আমি এখনও শিশুসাহিত্যের শিক্ষানবিশ শব্দ-শ্রমিক- জাহাঙ্গীর আলম জাহান

ছড়া-কবিতা, শিশুসাহিত্য মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক গবেষণাধর্মী লেখায় বর্তমান সময়ে সাহিত্য জগতে আলোচিত ও সবার অত্যন্ত প্রিয়মুখ জনাব জাহাঙ্গীর আলম জাহান। তাঁর শিশুসাহিত্য, মুক্তিযুদ্ধ ও লোকসাহিত্যের গবেষণাধর্মী লেখাগুলো জ্ঞানতৃষ্ণা মিটিয়ে আনন্দদানের পাশাপাশি দেশপ্রেমে বিবেক জাগ্রত করতেও যথেষ্ট তাৎপর্য বহন করে।

জনাব জাহাঙ্গীর আলম জাহানের পিতা একাত্তরের শহিদ মুক্তিয়োদ্ধা মো. জমশেদ আলী, মাতা- মরহুমা লুৎফুন্নেছা বেগম।
পিতার চাকরিসূত্রে ১৯৬০ সালের ১২ এপ্রিল কুমিল্লায় জন্ম নেন জাহাঙ্গীর আলম জাহান। পৈতৃক নিবাস কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলাধীন লতিবাবাদ ইউনিয়নের কাটাবাড়িয়া গ্রামে। তবে দীর্ঘ চারদশক ধরে তিনি কিশোরগঞ্জ শহরেই বসবাস করছেন। সত্তর দশকের প্রথমার্ধ থেকে ছড়া রচনার মধ্য দিয়ে তাঁর সাহিত্যে হাতেখড়ি। ছড়ার বাইরে তিনি সাহিত্যের অন্যান্য বিষয়েও লেখালেখি করেন। মননশীল প্রবন্ধ ও গবেষণাধর্মী লেখালেখিতেও তিনি সিদ্ধহস্ত। ভাষা বিষয়ক প্রবন্ধের বই ছাড়াও স্থানীয় লোকসংস্কৃতি বিষয়ক তাঁর গবেষণাধর্মী ৫টি বই প্রকাশ পেয়েছে। যথা- ‘লোকায়ত কিশোরগঞ্জ’ ‘লোকছড়ার রূপ-বৈচিত্র্য’ ‘সংস্কার লোকাচার লোকবিশ্বাস’ ‘লোকভাষার সুলুকসন্ধান’ এবং ‘কিশোরগঞ্জের লোকবিশ্বাস’। এছাড়া একাত্তরে কিশোরগঞ্জ জেলার শহিদদের বিবরণনির্ভর তাঁর ৫০০ পৃষ্ঠার বই ‘রক্তে ভেজা কিশোরগঞ্জ’, ‘কিশোরগঞ্জ জেলার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস’ এবং স্মৃতিচারণমূলক বই ‘স্মৃতিময় একাত্তর: লড়াকু শৈশব’ উল্লেখযোগ্য বই। তাঁর প্রকাশিত ছড়া ও কিশোর কবিতার বইয়ের সংখ্যা ১৮টি। এ বছর প্রকাশ পেয়েছে তাঁর ছড়ার বই ‘ইলিক ঝিলিক’ ‘দুলকি চালে ফুলকি ছড়া’ এবং ‘মন হয়ে যায় পাখি’। দীর্ঘ ৩৪ বছর সরকারি চাকরি শেষে সম্প্রতি কিশোরগঞ্জ জেলা প্রশাসন থেকে তিনি এডমিনিস্ট্রেটিভ অফিসার হিসেবে অবসরে আসেন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা-ঋদ্ধ শিশুসাহিত্যিক জাহাঙ্গীর আলম জাহান বর্তমানে একজন পূর্ণকালীন লেখক। তিনি কিশোরগঞ্জ ছড়া উৎসব ও কিশোরগঞ্জ ছড়া সম্মেলনের মূল রূপকার।

মোস্তাফিজুল হক: কাব্যশীলন ওয়েব ম্যাগের পক্ষ থেকে প্রথমেই আন্তরিক অভিনন্দন ও স্বাগত জানাচ্ছি।

জাহাঙ্গীর আলম জাহান: অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। কাব্যশীলনের প্রতিও আমার কৃতজ্ঞতা।

মোস্তাফিজুল হক: আপনার প্রথম লেখালেখি সম্পর্কে জানতে চাচ্ছি।

জাহাঙ্গীর আলম জাহান: লেখালেখির শুরুটা একেবারেই হুট করে। আমার বাবা একাত্তরের একজন শহিদ মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধের সময় বাবার চাকরিসূত্রে আমরা পাবনার ঈশ্বরদীতে ছিলাম। সেখানেই বাবা শহিদ হন। তাঁর লাশটিও আমরা পাইনি। স্বাধীনতার পর বাবার জন্য প্রায়ই আমাদের ঘরে কান্নাকাটির রোল পড়ে যেত। আমি ছোটবেলা থেকেই একটু ডানপিটে স্বভাবের ছিলাম। তখন আমি সবেমাত্র সাইকেল চালানো শিখেছি। বাড়িতে যখন সবাই আব্বার জন্য কান্নাকাটি করে আমি তখন বাড়ির পাশে সাইকেল চালানো নিয়ে ব্যস্ত থাকি। আমার এসব কাণ্ডকারখানা দেখে মুরুব্বিরা বলতো আমি নাকি পাষাণ। কিন্তু আমি তো জানি, বাবার জন্য চোখে জল না ঝরলেও আমার ভেতরটা খাক হয়ে যায়। তাই পাড়া-প্রতিবেশীদের বোঝানোর জন্য এক রাতে আমি অন্তরের হাহাকারগুলো কবিতার ছন্দে প্রকাশ করি- “জল ঝরিয়ে কাঁদলেই কি কান্না শুধু হয়/ হৃদয় কাঁদে গুমরে গুমরে সেটা কি কান্না নয়?” এভাবেই শুরু। দু’ লাইনের এই পংক্তিই ছিল আমার জীবনের প্রথম কবিতা।

মোস্তাফিজুল হক: প্রথম লেখার প্রেরণাটা কীভাবে পেলেন?

জাহাঙ্গীর আলম জাহান: মুক্তিযুদ্ধে বাবার আত্মদানই সম্ভবত আমার লেখালেখির মূল প্রেরণা।

মোস্তাফিজুল হক: আজকে আপনার এই যে খ্যাতি- ছোটবেলায় কি এ নিয়ে কখনো ভেবেছিলেন?

জাহাঙ্গীর আলম জাহান: আমার কি আসলেই কোনো খ্যাতি আছে? কিছু মানুষ আমার ছড়া পছন্দ করে। এটাকে খ্যাতি না বলে ভালো লাগার আতিশয্য বলা যায়। খ্যাতি অর্জনের মতো ভালো কোনো কাজ এখনও আমি করতে পারিনি।

মোস্তাফিজুল হক: স্কুল বা কলেজ জীবনে কার লেখা আপনাকে মুগ্ধ করতো?

জাহাঙ্গীর আলম জাহান: স্কুল জীবনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, সুকুমার রায়, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, যতীন্দ্রমোহন বাগচী, জসীম উদদীন প্রমুখই ছিলেন আমার পছন্দের তালিকায়। যখন অতিমাত্রায় ছড়ার দিকে ঝুঁকে পড়ি, সেই কলেজ জীবনে আবুল খায়ের মুসলেহউদ্দিন, আহসান হাবিব, আবু সালেহ প্রমুখের ছড়া/কবিতা আমাকে খুবই টানতো।

মোস্তাফিজুল হক: কবিতা, ছড়া বা গবেষণামূলক লেখার মধ্যে কোনটা বেশি আনন্দদায়ক?

জাহাঙ্গীর আলম জাহান: ছড়াতেই আমি বেশি স্বাচ্ছন্দ্য এবং আনন্দ অনুভব করি। তবে মুক্তিযুদ্ধ ও লোকসংস্কৃতির ওপর কিছু গবেষণাধর্মী কাজ আমি করেছি। সেগুলো খুবই শ্রমসাধ্য কাজ। কাজ করার সময় কষ্টের সীমা ছিল না। কিন্তু বই আকারে প্রকাশের পর অসাধারণ আনন্দে উদ্বেলিত হয়েছি। সৃজনশীল ও মননশীল সকল কাজেই এক ধরনের প্রচ্ছন্ন আনন্দ আছে।

মোস্তাফিজুল হক: গুরুত্বপূর্ণ সরকারি দপ্তরে চাকরি করে সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় লেখালেখির সময় কীভাবে পান?

জাহাঙ্গীর আলম জাহান: কথায় বলে না ‘যে রাঁধে সে চুলও বাঁধে’। আন্তরিকতা, সদিচ্ছা আর কমিটমেন্ট থাকলে চাকরি কোনো সমস্যাই নয়। রাতের একটা দীর্ঘ সময়ই আমার লেখালেখির সর্বোত্তম সুযোগ। আমি সে সুযোগটিই কাজে লাগিয়েছি।

মোস্তাফিজুল হক: কবিতা ও ছড়ার শিল্পরস সম্পর্কে কিছু বলুন।

জাহাঙ্গীর আলম জাহান: কবিতা ও ছড়ার শিল্পরস দুটি ভিন্ন প্রেক্ষিত। ছড়ার শিল্পরস পাঠক ছড়া পড়তে পড়তেই উপলব্ধি করেন। কারণ ছড়ার একটি তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া আছে। কবিতার শিল্পরস কবিতাকে নিংড়ে তারপর বের করতে হয়। যে কারণে কবিতার শিল্পরস পেতে পাঠকের গভীর অভিনিবেশ প্রয়োজন পড়ে।

মোস্তাফিজুল হক: ছড়ায় ‘দাঁড়িয়ে, হারিয়ে, মোবাইল’ এসব শব্দ স্বরবৃত্তে দুই না তিনমাত্রা গণনার যে মতবিরোধ এ নিয়ে আপনার অভিমত জানতে চাই।

জাহাঙ্গীর আলম জাহান: এই শব্দগুলো ছড়ায় কিভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে সেটার ওপর এর মাত্রা গণনা নির্ভর করে। দুই মাত্রা নাকি তিন মাত্রা এ বিতর্কের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে শব্দগুলো ছড়ার গতিকে কোনোভাবে থমকে দিচ্ছে কিনা। যদি না দেয় তাহলে মাত্রা দুই হলো নাকি তিন হলো সেটি কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়।

মোস্তাফিজুল হক: আপনাকে সময়ের সেরা দশজন শিশুসাহিত্যিকের একজন ভাবা হয়। এ বিষয়ে আপনার অনুভূতি জানতে চাই।

জাহাঙ্গীর আলম জাহান: সময়ের সেরা দশজন শিশুসাহিত্যিকের মধ্যে আমাকে একজন ভাবা হয় এ কথা আজ প্রথম শুনলাম। প্রশংসাসূচক বাক্য সবারই ভালো লাগে, আমারও লাগছে। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, আমি এখনও শিশুসাহিত্যের একজন শিক্ষানবিশ শব্দ-শ্রমিক। দশজনের একজন হবার মতো যোগ্যতা এখনও আমার জন্য সুদূরপরাহত। যারা এমনটি ভাবেন তারা হয়তো আমার ছড়া বেশি পছন্দ করেন। তাদের প্রতি আমার নতজানু শ্রদ্ধা।

মোস্তাফিজুল হক: একজন লেখককে শিশুসাহিত্যিক হতে হলে কোন বিষয়গুলো সবসময় মাথায় রাখতে হবে?

জাহাঙ্গীর আলম জাহান: শিশুসাহিত্যক হতে হলে শিশুর মনস্তত্ত্ব বোঝার যোগ্যতা অর্জন করতে হবে। শিশু-উপযোগী রচনায় কোমল ও নিটোল শব্দের ব্যবহার করা জানতে হবে। কঠিন, দুর্বোধ্য বা যুক্তাক্ষর যথাসম্ভব পরিহার করার চেষ্টাও জরুরি।

মোস্তাফিজুল হক: যদি কিছু মনে না করেন, লেখালেখির ক্ষেত্রে আপনার প্রাপ্ত ও প্রত্যাশিত স্বীকৃতি সম্পর্কে জানতে চাই।

জাহাঙ্গীর আলম জাহান: লেখালেখি করে কিছু পাবো সে আশা নিয়ে সাহিত্যে আসিনি। এরপরও কিছু কিছু সংগঠন আমাকে বিভিন্ন সময় সম্মাননা দিয়েছে। এতে অবশ্যই সম্মানবোধ করেছি। তবে পুরস্কার, পদক বা সম্মাননা পাওয়ার প্রত্যাশা নিয়ে কখনোই লেখালেখি করিনি। পাঠকের ভালোবাসাই আমার কাছে সবচেয়ে বড় সম্মান।

মোস্তাফিজুল হক: ওয়েব ম্যাগাজিন সম্পর্কে আপনার মতামত পাঠকদের জানাতেন যদি…

জাহাঙ্গীর আলম জাহান: প্রিন্টিং মিডিয়ার বিকল্প হিসেবে ওয়েব ম্যাগাজিনগুলো সাম্প্রতিক সময়ে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। অদূর ভবিষ্যতে লেখক ও পাঠকদের কাছে ওয়েব ম্যাগাজিনই হয়ে উঠবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। সে আলামত ইতোমধ্যেই স্পষ্ট হতে শুরু করেছে।

মোস্তাফিজুল হক: নবীন লিখিয়ে এবং যাঁরা ফেইসবুকে লিখছেন, তাঁদের জন্য আপনার উপদেশ ও পরামর্শ জানতে চাচ্ছি।

জাহাঙ্গীর আলম জাহান: নবীন লেখকদের লেখার চেয়ে পড়ার ওপর আরও গুরুত্ব দিতে হবে। শুধু পড়া নয়, হতে হবে অধ্যয়নমুখী।
ফেইসবুকে যারা লিখছেন তাদের মধ্যে অনেকেই বেশ ভালো লিখছেন। তবে যেনতেন লেখা ফেইসবুকে আপলোড যত কম করা যায় ততই ভালো।

মোস্তাফিজুল হক : আঞ্চলিক বা মফস্বলের সাহিত্য সংগঠন গুলো সাহিত্যিক তৈরি করতে কতটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে?

জাহাঙ্গীর আলম জাহান: সংগঠন কোনোদিনই লেখক তৈরি করে না। তবে লেখকের মনোজগতে বাড়তি উদ্দীপনা ও অভিনিবেশ তৈরি করে দেয়। সে বিবেচনায় মফস্বলের সব সংগঠন সেটি যথাযথভাবে করতে পারছে বলে মনে হয় না। কারণ লেখককে উদ্দীপ্ত করার মতো প্রজ্ঞাবান ব্যক্তিত্ব মফস্বলের অধিকাংশ সংগঠনেই খুঁজে পাওয়া যায় না।

মোস্তাফিজুল হক: কথিত আছে মফস্বলের সাহিত্যিকরা উচ্চ পর্যায়ে বিভিন্ন সাহিত্য সেবা বা সুযোগ সুবিধা যাই বলি না কেন সেগুলো থেকে বঞ্চিত হয়। আপনি ও কি এই বিষয়ে একমত।

জাহাঙ্গীর আলম জাহান: এখন মুরুব্বি ধরার যুগ। মাথার ওপর ছাতা না থাকলে অনেক প্রাপ্তিই জোটে না। ছাতার আশ্রয় নিতে পারলে মফস্বল কোনো বিষয় নয়।

মোস্তাফিজুল হক: জীবনের চার ভাগের তিন ভাগ সময়ই তো সাহিত্যের জন্য কাজ করলেন! এই দীর্ঘ সময় সাহিত্যের জন্য কাজ করে রাষ্ট্র বা সরকারি প্রাপ্তি বলতে তেমন কিছুই তো পাওয়া হলো না! এই বিষয়টিকে কেমন করে দেখেন?

জাহাঙ্গীর আলম জাহান: আগেই বলেছি, প্রাপ্তির প্রত্যাশা নিয়ে লেখালেখিতে আসিনি। লিখে মানুষের ভালোবাসা পাচ্ছি এটাই বড় প্রাপ্তি। রাষ্ট্র বা সরকার উপযুক্ত মনে করছে না বলেই হয়তো আমাকে নিয়ে ভাবছে না। আমার চেয়ে অনেক যোগ্য মানুষ এখনও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি থেকে বঞ্চিত। আমি তো কোন্ ছার।

মোস্তাফিজুল হক: আপনার সকল ব্যস্ততা উপেক্ষা করে কাব্যশীলন তথা আমাকে সময় দেবার জন্য আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন সবসময়।

জাহাঙ্গীর আলম জাহান: আমার আবার ব্যস্ততা! বরং আমার মতো কাঠখোট্টা মানুষকে এতটা গুরুত্ব দেওয়ায় উল্টো আপনাদের কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। কাব্যশীলনের পথচলা আরও গতিময় হোক সে কামনা রেখে আপনাকে জানাই আন্তরিক ধন্যবাদ।

মোস্তাফিজুল হক: আমি খুবই আনন্দিত যে, আপনার মতো একজন গুণী লেখকের সাক্ষাৎকার নিতে পেরেছি। আবারও আপনার গৌরবময় জীবন ও সুস্বাস্থ্যময় দীর্ঘায়ূ কামনা করছি।

জাহাঙ্গীর আলম জাহান: ধন্যবাদ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *