সাক্ষাৎকার।। অনলাইনেই সাহিত্য চর্চার ভবিষ্যৎ দেখি।। সৈয়দ ইফতেখার
পুরো নাম সৈয়দ ইফতেখার আলম। শুরুতে এই নামেই লেখালেখি করতেন। পরে শুধু সৈয়দ ইফতেখার নামে লেখা আরম্ভ করেন। নাম দুই অক্ষরে রাখার জন্য মূলত। সে হিসেবে তিনি নাম পরিবর্তন করেননি। নিজের আসল নামেই লেখেন। ২০০৭ সালে, তরুণ বয়সে তাঁর সাংবাদিকতায় হাতেখড়ি একুশে টেলিভিশনে মুক্তখবরের মাধ্যমে। পরে কয়েকটি পত্রিকা ও অনলাইনে কাজ করেন প্রতিবেদক হিসেবে। ২০১৪ সালে যুক্ত হন বসুন্ধরা গ্রুপের অনলাইন নিউজ পোর্টাল বাংলানিউজে। সেখানে বার্তাকক্ষে কাজের পাশাপাশি বিশেষ প্রতিবেদন তৈরি করে কাটে বছর চারেক। ২০১৮’তে যোগ দেন দেশের শীর্ষ সংবাদভিত্তিক চ্যানেল সময় টেলিভিশনে। পর্দার সামনে ও পেছনে দুখানেই কাজ করছেন এখন।
সংবাদভিত্তিক চ্যানেল সময় টেলিভিশনে চ্যানেলের আন্তর্জাতিক বিভাগে কর্মরত আছেন। কাজের চাপে সময় খুব কম পান। যতটুকু সুযোগ পান তাও কাটে অলসতা করে। তারপর মাঝেমধ্যে জাতীয় দৈনিক ও অনলাইনে লেখেন— কলাম, ফিচার, কবিতা, ছড়া ও গল্প।
তাঁর জন্ম, ১৪ই আগস্ট, ৩০শে শ্রাবণ, ঢাকায়। তাই বর্ষা তথা শ্রাবণ তাকে আন্দোলিত করে। সৈয়দ ইফতেখার, একাধারে পূর্ণকালীন সাংবাদিক ও লেখক। সংবাদ নিয়ে কাজ কারবার তার পেশা, শিল্প-সাহিত্য তার নেশা। ঢাকায় জন্ম ও বেড়ে ওঠা তার। তবে পৈতৃক ভিটা উত্তরবঙ্গে, বরেন্দ্র অঞ্চলে। বাবা ছিলেন সরকারি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, মা শিক্ষকতা করেছেন। দুই ভাইয়ের মধ্যে সৈয়দ ইফতেখার বড়। গ্রাম বাংলা, প্রেম ও নাগরিক জীবনের সমস্যা, সম্ভাবনা তার লেখার উপজীব্য। সৈয়দ ইফতেখার-এর সাথে সাহিত্যের নানান বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন কবি ও সাংবাদিক শব্দনীল। নিন্মে বিস্তারিত।
কাব্যশীলন:
লেখালেখি শুরুর গল্পটি জানতে চাই…
সৈয়দ ইফতেখার:
পুরো দমে লেখালেখির সূত্রপাত ২০০৬ সাল থেকে। নিয়মিত ছড়া লেখা হতো। এরপর কবিতা, গল্প লেখা। কলম চলতে থাকে দুর্বার গতিতে। বর্তমানে চলছে কিবোর্ড।
কাব্যশীলন:
বর্তমানে ‘ছড়া’ শুনলে অনেক সাহিত্য বোদ্ধা ও পাঠক আড় চোখে দেখে। এই তাকানোকে আপনি কীভাবে দেখেন?
সৈয়দ ইফতেখার:
কারা আড় চোখে দেখে, আর কারা দেখে না তা দিয়ে সাহিত্য চলে না। আমি এও বিশ্বাস করি না যে, বাঁকা চোখে কেউ দেখেও। ছড়া সাহিত্যের সবচেয়ে প্রাচীন অংশ। ছড়া লেখা যত সহজ তত কঠিনও। হুট করে এটা মাথায় আসতে পারে আবার দিনের পর দিন গেলেও মন মতো ছন্দ না মিলতে পারে। সে তুলনায় গল্প বা উপন্যাস লেখে গেলেই হয়, আহামরি কৌশল করা লাগে না, গল্প সাজানো ও ধৈর্যটাই মুখ্য। বাংলা কাব্যের রীতিতে অক্ষরবৃত্ত ছন্দ, মাত্রাবৃত্ত ও স্বরবৃত্ত ছন্দের ব্যবহার রয়েছে। তবে ছড়ার ক্ষেত্রে স্বরবৃত্ত ছন্দই বেশি প্রাধান্য পায়। কারণ স্বরবৃত্ত ধ্বনি মধুর। মাধুর্যই এর প্রাণ। মাধুর্য ধরে রাখার কলায় ছড়াতে খাজনার চেয়ে বাজনা বেশির মতো দশা। তাই একে খুব কোমলভাবে গড়ে তুলতে হয়। প্রতিবাদী ছড়াতেও যে পিনবিদ্ধ হয় সেখানেও থাকে একটা মুচকি কৌশল।
সুতরাং, প্রাণবন্তভাবে ছড়া রচনায় আদতে নিটল স্বরবৃত্ত ছন্দের বিকল্প নেই। স্বরবৃত্ত ছন্দে বিশেষভাবে লঘু ও রসালো মনোভাবই সাবলীলভাবে প্রকাশ করা যায়। এসব নিয়ে যাদের আপত্তি তারাই ছড়াকে সেকেলে বলে হয়ত।
কাব্যশীলন:
ছন্দের তাল থেকে ‘ছড়া’কে কি বের করা সম্ভব বলে মনে করেন আপনি?
সৈয়দ ইফতেখার:
একবার কী হলো, একটা পত্রিকায় লেখা পাঠালাম। প্রথম লাইন ও তৃতীয় লাইন, দ্বিতীয় লাইন ও চতুর্থ লাইন সমান ছন্দের। একটু নিজের মতো করে সাজানো আরকি। তবে তিনি ভুল ধরলেন ‘পদ্ধতিগত’। কারণ ওই যে ছকে বন্দি নিয়মে হয়নি! সে অনেক আগের কথা। না জেনে কিন্তু সেটা আমি করিনি। তবুও তিনি মানতে নারাজ। আর কথা বাড়াইনি। ছন্দের তাল থেকে ‘ছড়া’কে বের করে আনা বা ছন্দ ভাঙার রীতিকে হাদিস সংশোধন করে দেখার মতো ভাবলে নতুন কিছু গড়া কঠিনই বটে। আশা করতে পারি, বর্তমানে যারা স্কুলে পড়ছে তাদের মধ্য থেকে যদি লেখক তৈরি হয় তাহলে তারা তাদের মতো করে কিছু একটা তৈরি করবে। যা হবে আরও আধুনিক। বলে রাখা ভালো, আধুনিকতার সংজ্ঞা কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তন হয়, আমি সে অর্থে বলছি।
কাব্যশীলন:
বিশ্ববিদ্যালয় আপনার লেখালেখিতে কতটুকু প্রভাব রেখেছে বলে মনে করেন।
সৈয়দ ইফতেখার:
জীবনে দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছোঁয়া রয়েছে। ‘মিডিয়া স্টাডিজ অ্যান্ড জার্নালিজমে’ পড়াশোনা সম্পন্ন করেছি ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশ (ইউল্যাব) থেকে। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে টেলিভিশন, ফিল্ম অ্যান্ড ফটোগ্রাফিতে আড়াই বছর পড়েছি। দুটি প্রতিষ্ঠান দুইভাবে গভীরতা দিয়েছে আমাকে। কাল মার্কস ধারা, সিগমুন্ড ফ্রয়েডের ভাবনা, স্যার অ্যালফ্রেড যোসেফ হিচকক, জঁ-লুক গদারদের মতো অসংখ্য বিখ্যাত ব্যক্তি ও তাদের দর্শন, ভাবধারা যেমন পেয়েছি, তা দিয়ে নিজের ভাবনার খোরাককে আরও প্রসারিত করতে পেরেছি। অন্যদিকে রাজনীতিকেও খুব কাছ থেকে দেখেছি। নিতান্তই শখের বসে নির্মাতা হিসেবে তৈরি করেছি প্রামাণ্যচিত্র ও শর্টফিল্ম। করেছি টেলিভিশনে অভিনয়ও। আর সাংবাদিকতায় পড়াশোনা একজন নিরলস সংবাদকর্মী হিসেবে গড়ে তুলেছে। যার কোনো সুনাম থাকবে না, কিন্তু লেখে যেতে হবে। এই চিন্তা চেতনা মন-মননে তৈরি করে দিয়েছে।
কাব্যশীলন:
কলাম, ফিচার, কবিতা, ছড়া ও গল্পের কোনটিতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন?
সৈয়দ ইফতেখার:
মাথায় প্রচুর তথ্য ঘুরে সংবাদ নিয়ে দিনরাত্রি পার করার কারণে। তাই কলাম লেখাটা আমার জন্য বেশি সহজ। সারাদিন কত শত অনিয়ম দেখি, তার সমাধান আমার কাছে আছে মনে করি। আমি হলে সেই সমস্যার সমাধান কীভাবে করতাম তাই লেখার চেষ্টা করি কলামে। আর ব্যক্তি আমি বাদে প্রশাসন কী কী পদক্ষেপ নিলে সংকট দূর হবে সেটিও থাকে লেখায়।আর কবিতার বিষয়টি হলো আমার কাছে ভাবনার মতো। সবসময় ভাবনার পরিধি বিস্তৃত থাকে না। সেটা ঐশ্বরিক, দেবোপম মন না হলে লেখা সম্ভব নয়।
তাছাড়া গল্প, উপন্যাসের কথা যদি বলি, তাহলে বলতে হবে প্রচুর সময় নিয়ে আরও মনোযোগী হয়ে লেখা উচিত আমার। সেই সময় আমি আমার লেখাকে দেই না। চর্চার সময়টা খুবই কম পায় আমার লেখনি শক্তি। এই এই শক্তিতে আমি ধার দেখি না আপাতত। যেদিন সময় দিতে পারবো, আশা করি ভালো কিছু হবে। তার আগ পর্যন্ত আমি এখনও লেখক নই, ক্ষুদ্র বাক্য নির্মাতা।
কাব্যশীলন:
অনলাইনে সাহিত্য চর্চা কতটুকু মঙ্গলদ্বায়ক হচ্ছে বলে মনে করেন?
সৈয়দ ইফতেখার:
‘বর্তমান যুগ নিউ মিডিয়ার। পশ্চিমা দেশগুলোর অনেক ছাপা সংবাদপত্র ইতোমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। টিকে আছে শুধু অনলাইন ভার্সন। এ অবস্থায় ছাপা অক্ষরের সাংবাদিকতার সংকট নয়, মৃত্যু ঘটতে চলেছে, এমনটাই মনে করেন অনেকে। কেউ কেউ আবার বাড়তিভাবে বলছেন, সংবাদমাধ্যম যুগেরই অবসান ঘটছে। মানুষে মানুষে যোগাযোগের জগৎ ও মাধ্যমটা এখন আর সংবাদমাধ্যমের নিয়ন্ত্রণে নেই, অসংবাদমাধ্যমের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। অসংবাদমাধ্যম বলতে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকেই বোঝানো হচ্ছে (গুগল, ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউব, হোয়াটসঅ্যাপ, ইনস্টাগ্রামসহ আরও কিছু মাধ্যম)। এই অসংবাদমাধ্যম আরও শক্তি অর্জন করেছে যখন এ থেকে মানুষ আয়ের উৎস খুঁজে পেয়েছে তখন। অসংবাদমাধ্যমে বিজ্ঞাপন দাতারাও ছুটছেন। এতে ভাগ হয়ে যাচ্ছে বিজ্ঞাপন। কমতি পড়ছে গণমাধ্যমের আয়ে।’
এই প্যারাটি নিয়েছি আমার ‘সাংবাদিকতা ও গুজব’ কলাম থেকে। সেসব অন্য প্রসঙ্গ। সাংবাদিকতা নিয়ে। তবে অনলাইনে সাহিত্য চর্চা কতটুকু মঙ্গলজনক হচ্ছে বলে প্রশ্ন করা হলে আমি বললো, নিউ মিডিয়ার যুগে টিকে থাকতে সাহিত্য চরয়িতাকেও লড়াই করতে হবে তার কাঙ্ক্ষিত মাধ্যম নিয়ে। বিক্রি নেই সেভাবে, নেই জৌলুস, তাই খরচ কমাতে পত্রিকাগুলো আশ্রয় নিয়েছে পাতা কমানোর। সেজন্যে হরহামেশাই সাহিত্য পাতার ওপর আঘাত পড়ছে। উদাহরণ যদি দেই তাহলে বলতে হবে— বিশেষ কোনো দিন বা বিজ্ঞাপন এলে সবার আগে পত্রিকার শিশুতোষ পাতায় আঘাত পড়ে, এরপর আঘাত লাগে বড়দের সাহিত্য পাতায়। আর ওই পাতা বের হলেও সেখানে কটা কবিতা ঠাঁই পায়? তিনটি থেকে চারটি। আর গল্প থাকে একটি থেকে দুটি। তার মানে মাত্র পাঁচ-ছয়জনের অংশগ্রহণ! পাঁচ-সাতটা ভালো পত্রিকায় ঘুরে ফিরে পাঁচ-ছয়জনই লেখেন। তাহলে নতুন লেখক তৈরি হবে কী করে! সবকিছু মিলিয়ে আমি অনলাইনেই সাহিত্য চর্চার ভবিষ্যৎ দেখি আমি। এখন কিন্তু বইও বিক্রি কমেছে। আস্তে আস্তে ছাপা অক্ষরের বই নয়, পিডিএফ বই-ই বিক্রি হবে। তখন আরও চাহিদা বাড়বে অনলাইনের। প্রকাশনা জগতেও বড় পরিবর্তন আসছে (বেশি নয়, আর বছর দশের দেরি)।
কাব্যশীলন:
জাতীয় দৈনিকগুলো কি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সাহিত্য চর্চার নতুন পথ দেখাতে পারছে বলে মনে করেন?
সৈয়দ ইফতেখার:
যেখানে জাতীয় দৈনিক রীতিমতো ধুঁকছে, সেখানে নতুন সূর্যের আলো আসবে না সেটাই স্বাভাবিক। দেশ সেরা পত্রিকা এখন পাঁচ থেকে ছয়টি বড়জোর। সেরা বলতে আমি বোঝাচ্ছি যা পাঠকের হাতে যায়, সার্কুলেশন আছে। বাকিগুলোর সেই দশা নেই। এতে তারা যেখানে নিজেরা সাংবাদিকতা নিয়ে টিকে থাকার লড়াইয়ে মগ্ন, সেখানে তাদের সুযোগ কই সাহিত্যের মান উন্নয়নে কাজ করার! এতে সুযোগ সংকুচিত হয়ে আসছে। আমার আগের উত্তরে এই বিষয়ই আমি বলেছি।
কাব্যশীলন:
আপনি একজন নির্মাতা হিসেবে বর্তমান সময়ের নাটক ও শর্টফিল্মের চিত্রনাট্যগুলোকে কীভাবে দেখছেন?
সৈয়দ ইফতেখার:
আমি নিজে খুব ভালো কিছু নই এটি বলার জন্য। তবে সাধারণ চোখে যদি বলি, চিত্রনাট্যে শুধু আছে কর্মাশিয়ালাইজেশন। নাটক বেচতে পারলেই হলো! এটিকে আর শিল্প হিসেবে বিবেচনার সময় কই নির্মাতা আর চিত্রনাট্যকারদের! এই ধারার জন্যই টেলিভিশন নাটকে বৈচিত্র্য কম। তবে আশার জাগাচ্ছে ওয়েব সিরিজ। নিউ মিডিয়ার মতো বিনোদনের জন্য ওয়েব সিরিজই এখন মুখ্য বলে মনে করি। সার্বিকভাবে সেখানে খুব ভালো কাজ হচ্ছে, যা ইতিবাচক।
কাব্যশীলন:
অনেক বছর ধরে সাংবাদিকতা করছেন, নতুন যারা এই পেশায় আগ্রহী হচ্ছে তাদের যদি কিছু বলার থাকে আপনার?
সৈয়দ ইফতেখার:
প্রথমত সাংবাদিকতায় খুব বেশি অর্থ নেই। উল্টো সময়কাল বিনিয়োগ করতে হবে। যারা সেটি করতে প্রস্তুত তাদের স্বাগত।
কাব্যশীলন: কাব্যশীলন কে আপনার মূল্যবান সময় দেবার জন্য ধন্যবাদ।
সৈয়দ ইফতেখার: কাব্যশীলন কেউ ধন্যবাদ তরুণদের নিয়ে এমন একটি চমৎকার উদ্যোগ নেবার জন্য।