নারীমুক্তির তিন দিশারী: রামমোহন-বিদ্যাসাগর-রোকেয়া।। আলী রেজা
সুদীর্ঘকাল ধরে ভারতীয় হিন্দু সমাজে ধর্মীয় মর্যাদায় প্রচলিত ছিল বিধবা নারীর প্রতি অতি নৃশংস সতীদাহ প্রথা। স্বামী মৃত্যুবরণ করলে স্বামীর চিতায় স্ত্রীকেও একসাথে দাহ করে স্ত্রীর সতীত্ব অক্ষয় করে রাখার এক নির্মম প্রথাই সতীদাহ প্রথা। কুসংস্কারাচ্ছন্ন প্রাচীন ভারতীয় হিন্দু সমাজে এ প্রথা এতোটাই পালনীয় বিষয় ছিল যে কেউ এর বিরুদ্ধে কথা বলতে পারতো না, এমনকি রাষ্ট্রও সামাজিক চাপে এ প্রথা বন্ধের কোন কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারেনি। সর্বপ্রথম রাজা রামমোহন রায় (১৭৭২-১৮৩৩ খ্রি.) শাস্ত্রীয় ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের মাধ্যমে সতীদাহ প্রথার অসারতা প্রমাণ করলেন এবং আইনের মাধ্যমে এই মির্মম প্রথার অবসান ঘটালেন। ফলে বিধবা নারী ফিরে পেল প্রাণ। বিধবা নারী প্রাণে বেঁচে গেল বটে; কিন্তু সমাজে বিধবাবিবাহ নিষিদ্ধ থাকার ফলে সমাজে বিধবার সংখ্যা বাড়তে থাকলো। বালিকা বা যুবতী বয়সে বিধবা হয়ে যাওয়া এ সব নারীদের কোন সামাজিক মর্যাদা ছিল না। নানা বিধি-নিষেধ ও অনাদর-অবহেলার ফলে বিধবাদের জীবন হয়ে ওঠে যন্ত্রণাময়। এই যন্ত্রণাময় জীবন থেকে বিধবা নারীকে মুক্তি দিতে এলেন ঈশ^রচন্দ্র বিদ্যাসাগর (১৮২০-১৮৯১ খ্রি.)। বিধবা বিবাহের পক্ষে শাস্ত্রীয় বিধান উপস্থাপন করলেন সমাজের কাছে। রক্ষণশীল হিন্দু ও শাস্ত্রীয় পন্ডিতদের প্রবল বিরোধিতা সত্ত্বে ও বিদ্যাসাগর সফল হলেন। আইনের মাধ্যমেই বিধবাবিবাহ প্রচলিত হলো। বিধবা নারী ফিরে পেল তার যাপিত জীবন। বিদ্যাসাগর শুধু বিধবাবিবাহ নয়; বহুবিবাহ ও বাল্যবিবাহ’র বিরুদ্ধেও সামাজিক আন্দোলনে নামেন এবং সফল হন। সতীদাহ প্রথা বিলোপের মাধ্যমে প্রাণ ও বিধবা বিবাহ প্রবর্তনের মাধ্যমে স্বাভাবিক জীবন ফিরে পাওয়ার পর নারীদের শিক্ষা ও সামাজিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন দেখা দেয়। কারণ অশিক্ষার অন্ধকারে ডুবে থাকার ফলে নারীরা পুরুষের দাসীতে পরিণত হয়। অর্থনৈতিক স্বাধীনতা না থাকায় নারীরা সবদিক দিয়ে পুরুষের অধীনস্থ হয়ে পড়ে। নারীকে এই নির্ভরশীলতার অভিশাপ থেকে মুক্ত করে শিক্ষা ও অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের মাধ্যম সামাজিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করার সংগ্রামে আত্মনিয়োগ করেন মহীয়সী নারীবেগম রোকেয়া (১৮৮০-১৯৩২ খ্রি.)। রামমোহন নারীকে দিলেন প্রাণে বাঁচার অধিকার। বিদ্যাসাগর নারীকে দিলেন বৈধব্যের অভিশাপ থেকে মুক্ত হয়ে স্বাভাবিক জীবন যাপনের অধিকার। আর রোকেয়া নারীকে দিলেন শিক্ষা। দেখালেন অর্থনৈতিক মুক্তির পথ। নারীমুক্তির পথপরিক্রমায় এই তিন যুগরষ্টার সংগ্রামী অবদার বিশ্লেষণ করাই আলোচ্য প্রবন্ধের প্রধান লক্ষ্য পলাশীর যুদ্ধে (১৭৫৭) বাংলার নবাব সিরাজের পরাজয়ের মাধ্যমে বাংলায় কোম্পানি (ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি) আমল শুরু হয়। প্রাকৃতিক দুর্যোগে ফসলহানির সাথে কোম্পানির ক্রমবর্ধমান হারে খাজনা আদায়ের ফলে বাংলায় দুর্ভিক্ষ (ছিয়াত্তরের মন্বন্তর) দেখা দেয়। এই দুর্ভিক্ষের ধকল চলাকালে ১৭৭২ খ্রিস্টাব্দে (মতান্তরে ১৭৭৪ খ্রি.) হুগলি জেলার রাধানগর গ্রামের এক ব্রাহ্মণ পরিবারে রাজা রামমোহন রায় জন্মগ্রহণ করেন। রামমোহনের বংশীয় উপাধি ছিল বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু তাঁর পিতৃপুরুষ নবাব সরকারের কাজ করে ‘রায়’ উপাধি লাভ করেছিল। রামমোহন গৃহেই বাল্যশিক্ষা সমাপ্ত করেন। তারপর উপযুক্ত শিক্ষা লাভ করার জন্য পিতা রামকান্ত রায় তাঁকে পাটনায় পাঠান। পাটনায় গিয়ে স্বল্পকালেই রামমোহন আরবি ও ফারসি ভাষায় বিশেষ পারদর্শী হয়ে ওঠেন। পাটনায় অবস্থানকালে রামমোহন কুরআন ও মুসলিম সূফি দার্শনিকদের গ্রন্থাদিও গভীর মনোযোগের সাথে অধ্যয়ন করেন। আরবি-ফারসি ভাষা ও মুসলিম সূফিদর্শনে প্রভাবিত হওয়ার খবর পেয়ে পিতা রামকান্ত রায় অতিশয় দুঃখিত হন। পুত্রকে সংস্কৃত ভাষায় সুপন্ডিত করার উদ্দেশ্যে অতিসত্বর পাটনা থেকে ফিরিয়ে এনে কাশী পাঠিয়ে দেন। কাশীতে এসে রামমোহন সংস্কৃত ভাষা ও হিন্দুশাস্ত্রে গভীর ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন। একই সাথে তিনি বুঝতে পারেন ইসলামের একত্ববাদ ও বেদ-উপনিষদের ব্রহ্মবাদের মধ্যে স্বরূপত কোন পার্থক্য নেই। এই ধর্মবোধ থেকে রামমোহন হিন্দুধর্মের বহুত্ববাদী পৌত্তলিকতার অসারতা প্রমাণ করে একটি গ্রন্থ লিখেন। ফলে পিতা ও পুত্রের মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটে। রামমোহন গৃহত্যাগ করেন। গৃহত্যাগ করে রামমোহন হিন্দুধর্ম ও সমাজের সংস্কার সাধনে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন। পরবর্তী জীবনে তিনি তাঁর প্রতিজ্ঞায় অবিচল থেকে ধর্ম, সমাজ, শিক্ষা ও প্রচলিত আইন সংস্কারে আত্মনিয়োগ করেন। ধর্মসংস্কার করতে গিয়ে রামমোহন খ্রিস্টধর্মের যাজক, হিন্দুধর্মের শাস্ত্রজ্ঞ পন্ডিত ও ইসলাম ধর্মের মৌলবিদের রোষানলে পড়েন। সামাজিক সমর্থন এসব ধর্মব্যবসায়ী ও ধর্মান্ধদের পক্ষে থাকায় রামমোহন ধর্ম সংস্কারের পাশাপাশি সমাজ সংস্কারে মনোনিবেশ করলেন। যুক্তি ও বিচার-বিশ্লেষণের মাধ্যমে তিনি প্রচলিত সামাজিক কুসংস্কারের অসারতা প্রমাণ করলেন। তৎকালীন কুসংস্কারাচ্ছন্ন হিন্দু সমাজের নির্মম-নিষ্ঠুর প্রথা ছিল সতীদাহ প্রথা। পাশাপাশি ছিল জাতিভেদ, বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ। বিধবা নারীর প্রাণ বাঁচানোর জন্য রামমোহন প্রথমেই সতীদাহ প্রথার বিরুদ্ধে সর্বশক্তি নিয়োগ করলেন। রামমোহন উপলব্ধি করলেন যে, সতীদাহ কোন ধর্মীয় বিধান হতে পারে না। সতীদাহ আসলে ধর্মীয় আবরণে নারী নির্যাতনের এক সামাজিক অস্ত্র। এই চরম নির্যাতনের হাত থেকে নারীকে বাঁচাতে ইতোপূর্বে মনে-প্রাণে কেউ এগিয়ে আসেনি। যাঁরা আসতে চেয়েছেন তাঁরাও শাস্ত্রীয় শাসনের চাপে পড়ে সফল হতে পারেননি। রামমোহনের পূর্বে এই নিষ্ঠুর প্রথা নিবারণের জন্য এগিয়ে এসেছিলেন মোগল স্রমরাট আকবর। সম্রাট আকবর তাঁর প্রবর্তিত দীন-ই-ইলাহী’র মাধ্যমে এই নির্মম প্রথাটির অবসান ঘটাতে চেয়েছিলেন। সম্রাট জাহাঙ্গীর জরিমানা ধার্য করে প্রথাটি বিলুপ্ত করতে চেয়েছিলেন। আওরঙ্গজেবও চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু রক্ষণশীল শাস্ত্রজ্ঞ পন্ডিত ও গোঁড়া হিন্দুদের বিরোধিতার কারণে কেউ সফল হতে পারেননি। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি হিন্দুদের ধর্ম ও সামাজিক প্রথায় হস্তক্ষেপ করতে চায়নি। তাই বাধ্য হয়ে এই নিষ্ঠুর প্রথার ব্যাপারে নীরব থেকেছে। তারপর ভারতের গভর্নর জেনারেলগণ (লর্ড ওয়েলেসলি, লর্ড কর্নওয়ালিশ প্রমুখ) চেষ্টা করেছিলেন। শেষমেশ গর্ভবতী, ঋতুবতী, নাবালিকা ও শিশু সন্তানের মায়ের ক্ষেত্রে সতীদাহ প্রথা নিবারণ করতে পেরেছিলেন। কিন্তু গোঁড়া হিন্দুরা শাস্ত্রের দোহাই দিয়ে এবং স্বর্গে সাড়ে তিন কোটি বছর স্বামীর সাথে বিরতিহীন সহবাসের মিথ্যা ও কাল্পনিক প্রলোভন দেখিয়ে সতীদাহের পক্ষে অবস্থান নেন এবং ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে সরকারের কাছে আবেদন করে সব বিধবার ক্ষেত্রেই সতীদাহ প্রথা বলবৎ রাখার জোর দাবি করেন। রামমোহন বুঝতে পারেন যে, এ প্রথা বিলোপ করতে হলে শাস্ত্রশাসিত সমাজে শাস্ত্রীয় সমর্থন প্রমাণ করতে হবে। শাস্ত্রীয় সমর্থন প্রমাণিত হলে সামাজিক সমর্থন পাওয়া যাবে। তখন আইনের দ্বারাও এ প্রথা নিষিদ্ধ করা যাবে। কাজেই রামমোহন শাস্ত্রীয় ব্যাখ্যার দ্বারা সতীদাহ প্রথার অসারতা প্রমাণ করার জন্য পর পর দুটি গ্রন্থ লিখেন। প্রবর্ত্তক ও নিবর্ত্তকের সম্বাদ নামে গ্রন্থটি প্রকাশ করেন ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দের শেষের দিকে। গ্রন্থটি ইংরেজিতে অনুবাদ হলে ইংরেজ সরকারও বিষয়টি সম্পর্কে সচেতন হয়। প্রবর্তক ও নিবর্তকের সংলাপের মাধ্যমে বিষয়টি তুলে ধরেন রামমোহন। প্রবর্তক সতীদাহ’র পক্ষে শাস্ত্রের যুক্তিতে পরাজিত হয়ে পাপ ও নিন্দার কথা বলেছেন। সেখানেও সুবিধা করতে না পেরে প্রবর্তক আসল কারণ হিসেবে বলেছেন- ‘লৌকিক এক আশঙ্কা আছে যে, স্বামীর মৃত্যু হইলে স্ত্রী সহগমন না করিয়া বিধবা অবস্থায় রহিলে তাহার ব্যভিচারী হওয়ার সম্ভাবনা থকে। কিন্তু সহমরণ করিলে তাহার এ আশঙ্কা থাকে না, জ্ঞাতি-কুটুম্ব সকল নিঃশঙ্ক হইয়া থাকেন।’ সুতরাং দেখা গেল শাস্ত্রীয় বিধান নয়, লৌকিক আশঙ্কাই সতীদাহের মতো এতো বড় নৃশংসতার মূল কারণ। ১৮১৯ খ্রিস্টাব্দের শেষের দিকে রামমোহন প্রবর্ত্তক ও নিবর্ত্তকের দ্বিতীয় সংবাদ নামে দ্বিতীয় গ্রন্থটি প্রকাশ করেন। এখানেও তিনি শাস্ত্রীয় পন্ডিতদের যুক্তিতে পরাস্ত করে দেখান যে, সতীদাহ প্রথা একটি লোকাচার মাত্র; এটি শাস্ত্রের অবশ্য পালনীয় কোন বিধান নয়। বিকল্প বিধানও শাস্ত্রে আছে। এভাবে রামমোহন যখন সতীদাহ’র বিপক্ষে জনমত তৈরি করে চলেছেন তখন বাংলায় আসেন লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক। তিনি রামমোহনের সতীদাহ নিবারণ প্রচেষ্টার কথা আগে থেকেই জানতেন। তাই তিনি রামমোহনের সঙ্গে আলোচনায় বসেন। রামমোহনের যুক্তি ও বিচার-বিশ্লেষণ এবং সতীদাহের নৃশংসতার আবেগময় বর্ণনা বেন্টিঙ্ক- এর অন্তর স্পর্শ করে। বেন্টিঙ্ক আরও কয়েকজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তির সঙ্গে পরামর্শ করে এ নির্মম প্রথাটি বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেন। ১৮২৯ খ্রিস্টাব্দের ৪ ডিসেম্বর সতীদাহ প্রথা নিষিদ্ধ করে আইন পাস হয়। এভাবে বৌদ্ধিক আন্দোলনের মাধ্যমে রামমোহন বিধবা নারীর প্রাণ রক্ষা করেন। ভারতীয় হিন্দু সমাজ একটি নির্মম কুসংস্কার থেকে মুক্তি পায়। বিধবা নারীর প্রাণ রক্ষা করেই রামমোহন থেমে যাননি। নারীর জীবনে আরও দুটি অভিশাপ ছিল কৌলিন্য প্রথা ও বহুবিবাহ প্রথা। এ দুটি প্রথা যে সম্পূর্ণরূপে শাস্ত্রবিরুদ্ধ রামমোহন তা বলিষ্ঠ যুক্তির মাধ্যমে প্রমাণ করেন। রামমোহন বিশ্লেষণ করে দেখান যে, বহুবিবাহের বলি বিধবাদের জীবন যারপরনাই যন্ত্রণাময়। এরা স্বামীর উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত হন এবং দুর্বিষহ জীবন থেকে মুক্তি পেতে অনেকেই আত্মহত্যা করেন। এ অবস্থা থেকে মুক্তির জন্য প্রয়োজন নারীর অর্থনৈতিক অধিকার। অর্থনৈতিক অধিকার ছাড়া পুরুষশাসিত সমাজে নারী কোনভাবেই নিরাপদ নয়। রামমোহন প্রমাণ করেন যে নারীর অর্থনৈতিক অধিকার প্রাচীন হিন্দু সমাজে ছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে তা হরণ করা হয়। এ বিষয়টি প্রমাণের জন্য তিনি লিখেন হিন্দুদের উত্তরাধিকার আইন অনুসারে স্ত্রীলোকের প্রাচীন অধিকারসমূহের উপর হস্তক্ষেপ নামক গ্রন্থ। এ গ্রন্থে তিনি দেখান যে প্রাচীনকালে বিধবা স্ত্রীরা তাদের প্রয়াত স্বামীর সম্পত্তির উত্তরাধিকার হতেন। তারা পুত্রের সমান সম্পত্তিই পেতেন। কিন্তু পরবর্তীকালে শাস্ত্রীয় পন্ডিতরা এ বিধিটি বাতিল করে। সম্ভবত বহুবিবাহ প্রথায় বহু স্ত্রী থাকায় সবাইকে বঞ্চিত করাই সম্পত্তি রক্ষার অনুকূল হয়। তাই শাস্ত্রীয় পন্ডিতরা কৌলিন্য প্রথার স্বার্থ রক্ষা করতে গিয়ে বিধবা নারীকেই বঞ্চিত করে। অনুরূপভাবে প্রাচীন নিয়মে পিতার সম্পত্তিতে কন্যার অংশ থাকলেও পরবর্তী সময়ে কন্যাকেও বঞ্চিত করা হয়। রামমোহন সম্পত্তিতে নারীর এই উত্তরাধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা চালান। এই প্রচেষ্টার ধারাবাহিকতায় পিতা ও স্বামীর সম্পত্তিতে কন্যা ও স্ত্রীর অধিকার আইনগতভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। তাই দেখা যায় রামমোহন সতীদাহ প্রথা বিলোপের মাধ্যমে বিধবা নারীর প্রাণ রক্ষা করেই তার নারীমুক্তির সংগ্রাম শেষ করেননি। নারীর অর্থনৈতিক মুক্তির চিন্তাও করেছিলেন। লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো, এমন একটি সময় তিনি নারীমুক্তির আন্দোলনে নেমেছিলেন যখন নারীরা ধর্মীয় ও সামাজিক কুসংস্কারের জালে আটকে থাকা নিজেদের নিয়তি বলে মেনে নিয়েছিল। ধর্মশাস্ত্রের অপব্যাখ্যা কিংবা খন্ডিত ব্যাখ্যার মাধ্যমে শাস্ত্রীয় পন্ডিতরা নারীমুক্তির সকল পথ বন্ধ করে দিয়েছিল। রক্ষণশীল হিন্দুরা ধর্মীয় গোঁড়ামিকে মেনে নিয়ে নারীদের সকল প্রকার সামাজিক ও মানবিক অধিকার কেড়ে নিয়েছিল। সামাজিক ধিক্কার ও ধর্মশাস্ত্রীয় অনুশাসনের ভয়ে কেউ নারীঅধিকার ও নারীমুক্তির কথা বলতো না। এমন প্রতিকূল সমাজব্যবস্থায় রামমোহন নারীমুক্তির বার্তা ঘোষণা করলেন। ধর্মশাস্ত্রের সঠিক ব্যাখ্যা তুলে ধরে তিনি ধর্মগুরুদের কোণঠাসা করলেন। ফলে নারী অধিকারের পক্ষে সামাজিক সমর্থন বাড়তে লাগলো। সতীদাহ প্রথা নিষিদ্ধ হওয়ার মাধ্যমে নারী যখন তার প্রাণ ফিরে পেল তখন তার অন্যান্য সামাজিক ও অর্থনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার পথও তৈরি হলো। রামমোহনের পর নারীর সামাজিক, অর্থনৈতিক ও মানবিক অধিকার প্রতিষ্ঠার পথ সুগম করতে আলোর মশাল নিয়ে হাজির হলেন বিদ্যাসাগর। বিদ্যাসাগর ১৮২০ খ্রিস্টাব্দে মেদিনীপুর জেলার বীরসিংহ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। সাধারণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করে তিনি অতি অসাধারণ হয়ে উঠেছিলেন। সকল ধর্মীয় ও সামাজিক অনুশাসনের উর্ধ্বে উঠে তিনি মানুষের কল্যাণে সমগ্র জীবন ব্যয় করেছেন। পিতা ঠাকুর দাস নিজে চেয়েছিলেন সংস্কৃত অধ্যয়ন করে পারিবারিক ঐতিহ্য অনুসারে চতুষ্পাঠী (শিক্ষা প্রতিষ্ঠান) পরিচালনা করে জীবন কাটাবেন। কিন্তু নানাবিধ কারণে তাঁর সে আকাক্সক্ষা পূর্ণ হয়নি। তিনি ছেলের মাধ্যমে সে আকাক্সক্ষা পূর্ণ করতে চাইলেন। ঈশ^রচন্দ্রের নিজের ইচ্ছা ছিল ইংরেজি শেখার। মাতৃকূলের এক আত্মীয় মধুসূদন বাচস্পতির পরামর্শে বিদ্যাসাগর সংস্কৃত কলেজে ভর্তি হয়ে সংস্কৃত ও ইংরেজি উভয় বিষয় শেখার সুযোগ পেলেন। মেধাবী ঈশ্বরচন্দ্র শিক্ষাজীবনের সকল স্তরেই মেধাবৃত্তি লাভ করেছেন। সকল বিষয়ে সর্বোচ্চ মেধা ও ধীশক্তি প্রদর্শনের স্বীকৃতি স্বরূপ সংস্কৃত কলেজ তাঁকে বিদ্যাসাগর’ উপাধিতে ভূষিত করে। বিদ্যাসাগরের প্রাতিষ্ঠানিক কর্মজীবন শুরু হয় ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে ( ২৯ ডিসেম্বর ১৮৪১ খ্রিস্টাব্দ) এবং শেষ হয় সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করার মাধ্যমে। অধ্যক্ষ হিসেবে বিদ্যাসাগর সকল ধর্ম-বর্ণের ছাত্রদের জন্য সংস্কৃত কলেজের দ্বার উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন এবং বন্ধ হয়ে যাওয়া ইংরেজি বিভাগ পুনরায় চালু করেছিলেন। কর্তৃপক্ষের সাথে মতানৈক্যের ফলে ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ ও স্কুল পরিদর্শক- এই উভয় পদ থেকে পদত্যাগ করেন। প্রকৃতপক্ষে তাঁকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়। এভাবেই তাঁর সরকারি চাকরি জীবনের অবসান ঘটে। নারীমুক্তির ক্ষেত্রে বিদ্যাসাগর রামমোহনের যোগ্য উত্তরসূরি। সতীদাহ উচ্ছেদের মাধ্যমে রামমোহন বিধবা নারীর প্রাণ বাঁচিয়েছিলেন। কিন্তু প্রাণে বাঁচলেও বিধবা নারী স্বাভাবিক জীবনযাপন থেকে ছিল বঞ্চিত। নানা বিধি-নিষেধ আর সামাজিক অবহেলার অন্তরালে বিধবার জীবন ছিল বিপন্ন। সতীদাহ প্রথা উচ্ছেদের ফলে বিধবার সংখ্যাও বাড়তেছিল দ্রুত। কৌলিন্য প্রথার কারণে একজন কুলিন ব্রাহ্মণ অনেকগুলো বিয়ে করতো। অতি বৃদ্ধ বয়সেও যুবতী মেয়েদের বিয়ে করতো কুলিন ব্রাহ্মণরা। কন্যাদায়গ্রস্ত পিতারা বাধ্য হয়ে এ বিয়ে মেনে নিতেন। ফলে একজন কুলিন ব্রাহ্মণ মারা যাওয়ার পর তার সকল স্ত্রী একসাথে বিধবা হতো। সামাজিক কুসংস্কার ও ধর্মীয় অপব্যাখ্যার মাধ্যমে এই বিধবাদের পুনঃবিবাহ নিষিদ্ধ ছিল। বিধবা নারীর এই যন্ত্রণাময় জীবন থেকে মুক্তি দেওয়ার জন্য বিদ্যাসাগর বিধবাবিবাহ প্রবর্তনের আন্দোলনে নামেন। এই আন্দোলন সফল করার জন্য বিদ্যাসাগরকেও শাস্ত্রীয় সমর্থনের পথ অনুসন্ধান করতে হয়। কারণ তখনও শাস্ত্রীয় শাসনে সমাজ পরিচালিত হতো। আর ধর্মাশ্রিত সামাজিক প্রথার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে গেলে ধর্মশাস্ত্রের সমর্থন নিয়েই হাজির হতে হয়। নারীর মানবিক ও সামাজিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠার যে সংগ্রাম রামোহন শুরু করেছিলেন বিদ্যাসাগর তা অনেক দূর এগিয়ে নেন। বিদ্যাসাগর প্রথমেই বিধবা নারীর সামাজিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় মনোনিবেশ করেন। বিদ্যাসাগর উপলব্ধি করেন যে বৈধব্যের অবসানই হতে পারে এর একমাত্র সমাধান। তাই বিধবাবিবাহ প্রবর্তন করে সমাজে তাদের যথাযোগ্য মর্যাদা প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে ব্রতী হন বিদ্যাসাগর। বিদ্যাসাগরের পূর্বে ১৭৬৯ খ্রিস্টাব্দে রাজা রাজবল্লভ তাঁর বিধবা কন্যার বিয়ের ব্যাপারে শাস্ত্রীয় পÐিতদের অনুকূল মত সংগ্রহ করেছিলেন। পন্ডিতগণ মত প্রকাশ করেছিলেন যে, অক্ষত যোনি বিধবাদের পুনর্বিবাহে হিন্দুশাস্ত্রে কোন নিষেধ নেই। কিন্তু নবদ্বীপের রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের চক্রান্তে রাজবল্লভ সফল হতে পারেননি। ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত রামমোহনের ‘আত্মীয় সভা’র সদস্যরাও বিধবাবিবাহের পক্ষে নিয়মিত আলোচনা ও তর্কবিতর্ক করে ব্যর্থ হন। বিদ্যাসাগরের বিধবাবিবাহ বিষয়ক পুস্তিকা প্রকাশের ২০ বছর পূর্বে মধ্যপ্রদেশের জনৈক ব্রাহ্মণ বিধবাবিবাহের পক্ষে আন্দোলন করেছিলেন। তিনিও সফল হতে পারেননি। ১৮৩৭-৩৮ খ্রিস্টাব্দে ভারতীয় আইন কমিশন বিধবাবিবাহের পক্ষে আইন প্রণয়নের জন্য মতামত জানতে কলকাতা, মাদ্রাজ, এলাহাবাদ প্রভৃতি অঞ্চলের সদর আদালতের বিচারকদের কাছে চিঠি পাঠায়। চিঠির উত্তরে বিচারকগণ বিধবাবিবাহের পক্ষেই মত প্রদান করেন। কিন্তু এ জাতীয় আইন পাস করা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পক্ষে বিপদ হতে পারে আশঙ্কায় এ বিষয়ে আইন না করার পরামর্শ দেন। ফলে বিষয়টি সাফল্যের মুখ দেখেনি। ১৮৪২ খ্রিস্টাব্দ হতে ডিরোজিও’র শিষ্যগণ বেঙ্গল স্পেকটেটর পত্রিকার মাধ্যমে কয়েক মাস ধরে বিধবাবিবাহের বৈধতা বিষয়ে বিচার-বিশ্লেষণ চালিয়েছিলেন। যে পরাশর বচনের উপর ভিত্তি করে বিদ্যাসাগর শাস্ত্রীয় পন্ডিতদের সহিত তর্কযুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিলেন তা সর্বপ্রথম উক্ত পত্রিকায়ই উদ্ধৃত করা হয়েছিল। ১৮৫০-৫১ খ্রিস্টাব্দে কৃষ্ণনগরের মহারাজা শ্রীশচন্দ্র ব্রাহ্মসমাজ প্রতিষ্ঠা করে সেখানে নবদ্বীপের পন্ডিতদের দিয়ে বিধবাবিবাহ শাস্ত্রানুমোদিত করার প্রাণপণ চেষ্টা করেন। কিন্তু বিরুদ্ধবাদীদের চক্রান্তে সে চেষ্টা ব্যর্থ হয়। ১০ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দের সংবাদ প্রভাকর পত্রিকা মারফৎ জানা যায় যে, কলকাতার প্রসিদ্ধ ধনাঢ্য মতিলাল শীল বিধবাবিবাহ প্রচলনের চেষ্টা করেছিলেন। এর জন্য তিনি বহু অর্থ ব্যয় করতেও প্রস্তুত ছিলেন। কিন্তু সফল হতে পারেননি। এসব ঘটনাবলি বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়, তৎকালীন সমাজমানস বিধবাবিবাহের পক্ষেই ছিল। শাস্ত্রীয় পন্ডিতদের একাংশও অনুকূল ছিলেন। কিন্তু প্রধান বাধা ছিল লোকাচার বা দেশাচার। আইনের মাধ্যমে বিধবাবিবাহ প্রবর্তনের ক্ষেত্রে এ লোকাচার রক্ষাকারী রক্ষণশীল গোঁড়া হিন্দুদের বিরোধিতা ছিল চরম। আার এই বিরুদ্ধবাদীরা সামাজিকভাবে প্রভাবশালী ছিলেন। এই সামাজিক পরিস্থিতিতে বিদ্যাসাগর বিধবাবিবাহ প্রবর্তনের ব্রত নিয়ে সামাজিক আন্দোলনে নামেন। বিরুদ্ধবাদী গোঁড়া হিন্দু ও পন্ডিতদের শাস্ত্রীয় যুক্তি খন্ডনের জন্য বিদ্যাসাগর রচনা করেন বিধবাবিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কি-না এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব (জানুয়ারি ১৯৫৫) প্রয়োজনীয়তা ও বিধবাবিবাহ প্রচলিত না থাকায় যে নানা অনিষ্ট ঘটে তা নির্দেশ করেন। বিধবাবিবাহের পক্ষে শাস্ত্রীয় যুক্তি উপস্থাপন করতে গিয়ে বিদ্যাসাগর স্মৃতিশাস্ত্রের অন্যতম প্রণেতা পরাশরের মত উল্লেখ করেন। পরাশরের মতে, স্বামী নিরুদ্দেশ হলে, মারা গেলে, ক্লীব হলে, সংসারত্যাগী হলে কিংবা পতিত হলে স্ত্রীরা পুনর্বার বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারেন। শাস্ত্রীয় যুক্তি গ্রহণ-বর্জনের নীতি প্রসঙ্গে বিদ্যাসাগর বেদব্যাসের বক্তব্য উদ্ধৃত করে বলেন- বেদ, স্মৃতি ও পুরাণশাস্ত্র পরস্পরে বিরোধ হলে বেদকে অনুসরণ করাই শ্রেয়। আর স্মৃতি ও পুরাণশাস্ত্র পরস্পরে বিরোধ হলে স্মৃতিকেই অনুসরণ করতে হবে। মনুসংহিতা’র বক্তব্যের উদ্ধৃতি দিয়ে বিদ্যাসাগর এটাও প্রমাণ করেন যে, এক যুগের ধর্ম অন্য যুগে প্রযুক্ত নয়। এ ব্যাপারে পরাশর সংহিতায় বলা হয়েছে, মনুসংহিতায় নিরূপিত ধর্ম সত্যযুগের ধর্ম। আর পরাশর নিরূপিত ধর্ম কলিযুগের ধর্ম। এ থেকে বিদ্যাসাগর সিদ্ধান্ত করেন যে, কলিযুগে পরাশর শাস্ত্রই প্রধান। পরাশর সংহিতায় যেহেতু পূর্বোক্ত পাঁচটি অবস্থায় বিধবার পুনর্বিবাহের নির্দেশ রয়েছে তাই কলিযুগে বিধবার পুনর্বিবাহ সম্পূর্ণ শাস্ত্রানুমোদিত। পরাশর সংহিতার শাস্ত্রীয় যুক্তির মাধ্যমে বিধবাবিবাহ শাস্ত্রানুমোদিত প্রমাণ করার পর বিদ্যাসাগর বিরুদ্ধবাদীদের শাস্ত্রীয় ব্যাখ্যার অসারতাও প্রমাণ করেন। তারপরও বাধা হয়ে দাঁড়ায় লোকাচার, দেশাচার বা শিষ্টাচার। বিদ্যাসাগর দেখান যে, যেখানে শাস্ত্র অনুমোদন দেয় সেখানে লোকাচার বা শিষ্টাচারের কথা বলে তা অকর্তব্য কর্মরূপে আখ্যায়িত করা বিচারসিদ্ধ নয়। তাই কলিযুগে লোকাচার বিধবাবিবাহের বাধা হতে পারে না। বিদ্যাসাগরের এই পুস্তিকাটি প্রকাশিত হওয়ার পর তা ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। অনেক অপ্রত্যাশিত স্থান থেকেও বিদ্যাসাগর সমর্থন পেতে থাকেন। কিন্তু বিরুদ্ধবাদী শাস্ত্রব্যবসায়ী ব্রাহ্মণ পন্ডিতগণ বিদ্যাসাগরের শাস্ত্রীয় যুক্তি খন্ডনের জন্য উঠেপড়ে লাগেন। অনেকে পাল্টা গ্রন্থ রচনা করে বিধবাবিবাহের বিপক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করেন। বিদ্যাসাগর প্রদত্ত পরাশর সংহিতার বিধানটি বাগদত্তা কন্যার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য, বিধবা নারীর ক্ষেত্রে নয় বলে অনেকে যুক্তি দেন। কিন্তু ওসব হাস্যকর যুক্তি গোঁড়া রক্ষণশীলগোষ্ঠী ছাড়া কেউ গ্রহণ করেনি। তবু বিরুদ্ধবাদীদের সমালোচনার উত্তরে বিদ্যাসাগর বৃহৎ কলেবরে প্রকাশ করেন বিধবাবিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কি-না এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব, দ্বিতীয় পুস্তক (অক্টোবর ১৮৫৫)। এ পুস্তকে বিদ্যাসাগর গোঁড়া রক্ষণশীলদের দুর্বল শাস্ত্রীয় যুক্তি খন্ডন করে বিধবাবিবাহের পক্ষে তাঁর বক্তব্য আরও জোরালোভাবে তুলে ধরেন। তিনি যুক্তি দিয়ে আবারও দেখান যে, পরাশরের পূর্বোক্ত বিবাহবিধি বাগদত্তার ক্ষেত্রে নয়, বিধবার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। দেশাচার বা শিষ্টাচার সম্পর্কে বিরুদ্ধবাদীদের বক্তব্যের অসারতা যুক্তির মাধ্যমে প্রমাণ করেও মানবিক আবেদনের অস্ত্রও প্রয়োগ করেন। তিনি বলেন, দেশাচার বা লোকাচার কোন ধর্মীয় বিধি-ব্যবস্থা নয়। তাই দেশাচারের কথা বলে বিধবাদের বৈধব্য যন্ত্রণায় দ্বগ্ধ করা অমানবিক। বিধবাদের পক্ষে বিদ্যাসাগরের এই মানবিক আবেদন দেশবাসীর বিবেকবোধকে জাগ্রত হরে। তিনি শাস্ত্রীয় যুক্তির সাথে মানবিক আবেদনের সমন্বয় ঘটিয়ে বিধবাবিবাহের জন্য আইন পাস করতে সচেষ্ট হন। এ লক্ষ্যে বিদ্যাসাগর ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবর ৯৮৬ জন ব্যক্তির স্বাক্ষরসহ একটি আবেদন ভারত সরকারের কাছে পেশ করেন। ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল থেকেও সরকারের কাছে অনুরূপ আবেদন আসতে থাকে। এ সব আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দের ১৭ নভেম্বর বিধবাবিবাহের পক্ষে আইন পরিষদের অন্যতম সদস্য জে. পি গ্রান্ট একটি আইনের খসড়া আইন পরিষদে উত্থাপন করেন। ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দের ৯ জানুয়ারি খসড়াটি দ্বিতীয় বার উত্থাপিত হলে তা বিবেচনার জন্য সিলেক্ট কমিটিতে প্রেরিত হয়। এদিকে বিধবাবিবাহ আইনসিদ্ধ না করার জন্য রক্ষণশীল গোঁড়াপন্থী বিরুদ্ধবাদীর দল রাজা রাধাকান্ত দেবের নেতৃত্বে ৩৩০০০ স্বাক্ষরসহ একটি আবেদন সরকারের কাছে পেশ করে ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দের ১৭ মার্চ। ভারতের অন্যান্য অঞ্চল থেকেও বিধবাবিবাহের বিপক্ষে আবেদন আসতে থাকে। এভাবে বিধবাবিবাহ আইন প্রণয়নের পক্ষে-বিপক্ষে জনমত সংগঠিত হতে থাকে। অবশেষে সিলেক্ট কমিটি গ্রান্ট সাহেবের খসড়া অনুমোদন করে এবং ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দের ২৬ জুলাই সম্ভাব্য সকল প্রতিবন্ধকতা দূর করে বিধবাবিবাহ আইন পাস হয়। এভাবেই অনেক ত্যাগ- তিতিক্ষা, যুক্তি-বিচার, শাস্ত্রীয় প্রমাণ ও মানবিক আবেদন-নিবেদনের মাধ্যমে বিদ্যাসাগরের প্রচেষ্টা সফল হয়। বিধবা নারী পায় তার স্বাভাবিক জীবন নিয়ে বাঁচার অধিকার। এ ব্যাপারে বিদ্যাসাগর তাঁর অনুজ শ্রীশম্ভুচন্দ্র বিদ্যারত্নের কাছে লেখা এক চিঠিতে বলেন- ‘বিধবাবিবাহ প্রবর্তন আমার জীবনের সর্বপ্রধান সৎকর্ম্ম। এ জন্মে যে ইহা অপেক্ষা অধিকতর আর কোন সৎকর্ম্ম করিতে পারিব, তাহার সম্ভাবনা নাই।’ বিধবাবিবাহ প্রবর্তনের ফলে বিধবা নারী স্বাভাবিক জীবন ফিরে পেলেও নারীমুক্তি অধরাই রয়ে গেল। সতীদাহ প্রথা নিবারণের ফলে সমাজে বিধবার সংখ্যা বেড়ে গিয়ে বিধবা সমস্যার সৃষ্টি হয়েছিল। অনুরূপভাবে বিধবাবিবাহ প্রবর্তনের ফলে সমাজে বহুবিবাহ সমস্যার সৃষ্টি হয়। বিধবাবিবাহ আইন পাস হওয়ার ফলে একদল অর্থলোভী অর্থের লোভে কারণে-অকারণে বিধবাবিবাহ করতে আরম্ভ করে। এতে বহুবিবাহ নামক প্রচলিত সমস্যাটি আরও প্রকট হয়। কুলীন ব্রাহ্মণদের মধ্যে এমনিতেই বহুবিবাহ প্রচলিত ছিল। বিধবাবিবাহ আইনসিদ্ধ হওয়ার ফলে তা আরও বৃদ্ধি পায়। বিদ্যাসাগর নারীমুক্তির জন্য এই সামাজিক সমস্যাটিও উচ্ছেদ করতে মনোযোগী হন। এ বিষয়ে তিনি ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দের ১০ আগস্ট প্রকাশ করেন বহুবিবাহ রহিত হওয়া উচিত কি-না এতদ্বিষয়ক বিচার, প্রথম পুস্তক। এ পুস্তক প্রকাশের পর এ ব্যাপারেও গোঁড়া হিন্দু, রক্ষণশীল কুলীনগোষ্ঠী ও শাস্ত্রীয় পন্ডিতদের বিরোধিতা প্রবল হয়। বিদ্যাসাগর আবারও শাস্ত্রীয় ব্যাখ্যা, যুক্তি-বিচার ও মানবিক আবেদনের মাধ্যমে সমাজমানসকে নিজের অনুকূলে আনার চেষ্টা করেন। বিরুদ্ধবাদী পন্ডিতদের বক্তব্য খন্ডনের জন্য ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাসে প্রকাশ করেন বহুবিবাহ রহিত হওয়া উচিত কি-না এতদ্বিষয়ক বিচার, দ্বিতীয় পুস্তক। এ পুস্তকেও বিদ্যাসাগর পন্ডিতদের শাস্ত্রীয় যুক্তির অসারতা প্রমাণ করেন এবং বহুবিবাহের বিপক্ষে জনমত গঠনে সক্ষম হন। বিদ্যাসাগর তৎকালীন সমাজে প্রচলিত বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধেও বৌদ্ধিক আন্দোলনে নেমেছিলেন। এভাবে বিদ্যাসাগর শাস্ত্রীয় ব্যাখ্যা, যুক্তি-বিচার ও মানবিক আবেদনের সমন্বয়ে বিধবাবিবাহ প্রবর্তন এবং বহুবিবাহ ও বাল্যবিবাহ নিরোধে সর্বোচ্চ অবদান রাখেন। সংস্কারের জন্য সংস্কার নয়; মানুষের কল্যাণের জন্যই সংস্কার আন্দোলনে আত্মনিয়োগ করেছিলেন বিদ্যাসাগর। নারীর যথাযোগ্য সামাজিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করে তাকে যুগযন্ত্রণার হাত থেকে মুক্ত করাই ছিল তাঁর প্রধান লক্ষ্য। বিদ্যাসাগরের প্রচেষ্টায় নারীরা ন্যায়সঙ্গত সামাজিক অধিকার লাভ করে। কিন্তু নারীরা সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠা লাভ না করলে প্রকৃত নারীমুক্তি সম্ভব নয়। নারীদের পপি্ষ্ঠা লাভ করতে হবে সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে। আর এ জন্য প্রয়োজন নারীশিক্ষা। নারীমুক্তির জন্য নারীশিক্ষার ব্রত নিয়ে বৌদ্ধিক আন্দোলনে নামলেন নারীজাগরণের অগ্রদূত মহীয়সী নারী বেগম রোকেয়া (১৮৮০-১৯৩২ খ্রি.)। রামমোহন সতীদাহ প্রথা উচ্ছেদের মাধ্যমে নারীর প্রাণ রক্ষা করেন। বিদ্যাসাগর বিধবাবিবাহ প্রবর্তনের মাধমে নারীদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনেন। আর রোকেয়া নারীশিক্ষার মাধ্যমে নারীদের সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করার সংগ্রামে আত্মনিয়োগ করেন। রোকেয়া ছিলেন রক্ষণশীল জমিদার পরিবারের মেয়ে। সাড়ে তিনশত বিঘা জমির মাঝখানে ছিল তাঁদের বৃহৎ বাগানবাড়ি। এই বাগানবাড়িতে পরমসুখেই কেটেছিল রোকেয়ার শৈশব। রোকেয়ার শৈশব মানে উনিশ শতকের শেষভাগ। তখন মুসলমান নারীদের সামান্য আরবি-ফারসি শেখার সুযোগ থাকলেও বাংলা ও ইংরেজি শিক্ষা ছিল নিষিদ্ধ। রোকেয়ার রক্ষণশীল জমিদার পিতাও ছিলেন মেয়েদের বাংলা ও ইংরেজি শিক্ষার ঘোর বিরোধী। এই প্রতিকূল পারিবারিক পরিবেশে রোকেয়া গভীর রাতে গোপনে বাংলা ও ইংরেজি শেখা শুরু করেন। এ ব্যাপারে সহযোগিতা করেন প্রগতিশীল বড় ভাই ইবরাহীম সাবের ও বড়বোন করিমুন্নেসা। এই হলো রোকেয়ার জীবনের প্রথম অধ্যায়। ১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দে রোকেয়ার বিয়ে হয় ভাগলপুরের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট বিপন্তীক সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে। সাখাওয়াত হোসেনের অনুপ্রেরণায় রোকেয়ার লেখিকা হিসেবে আত্মপ্রকাশ ঘটে। রোকেয়ার প্রথম প্রকাশিত প্রবন্ধ ‘পিপাসা’ (নবপ্রভা, ফাল্গুন ১৩০৮), ইংরেজি ভাষায় লিখিত সুলতানার স্বপ্ন (লিখিত : ১৯০৫, গ্রন্থাকারে প্রকাশিত : ১৯০৮) ও মতিচূর (প্রথম খন্ড : ১৯০৫) স্বামীর জীবিতাবস্থায়ই প্রকাশিত হয়। রোকেয়া এই অনুকূল পরিবেশ (যদিও পারিবারিক পরিবেশ সবদিক দিয়ে অনুকূল ছিল না। অসুস্থ স্বামীর সেবা, দুটি সন্তানের জন্মদান ও তাদের অকালমৃত্যুর শোক নিয়েই কেটেছিল রোকেয়ার সংসার জীবন) বেশি দিন পাননি। স্বামী মৃত্যুবরণ করেন ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দের ৩ মে। আমরা বলতে পারি এভাবেই শেষ হয় রোকেয়ার জীবনের দ্বিতীয় অধ্যায়। কঠোর আত্মপ্রত্যয়ী রোকেয়া স্বামীর মৃত্যুর শোককে শক্তিতে পরিণত করে নারীশিক্ষায় আত্মনিয়োগ করেন। ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দেই স্বামীর নামে ভাগলপুরে প্রতিষ্ঠা করেন সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল। ঐ সময় মেয়েদের জন্য স্কুল প্রতিষ্ঠা সহজ কাজ ছিল না। বাড়ি বাড়ি ঘুরে ছাত্রী সংগ্রহ করতে হতো। অভিভাবকরা তাদের মেয়েদের স্কুলে পাঠাতে আগ্রহী ছিল না। তবু চলছিল রোকেয়ার স্কুল প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম। কিন্তু এ সময় দেখা দেয় আর এক বিপত্তি। সম্পত্তির লোভে স্বামীর পূর্ব স্ত্রীর (সতীন) কন্যা ও জামাতার দুর্ব্যবহার ও অত্যাচার বাড়তে থাকে। ফলে বাধ্য হয়ে রোকেয়া ভাগলপুর ছেড়ে কলকাতায় চলে আসেন এবং সকল বাধাবিঘ্ন অতিক্রম করে, অসীম মানসিক শক্তি ও অদম্য সাহস নিয়ে আবার কলকাতায় স্থাপন করেন সাখাওয়াত মেমোরিয়াল বালিকা বিদ্যালয় (১৬ মার্চ ১৯১১)। একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো দীর্ঘ সময়েও রোকেয়া তাঁর স্কুলে বাঙালি ছাত্রী পাননি। স্কুলের ছাত্রী, শিক্ষয়িত্রী, পরিচারিকা- সবাই উর্দুভাষী। ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত স্কুলে ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে ছাত্রী সংখ্যা যখন ১১৪ জন তখন তার মধ্যে বাঙালি ছাত্রী মাত্র দুই জন [ সূত্র : আবদুল মান্নান সৈয়দ, বেগম রোকেয়া, অবসর, ঢাকা, পৃ-২৪]। এ অবস্থায় বাঙালি নারীর ভবিষ্যৎ নির্মাণ করা যে কত কঠিন তা বলাই বাহুল্য। এই কঠিন কাজটিই করে গেছেন রোকেয়া তাঁর জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত। রোকেয়া উদ্দেশ্যবাদী বুদ্ধিজীবী, লেখিকা ও কর্মী। তাঁর সাহিত্য রচনার মূল উদ্দেশ্য হলো নারী জাগরণ। তাই রোকেয়াসাহিত্যের শিল্পমান বিচারের চেয়ে তাঁর লক্ষ্যের দিকেই পাঠকের দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে হয়। রামমোহন-বিদ্যাসাগরের লেখাও ছিল উদ্দেশ্যবাদী। তৎকালীন হিন্দুধর্ম ও সমাজের কুসংস্কারগুলো চিহ্নিত করে সেগুলো নিরোধ করার প্রচেষ্টা চালানো ছিল তাঁদের লেখালেখির মূল উদ্দেশ্য। রোকেয়ার উদ্দেশ্যও অভিন্ন। রোকেয়া শুধু মুসলিম মহিলা নন, তিনি মনে-প্রাণে খাঁটি বাঙালি ছিলেন। তবে মুসলিম সমাজের পিছিয়ে পড়া নারীদের প্রতিই রোকেয়ার দৃষ্টি ছিল বেশি। কারণ রোকেয়াযুগে মুসলিম নারীদের শিক্ষার ব্যাপারে কোন সামাজিক প্রচেষ্টা ছিল না। এই অশিক্ষার সাথে যোগ হয়েছিল অবরোধ প্রথা। এই অবরোধ প্রথার বর্ণনা দিয়েছেন রোকেয়া তাঁর অবরোধবাসিনী গ্রন্থের ২৩ সংখ্যক ঘটনায় : মাত্র পাঁচ বছর বয়স হইতে আমাকে স্ত্রীলোকদের হইতেও পর্দা করিতে হইত। ছাই কিছুই বুঝিতাম না যে, কেন কাহারো সম্মুখে যাইতে নাই; অথচ পর্দা করিতে হইত। পুরুষদের তো অন্তঃপুরে যাইতে নিষেধ, সুতরাং তাহাদের অত্যাচার আমাকে সহিতে হয় নাই। কিন্তু মেয়ে মানুষের অবাধ গতি- অথচ তাহাদের দেখিতে না দেখিতে লুকাইতে হইবে। পাড়ার স্ত্রীলোকেরা হঠাৎ বেড়াইতে আসিত; অমনি বাড়ীর কোন লোক চক্ষুর ইশারা করিত, আমি যেন প্রাণভয়ে যত্রতত্র- কখনো… রান্নাঘরে ঝাঁপের অন্তরালে কখনও কোন চাকরাণীর গোল করিয়া জড়াইয়া রাখা পাটির অভ্যন্তরে,কখনও তক্তপোষের নীচে লুকাইতাম। … কোন সময় চক্ষের ইশারা বুঝিতে না পারিয়া দৈবাৎ না পলাইয়া যদি কাহারও সম্মুখীন হইতাম, তবে হিতৈষিণী মুরুব্বিগণ, ‘কলিকালের মেয়েরা কি বেহায়া, কেমন বেগয়রৎ’ ইত্যাদি বলিয়া গঞ্জনা দিতে কম করিতেন না। এই ছিল রোকেয়ার শৈশব। এই পরিবেশে বেড়ে উঠলেও রোকেয়া অন্তরালে থেকেই তাঁর জীবনবোধে পরিবর্তন নিয়ে আসেন এবং পরে সমাজচিন্তক হিসেবে কলম ধরেন। কর্মী হিসেবে স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথে নেমে পড়েন। কী ছিল রোকেয়ার স্বপ্ন? উত্তরে বলা যায়, শৈশব থেকে রোকেয়া একটি স্বপ্নই লালন করতেন। আর সে স্বপ্ন হলো নারীজাগরণ, নারীমুক্তি। আধুনিক শিক্ষার মাধ্যমে নারীকে পুরুষের মতো সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে যোগ্য করে গড়ে তুলে নারীমুক্তির পথ সুগম করা। ভারতে মুসলিম শাসনামলে রাজভাষা ছিল ফারসি। ব্রিটিশ আমলে রাজভাষা হয় ইংরেজি। ইংরেজি না শিখে মুসলমানরা পিছিয়ে পড়ে। হিন্দুরা এগিয়ে যায়। নবাব আবদুল লতিফ (১৮২৮-১৮৯৩ খ্রি.), সৈয়দ আমীর আলী (১৮৪৯-১৯২৮ খ্রি.) প্রমুখ মুসলিম সংস্কারকগণ বাঙালি মুসলমান সমাজের মধ্যে আধুনিক শিক্ষা বিস্তারের চেষ্টা করেন। কিন্তু তাঁরা মুসলিম সমাজের বৃহত্তর অংশের সহযোগিতা না পেয়ে কাক্সিক্ষত লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হন। আবদুল লতিফ, আমীর আলী প্রমুখ সংস্কারকগণ অভিজাত মুসলমানদের একটি ক্ষুদ্র অংশকেই প্রভাবিত করতে পেরেছিলেন। বৃহত্তর বাঙালি মুসলমান সমাজে তেমন চাঞ্চল্য সৃষ্টি করতে পারেননি, যেমন করতে পেরেছিলেন রামমোহন ও বিদ্যাসাগর। কারণ তাঁরা চৈতন্যের দিক থেকেও ছিলেন শাসক ইংরেজের সমগোত্রীয়। ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বরে মুসলিম লীগ গঠনের মাধ্যমে শাসক ইংরেজের সঙ্গে মুসলিম সম্প্রদায়ের রাজনৈতিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এ সময় ইংরেজি ভাষায় রোকেয়ার সুলতানার স্বপ্ন প্রকাশিত হয় (১৯০৮)। সুলতানার স্বপ্নেই রোকেয়া পুরুষশাসিত সমাজের বিরুদ্ধে নারীর প্রতিবাদ, পুরুষের বিরুদ্ধে নারীর প্রতিশোধের চিত্র তুলে ধরেন। এখানে রোকেয়া শুধু নারীবাদী নন; বিদ্রোহীও। সুলতানার স্বপ্ন প্রথম পড়েছিলেন তাঁর ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট স্বামী। পড়েই বলে উঠেছিলেন অ ঃবৎৎরনষব ৎবাবহমব. এই প্রতিশোধের স্পৃহা বুকে নিয়েই রোকেয়া নারীজাগরণের ডালপালা বিস্তার করেন। সুলতানার ‘নারীস্থান’ রোকেয়ার মানসপৃথিবী। রোকেয়া সেখানে নারীদের প্রতিষ্ঠিত করেছেন পুরুষের সমকক্ষ করে। পুরুষের চেয়েও বেশি করে। ‘নারী যাহা দশ বছরে করিতে পারে, পুরুষ তাহা শতবর্ষেও করিতে অক্ষম’- এ রকম তীব্র বাক্যও আছে সুলতানার স্বপ্নে। পদ্মরাগে রোকেয়া আরও বিদ্রোহী। তারিণী ভবনের প্রতিষ্ঠাতা দীনতারিনী দেবীর কাছে সিদ্দিকা তার স্বামীর উদ্দেশ্যে বলে, ‘তোমরা পদাঘাত করিবে আর আমরা তোমাদের পদলেহন করিব, সেদিন আর নাই’ তখন কাজী নজরুল ইসলামের কথা মনে পড়ে। নজরুল একই কথা বলেছেন ‘সেদিন হয়েছে বাসি/যেদিন পুরুষ দাস ছিল নাকো নারীরা আছিল দাসী।’ নারীর এই সুপ্তশক্তি স্বপ্ন নয়; বাস্তবে নিয়ে আসার মাধ্যমে নারীজাগরণ ও নারীমুক্তির প্রচেষ্টা চালান রোকেয়া। লিখেন অবরোধবাসিনী। অবরোধবাসিনী গ্রন্থকারে প্রকাশিত হয় ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে। মাঝখানে প্রকাশিত হয় মতিচূর- ২য় খন্ড (১৯২২) ও পদ্মরাগ উপন্যাস (১৯২৪)। সুলতানার স্বপ্নে যা ছিল কল্পনা, অবরোধবাসিনী ও পদ্মরাগে তাঁর বাস্তবরূপ দেওয়ার চেষ্টা চালান রোকেয়া। রোকেয়ার মতে, আমরা (নারী) সমাজেরই অর্ধঅঙ্গ। আমরা পড়িয়া থাকিলে সমাজ উঠিবে কিরূপে? কোন ব্যক্তির এক পা বাঁধিয়া রাখিলে, সে খোঁড়াইয়া খোঁড়াইয়া কতদূর চলিবে? পুরুষদের স্বার্থ আর আমাদের স্বার্থ ভিন্ন নহে- একই। তাঁহাদের জীবনের উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য যাহা, আমাদের লক্ষ্যও তাহাই। শিশুর জন্য পিতামাতা- উভয়েরই সমান দরকার। কি আধ্যাত্মিক জগতে, কি সাংসারিক জীবনের পথে- সর্বত্র আমরা যাহাতে তাঁহাদের পাশাপাশি চলিতে পারি, আমাদের এরূপ গুণের আবশ্যক (স্ত্রীজাতির অবনতি, মতিচূর- ১ম খন্ড)। এ গুণ অর্জনের জন্য শিক্ষার কোন বিকল্প নাই। তাই শিক্ষার উপর সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছেন রোকেয়া। এ শিক্ষা শুধু সামান্য ধর্ম বা নীতি শিক্ষা নয়; রোকেয়া চেয়েছেন সেই শিক্ষা ‘যাহা তাহাদিগকে (নারীদের) নাগরিক অধিকার লাভে সক্ষম করিবে, তাহাদিগকে আদর্শ কন্যা, আদর্শ ভগিনী, আদর্শ গৃহিণী এবং আদর্শ মাতারূপে গঠিত করিবে (সুবেহ সাদেক)। কিন্তু এই শিক্ষায় পিছিয়ে ছিল বাংলার নারী সমাজ। বিশে^ নারীজাগরণ ঘটলেও বাঙালি নারীর নিদ্রামগ্ন দশা দেখে রোকেয়া হতাশ হয়েছেন। তিনি সমাজচিন্তকের দৃষ্টিতে দেখেছেন- ‘ যৎকালে সমগ্র জগতের নারীজাতি জাগিয়ে উঠিয়াছে, তাহারা নানাবিধ সামাজিক অন্যায়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করিয়াছে- তাহারা শিক্ষামন্ত্রী হইয়াছে, তাহারা ডাক্তার, দার্শনিক, বৈজ্ঞানিক, যুদ্ধমন্ত্রী, প্রধান সেনাধ্যক্ষা, লেখিকা, কবি ইত্যাদি ইত্যাদি হইতেছে- আমরা বঙ্গনারী গৃহ-কারাগারে অন্ধকার স্যাঁতসেতে মেজেতে পড়িয়া অঘোরে ঘুমাইতেছি, আর যক্ষা রোগে ভুগিয়া হাজারে হাজারে মরিতেছি (সুবেহ সাদেক)। এই অবরোধবাসিনী নিদ্রামগ্ন বঙ্গনারীর জাগরণের জন্য রোকেয়া আমৃত্যু কর্মী হিসেবে কাজ করেছেন। নারীশিক্ষার সাথে যেহেতু তৎকালে ধর্মীয় অনুভূতি জড়িত ছিল তাই রোকেয়ার চিন্তায় ধর্মীয় ব্যাখ্যাও স্থান পেয়েছে। পদ্মরাগ উপন্যাসের নিবেদন অংশে রোকেয়া বলেন : ধর্ম একটি ত্রিতল অট্টালিকার ন্যায়। নীচের তলে অনেক কামরা, হিন্দু- ব্রাহ্মণ, শূদ্র ইত্যাদি বিভিন্ন শাখা; মুসলমান- শিয়া, সুন্নী, হানাফী, সাফী প্রভৃতি নানা সম্প্রদায়; এরূপ খ্রীস্টান, রোমান ক্যাথলিক, প্রোটেস্টান্ট ইত্যাদি। তাহার উপরে দ্বিতলে দেখ, কেবল মুসলমান- সবই মুসলমান; হিন্দু- সবই হিন্দু ইত্যাদি। তাহার উপরে ত্রিতলে উঠিয়া দেখ, একটি কক্ষ মাত্র, কামরা বিভাগ নাই, অর্থাৎ মুসলমান-হিন্দু কিছুই নাই- সকলে একপ্রকার মানুষ এবং উপাস্য কেবল এক আল্লাহ। রোকেয়া এখানে একত্ববাদের যে কথা বলেছেন তা রামমোহনের ধর্ম সমন্বয়ের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। রোকেয়ার এই সমন্বয়বাদী চিন্তা শুধু তাত্তি¡ক নয়; তারিণী ভবনের (পদ্মরাগ) শিক্ষাকার্যক্রমে রোকেয়া এই অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মনিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গিই প্রয়োগ করেছেন। তারিণী ভবন এমন একটি শিক্ষাকেন্দ্র যেখানে ব্রাহ্ম, হিন্দু, খ্রিস্টান, মুসলমানসহ সব ধর্মমতের নারীরা সহাবস্থান করে। তারিণী ভবনে বাংলা, ইংরেজি, আরবি, ফারসি, উর্দু শিক্ষাসহ বিজ্ঞান ও বৃত্তিমূলক আধুনিক শিক্ষারও ব্যবস্থা আছে। মূলত তারিণী ভবনের শিক্ষাই রোকেয়ার শিক্ষাদর্শন। রোকেয়ার মানসকন্যা সিদ্দিকা যখন বলেন ‘আমি আজীবন তারিণী- ভবনের সেবা করিয়া নারীজাতির কল্যাণসাধনের চেষ্টা করিব এবং অবরোধ প্রথার মূলোচ্ছেদ করিব’ তখন সেখানেই আমরা রোকেয়ার শিক্ষার মাধ্যমে নারীমুক্তির বীজমন্ত্রটি খুঁজে পাই। নারী জাগরণের এই অগ্রদূত রোকেয়ার ব্যক্তিজীবন কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। সংগ্রাম ও শোকে জর্জরিত ছিল তাঁর ব্যক্তিজীবন। মৃত্যুর আগের বছর (৩০ এপ্রিল ১৯৩১ খ্রি.) চাচাতো বোন মোহসেনা রহমানকে লিখিত এক চিঠিতে রোকেয়া বলেন : শৈশবে বাপের আদর পাইনি, বিবাহিত জীবনে কেবল স্বামীর রোগের সেবা করেছি। প্রত্যহ ঁৎরহব পরীক্ষা করেছি, পথ্য রেঁধেছি, ডাক্তারকে চিঠি লিখেছি। দুবার মা হয়েছিলুম- তাদেরও প্রাণভরে কোলে নিতে পারিনি। একজন ৫ মাস বয়সে, অপরজন চার মাস বয়সে চলে গেছে। আর এই ২২ বৎসর যাবৎ বৈধব্যের আগুনে পুড়ছি। শিক্ষা ও সমাজ সংস্কারের কথা বলতে গিয়ে রোকেয়াও গোঁড়া ধর্মান্ধ কাঠমোল্লাদের বিরাগভাজন হয়েছেন। অবরোধবাসিনী’র প্রবেশক অংশে রোকেয়ার আক্ষেপোক্তি : ‘জীবনের পঁচিশ বছর ধরিয়া সমাজসেবা করিয়া কাঠমোল্লাদের অভিসম্পাত কুড়াইয়াছি।’ এই হলেন মহীয়সী নারী বেগম রোকেয়া। রামমোহন যখন মারা যান তখন বিদ্যাসাগরের বয়স ১৩ বছর আর বিদ্যাসাগর যখন মারা যান তখন রোকেয়ার বয়স ১১ বছর। এই অসমবয়সী তিন সমাজদার্শনিকের চিন্তা ও কর্মের মধ্যে ছিল গভীর সাদৃশ্য। রামমোহন, বিদ্যাসাগর ও রোকেয়া- তিনজনের চৈতন্যেই আমরা খুঁজে পাই মানবকল্যাণের সুর। ধর্মান্ধ ও গোঁড়া সমাজের শাস্ত্রীয় পন্ডিতরা তিনজনকেই ক্ষত-বিক্ষত করেছে। নারীমুক্তির ক্ষেত্রে তিনজনই ছিলেন আপোষহীন। সমাজের ধিক্কার ও নিন্দাবাদ মাথায় নিয়েই তাঁরা লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে গেছেন। সতীদাহ প্রথা উচ্ছেদ করে রামমোহন নারীর প্রাণ রক্ষা করেছেন। ‘আত্মীয় সভা’ প্রতিষ্ঠা মাধ্যমে কন্যা বিক্রয় নিরোধ করেছেন। পিতা ও স্বামীর সম্পত্তিতে হিন্দু নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করেছেন। বিদ্যাসাগর বিধবাবিবাহ প্রবর্তন ও বহুবিবাহ-বাল্যবিবাহ নিরোধ করে নারীকে স্বাভাবিক জীবনে প্রতিষ্ঠা করার সংগ্রাম করেছেন। আর রোকেয়া নারীমুক্তি আন্দোলনের একজন পথিকৃত হিসেবে নারীশিক্ষার মাধ্যমে নারীমুক্তি ও নারীজাগরণের সংগ্রাম করেছেন। তাই এই তিন মানবতাবাদী সংস্কারক নারীমুক্তির দিশারী হিসেবে মানবজাতির নমস্য।
আলী রেজা
প্রবন্ধিক ও সাহিত্যচিন্তক
সেলফোন- ০১৭১২২০১৫৫৪