সাক্ষাৎকার

শিশুসাহিত্যে সংবেদনশীল মনের বীজ বপণ করতে হবে : আসাদ জোবায়ের

নাম: আসাদ জোবায়ের
পিতা: রিয়াজুল ইসলাম
মাতা: মুহতাদিয়া বানু
জন্ম: ৫ সেপ্টেম্বর ১৯৮৪, বগুড়ায়।
স্ত্রী মাকসুদা আক্তার নূরী ও একমাত্র সন্তান আরিজ উমায়েরকে নিয়ে ছোট্ট সংসার। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জনের পর জড়িয়ে পড়েন সাংবাদিকতায়। কাজ করছেন একটি জাতীয় দৈনিকে। সম্পাদনা করছেন দৈনিক মানবকণ্ঠের ছোটদের পাতা ‘এলেবেলে’ এবং গণমুখী ছড়ার টিশার্ট অ্যালবাম ‘ইশতেহার’। সাংবাদিকতা ও সম্পাদনার পাশাপাশি ছোট ও বড়দের জন্য ছড়া, কিশোর কবিতা এবং ছোটদের জন্য গল্প লিখছেন নিয়মিত।
ইতিপূর্বে প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ৩। ছড়া ও কিশোর কবিতার বই ‘বোতাম খোলা দুপুর’, কিশোর কবিতার বই ‘ইচ্ছেনদীর ভেলা’ এবং গল্পের বই ‘মেঘপরীদের রাজ্যে’। জনপ্রিয় শিশুসাহিত্যিকের মুখোমুখি হচ্ছেন শিশুসাহিত্যিক মোস্তাফিজুল হক।

মোস্তাফিজুল হক: কাব্যশীলন ওয়েব ম্যাগের পক্ষ থেকে আপনাকে স্বাগত জানাচ্ছি।

আসাদ জোবায়ের: ধন্যবাদ আপনাকে।

মোস্তাফিজুল হক: লেখালেখিতে কখন কীভাবে সম্পৃক্ত হলেন?

আসাদ জোবায়ের: দিনক্ষণ তো বলা সম্ভব নয়। তবে ছোটবেলা থেকেই লেখক সত্ত্বা লালন করতাম। স্কুল জীবন থেকেই পাঠ্যবইয়ের বাইরে অনেক বই পড়েছি। তখন গ্রামে শিশুসাহিত্য তেমন পাইনি আমরা। তবে ছোট বয়সেই রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, বঙ্কিম, নজরুল ইসলাম, বিভুতিভূষণদের গল্প-উপন্যাস পড়ে ফেলেছি। ক্লাস সিক্স-সেভেনেই রবীন্দ্রনাথের গল্পগুচ্ছ পড়া শেষ করেছিলাম। তখন একেকটা বই পড়েই ভাবতাম আমি কেন এরকম বই লিখতে পারবো না? আমার মনে আছে, সেভেন কি এইটে থাকতেই লুকিয়ে লুকিয়ে একটা উপন্যাস লেখা শুরু করেছিলাম। কতবড় দুঃসাহস ছিল আমার। অথচ এখন উপন্যাস লেখার সাহস করতে পারি না। তবে ছড়া দিয়েই আমার লেখালেখি শুরু বলা যায়। ২০০০ সাল থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত ছড়াচর্চা করেছি। এরপর অনেকটা নিভৃতে থেকেছি। ২০১৬ সালে আবার নতুন উদ্যোমে লেখালেখি শুরু।

মোস্তাফিজুল হক: পত্রিকায় আপনার প্রথম লেখা প্রকাশের অনুভূতি কেমন ছিল?

আসাদ জোবায়ের: ১৯৯৬ সালে আমি যখন ৭ম শ্রেণিতে পড়ি। তখন বগুড়ার স্থানীয় একটি দৈনিকে আমার ছড়া প্রকাশ হয়। অনুভূতি কেমন ছিল সেটা অবশ্য বলার অপেক্ষা রাখে না। পত্রিকা হাতে করে নিয়ে দৌড়ে দৌড়ে বিভিন্নজনকে শুনিয়েছি। অবশ্য ছড়াটা আমার সংরক্ষণে নেই। স্মরণেও নেই।

মোস্তাফিজুল হক: আপনার প্রকাশিত বইগুলো সম্পর্কে পাঠকদের উদ্দেশ্যে কিছু বলতেন যদি…

আসাদ জোবায়ের: আমার প্রথম বই প্রকাশ হয় ২০১৭ সালের বইমেলায়। নাম- ‘বোতাম খোলা দুপুর’। ওটা ছিল ছড়ার বই। তবে বেশ কয়েকটা কিশোর কবিতাও ছিল সেখানে। এরপর ২০১৮ সালের বইমেলায় এসেছে ‘ইচ্ছেনদীর ভেলা’। এই বইয়ে শতভাগ কিশোর কবিতা রাখার চেষ্টা করেছি। এরপর গল্প লেখায় পেয়ে বসে আমাকে। পরের বছর অর্থাৎ ২০১৯ সালের বইমেলায় তাই এসেছে কিশোর গল্পসংকলন- ‘মেঘপরীদের রাজ্যে’। ১০টি গল্প নিয়ে সাজানো এই বই। এই ধারাবাহিকতায় আগামী বই মেলায় ৫টি গল্পের বই আসবে বলে আশা করছি।

মোস্তাফিজুল হক: সাংবাদিকতায় কীভাবে এলেন?

আসাদ জোবায়ের: লেখক হওয়ার মতো সাংবাদিক হওয়ার বাসনাও ছিল ছোটবেলা থেকেই। তবে সাংবাদিকতা শুরু করেছি পড়ালেখা শেষ করে। ঢাকায় এসে চাকরি খোঁজার পাশাপাশি থিয়েটার করতাম। থিয়েটারের এক বড় আপু একদিন বললেন, সাংবাদিকতা করতে চাও। আমি বললাম হ্যাঁ। তিনি ঐ নাট্যদলের সভাপতির কাছে আমাকে পাঠিয়ে দিলেন। যিনি ছিলেন সাপ্তাহিক ২০০০-এর তৎকালীন সহযোগী সম্পাদক আহমেদ মূসা ভাই। সেটা ছিল ২০১০ সালের ঘটনা। মূসা ভাই আমাকে দিয়ে শুরুতে অনুবাদ করিয়ে নিতেন। এরপর মাঠের রিপোটিংয়ের জন্য বললেন। সেই রিপোর্ট করতে আমাকে খুঁজে খুঁজে কুমিল্লার বরুড়া উপজেলার একটি গ্রামে পর্যন্ত যেতে হয়েছিল। সেই রিপোর্ট প্রকাশের পরপরই আমাকে নিয়োগ দেয়া হয় সেখানে। তারপর থেকেই চলছে।

মোস্তাফিজুল হক: পত্রিকার ছোটদের পাতা সাজানোর ক্ষেত্রে আপনি কোন কোন বিষয়গুলো গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন?

আসাদ জোবায়ের: ছোটদের পাতা সম্পাদনায় সবার আগে গুরুত্ব দিতে হবে ছোটদের চাহিদাকে। শত শত লেখক আপনার দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করবে। তাদের একটি লেখা এখানে ছাপা হলেই তারা খুশি। আপনাকে ধন্যবাদে ভাসিয়ে দেবে। কিন্তু আপনাকে চিন্তা করতে হবে সেই লেখা কতটা ছোটদের উপযোগী। লেখার পাশাপাশি ছবিকেও গুরুত্ব দিতে হবে। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো, পত্রিকার মালিকরা একজন চিত্রশিল্পী স্টাফ হিসেবে রাখাকে অপব্যয় মনে করেন। ফলে নেট থেকে ছবি নিয়ে পাতা করতে হচ্ছে বিভাগীয় সম্পাদক কিংবা দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে। যা অধিকাংশই শিল্পসম্মত হচ্ছে না।

মোস্তাফিজুল হক: নবীন-প্রবীণের জন্য পৃথক জায়গা বরাদ্দ রাখা কতটুকু যুক্তিযুক্ত?

আসাদ জোবায়ের: এটা আমি যৌক্তিক মনে করি না। নবীন-প্রবীণের মধ্যে পার্থক্য করবেন কিসের ভিত্তিতে? বয়সের ভিত্তিতে? তাহলে কত বয়স হলে তাকে প্রবীণ বলবেন? এসব প্রশ্নের যেহেতু সুনির্দিষ্ট জবাব নেই। সেহেতু পৃথক জায়গা বরাদ্দ রাখারও প্রয়োজন নেই। পাশাপাশি লেখা থাকলেই বরং সেতুবন্ধন তৈরি হয়।

মোস্তাফিজুল হক: পাঠক হিসেবে আপনার ভাললাগা লেখক ও লেখা সম্পর্কে জানাতেন যদি…

আসাদ জোবায়ের : নবীনদের কথা যদি বলতে হয়, তাহলে বলবো অনেকেই ভালো লিখছেন। আবার বহুসংখ্যক লেখক আছেন যাদের লেখা হচ্ছে না। তাদের কারো নাম উল্লেখ করা ঠিক হবে না। আর সিনিয়রদের মধ্যে সেলিনা হোসেন-এর কিশোর সাহিত্য আমাকে প্রচণ্ড টানে। তাঁর একটি কিশোর উপন্যাস আছে, ‘অন্যরকম যাওয়া’। প্রকৃতিকে কত আপন করে ভাবা যায়, তা এই উপন্যাস পড়ে আমি বুঝেছি।

মোস্তাফিজুল হক: ‘ছড়া, কিশোর কবিতা, ছোটগল্প’ -এই তিনটার মধ্যে কোনটা বেশি আনন্দদায়ক?

আসাদ জোবায়ের : ছড়া আমার লেখালেখির ভিত্তি। পরে কিশোর কবিতা ও গল্পে হাত দিয়েছি। সবগুলোই আনন্দের। ছড়াতে শব্দ নিয়ে খেলা করার অন্যরকম আনন্দ আছে। আবার কিশোর কবিতার কল্পনার জগতে ভেসে বেড়াতে কার না ভালো লাগে? আবার দেখুন, শিশুদের জন্য গল্প লিখতে গিয়ে পাখির সাথে গল্প করা যায়, মেঘের সাথে গল্প করা যায়, গাছের সাথে গল্প বলা যায়, বৃষ্টিকে বন্ধু বানানো যায়- এইসব কি কম আনন্দের? তবে সব লেখা একই সাথে লিখতে পারি না আমি।

মোস্তাফিজুল হক: কবিতায় ছন্দ, শ্রুতিকল্প ও চিত্রকল্প -কোনটা জরুরি?

আসাদ জোবায়ের : সবকিছু মিলেই তো কবিতা। জগতের সুন্দরতম কথা হচ্ছে কবিতা। এখানে ছন্দ, শ্রুতিকল্প ও চিত্রকল্প -কোনোটাকেই খাটো করে দেখার সুযোগ নেই।

মোস্তাফিজুল হক: বর্তমান সময়ের শিশুদের জন্য কেমন গল্প লেখা উচিৎ?

আসাদ জোবায়ের : বর্তমান সময়ে সবচেয়ে বড় সঙ্কট হচ্ছে মানবিকতার সঙ্কট। একটা সময় আরেকজনের গায়ে একটা ইনজেকশন পুশ করা দেখলেও আমরা কুকড়ে যেতাম। এখন সেই আমরাই আরেকজনের পেটে ছুরি চালাতে একটু দ্বিধা করছি না। এই যে অনুভূতির সঙ্কট তৈরি হয়েছে। এখান থেকে ফিরে আসতে হবে। এজন্য শিশুদের জন্য এমন গল্পই লিখতে হবে যাতে প্রাণ ও প্রকৃতির প্রতি মায়া তৈরি হয়। একটা একটা ফুলের প্রতি, প্রজাপতির প্রতি মায়া, ভালোবাসার জন্ম দিতে হবে। শিশুদের নরম মন যাতে একটা তৃণলতার প্রতিও অনুভূতিশীল হয়। সেই চেষ্টা থাকতে হবে একজন গল্প লেখকের।

মোস্তাফিজুল হক: লেখালেখি নিয়ে আপনার প্রাপ্তি ও প্রত্যাশা সম্পর্কে জানতে চাই।

আসাদ জোবায়ের: আমার প্রাপ্তি ও প্রত্যাশা দুটোই পাঠককে ঘিরে। ধরুন ১০জন মানুষ আমাকে শুধুমাত্র লেখার কারণে চেনেন, আমার লেখা পড়েন, আমাকে ভালোবাসেন। এটাই আমার প্রাপ্তি। আর প্রত্যাশা হলো আরো ১০জন মানুষ, যারা আমাকে খুব কাছে থেকে চেনেন, কিন্তু আমার লেখা পড়ে দেখেননি। তারাও যাতে আমার পাঠক হয়ে ওঠেন। সেটাই আমার বড় প্রত্যাশা।

মোস্তাফিজুল হক: সাহিত্যচর্চা বা লেখক তৈরি করতে ওয়েব ম্যাগ, ফেইসবুক ও পত্রিকার ভূমিকা কতটুকু?

আসাদ জোবায়ের: লেখালেখি তো পত্রিকা, লিটলম্যাগ- এগুলো ঘিরেই হয়ে আসছে। লেখকও তৈরি হচ্ছে এগুলোকে প্লাট ফরম ধরেই। তবে নতুন দুনিয়ায় ফেইসবুক ও ওয়েবম্যাগ এসেছে। এগুলোও ভূমিকা রাখছে সমান তালে। বরং কিছুটা বেশিই। লেখা প্রকাশে ফেইসবুক দিয়েছে অবারিত সুযোগ। মধ্যরাতে লেখা কোনো ছড়া সকালে ঘুম থেকে উঠেই পাঠক পেয়ে যাচ্ছেন। এর মধ্যে সবাই ভালো লিখছেন না। সেই দায় তো পত্রিকার সম্পাদকের মতো ফেইসবুক কতৃপক্ষ নেবে না। সেটা পাঠককেই বুঝে নিতে হবে। আর ওয়েবম্যাগ হচ্ছে প্রচলিত কাগজের ম্যাগাজিন ও ফেসইবুকের মাঝামাঝি। এখানে সম্পাদক কতৃক সম্পাদিত লেখা আপলোড হচ্ছে। আবার প্রচুর লেখা আপলোডের সুযোগ থাকছে ফেইসবুকের মতো। লেখক তৈরিতে অনেক অবদান রাখছে এ সবই।

মোস্তাফিজুল হক: পত্রিকা, ওয়েব ম্যাগ ও ফেইসবুক লেখালেখির জন্য কতটা নিরাপদ মাধ্যম?

আসাদ জোবায়ের: কাগজের পত্রিকা একটা ডকুমেন্ট। এটি শতভাগ নিরাপদ। একবার ছাপা হলে তা চুরি হবার ভয় নেই। যে ভয় ফেইসবুক ও ওয়েবম্যাগে আছে। ওয়েবম্যাগে আপলোডের তারিখ যেহেতু কাস্টমাইজ করা যায়, সেহেতু এই সুযোগ নিয়ে লেখা চুরি হওয়া অস্বাভাবিক নয়।

মোস্তাফিজুল হক: সকল ব্যস্ততা উপেক্ষা করে সময় দেবার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন।

আসাদ জোবায়ের: আমার মতো একজন ক্ষুদ্র মানুষের সাক্ষাৎকার নেয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। সেইসঙ্গে কাব্যশীলন পরিবারকেও অনেক অনেক শুভকামনা জানাই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *