সে আমার কেউ না ।। শফিক নহোর

০১.

সুমনাকে চুমু দেবার পর ও আমাকে ‘শয়তান, জানোয়ার’ বলে গালাগাল করল। তোর সঙ্গে কোনোদিন কথা বলবো না বলে তিরস্কার করতে লাগল। কথা শেষ না হতেই ওর চোখে জোয়ার ভাটার মতো পানি বইতে শুরু করল।

একটু ঢঙ করে সুমনার শরীর ঘেঁষে দাঁড়ালাম। আহ্লাদ করে ওর ওড়না দিয়ে চোখের জল মুছিয়ে দিতেই আবারও তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলো। তখন বুঝতে পারলাম- সুমনাকে বোঝাতে গেলে বোকা হয়ে যাব। তারচেয়ে এই মুহূর্তে আমি কোনো কথা না বাড়িয়ে সদর দরজা দিয়ে বের হয়ে যাই।

ঘটনাস্থল থেকে বের হতেই মৌ আমাকে দাঁড়াতে বলল। আমি বিদ্যুৎ গতিতে নজর এড়াতে চেষ্টা করলাম।

সুমনা এই ক’দিনে আমাকে কল করেনি। আমিও চেষ্টা করিনি। কারণ আমার ভেতরে একধরনের অপরাধবোধ কাজ করছে। তাকে এভাবে এতটা নিবিড় সম্পর্কে জড়ানো ঠিক হয়নি।

আমি রাধানগর শাপলা প্লাস্টিক মোড় পার হয়ে দাঁড়ালাম। টঙ দোকান থেকে একটা সিগারেট জ্বালিয়ে মৃদুপায়ে হাঁটতে শুরু করলাম। মনে হলো কেউ একজন আমার সঙ্গ নিয়েছে। আমি পেছনে তাকাতেই দেখি সুমনা!

আবার তাকিয়েই অবাক- সুমনা উধাও হয়ে গেল, নাকি কেউ এই মুহূর্তে ওকে গুম করল! কে জানে? আমি সিগারেটেরে আগুনটা ফেলে দেবো, নাকি আর একটা টান দেবো, দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে গেলাম। পাশ দিয়ে রিকসা, ইজি-বাইক, সিএনজি চালিত যানবাহন যেভাবে চলে, পেছনে কেউ একজন আছে কি না বোঝা বড়ই মুশকিল। মোবাইল ফোনের অ্যাপসটা চালু করে দেখে নিলাম। সুমনা সত্যিই আমার পেছনে ছিল কি না?

হ্যাঁ, সুমনা আমার পেছনেই ছিল। তাহলে সুমনা এখন কোথায়?

রিফ্রেশ করে আবার অ্যাপসটি চালু করতেই সুমনার ফোনটি অফলাইন হয়ে গেল। আইকনিক চিহ্ন দেখেই বুঝতে পারলাম। অথচ আমি বোকার মত ছায়াসঙ্গী হিসেবে সুমনাকে খুঁজছি।

শহরের শেষের দিকে এসেছিলাম জরুরি একটা কাজে। আবার শহরমুখী হতে হচ্ছে আমাকে। শহরে এখন অনেক আবাসিক হোটেল। কার সঙ্গে কার কী রিলেশন, তা দেখছে না কেউই। এর ভেতর দুএকজন একটু ভিন্ন। দুজনের এনআইডি দেখালে সহজেই রাতে থাকার অনুমতি মিলে যাবে। এভাবেই পারমিশন ডিসটাইন করে জীবনকে নিজের ইচ্ছের ভেতর নিয়ে আসছে আধুনিক বাবা মায়ের আধুনিক সন্তানেরা। তাদের মেধা নেই। মাথার ভেতর ঢুকে গেছে আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স চরিত্র। সময়কে ধরতে না পারলে সময়ের সামনে দাঁড়ানো যায় না। সেই মেধা যাদের আছে, তারা নোংড়ামিতে কখনো প্রতিযোগিতা করবে না। এসবে সুখ থাকলেও পরিতৃপ্তি নেই। আলোর গতির চেয়ে মনের গতির পরিবর্তন দ্রুত হয়। মানসিক সুখ, টাকাপয়সা, ক্ষমতা থাকলে একাই চলে আসে আঁধারে মোড়ানো ক্ষণস্থায়ী সুখের পশরা। জীবনে সুখী হতেই হবে এমন মনোভাব থেকে বের হতে না পারলে, সে আসলে সুখী হতে পারে না। সুখী হতে টাকা লাগবেই এমন কথাও নেই। তবে জীবনে টাকা দরকার, তা প্রয়োজনের অতিরিক্ত না। অর্থ বেশি হলেই ধীরে ধীরে সুখ নষ্ট হতে শুরু করবে। ঘুণে খাওয়া কাঠের মত ভেতরে ফাঁপা মেরুদণ্ডহীন হয়ে সমাজে অনেকেই দাঁড়িয়ে থাকে। সেসব দাঁড়িয়ে থাকা কঠিন মানুষ তাকিয়ে দেখবে, পাশে এসে দাঁড়াবে না। দূর থেকে মেকি হাসি দিয়ে দ্রুত বিদায় নিতে ব্যস্ত হয়ে পড়বে। লোকচক্ষুর আড়ালে ঘোলা জলে ডুব দিয়ে সাদা পোশাক পড়ে আতর মেখে সহি কথাবার্তা বলা লোক সমাজে এখন আগের থেকে অনেকবেশি। ভালোর ভেতর ভালো মিশে গেলে টের পাওয়া যায় না। কিন্তু ভালোর ভেতর খারাপ ঢুকে গেলে সঙ্গে সঙ্গে তা যে কেউ বুঝতে পারে।

রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে ভাবতে ভাবতেই সময় যাচ্ছে। একটি কুকুর ঠ্যাং উঁচু করে প্রসাব করতে লাগল। জাতে কুকুর, তার আবার লাজলজ্জা! মানুষ তার চেয়ে বেহায়া হয়ে দিনেরাতে, আবাসিক হোটেলে ঢুকে পড়ছে সুখের নীলদরিয়াতে। কীসের পাপ, কীসের লজ্জা! সেই অনুশোচনা মানুষের আদৌ নেই। আমি নিজেই তো খারাপ মানুষের দলে। তাহলে আমার ভাবনার ভেতরে এসব ভাবনা আসছে কেন?

সুমনা আমাকে এমনভাবে কথাটি বলতে পারলো? শুনেছি, মেয়েদের সয়ে যাওয়া স্বভাব। সেক্ষেত্রে হতেই পারে, আমিও বিষয়টা স্বাভাবিকভাবেই নিয়েছি।

শহর থেকে ফিরতে একটু দেরি হয়ে গেল। মোবাইল ফোনে তিনটা মিসডকল উঠে আছে। ফোন কখন যে সাইলেন্ট হয়ে গেছে, বুঝতে পারিনি।

আজ রাতেই রাতুলের জন্মদিন। আমাকে এমনভাবে বলেছে, না গেলে ছেলেটা ভীষণ মন খারাপ করবে। আসলে এশহরে আমি ছাড়া ওর কেউ নেই। মা-বাবাকে খুন করে শহরে বানভাসি মানুষের মত জীবন উৎযাপন করছে। নিজের ভেতরে অপরাধবোধ নেই। পাষাণ মানুষ। পাথরের ভেতরেই আমি গোলাপের ঘ্রাণ পেয়েছি। ওকে দেখে কখনো মনে হয়নি, ও মা-বাবাকে খুন করতে পারে। মানুষ গোপনে অথবা প্রকাশ্যে, কাউকে না কাউকে খুন করে। তারপর নীরব হয়ে বসে থাকে। তখন পরিচিত খুনি হয়ে ওঠে আমাদের পরম বন্ধু, অথবা কাছের আত্মীয়। নদীর পানির ভেতর বৃষ্টির পানি মিলে গেলে, তা আর আলাদা করা যায় না।

০২.

ভোররাতে হালকা শীত পড়েছে। চোখের পাতা খুলতে পারছি না। পা দিয়ে দুবার চেষ্টা করলাম গায়ে কাঁথা নিতে, শেষ পর্যন্ত সফল হলাম। কিন্তু গায়ের সঙ্গে গরম অনুভূত হওয়ায়, বুঝতে পারলাম কিছু একটা আমার শরীর ঘেঁষে আছে। আমার বুকের ভেতর দিয়ে নাভির দিকে নেমে আসছে। হাত দিয়ে কাঁথা সরিয়ে চিৎকার করে উঠলাম। আমার কণ্ঠ শুনে পাশের রুম থেকে কেউ এগিয়ে আসছে না।

আমি ভয়ে কেঁপে উঠলাম। এর ভেতর বিদ্যুৎ চলে গেল। এ যেন নিজের প্রতি নিজের অবিচার। কাউকে দোষী করতে পারছি না। নিজের নসিব ভালো না হলে যা হয়। তখন প্রিয় কবির পঙক্তি ঠোঁটের ফাঁকা দিয়ে বের হয়ে আসছে-

‘বাতাসহীন রঙিন বেলুনের মতো ধূসর কণ্ঠস্বরে।

শোনা গেল লাশকাটা ঘরে

নিয়ে গেছে তারে;

কাল রাতে-ফাল্গুনের রাতের আঁধারে

যখন গিয়েছে ডুবে পঞ্চমীর চাঁদ

মরিবার হলো তার সাধ।’

মনে হলো কিছু একটা আমার শরীর থেকে নেমে গেছে। মোবাইল ফোন সবসময় আমার বালিশের নিচেই থাকে। অথচ আজ বিছানার কোথাও খুঁজে পাচ্ছি না। আবার বিছানায় শরীর এলিয়ে দিলাম। চোখ বন্ধ করে রাখলেও চোখে ঘুম আসছে না। একবার বিছনার উপর বসে আবার শুয়ে পড়লাম। মনের ভেতর অদ্ভুত সব ভাবনা এসে ভিড় করতে লাগল।

আজাদকে আমি মনে মনে প্রচণ্ড ঘৃণা করি। অথচ আজাদের মুখাবয়ব বারবার মানসপটে উদ্ভাসিত হচ্ছে। তাকে মনে করার কিছু নেই, তবুও সে আমার সমস্ত অনুভূতি জুড়ে আঘাত করছে। আমি ঘুমিয়ে গেলে মনে হচ্ছে মরে গেছি। আবার জেগে থেকেও মরতে ইচ্ছে করছে।

ঘুমিয়ে পড়লেও একটি অদ্ভুত সাপ অথবা মানুষের হাত শরীরের ভেতর ঢুকে পড়ে। নিজের শরীর কেঁপে ওঠে। চিৎকার করে কাউকে কাছে ডাকতে চাইলে মনে হয় আমার পাশে কেউ নেই। আমার কথা কেউ শুনছে না। আমার দিকে কেউ এগিয়ে আসছে না। শরীরে কে যেন অকটেন ঢেলে দিয়ে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। আমি আরও উচ্চ স্বরে চিৎকার করছি, তবুও কেউ আমার কথা শুনতে পাচ্ছে না। তখন মনে হলো আমি নিজেই ভুল বলছি, আমার নিজের একজন মানসিক ডাক্তার দেখানো দরকার। আমি গেলামও ঠিক, তবে ডাক্তারের কাছে গিয়ে কোনো লাভ হয়নি। দেখলাম সকলেই আমার মতো একই সমস্যা নিয়ে ডাক্তারের পরামর্শ নিতে এসেছেন। শুধু একজন এসেছেন, তার চোখ ধীরে ধীরে বুকের নিচে নেমে যাচ্ছে। সে আর কোনো মানুষের চেহারা দেখতে পাচ্ছে না।

আমি যে চেয়ারটাতে বসেছি, ঠিক তার পাশ থেকে উচ্চস্বরে কে যেন বলে উঠলো,

─ ডাক্তার আর কোনো রোগী দেখতে পারবে না। তাঁর চোখও ধীরে ধীরে বুকের নিচে নেমে আসছে। তিনি কোনো মানুষের চেহারা দেখতে পাচ্ছেন না। শুধু পা দেখতে পাচ্ছেন।

০৩.

আজাদ সুমনাকে রাতে একটা চিরকুট দিয়েছে। সেখানে সে লিখেছে, আমরা দুজন মুখোমুখি হতে চাই।

নিজের প্রতি এক ধরণের অবিশ্বাস ও ঘৃণাবোধকে পরাজিত করেই শত্রুপক্ষের সঙ্গে মোলাকাত করতে হলো। এ বহুত রিস্কি কাজ। তবে মন যখন একবার কোনো কাজের প্রতি সচরাচর সায় দেয়, তখন ভেতর থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সাহস চলে আসে। সামনে পাথরের পাহাড় পড়লেও তা সরিয়ে এগিয়ে যাওয়া যায়। সুমনা এমন একটি সুযোগ ও সময়ের অপেক্ষায় ছিল হয়তো।

ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি আর তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ব্যাঙের ডাক, মৃদু শব্দ। অনেকদিন বৃষ্টি না হওয়াই রাস্তায় ধুলো-ময়লা পরিবেশ ও প্রকৃতির উপর দৈন্যদশার আস্তরণ ফেলেছিল। আজ বৃষ্টিজল ধুয়ে দিয়েছে চারিদিক। প্রকৃতি যেন হাসছে। বৃষ্টি থেকে সৃষ্টি হয়েছে কাদা। রিকসা ভাড়া ত্রিশ টাকা থেকে ষাট টাকা হয়ে গেল, শুধুমাত্র বৃষ্টির কারণে। আজ বৃষ্টির স্পর্শে প্রকৃতি মানুষের উপকার বেশি করলেও, নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষকে নাজেহাল অবস্থায় ফেলেছে। অপ্রত্যাশিত নাগরিক বৃষ্টি। নিম্নবিত্তের মানুষেরা সৃষ্টিকর্তা ছাড়া কারো কাছে বিচার নিয়ে যায় না। কারো কাছে হাত পাতে না। সেসব মানুষ ধীরে ধীরে মানুষের মনুষত্বকে জাগিয়ে তুলতে সাহায্য করে; ঠিক ইটের নিচে চাপাপড়া নবাঙ্কুরিত চারা গাছটির মতো।

সরষে ফুলের ডগায় মৌমাছি যে বিশ্বাস ও প্রেম নিয়ে বসে, মানুষ তার প্রেমিকার শরীরের উপর তার চেয়ে ভয়ংকর ভাবে বসে। সদ্য-জন্মানো কলির মধু ধুলো-ময়লার স্তূপের মধ্যে ফেলে চলে যায় নিজের ক্ষমতা দেখানোর জন্য। এই মানুষই অপর মানুষকে ঘৃণা করে। এই মানুষই মানুষের কাছে সাধু। মুখ ও মুখোশের আড়ালে আজাদের মতো মানুষ সমাজে হয়ে উঠছে বিশ্বাসী।

ভাবনার ছেদ পড়ল। পেছন থেকে কে যেন মার্জিত কণ্ঠে বলল,

─ আজাদ ভাই, আপনি এখানে ?

মেঘের ছায়ার মতো বিষণ্ণ মেঘ ছেয়ে ধরলো আজাদের রঙিন চেহারা, মুহূর্তে ফ্যাকাসে হয়ে গেল সে।

মনের ভেতর সাতপাঁচ একটা ভাবনা দলা পাকাতেই মৌ বলল,

─ জানেন, মিথিলার তো বাচ্চা হয়েছে। আপনি বাবা হয়ে একবারও খোঁজখবর নেননি। এরকম করাটা ঠিক হয়নি। এটা অবশ্যই অতি অমানবিক আচরণ। আপনি শিক্ষিত মানুষ। অথচ মিথিলার নামে কত মিথ্যে অপবাদ দিয়েছেন। সুমনার সঙ্গেও যে আচরণ করেছেন, সেটাও নিশ্চয়ই কোনো সভ্য মানুষের কাজ না। একজনকে আপনার ভালো লাগতেই পারে, তাই বলে তার সঙ্গে মিশে তাকে পিষে দেবেন এভাবে? কীভাবে পারেন আপনি?

পশ্চিম আকাশে সূর্য ক্রমান্বয়ে আত্মসমর্পণ করছে। তেমনি আজাদের মাথাও হেলে পড়তে লাগল।

ভ্যানিটিব্যাগ থেকে ফোন বের করে মিথিলাকে ফোন দিলো মৌ। আজাদের কথা বলতেই মিথিলা বলে উঠল, সে আমার কেউ না!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *