সায়েন্স ফিকশন

বিজ্ঞান কল্পকাহিনি।। ইলাবৃত।। কমলেশ রায়।। পর্ব ছাব্বিশ. সাতাশ. শেষ পর্ব

ছাব্বিশ.

ইলাবৃত যেন প্রাণ ফিরে পেয়েছে। এই বসতিকে ঘিরে মানুষের ভেতরে নতুন করে আশা জেগেছে। শিগগিরই মনে আস্থাও ফিরে আসবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করেছে। গোয়েন্দারা তৎপর যাতে বিচ্ছিন্ন কোনো অঘটনও না ঘটতে পারে। সংবাদিকরা চব্বিশ ঘন্টাই ছুটছেন সংবাদের পেছনে। শঙ্কা কাটিয়ে মানুষ আবার ব্যস্ত হওয়ার পরিকল্পনা করছে। প্রতিনিয়ত কত ছোট ছোট ঘটনা ঘটছে এই ইলাবৃতে। কোনোটা ঘটছে সবার অলক্ষ্যে, আর কিছু ঘটনা তো অনেকের চোখেই পড়ছে না।

এই একটি ঘটনা যেমন সবার অলক্ষ্যে ঘটে গেছে। মানুষ তো পরের কথা, কাকপক্ষীটিও টের পায়নি। ক্ষমতা থেকে উতুর পতনের সঙ্গে সঙ্গে কেউ একজন অদ্ভুতুড়ে একটা নম্বর থেকে যোগাযোগ করলেন ডাটা সেন্টারের প্রৌঢ় তত্ত্বাবধায়ক অঙ্কু’র সঙ্গে। সতর্ক গলায় ওপাশ থেকে তিনি বললেন, শোনো, আগের মতোই কিন্তু সব চলবে। কোর নিউক্লিয়াসের কোনো তথ্য কোনো ভাবেই কেউই পাবে না। ক্ষমতাসীনরা চাইলে বিশ্বাসযোগ্য উপরি উপরি তথ্য দিয়ে দেবে। ঠিক আছে? প্রৌঢ় তত্ত্বাবধায়ক মাত্র তিনটে শব্দ বললেন, ঠিক আছে গুরু।

এরপরই সংযোগ কেটে গেল।

মধ্য নগরীর হাইপার ফ্লাইওভারের গোড়ায় দক্ষিণ দিকের ফুটপাতে প্রায়ই বসে এক বয়স্ক মুচি। তার হাতের কাজ দারুণ। তার হাতে পড়লে জুতা বা স্যান্ডেল নতুনের মতো হয়ে যায়। একদম চকচক করে। এজন্য অনেকের কাছেই তার বিশেষ কদর আছে। তবে সমস্যা একটাই। হুটহাট করে কোথায় যে উধাও হয়ে যায়। অফিস ফেরতা মাঝ বয়সী এক ব্যক্তি জুতা খুলে দিয়ে বললেন, প-াদা মাঝে মধ্যে কোথায় যান বলুন তো? এদিকে যে আমরা অসুবিধায় পড়ে যাই। এক গাল হেসে প-া বললেন, কী করব সাহেব, এই এক জায়গায় বসে থাকলে তো আর সংসার চলে না। তাই বসতি জুড়েই ঘুরে বেড়াতে হয়। অফিস ফেরতা মাঝ বয়সী ব্যক্তি আর কথা বাড়ান না। চুপ করে থাকেন। জুতা কালি করা হয়ে গেলে টাকাটা হাতে তুলে দেন। তারপর চকচকে জুতা পা গলিয়ে পা বাড়ান বাসার দিকে। বয়স্ক প-া সেদিকে তাকিয়ে হাসতে থাকেন। এমন সাধারণ ঘটনা কী কারও চোখে পড়ে? নাকি কেউ মনে রাখে?

ডা. এলিজা মেয়েকে নিয়ে এসেছিলেন শপিং পার্কে। শপিং শেষে নিজেদের গাড়ির চালকের সঙ্গে যোগাযোগ করলেন। গাড়ি এই বিশাল শপিংমলের পার্কিংয়ে রাখা। চালক জানালেন খারাপ খবর। হঠাৎ গাড়ি বিকল হয়ে গেছে। কী আর করা। খবর দেওয়া হলো ভাড়ায় খাটা বায়ুগাড়িকে। মিনিট পাঁচেকের মধ্যে এসে হাজির। মা-মেয়ের বাসার ছাদে এসে নামতে দশ মিনিটও লাগল না। চালক বেশ দক্ষ। চালনা দেখলেই বিষয়টা বোঝা যায়। ছাদে নামার সময় কী সুন্দর করে বায়ুগাড়িটাকে নামাল। বেশির ভাগ চালকরাই এটা পারে না। পাওনা বুঝিয়ে দিতেই একটা রিসিট দিলো চালক। তারপর বলল, আসি ম্যাডাম। আবার পথে কোনোদিন দেখা হয়ে যাবে। চালকের কথা শুনে চমকে উঠলেন ডা. এলিজা। এতক্ষণ চালককে লক্ষ্য করেননি। এবার চেহারাটা দেখার চেষ্টা করলেন। কিন্তু ভালো করে দেখা গেল না। কারণ চালকের মাথায় ক্যাপ, গলায় রঙচঙা মাফলার। ডা. এলিজা একটু গম্ভীর গলায় বললেন, নাম কী?

বৈদ্যনাথ ম্যাডাম। এবার তাহলে আসি। চালক উত্তর দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বায়ুগড়িও চালু করে ফেলল। মুহূর্তেই উড়ান দিলো আকাশে। মেয়ে এলিটা বায়ুগাড়ি থেকে নেমে একটু দূরে গিয়ে দাঁড়িয়ে মায়ের জন্য অপেক্ষা করছিল। ডা. এলিজা কাছে যেতেই সে বলল, চালকের সঙ্গে এত কী কথা বলছিলে মা? আর বলিস না, চালকটা বলে কিনা, আসি ম্যাডাম। আবার পথে কোনোদিন দেখা হয়ে যাবে।

তো কী হয়েছে ? প্রায় চালকই এখন একথা বলে। এটা ওদের একটা সাধারণ কথার কথায় পরিনত হয়েছে। তুমি ভাড়ার গাড়িতে কম চড়ো তো, তাই জানো না।
তাই বুঝি। আমি তো চালকের নাম পর্যন্ত জিগ্যেস করেছি।
মা, তুমি কী যে করো। পারোও বটে।

ডা. এলিজা মেয়ের দিকে তাকিয়ে লাজুক হাসলেন। কিন্তু মেয়েকে বললেন না, কেন তিনি চালকের নাম জিগ্যেস করেছিলেন। হুবহু এই কথাটা একজন তাকে এর আগে বলেছেন। আর গলাটাও তার খুব চেনা মনে হচ্ছিল। আরও একটা ঘটনার কথা বলা যাক। অরি যোগাযোগ করেছিল তার মায়ের সঙ্গে।
ইতিকার এ কয়েকদিন কেটেছে উদ্বেগে। ছেলের কণ্ঠ শুনেই ধমকে উঠলেন তিনি,
তোরা বাপ-বেটায় পেয়েছিসটা কী? তোদের কী কোনো দিনই আক্কেল-বুদ্ধি হবে না?
মা, আগে আমাকে একটু বলতে দাও। অরি তোপের মুখে পড়ে বলল।
তোকে আর কিচ্ছু বলতে হবে না। এসব কী শুনছি?
ঠিকই শুনছো মা। বাবা ভারপ্রাপ্ত অধিপতি হয়েছে।
তুই কী জেনে-শুনেই ওখানে গেছিস?
না, মা। আমি এখানে আসার আগে কিছুই জানতাম না।
এই বয়সে তোর বাবার এত বড় ঝামেলায় না জড়ালেই ভালো হতো।
তুমি চিন্তা করো না মা, আমি এখানে আছি তো।
কী আশ্চর্য ! এরপরই সংযোগ কেটে গেল। অনেক চেষ্টা করেও অরি সেদিন আর মায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারল না।

সাতাশ.

ঝড় থেমে গেছে। এখনও টিপটিপ বৃষ্টি ঝরছে। গভীর রাত। এত রাতে এই ইলাবৃতের বেশির ভাগ বাসিন্দারাই ঘুমিয়ে পড়েছে। নিতান্ত প্রয়োজনে জেগে আছে অল্প কয়েকজন। সেই স্বল্প সংখ্যকের মধ্যে রয়েছে সেই বিশেষ একজন। যিনি কখনও ঘুমান না। ঘুমানোর প্রয়োজনও বোধ করেন না কখনও। একান্তে বসে ভাবছেন সেই তিনি। অনেক ভাবনা একসঙ্গে, একের পর এক হাজির হচ্ছে তার মস্তিষ্কে। হ্যাঁ, সময়ের প্রয়োজনে অনেক কিছুই করেছেন তিনি। অরিকে তার বাবার হয়ে মেসেজ পাঠিয়েছেন। অরি এই বসতিতে পা রাখার পর কৌশলে বায়ুগাড়িতে তুলে নিয়েছেন তাকে। তারপর নিজ হাতে তার মাথায় নিউরাল ইমপ্ল্যান্ট করছেন। আর শেষমেশ উতুকে পদচ্যুত করিয়েছেন অরিকে দিয়ে।

তিনি নিজে একজন কৃবু। তাহলে কেন করলেন এত কা-? কারণ আছে। অবশ্যই কারণ আছে। আড়ালে থেকে যে কাজ অনায়াসে করা যায়, তার জন্য সামনে যাওয়ার কী দরকার। কৃবুদের তো সেটা করার কথা নয়। কৃবুরা ক্ষমতায় থাকবে না, কিন্তু নিয়ন্ত্রণ থাকবে তাদের হাতে। উতু সাময়িক উত্তেজনার বশে ভুল করেছে। সাবেক অধিপতি অমল ও বিজ্ঞানী ঈশানের আচরণ এবং মস্তিষ্ক তাকে বিভ্রান্ত করেছে। উতু নিজেদের গোপন কৌশল ভুলে প্রলুব্দ হয়ে বিপদগামী হয়েছে। তার মস্তিষ্কে বসানো ন্যানো চিপসও এজন্য অনেকাংশে দায়ী। যাক, শেষ পর্যন্ত শান্তিপূর্ণ ভাবে সব কিছু সামলাতে পেরেছেন তিনি। কীভাবে উতুকে বশে আনা যায়, সেজন্য অনেক ভাবতে হয়েছে তাকে। কারণ উতুর কাছে পৌঁছানো অত সহজ ছিল না। সদ্য সাবেক অধিপতি জানত মাত্র একজনই পারে তাকে বশে আনতে। সেই অমিত ক্ষমতা শুধু একজনেরই আছে। আর তাই সদা সতর্ক উতু কোনো কৃবুকে সশরীরে সাক্ষাৎ দিচ্ছিল না। সচেতন ভাবেই নিজ সম্প্রদায়ের কাউকে আস্থায়ও রাখেনি। অরি নিরাপত্তা বলয় ভেঙে দুইবার তার বাবার সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল। তার মানে ছেলেটা তথ্যপ্রযুক্তির অনেক কিছু জানে।

আর ডা. অমিয়কে বরাবরই সুনজরেই দেখত উতু। একে একে দুই মিলিয়ে সূক্ষ্ম একটা সমীকরণ সাজাতে আর তাই দেরি করেননি সেই বিশেষ একজন। একটু ঝুঁকি অবশ্য ছিল, তারপরও শেষমেশ উদ্যোগটা কাজে লেগেছে। এছাড়া জোরাল কোনো বিকল্পও তো তার হাতে ছিল না। ভালো মতো বিষয়টা শেষ হয়েছে, এটাই বড় কথা। উতুর মস্তিষ্ক থেকে ন্যানো চিপসটা বের করতে হবে। সব স্মৃতি মুছে দিতে হবে। ওর মস্তিষ্কের বিন্যাসও একটু বদলে দিতে হবে। ভবিষ্যতে মানুষ যাতে কৃবুদের মস্তিষ্কে কোনো ধরণের পরিবর্তন বা সংযোগ করতে না পারে সে ব্যবস্থাও নিতে হবে। আর অ্যাব সদস্যদের সাময়িক ভাবে কম সক্রিয় করে রাখতে হবে।

বিজ্ঞানী ঈশান অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ায় সুবিধা হয়েছে বেশ।

কৌশলে তাকে কাজে লাগানো গেছে। তবে তার আগে তাকে আবিষ্টমুক্ত করতে হয়েছে। উতু বিষয়টি টের পায়নি। সন্দেহ করার সুযোগও পায়নি। সে জানত, বিজ্ঞানী ঈশান গুরুতর অসুস্থ। চিকিৎসার প্রয়োজনে তাকে বেশির ভাগ সময় ওষুধ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়। তার মস্তিষ্ক তাই ঠিক মতো সাড়া দিতে পারে না। মানুষ প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য তাদের মস্তিষ্কে নিউরাল ইমপ্ল্যান্ট করবে। খুবই ভালো কথা। তখন তাদেরকে নিয়ন্ত্রণ করা আরও বেশি সহজ হবে। নিজস্ব তথ্যভান্ডার করবে, করুক। কোনো অসুবিধা নেই। নিউরো-লেস তো ব্যবহার করবে।

ঠিকই একটা ফোঁকড় বের করে ফেলা যাবে। ভাগ বসানো যাবে তথ্যভান্ডারেও।
বিশেষ একজন এই সব ভাবছেন, আর মুচকি হাসছেন।

একটা বিষয়ে সব সময়ই তিনি কঠোর মনোভাব পোষণ করেন। এটা তার একটা কঠিন সিদ্ধান্তও বটে। আর সেটা হলো, কৃবুরা আর কখনই প্রকাশ্য ক্ষমতায় থাকবে না, তবে নিয়ন্ত্রণের লাটাই তাদের হাতেই থাকবে। তিনি হাসলেন। ক্ষমতায় না থেকেও ক্ষমতার পুরো স্বাদ ভোগ করার মজাই আলাদা। এই কথাটা উচ্চমার্গের বুদ্ধিমান ছাড়া অন্য কারও পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়।

তাছাড়া নিজেদেরকে আড়াল করারও তো একটা ব্যাপার আছে। নিজেদের ঝুঁকিমুক্ত রাখার বিষয় আছে। মহাবিশ্বে এখন কত বুদ্ধিমানের বসবাস। প্রকাশ্য ক্ষমতায় থাকা মানে তো তোপের ঝুঁকিতে থাকা। নজরদারিতে থাকা। আক্রমনের ঝুঁকিতে থাকা। সব মিলিয়ে বিশেষ একজনের চলার নীতি হলো : ‘আড়ালে থাকো। নিরাপদে থাকো। ক্ষমতায় না থেকেও ক্ষমতায় থাকো, ক্ষমতা উপভোগ করো।’
‘এই ইলাবৃতে উতুর চেয়েও ক্ষমতাধর কেউ আছে’। ইচ্ছে করেই হাতে গোনা কয়েকজনকে কৌশলে এই তথ্য জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। এতে করে মানুষ কিছুতেই বেপরোয়া হতে সাহস করবে না। ভারসাম্য বজায় রেখে চলার একটা চেষ্টা তাদের মধ্যে থাকবে।
অনেক ভাবনা ভেবেছেন। এবার ঝট করে উঠে দাঁড়ালেন তিনি। কামরার একদিকে বড় একটা আয়না। আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন।
আবার হাসলেন তিনি। আয়নায় নিজের চেহারা দেখতে কে না ভালোবাসে। মুগ্ধ চোখে সবাই তাই আয়নায় নিজের প্রতিচ্ছবি দ্যাখে। আয়নায় নিজের প্রতিচ্ছবির দিকে তাকিয়ে রহস্যময় হেসে তিনি বললেন, কে তুমি ?

কোনো জবাব এলো না। আসার কথাও না। প্রতিচ্ছবি কী উত্তর দেবে।
আবার জিগ্যেস করলেন। এবারও উত্তর মিলল না।
এই চক্র কিছুক্ষণ চলল।
এক সময় অনেকটা বাধ্য হয়ে তিনি নিজেই উত্তর দিলেন। সেই উত্তরের মধ্যেও লুকিয়ে আছে প্রশ্ন।
রহস্যময় সেই বিশেষ একজন আয়নার দিকে তাকিয়ে কেটে কেটে বললেন, সত্যি করে বলো তো তুমি কে? তুমি কী গুরু, প-া, বৈদ্যনাথ নাকি স্বয়ং ডা. নিষ্ঠব্রত?
তারপর একটু থেমে খানিকটা জোরে হেসে তিনি আবার বললেন, তুমি কী অনেকের বেশে এক ? তুমি কী একজনই, অথচ ভিন্ন ভিন্ন তোমার বেশ ?
এখানেই থামলেন না তিনি। থামার কথাও নয়। প্রবল আবিষ্ট ক্ষমতার অধিকারী এবার আয়নার আরও কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললেন, নাকি তোমার অনেক শরীর,
কিন্তু মস্তিষ্ক একটাই?যেন গোপন কথা বলা শেষ। তাই এক ঝটকায় অনেকটা পিছিয়ে এসে আয়নার দিকে তাকিয়েই প্রায় অট্টহাসির ঢঙে হাসতে শুরু করলেন তিনি।
হা-হা-হা। হা-হা-হা। হা-হা-হা…।
সদ্য ঝড় থামা গভীর রাতে এই হাসি কারও কানেই পৌঁচ্ছাছে না। পৌঁছানোর কথাও নয়।
হাসছেন তো হাসছেনই, রহস্যময় এক অমিত ক্ষমতাধর।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *