জনপ্রিয়তা ক্যান্সারের কোষের মতো, বাড়তে বাড়তে লেখককে শেষ করে ফেলে
মোস্তাফিজুল হক: কাব্যশীলন ওয়েবম্যাগের পাঠক ও আমার তরফ থেকে শুভেচ্ছা নিন।
প্রিন্স আশরাফ: কাব্যশীলন ওয়েবম্যাগের পাঠক ও কাব্যশীলন পরিবারকে আমার পক্ষ
থেকেও অনেক শুভেচ্ছা, আন্তরিক অভিনন্দন ও ভালোবাসা সাহিত্যকে কাব্যশীলনের মাধ্যমে পাঠকের কাছে তুলে ধরার নিরন্তর এই প্রচেষ্টার জন্য।
মোস্তাফিজুল হক: প্রথমেই আপনার লেখালেখির সূচনা, প্রিয় লেখক ও প্রিয় বই সম্পর্কে জানতে চাচ্ছি-
প্রিন্স আশরাফ: লেখালেখির সূচনা স্কুল জীবনেই, অনেকটা জোর করেই। ক্লাস এইটে
থাকতে স্কুল ম্যাগাজিন ‘প্রতিভা’র জন্য বাংলা শিক্ষক বাধ্যতামূলকভাবে আমাদের কয়েকজন ভালো ছাত্রকে ম্যাগাজিনের জন্য লেখা দিতে বললেন। লেখালেখির
কিছুই জানি না, পড়তে ভালোবাসি, কীভাবে লিখতে হয় বাংলা স্যার একটু শিখিয়ে
দিলেন এবং অবশ্যই তা মিল দিয়ে লেখা ছড়া, কবিতা। সেই মিলের প্রচেষ্টায় যা
দেখি তা দিয়েই ছড়া বানিয়ে ফেলি। শেষমেষ একুশে ফেব্রুয়ারি এবং দাদুর ছাতা
নামে দুটো ছড়া লিখে জমা দিলাম। দুটোই ছাপা হলো, একটা আমার নামে, অন্যটা
সিনিয়র ভলান্টিয়ার পরেশদার নামে। সেদিনই প্রথম জানলাম একজনের লেখা
আরেকজনের নামে ছাপা হয়!
মোস্তাফিজুল হক: আপনার প্রিয় লেখক ও প্রিয় বই সম্পর্কে জানতে চাচ্ছি-
প্রিন্স আশরাফ: হুমায়ূন আহমেদের বই পড়েই লেখালেখির জগতটার সাথে পরিচয় এবং কিছু লেখার সাহস সঞ্চয় করা, সেদিক থেকে বিবেচনায় অবশ্যই হুমায়ূন আহমেদ প্রিয় লেখক। তবে বয়স বাড়ার সাথে সাথে প্রিয় লেখকের তালিকা দেশকালগণ্ডি ছাড়িয়ে আর্ন্তজাতিকতায় পৌঁছেছে। ক্লাসিক আর্নেস্ট হেমিংওয়ে, মার্ক টোয়েনকে বাদ
দিলে সাহিত্যে জাদুবাস্তবতার গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজই প্রিয় লেখক।
প্রিয় বই বিভূতিভূষণের ‘পথের পাঁচালী’, সার্ভেন্তাসের ‘ডনকুইক্সোট’, মার্কেজের ‘নিসঙ্গতার একশ বছর’, ইয়েস্তান গর্ডারের ‘সোফির জগৎ’ ও সম্প্রতি পড়া ‘স্যাপিয়েন্স’।
মোস্তাফিজুল হক: চিকিৎসক, লেখক, প্রকাশক, পত্রিকার সাহিত্যপাতার সম্পাদক- এসবের কোনটা বেশি আনন্দদায়ক?
প্রিন্স আশরাফ: লেখালেখিটাই বেশি আনন্দদায়ক, তবে বেদনাদায়কও বটে। প্রোফাইলে একসময় লিখেছি পেশায় চিকিৎসক, নেশায় লেখক। যায়যায়দিনের শিশুতোষ পাতা ‘হাট্টিমাটিমটিম’ সম্পাদনা শখের বশে হলেও দীর্ঘ দশবছর জড়িত থাকায় ওটা এখন দায়িত্ব ও কর্তব্যের মধ্যে চলে এসেছে। পত্রিকা অফিসের কিছু সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও সর্বোচ্চ চেষ্টা করি তরুণ ও নবীন লেখকদের লেখা প্রকাশে প্রাধান্য দিতে। এখনকার অনেক তরুণ লেখকের প্রথম লেখাটা আমার হাত
দিয়ে হাট্টিমাটিমটিমেই প্রথম প্রকাশিত হয়েছে। তারা একটা প্লাটফর্ম খুঁজে
পাওয়ায় সাহিত্যাঙ্গনে বিচরণ করাটা সহজ হয়েছে।
মোস্তাফিজুল হক: এবছর তো কয়েকটা পাণ্ডুলিপি পুরস্কার পেয়েছেন?- এ প্রসঙ্গে কিছু বলতেন যদি…
প্রিন্স আশরাফ: পাণ্ডুলিপি পুরস্কারটা আসলে বই প্রকাশের একটা মাধ্যম হিসাবেই
নিয়েছি। পাণ্ডুলিপি পুরস্কারের জন্য নির্বাচিত হলে সেটা বই আকারে প্রকাশ পায়। এক্ষেত্রে প্রকাশকের একটা দায়িত্ব থাকে পুরস্কার পাওয়া বইটার প্রচার প্রসারে। ফলে লেখক কিছুটা হলেও প্রচারের বাড়তি দায়িত্ব থেকে বাঁচে। তাছাড়া সবসময় কিছু না কিছু লেখার চর্চায় থাকার কারণে আমার ল্যাপটপে অনেক পাণ্ডুলিপিই জমে থাকে। সময়-সুযোগ এবং প্রকাশকদের সাথে যেচে যোগাযোগ
বিমুখতার কারণে সেসব লেখা কম্পিউটারের অক্ষরেই থাকে, ছাপার অক্ষরে প্রকাশ পায় না। পাণ্ডুলিপি প্রতিযোগিতা সেগুলো ছাপার অক্ষরে দেখার সুযোগ করে দেয়। আর
এক্ষেত্রে সহধর্মিনী সুলেখিকা তাহমিনা সানিকে ধন্যবাদ জানাতে চাই। সে-ই জোর জবরদস্তি করে বিগত বছরে দেশজ জাতীয় পাণ্ডুলিপি প্রতিযোগিতার জন্য আমার
পাণ্ডুলিপি পাঠানোয় উদ্যোগ নিয়েছিল। দেশজ জাতীয় পাণ্ডুলিপি প্রতিযোগিতার
প্রথম আয়োজনে আমার গল্পগ্রন্থ ‘অন্ধের শহরে একজন আয়নার ফেরিওয়ালা’ ও
উপন্যাস ‘কাঁটাতারে পুষ্পলতা’ প্রথম স্থান অর্জন করে। দুটোই বই আকারে প্রকাশের পাশাপাশি একটা হ্যান্ডসাম অর্থ পাই, যেটা সাধারণভাবে কোনো প্রকাশক বই বিক্রির পরে রয়্যালিটি হিসেবে কখনই দেয় না। তো সেই লোভে লোভে এ বছর কিশোর কলম, প্রিয় বাংলা, অক্ষরবৃত্ত এই তিন জায়গাতে নিয়ম মেনে পাণ্ডুলিপি পাঠাই এবং হয়তো পাণ্ডুলিপির গুণেই তিনক্ষেত্রে ওগুলো পুরস্কারের যোগ্যতা অর্জন করে। আমার মনে হয় নতুন লিখিয়েদের ক্ষেত্রে পাণ্ডুলিপি পুরস্কার খুব ভালো একটা প্লাটফর্ম হিসেবে সুযোগ সৃষ্টি করে দিতে পারে।
মোস্তাফিজুল হক: আপনার লেখা ও প্রকাশিত বই সম্পর্কে তথ্য দেবেন কি?
প্রিন্স আশরাফ: অমর একুশে বইমেলা ২০২০ ও মুজিব শতবর্ষে আমার বেশ কয়েকটি বই প্রকাশিত হচ্ছে। এর মধ্যে কয়েকটি আছে পাণ্ডুলিপি পুরস্কারপ্রাপ্ত গ্রন্থ।
মাটি ও মানুষের যাপিত জীবনের কথা নিয়ে প্রিয় বাংলা পাণ্ডুলিপি পুরস্কারপ্রাপ্ত উপন্যাস ‘মাটি’ পাওয়া যাবে প্রিয় বাংলার ২২২-২২৩ নং স্টলে। আমার এ যাবৎকালের সেরা গল্পগুলো নিয়ে অক্ষরবৃত্ত পাণ্ডুলিপি
পুরস্কারপ্রাপ্ত গল্পগ্রন্থ ‘এখানে শিরদাঁড়া মেরামত করা হয়’ পাওয়া যাবে অক্ষরবৃত্তের ১৮০ নং স্টলে। কিশোর মুক্তিযুদ্ধের গল্প নিয়ে কিশোর কলম পাণ্ডুলিপি পুরস্কারপ্রাপ্ত গ্রন্থ ‘পতাকার ফেরিওয়ালা’ পাওয়া যাবে রাতুল গ্রন্থ প্রকাশ-এর ২৩৯ নং স্টলে। এবারের বইমেলায় আমার লেখা একমাত্র প্রেমের উপন্যাস ‘খাঁচা’ নীতুল প্রকাশনীর ব্যানারে পাওয়া যাবে দেশ পাবলিকেশন্সের
২৫৩-২৫৪ নং স্টলে। ধর্ষণের প্রেক্ষাপট নিয়ে লেখা বৃহৎ কলেবরের উপন্যাস ‘রাজশহরের পরী’ পাওয়া যাবে বায়ান্নর ৩৬৩ নং স্টলে। গোয়েন্দা গল্প ‘ডিটেকটিভ হেকিম হোমস’ থাকছে বাবুই এর ৭৭৭-৭৭৮ নং স্টলে। হাট্টিমাটিম টিমের ১০০ শিশুতোষ গল্প নিয়ে আমার সম্পাদনায় ‘হাট্টিমাটিম টিমের ১০০
গল্প’ রোদ্দুর প্রকাশনীর ব্যানারে পাওয়া যাবে ঝিনুক প্রকাশনীর ১৯৭-২০০ নং স্টলে। এছাড়াও রুবেল কান্তি নাথ সম্পাদিত ‘ভয় অমনিবাস’ ও শফিক হাসান সম্পাদিত ‘কাশির চেয়ে হাসি ভালো’ গ্রন্থে থাকছে আমার দুটো লেখা।
মোস্তাফিজুল হক: এই সময়ের একজন জনপ্রিয় লেখক হয়ে উঠার মূলমন্ত্রটা জানাবেন কি?
প্রিন্স আশরাফ: জনপ্রিয় লেখক এই প্রসঙ্গটা এড়িয়ে যাওয়াই ভালো, কারণ আমি
জনপ্রিয় লেখক নই। নিজস্ব কিছু পাঠক হয়তো আমার লেখা পছন্দ করে, পড়ে- এই আর কি! তবে আমার মনে হয় প্রতিটি লেখকই জনপ্রিয়তা পছন্দ করে, আশা করে, কামনা করে, কেউ পায়, কেউ পায় না। তবে জনপ্রিয়তার আড়ালে ভালো লেখকের তকমা পাওয়াটা একজন লেখকের মূলমন্ত্র হওয়া উচিত বলে আমি মনে করি।
মোস্তাফিজুল হক: শিশুসাহিত্যের মনস্তাত্ত্বিক চিন্তাধারা কেমন হওয়া উচিৎ বলে মনে করেন?
প্রিন্স আশরাফ: আমার মেয়ে সারাহকে জন্মের পর থেকে তার এই সাড়ে আট বছর বয়স পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করে আমার যেটুকু মনে হয়েছে শিশুসাহিত্যের ধারাও সময়ের সাথে সাথে বদলানো উচিৎ। সেই ‘ঠাকুরমার ঝুলি’, ‘বুড়ো অ্যাংলো’, ‘ক্ষীরের পুতুল’-এর সাথে ওদেরকে হয়তো কোনোভাবে পরিচিত করানো যেতে পারে, কিন্তু এখনকার ইলেকট্রনিক গ্যাজেট অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। কাজেই সেভাবে পুরনো ও নতুনের সংমিশ্রণেই ওদের মনস্তত্ব গড়ে তোলা উচিৎ। পুরনোই ভালো বলে জোর করে তা চাপিয়ে দেওয়া উচিৎ নয়, আবার নতুন সব খারাপ বলে তা থেকে দূরে রাখাও উচিৎ নয়। দু’য়ের মাঝে সামঞ্জস্য রাখা উচিৎ।
মোস্তাফিজুল হক: এতসব গুরুত্বপূর্ণ কাজে জড়িত থেকেও লেখালেখি আর আনন্দঘন জীবনযাপন কীভাবে সম্ভব?
প্রিন্স আশরাফ: যখন যে কাজটা করি, সেটা আনন্দের সাথে করলেই বোধ হয় লেখালেখি আর জীবনযাপনকে আনন্দঘন করা সম্ভব। শুধু লেখালেখির সিন্দবাদের ভূত ঘাড়ে চাপিয়ে তা বহন করতে গেলে জীবনযাপন দুর্বিষহ হয়ে উঠতে পারে। ছোটবেলার প্রবাদ ‘পড়ার সময় পড়া, খেলার সময় খেলা’র মতো লেখালেখির সময় লেখালেখি আর
বাকি সময়টা লেখক সত্বাকে ভুলে সাধারণ মানুষের জীবন যাপন করাই উচিৎ। কারণ
আমরা জানি, লেখকের জীবন ডগস লাইফ বা কুত্তার জীবন। কাজেই ওটাকে একপাশে
সরিয়ে মানুষের জীবনযাপন করাটাও খুব দরকার।
মোস্তাফিজুল হক: পত্রিকা, ওয়েবম্যাগ, ম্যাগাজিন ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম লেখক তৈরিতে কতটুকু ভূমিকা রাখছে?
প্রিন্স আশরাফ: অনেক, অনেকখানি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম যে এখন লেখক তৈরিতে শুধু ভূমিকাই রাখছে তা নয়, লেখক চিনতেও সাহায্য করছে এবং সবাইকে এরমধ্যে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ফেলছে। এ থেকে ভালো লেখক বেরিয়ে আসছে কিনা বলতে পারবো না, তবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এড়িয়ে থাকলে ভালো লেখক দূরে সরে থাকছে।
পাঠক ভালো লেখকদের কথা জানতে পারছে না। আমি নিজেও এই মাধ্যমটাকে এতোদিন এড়িয়ে ছিলাম, তাতে দেখলাম শুধু পিছিয়েই পড়িনি, হারিয়ে যেতে বসেছিলাম। তাই আপনাদেরও এখন আমার সক্রিয়তা চোখে পড়ে, যে যুগের যে ভাও!
মোস্তাফিজুল হক: শত ব্যস্ততার মাঝেও আমাকে সময় দেয়ার জন্য অশেষ ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।
প্রিন্স আশরাফ: আপনাকেও অসংখ্য ধন্যবাদ। ধন্যবাদ কাব্যশীলনকেও।
Khandakermustafizul41@gmail.com