মেয়েটি মা হতে চেয়েছিল- সালাহ উদ্দিন মাহমুদ

১.
দীর্ঘ বিচ্ছেদের পর রাশেদ মমতার সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করে। তিন মাসের ছুটিতে এসে মমতাকে খুব মনে পড়ে। মমতার বিয়ের কথা জানতে পেরে কষ্ট পায়। শ্বশুর বাড়ি বেশি দূরে বলে রাশেদও দেখা করার সুযোগে থাকে। এলাকার বেশিরভাগ মানুষই মমতার বিয়ের পর রাশেদের সঙ্গে সম্পর্কের কথা ভুলে যায়। মমতা বাড়ি গেলে সামনের রাস্তায় একদিন মুখোমুখি হয় রাশেদ। মমতা নিজেকে লুকায় না। বরং দুঃখ প্রকাশ করার জন্য দাঁড়িয়ে থাকে। ভরদুপুরে গ্রামের সবাই কাজে ব্যস্ত থাকায় ঘন জঙ্গলের আশ্রয় নেয় তারা।

দিন-দুপুরে জঙ্গলের এদিকে মানুষের পা পড়ে না। জন-মানবহীন গভীর বনে আবেগ সামলাতে পারে না তারা। আবেগাপ্লুত শরীর জাপটে ধরে একে অপরকে। বিরহের দূরত্ব যেন মুহূর্তেই কমে আসে। শত অভিযোগ-অভিমান মুহূর্তেই কেটে যায়। চঞ্চল হয়ে ওঠে দেহ ও মন। অনেক দিনের আকাঙ্ক্ষা আজ মাথা চাড়া দেয়। ভুলিয়ে দেয় লাজ-লজ্জা। নৈতিকতা নামক বস্তুটি মুহূর্তেই পরাজিত হয় দু’জনের উদ্দামতার কাছে।

২.
সব হারিয়ে মমতা যেন আজ নিঃস্ব। কোন চিঠি আসে না। আসে না কোন ক্যাসেট। এমনকি কোন দিন মমতার ফোনও আসেনি। মমতা কার জন্য অপেক্ষা করছে? জালাল নাকি রাশেদের জন্য। মাঝে মাজে নিজেও বুঝতে পারে না। লোক মারফত খবর পেয়েছে, রাশেদ মালয়েশিয়া থেকে ইতালি চলে গেছে। ফলে যথাসময়ে দেশে ফেরার সম্ভাবনা নেই।

জালালের খবর লোকমুখে যা শুনেছে, তা দুঃখজনক। অবৈধভাবে বিদেশ গিয়ে দীর্ঘদিন পালিয়ে থেকেছে। সব হারিয়ে সে-ও এখন নিঃস্ব। সে দেশের সরকার আটক করে জেলে পুড়ে রেখেছে। প্রবাসী বাঙালিরা চেষ্টা-তদবির করে টাকা-পয়সা তুলে দেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করছে। সে না হয় এলো। কিন্তু তাতে মমতার কী লাভ? জালাল কি মেনে নেবে মমতাকে। মমতাকে মেনে নিলেও মমতার সন্তান কি সে মেনে নেবে? রাশেদ কবে দেশে আসবে তারও কোন গ্যারান্টি নেই।

৩.
রাশেদ প্রায় সাত বছর পর দেশে ফিরেছে। মালয়েশিয়া থেকে ইতালি গিয়ে গ্রিন কার্ডের জন্য আবেদন করে দেশে এসেছে। এ কয় বছরে প্রচুর টাকার মালিক হয়ে গেছে। এবারের ছুটি ছয় মাসের। তাই বিয়ে-শাদি করে তবেই ফিরে যাবে। গিয়ে স্ত্রীকে নেওয়ার জন্য আবেদন করবে।

কাচিকাটা লঞ্চঘাটে নেমেই খবরটা পায় রাশেদ। সন্তান ভুমিষ্ট হওয়ার পর এলাকা ছেড়ে চলে গেছে মমতা। মমতার রেখে যাওয়া সন্তান লালিত-পালিত হচ্ছে বড় ভাই মেরাজের ঘরে। এক সপ্তাহের নবজাতক রেখে যে রাতে মমতা নিরুদ্দেশ হয়, সে রাতে নবজাতকের কান্নায় ঘুম ভাঙে সেনােরা বেগমের। উঠে মমতাকে ডাকে। ‌‘কী রে ছেমরি, পোলাডারে দুধ দে। কেমন কানতাছে, হোনছ না? আখেরের ঘুম ঘুমাইছোস?’

সেনোরা থামে। মমতার সাড়া নেই। সেনোরা ছুটে যায়। গিয়ে দেখে মমতা নেই। ছেলেটা হাত-পা নেড়ে নেড়ে কান্না-কাটি করছে। প্রস্রাবে ভিজে গেছে পিঠ। বাচ্চাটা তুলে নিয়ে বড় বউকে ডাকে।
শেফালি হোনছোসনি। একটু এইদিকে আয় তো।

এক ডাকেই সাড়া দেয় মেরাজের বউ শেফালি। মাত্রই কোলের মেয়েকে ভেজা কাথা থেকে সরিয়ে শুকনা জায়গায় শুইয়েছে। শুকনা জায়গা পেয়ে মেয়েটি কেবলই ঘুমিয়েছে। জোর গলায় বলে, ‘আইতাছি আম্মা।’ মেরাজকে ধাক্কা দিয়ে বলে, ‘এই হোনছেন। আম্মায় এত রাইতে বোলায় কেন? মমতার পোলাডাও কানতাছে।’

মাঝরাতে সেনোরা, শেফালির কথা-বার্তা আর বাচ্চাটার কান্নায় সেরাজ ও সেরাজের বউ লাইলিরও ঘুম ভাঙে। সেনোরার ঘরে এসে তারা জানতে পারে, মমতা ঘরে নেই। সেনোরা ছুটে যায় টয়লেটের দিকে। সেখানেও নেই। টয়লেটের দরজা খোলা। মেরাজ আর সেরাজ হারিকেন নিয়ে ছুটে যায় জঙ্গলে। গাছের ডালে ডালে চোখ বুলায়। ডালগুলোও ফাকা। চিন্তার রেখা সবার চোখে-মুখে। কোথায় যেতে পারে? কারোরই ধারণায় আসে না। বাচ্চাটা কেঁদেই যাচ্ছে। সেনোরা ফিরে এসে বড় বউ শেফালিকে বলে-
শেফালি, তুমি তো দুধেল। তোমার ওলান ভরা দুধ। তোমার কোলের মাইয়ার লগে মমতার পোলাডারে একটু খাওয়াইতে পারবা?

শেফালির চোখে জল আসে। সে মাথা নাড়ে। বাচ্চাটা কোলে নিয়ে আঁচল দিয়ে ঢেকে দেয়। বাহির থেকে চুকচুক শব্দ শোনা যায়। বাচ্চার কান্নার আওয়াজ বন্ধ। মেরাজ, সেরাজ, লাইলি আর সেনোরা চৌকির কিনারের ওপর বসে। সবার কপালেই চিন্তার ভাঁজ। মুখ খোলে সেনোরা-
মমতা রে, তুই আমারে মুক্তি দিয়া গেলি। তয় জঞ্জালডা কেন ফালায়া গেলি?
মা, এত রাইতে চিল্লা-ফাল্লা কইরো না। শেফালি তো আছে। আল্লাহর মাল আমরা কি ফালায়া দিমু?
ফালায়া দিবি না মানলাম। মমতাও আর ফিরবো না জানি। রাশেদও তারে মাইনা নিবো না। এহোন এই পোলার বাপের পরিচয় কী দিবি তোরা? আছে কোন উপায়?
চিন্তা কইরো না মা। গরিবের ভরসা আল্লাহ। একটু বড় হইলে কোন এতিমখানায় দিয়া আসমু নে।
মেরাজের কথায় ভরসা পায় সেনোরা বেগম। তখন থেকেই বাচ্চাটা মেরাজের কাছেই লালিত-পালিত হচ্ছে। এখন তো হাঁটতে পারে নিশ্চিত। অনেক বড় হয়ে গেছে। স্কুলে যাওয়ার বয়স হয়ে গেছে।

৪.
রাশেদের মনটা বিষাদে ছেয়ে যায়। মমতার জন্য অনুশোচনা হয়। কিন্তু সাত বছর পর সেই ঘটনার প্রায়শ্চিত্ত করার সুযোগ কই? কোথায় পাবে সে মমতাকে? কোথায় পাবে ছেলেটাকে? নিজের সন্তান বলেও তো দাবি করতে পারবে না। পরিবার থেকে বিয়ের কথা-বার্তা চলছে। তারা জানতে পারলে বিয়ে ভেঙে যাবে। উভয় সঙ্কটে পড়ে কোন সিদ্ধান্তে আসতে পারে না। মনের ভেতর একটা অপরাধবোধ তাড়া করে রাশেদকে।

মমতার কোন দোষ ছিল না। রাশেদও চায়নি অনাকাঙ্ক্ষিত এমন ঘটনা ঘটুক। সাত বছর আগে মমতা-রাশেদের প্রেম জাগ্রত হয়েছিল। বিবাহিত মমতার স্বামীর অবর্তমানে পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছে রাশেদ। সেই সুযোগে শরীরের চাহিদাকেও তারা অস্বীকার করতে পারেনি। হয়তো তখনই মমতার মা হওয়ার বাসনা জেগেছিল।

সাত বছর বিচ্ছিন্ন থেকে হাপিয়ে উঠেছে মমতা। গর্ভধারণের পর জালালের সঙ্গে বিবাহ-বিচ্ছেদ, অপরদিকে রাশেদের সঙ্গে যোগাযোগ না থাকায় হতাশায় নিরুদ্দেশ হয়েছে মমতা। ভাবতে ভাবতে ভারাক্রান্ত মন নিয়ে বাড়ির পথে পা বাড়ায় রাশেদ। লঞ্চে মমতার ঘটনা শোনার পর থেকে একটু ঘুমাতে পারেনি সে। হাঁটতে গিয়ে যেন পা দুটো টলছে। টলছে পুরো পৃথিবী। যেভাবে টালমাটাল হয়েছে মমতার জীবন।

রাশেদ ভাবে, প্রবাস জীবন তাকে অনেক দিয়েছে। কেড়েও নিয়েছে বিস্তর। হারিয়েছে ভালোবাসা, পিতৃত্বের অধিকার, সামাজিক মর্যাদা। সব হারানো এই জীবন কি তবে অজানা গন্তব্যের দিকেই এগিয়ে যাবে?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *