপনার কোন ক্ষতি করবোনা মা।ভোর হলেই চলে যাবো।
তাদের কথা শুনে অরুণের মায়ের চোখ ছলছল করে উঠল।
কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল,বাবারে আমার কি ক্ষতি করবা তোমরা,ক্ষতি তো আমার দেশের হয়ে যাইতেছে।মাকে তো তোমরাই রক্ষা করতে প্রাণ বিসর্জনে নেমেছ।তোমাদের সাহস দেখে আমি অবাক হয়ে যাই।দেখো তোমাদের দেখে আমার বুকটাও সাহসে ভরে উঠেছে।ভয় পেয়োনা।তোমরা এখানে নিশ্চিন্তে থাকো।আমি যায় তোমাদের কিছু খাওয়ার ব্যবস্থা করি। অরুণের মা ঘরের ভেতর গিয়ে দেখে মুড়ি ছাড়া খাওয়ার কিছুই নেই। তরিগরি করে তিনি মুড়ির সাথে চিনি মিশ্রণ করে চুলায় ভেজে নিলো।চিনি ভাজা মুড়ি আর এক জগ পানি নিয়ে তাদের খেতে দিলো।তারা এসব খাবার পেয়ে মহাখুশী।আনন্দিত। যুদ্ধের সময় এমন খাবার তাদের কাছে খোঁদার সেরা নেয়ামত মনে হলো।
অরুণের বাড়ির আশেপাশেই পাকবাহিনীর ঘাঁটি বসানো হয়েছিল।
যখনই বুঝতে পারলো অরুণের বাড়ির ভেতর কিছু একটা ঘটছে তৎক্ষণাৎ তারা সেখানে দৌড়ে গেলো। অরুণের মা মুক্তিযোদ্ধাদের কোন রকম ঘরের ছাঁদে তুলে দিয়ে তাদের জীবন বাঁচিয়ে দিলো।পরের দিন খবর পাওয়া যায় অরুণের পাশের বাড়ির রাজাকার আনু মিয়া পাকবাহিনীর সাথে মিলিত হয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সব খবরা খবর পাচার করছিল।এদিকে অরুণের মা এক দুর্দান্ত কাজে হাত দিলো।পাকবাহিনীর চোখকে ফাঁকি দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের লুকিয়ে রাখা স্ট্যান্ড গান আর মেক্সিন মুক্তি বাহিনীদের পৌঁছে দেয়া শুরু করলো।
মাসীমার সাহস দেখে আমি অবাক!অরুণের বন্ধু মান্নান বলল।
জানিস যুদ্ধ শুরু থেকেই মায়ের চোখে এক রাতও ঘুম ধরা দেয়নি।তার চোখগুলো রক্তাক্ত, মুখটা শুকিয়ে কাঠ।মুখে কোন কথা নেই।শুধু ভাবনায় ডুবে থাকতো। মায়ের সাহস দেখে আমিও আর বসে থাকতে পারিনি।যোগ দিলাম তোর সাথে।
খুব ভালো করেছিস।আমাদের যা করার জলদি করতে হবে।
হুম।
আমার পরে হাল তোকে ধরতে হবে।
তুই যা বলিস।
কয়েকদিন পর সুলতান মাহমুদের নেতৃত্বে চট্টগ্রামের রাউজানের মধুনাঘাট পাওয়ার হাউজ নষ্ট করে মান্নান আর অরুণ মিলে।তার আগে নৌকা করে অরুণ ও তার সহযোদ্ধারা হালদা পাড়ের জেলে বাড়ির পার্শে মাটি খনন করে তাদের বাড়তি অস্ত্রগুলো মাটির ভেতর পুতে রাখে।এদিকে অরুণ আর অরুণের মায়ের খবর পৌঁছে গেছে বাংলার রাজাকারের কানে।রাজাকারের ভয়ে তারা ঘর বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নেয়।পাকবাহিনীরা ওদের আর আশেপাশের সমস্ত ঘর বাড়ি জ্বালিয়ে দেয়।অবস্থা বেশী বেগতিক দেখে সেদিনই মধ্য রাতে তারা সবাই পাকিস্তানী শত্রুদের বিপক্ষে অপারেশনে নেমে যায়।কিন্তু দুঃখের বিষয় মান্নানের গায়ে গুলি লাগার কারণে তারা আর সামনে এগোতে পারলো না। সবার মন ভেঙ্গে গেলো।চার- চারটি বুলেট তার বুক ঝাঁঝরা করে দিলো।এক হাতে বন্ধুক আর অন্য হাত রক্তাক্ত হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পরল সে।
তার কণ্ঠে জয় বাংলা শ্লোগানে আকাশ- বাতাস মুখরিত হয়ে উঠল।মান্নানের কানে তখন শুধু একটাই শব্দ বাজছিল বঙ্গবন্ধুর সেই স্লোগান জয় বাংলা,জয় বাংলা।জয় বাংলা।শেষে মান্নান মৃত্যুর কোলে ঢলে পরল।
হাজার চেষ্টা করেও মান্নানকে বাঁচানো গেলনা।
ডাক্তার রেণু তাকে মৃত বলে ঘোষণা দিলেন।তার মৃত্যুতে অরুণ সহ সকলে চিৎকার করে কাঁদতে লাগলো।হায় যুদ্ধ এতো নিষ্ঠুর কেন হয়?মান্নানের মৃত্যু শত্রুর বিপক্ষে অস্ত্র ধরার জন্য নতুন কৌশল আয়ত্ত করতে শিখিয়ে দিলো অরুণদের।
মান্নানকে অরুণের বাড়ির পূর্ব পাশেই কবর দেওয়া হয়। কিছুদিন পর স্থানীয় বাজারে পাকিস্তানীরা বাজার করার খবর পেয়ে বাজার অপারেশনের প্রস্তুতি নেয় অরুণ।একের পর এক অপারেশন শেষে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর জয় বাংলা স্লোগানে মুখরিত হয় বাংলার একেকটা অঞ্চল,একেক একটা শহর। দীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধ শেষে একটি বাংলাদেশ পেয়েছি আমরা।একটি স্বাধীন লাল -সবুজের গৌরবের পতাকা পেয়েছি আমরা।কিন্তু অরুণের মতো যোদ্ধারা এখনো মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য যুদ্ধ করেই যাচ্ছে।দুর্নীতিবাজদের কারণে সরকারের কাছে পৌছাইনি আসল মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা।এখনো আসল যোদ্ধারা তাকিয়ে আছে সেই মাহেন্দ্রক্ষণের আশায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *