সাক্ষাৎকার।। আগামী প্রজন্মের মধ্যে জাতীয়তাবোধের জাগরণ জরুরি।। মামুন মুস্তাফা


৩ জুলাই, ১৯৭১ সালে মামুন মুস্তাফা জন্মগ্রহণ করেন পিতার কর্মক্ষেত্র বর্তমান বাগেরহাট জেলায়। তাঁর প্রকৃত নাম মুস্তাফা কালিমুল্লাহ আল মামুন। পিতা মুহম্মদ গোলাম রসূল ছিলেন বাগেরহাট সরকারি প্রফুল্লচন্দ্র মহাবিদ্যালয় ও খুলনা দৌলতপুর বিএল কলেজের ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক। মা হামিদা রসূল ছিলেন প্রথম জীবনে একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার কর্মকর্তা, পরে পুরোদস্তর গৃহিণী। বাবা=মা দুজনেই আজ প্রয়াত। দুই ভাইবোনের মধ্যে কনিষ্ঠ মামুন মুস্তাফা। তাঁর পৈতৃক নিবাস বর্তমান মাগুরা জেলার সদর থানার পারনান্দুয়ালী গ্রামে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে বিএসএস (অনার্স)সহ স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জন করেছেন। বর্তমানে তিনি দৈনিক বাংলাদেশের খবরের সহকারি সম্পাদক। পাশাপাশি দেখছেন দৈনিকটির সাহিত্যপাতাও। সাম্প্রতিক সময়ের কবিতা বিশেষভাবে নব্বইয়ের সময় থেকে জটিল দায়বদ্ধ ও গদ্যকবিতার সঙ্গে শিল্পগুণসমৃদ্ধ, পরিপার্শ্ববর্জিত সমাজনিরপেক্ষ─ঐতিহ্যে অন্তর্মুখীন কবিতার ধারা লক্ষ করা যায়। এ-সময়পর্বের কবিগণ কবিতায় অধিক প্রাণচাঞ্চল্য, মননশীলতা এবং বাস্তবতার আলোকে ব্যাপক আন্তর্জাতিকতাকে ধারণ করতে সক্ষম হয়েছেন। বাংলাদেশের কবিতায় তাই নব্বইয়ের দশক একটি উল্লেখযোগ্য স্থান অর্জন করে নিয়েছে। এ-সময়পর্বেরই মননবোধে উজ্জীবীত সৃজনশীল কবি হিসেবে চিহ্নিত হন মামুন মুস্তাফা। কবির প্রকাশিত গ্রন্থগুলোর ভেতরে রয়েছে কবিতা : সাবিত্রীর জানালা খোলা (১৯৯৮), কুহকের প্রত্নলিপি (২০০১ ও ২০০৯), আদর্শলিপি : পুনর্লিখন (২০০৭), এ আলোআঁধার আমার (২০০৮, কলকাতা সংস্করণ ২০১৪), পিপাসার জলসত্র (২০১০), শিখাসীমন্তিনী (২০১২), একাত্তরের এলিজি (২০১৩), শনিবার ও হাওয়াঘুড়ি (২০১৫), ব্যক্তিগত মেঘ ও স্মৃতির জলসত্র (২০১৭, কলকাতা; শৌভিক দে সরকারের সঙ্গে যুগলবন্দি), কফিনকাব্য (২০১৮) এবং নির্বাচিত কবিতার সংকলন দশ দশমী (২০২০)।

অন্যদিকে মামুন মুস্তফার রয়েছে চারটি প্রবন্ধগ্রন্থ : এই বদ্বীপের কবিতাকৃতি (২০০৯), মননের লেখমালা (২০১১), অন্য আলোর রেখা (২০১৬) ও বাংলা কবিতা : আধুনিকতার অনুসৃতি। সম্মাননা : চিহ্নসম্মাননা । সম্পাদনা : ২০১৫ সাল থেকে মামুন মুস্তাফা সম্পাদনা করছেন সাহিত্যের ছোটকাগজ লেখমালা ।

সাহিত্যে নানান বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন কবি ও সাংবাদিক শব্দনীল এর সাথ।

কাব্যশীলন : একজন কবি বা সাহিত্যকর্মী হয়ে সমসাময়িক সাংস্কৃতিক লড়াই কতটুকু উপভোগ করছেন বা করতে পারছেন?

মামুন মুস্তাফা : ‘সাংস্কৃতিক লড়াই’ কথাটির ব্যাপকতা অনেক। নিজস্ব সংস্কৃতি রক্ষায় লড়াইটা আমাদের থমকে আছে। সাহিত্যের ভেতরেও এই লড়াইটা একটা সময়ে জোরেশোরে হয়েছে, কিন্তু বর্তমানে উত্তরাধুনিকতার নামে আমাদের সংস্কৃতির জায়গাটা ক্রমশ ক্ষয়ে আসছে। এর ব্যাপকতা এখন ব্যক্তি-জীবন থেকে রাষ্ট্রীয় পর্যায়েও পরিলক্ষিত হচ্ছে। আমাদের দেশপ্রেম আজ লোক দেখানো মাত্র। দেশাত্মবোধ চেতনায় ধারণ না করা পর্যন্ত আমাদের সাংস্কৃতিক আন্দোলনও পথ খুঁজে পাবে না। তাই আপনার কাছেই আমার পাল্টা প্রশ্ন, যে, আসলেই কি সাংস্কৃতিক লড়াই কিছু হচ্ছে?

কাব্যশীলন : রাজনৈকিত প্রভাবক, বিশ্ব পরিস্থিতি, অর্থনীতির সঞ্চালন, শ্রম- শোষণের কথা এই সময়ের শিল্প-সাহিত্যে কেন আসছে না বলে মনে করেন।

মামুন মুস্তাফা : একটা সময়ে আমরা উপনিবেশবাদের দোহাই দিতাম। কিন্তু সে- সময়েও মানুষের মধ্যে জাতীয়তাবোধের উন্মেষ ঘটেছিল। শিক্ষা তখন বাণিজ্যিক হয় নি। তখন মানষের মধ্যে নৈতিকতার চর্চা ছিল। সে কারণেই তখন বলা সম্ভব হয়েছে,‘যেসব বঙ্গেতে জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী/সেসব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি; ‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই;
‘ভগবান, তুমি যুগে যুগে দূত, পাঠায়েছ বারে বারে
দয়াহীন সংসারে,
তারা বলে গেল “ক্ষমা করো সবে, বলে গেল “ভালোবাসো-
অন্তর হতে বিদ্বেষ বিষ নাশো”।;
‘গাহি সাম্যের গান-
মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই,
নহে কিছু মহীয়ান; ‘পাখিরা বল্লম তুলে নিচ্ছে না হাতে এই আমার দুঃখ
কেন রমণীয়
শিল্প থেকে বিষ উগরে ওঠে না’- ইত্যাদি সব সমাজ, রাষ্ট্র সর্বোপরি মানবজয়ের মর্মকথা। আজকের সমাজব্যবস্থায় আমার সন্তানকে উচ্চশিক্ষা দিতে গিয়ে যে ইংরেজি মাধ্যমে পড়াচ্ছি, সেখানে তাকে ভুলিয়ে দেয়া হচ্ছে তার নিজস্বতা, সংস্কৃতি ও জাতীয়তাবোধ। দেশপ্রেম তার ভেতর লালন হচ্ছে না। আর যে গুটিকয়েক মধ্যবিত্তের সন্তান বাংলা মাধ্যমে পড়ছে। সেখানেও নেই নিজস্ব সংস্কৃতির চর্চা, সৃজনশীলতা গড়ে তোলার কোনো পাঠ। তাকে ভালো ফল করার দৌড়ে কিছু কাঠামোবদ্ধ বিদ্যার্জনে কোচিং থেকে টিউটরের কাছে দৌড়ে বেড়াতে হচ্ছে। সবখানে দুর্নীতি রাহুর মতো গ্রাস করছে। এই সমাজব্যবস্থায় মানুষের পক্ষে দাঁড়ানোর কেউ নেই। এখন উপরে ওঠার লড়াইয়ে সবাই একা। যে যার মতো করে হাঁটছে। এ থেকে উত্তরণে আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধের মতো জাতিকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করার জন্যে বঙ্গবন্ধুর মতো দূরদর্শী নেতার প্রয়োজন এবং সেইসঙ্গে শিক্ষাব্যবস্থায় নৈতিক শিক্ষার চর্চায় ব্যাপক প্রসার দরকার। নতুবা জাতীয়তাবোধের জাগরণ আগামী প্রজন্মের মধ্যে ঘটবে না। সুতরাং আমি মনে করি, এসব কারণেই আমাদের শিল্প-সাহিত্যও এখন একরকম শোষণ-বঞ্চনার ভেতর দিয়েই এগুচ্ছে।

কাব্যশীলন : ‘সব কিছু নষ্টদের অধিকারে যাচ্ছে’ কথাটির সঙ্গে কতটুকু একমত পোষণ করছেন।

মামুন মুস্তাফা : আপনার আগের প্রশ্নের উত্তরের মধ্যে এই প্রশ্নের উত্তর অনেকখানি আপনি পেয়ে গেছেন বলে আমি মনে করি। তবে এখনও কিছু মননশীল লেখক, বুদ্ধিজীবী আছেন, যারা দেশ ও জাতিকে নষ্টদের অধিকার থেকে রক্ষা করতে সচেষ্ট। কিন্তু যখন শতকরা ৮০ ভাগ নীতিবর্জিত মতলববাজ হয়ে যায়, দুর্নীতির রাহুর গ্রাসে আচ্ছন্ন হয়; সেই তখন ২০ ভাগ প্রকৃত দেশপ্রেমিক জাতীয়তাবাদী সৃজনশীল বুদ্ধিজীবীর পক্ষে জাতিকে রক্ষা করাটা কঠিন হয়ে পড়ে। তথাপি বলব, এখন প্রয়োজন সামাজিক আন্দোলনের, যার নেতৃত্ব দিতে হবে ওইসব দিকদর্শনকারী বুদ্ধিজীবীদের এবং আবারো বলি, প্রয়োজন বঙ্গবন্ধুর মতো নেতৃত্ব। যেটি সম্ভব হয়েছিল ফরাসী বিপ্লবে, একাত্তরে আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধে।

কাব্যশীলন : মতলববাজ বা অসচেতন কবি লেখকদের পাঠক বুঝবে কি করে বা প্রকৃত শিল্প-সাহিত্যের খোঁজ তারা পাবে কোথা থেকে?

মামুন মুস্তাফা : যিনি প্রকৃত পাঠক, তিনি পাঠাভ্যাসের মধ্যেই থাকেন। তার পক্ষে স্টান্টবাজির কবি-লেখকদের সনাক্ত করা সহজ। কিন্তু যারা সিজিনাল পাঠক কিংবা লোকমুখে শুনে শুনে ধারণা পোষণ করে থাকে, তাদের পক্ষে ওই মতলববাজ লেখকদের নির্ধারণ করা কঠিন।

কাব্যশীলন : সাহিত্যের অপ্রয়োজনীয় হৈ-হুল্লোড় এবং আত্মপ্রচারের নগ্নতা নব্বই দশকে বেশি ছিলো নাকি বর্তমানে?

মামুন মুস্তাফা : আমি মনে করি আশির দশকের শেষ দিকে এর সূত্রপাত। যা এখন প্রকট আকার ধারণ করেছে।

কাব্যশীলন : সাহিত্যজগৎ এবং অন্তর জগতের এক বিস্ময়কর সংশ্লেষণ শিল্প। কবিতা তারই অঙ্গ। তবুও কবিতাকে ভিন্ন ভাবে দেখা হয় কেন?

মামুন মুস্তাফা : কবিতা কবির মনন ও বোধের স্ফুরণ। কবিতাকে পাঠকেরও ধারণ করতে হবে তার মনোজগতের শৈলীর ভেতরে। সুতরাং কবিতাকে বুঝতে পাঠককে যুদ্ধ করতে হয় প্রতিনিয়ত। আর এ কারণেই কবিতাকে সাহিত্যের অন্যান্য শাখা থেকে ভিন্ন চোখে দেখা হয়।

কাব্যশীলন : আধুনিক ভাষারীতির কবিতা চর্চা বাংলা সাহিত্যের কোন দশক থেকে শুরু হযেছে বলে মনে করেন?

মামুন মুস্তাফা : সব কালেই ওই সময়ের প্রচলিত ভাষারীতি অবলম্বনে সাহিত্য সৃষ্টি হয়েছে। সুতরাং সেই কালের বিচারে তা আধুনিক। তবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এতটাই আধুনিক ছিলেন যে, তাঁকে উত্তরণ করা তাঁর সময় কিংবা পরবর্তী প্রজন্মের লেখকদের পক্ষেও অসম্ভব হয়ে উঠেছিল। সেই বিচারে আধুনিক কাব্যসাহিত্য তিরিশের প্রধান পাঁচ কবির হাতেই প্রথম লক্ষ করা যায়।

কাব্যশীলন : তিন দশক ধরে সাহিত্যের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে সম্পৃক্ত আপনি। নিজের ভিতরের বিবর্তনকে ছয়টি কাব্যগ্রন্থে উপস্থাপন করেছেন। এই উপস্থাপনের কথা জানতে চাই।

মামুন মুস্তাফা : আমার নির্বাচিত কাব্য ‘দশ দশমী’ এবং ২০২১-এর বইমেলায় প্রকাশিত একটি অনুকাব্য ‘শায়কচিহ্ন’ নিয়ে মোট কবিতাগ্রন্থ ১৩টি। আপনি কোন্‌ ৬টি কাব্যের কথা বলছেন তা পরিষ্কার নয়। তবে আমি তৃপ্তি বোধ করেছি কুহকের প্রত্নলিপি, এ আলোআঁধার আমার, একাত্তরের এলিজি, শনিবার ও হাওয়া ঘুড়ি, ব্যক্তিগত মেঘ ও স্মৃতির জলসত্র এবং কফিনকাব্য লিখে। আমার এ কাব্যগুলোতে মানব-অন্তরের সূক্ষ্ম অনুভূতি ও নস্টালজিয়ার পাশাপাশি এক ধরনের মেটাফিজিক্যাল দর্শনের দেখা মেলে। এর আরেকটি স্বাতন্ত্রিকতা হচ্ছে এই প্রতিটি কাব্যের বিষয়-বৈচিত্র্যে ভিন্নতা লক্ষ করা যায়। কিন্তু আমার কথাই তো আর সর্বৈব নয়। সবশেষে সাহিত্যের প্রকৃত বিচারক তো পাঠক-সমালোচক। তারাই বলবেন এর সার্থকতা ও ব্যর্থতা প্রসঙ্গে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *