প্রবন্ধ।। ফারুক মাহমুদ-এর কবিতা প্রেম নিসর্গ-প্রকৃতি রোমান্টিকতার প্রতিচ্ছবি।। নাসির আহমেদ
রাত্রির কালো আঁধার খোপায় ফুটে থাকা বিষন্ন চাঁদ
পিছনে ফেলে অনেক কুয়াশার পথ পেরিয়ে
বাবা আমাকে তুলে দিয়ে গেলেন শহরমুখী ট্রেনের কামরায়
তার হৃদয়ে ঘন হয়ে ওঠা দীর্ঘশ্বাসগুলো মেখে নিয়ে
আমার বিষাদ মঞ্জুরিত হাতের মুঠোয় গুজে দিলেন
ঠিকানা কাঙ্খিত একফালি কাগজের মুখ।
সেই থেকে খুঁজছি জীবন আর মৃত্যুর ছায়াকে
একাকার করেও খুঁজে পাইনি আমি
জীবাণুমুক্ত একফোঁটা উপাদেয় জল, বিশুদ্ধ হাওয়া…
(ভুল দরজায়)
সত্তর দশকে স্বনামখ্যাত কবি ফারুক মাহমুদ এর প্রথম কাব্যগ্রন্থের এই কবিতাটির কথা মনে পড়ল তার শ্রেষ্ঠ কবিতার ভূমিকা পড়তে পড়তে। আসলে আমরা অনেকেই গ্রামবাংলার অমল সবুজ প্রকৃতির কোল থেকে ছিটকে পড়েছি দূষিত বাতাস-কবলিত ইট-কাঠের এই নগর-জঙ্গলে! ফারুক “শ্রেষ্ঠ কবিতা”র ভূমিকায় লিখছেন: আমি ভাষা আন্দোলনের সমান বয়সী,১৯৫২সালে আমার জন্ম।…১৬ ডিসেম্বর দেশ হানাদার মুক্ত হল, এর এক সপ্তাহের মধ্যে ঢাকায় চলে এলাম। তখনও বিধ্বস্ত সড়কপথ, রেলপথ চালু হয়নি। এসেছিলাম নৌকায় করে। কেন এলাম? উত্তরটা আমার অজানা নয়– কবিতা লিখব– তাই রাজধানীতে আসা। সেই থেকে আছি”।
কিন্তু কবিতার জন্য মায়ের স্নিগ্ধ কোল ছেড়ে, নিসর্গ সবুজ মমতার ঘ্রাণময় জন্মগ্রাম ছেড়ে এই যে ইট-কাঠের জঙ্গলে কবিতার প্রেমে পড়ে আটকে যাওয়া জীবন,সে-জীবনের হাহাকার “ভুল দরজা” কবিতায় ধ্বনিত! প্রথম কাব্যগ্রন্থ “পাথরের ফুল” থেকে সাম্প্রতিক কাব্যগ্রন্থ “দুই হৃদয়ের নদী” পর্যন্ত ফারুক মাহমুদ নিরন্তর অন্বেষণ করে যাচ্ছেন সেই অধরা মাধুরীকে, যার নাম কবিতা। কবিতার জন্যই অনিচ্ছুক এই বসবাস। কত অনুচ্চারিতদাহে দগ্ধ হচ্ছেন প্রতিনিয়ত! গ্রামজীবনের সহজ-সরল সৌন্দর্য খুঁজতে খুঁজতে কতযে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন এই কৃত্রিমতা কবলিত নগরজীবনে।শঠতা,প্রবন্চনা আর ক্লেদ-কালিমায় জর্জরিত নগর-জীবনে কখনো আপন সত্ত্বাকেই যেন তিনি বলে ফেলেন: সততা বাড়ি যাবে চলো। জ্যেৎস্না-ধোয়া মুগ্ধ দুয়ার তার জন্য পথ চেয়ে আছে সেই ফেলেআসা লোকজীবনে। যে কারণে তিনি বলতে বাধ্য হন: কালিঝুলি মাখা শতচ্ছিন্ন কাঁথা মুড়ি দিয়ে
রাতের উর্বর সময় পড়ে থাকো শিথিন ড্রেনের পাশে,
নিরন্ন থালা হাতে ঘোরো অনাবশ্যক দুয়ারে-দুয়ারে,
উচ্চতম করুন আছে তোমারে কাঙালপনা আমার আর ভালো লাগে না।…
( সততা, বাড়ি যাবে চলো)
“একটি অপ্রজনীয় গল্প” শিরোনামের কবিতাটি পড়ে মুগ্ধ হয়েছি নস্টালজিয়ার সহজ সৌন্দর্যে। একই গল্প দুজনের, একজন বৃক্ষের গল্প, প্রশ্নস্বর─এসব কবিতা পড়ে বুঝতে বাকি থাকে না ফারুক মাহমুদ নানান বিষযয়ে কবিতা লিখলেও তার কবিতার মূল সুর প্রেম আর রোমান্টিকতা। প্রথম দিকে যেমন সাম্প্রতিক কবিতাও ঐ চারিত্র লক্ষণ স্পষ্ট। “প্রত্যাবর্তন”ও “হারানো যায়নি তাকে” শিরোনামের কবিতা দুটির উল্লেখ করতে চাই:
ভালোবাসা ক্লান্ত হয়। শেষাবধি ছায়ামুখে ফিরে যায় ঘরে
ঘর মানে গ্রহ নয়, নিজেকে নিজের সঙ্গে ইচ্ছা চরাচরে
জ্বেলে রাখে অন্ধকার। তারপর বিস্তারিত মেঘের ছায়ায় শুক্লপক্ষ কৃষ্ণপক্ষ─ ফেরিঅলা থেকে থেকে কী যে ডেকে যায়
থাকে না ব্যাপক অর্থ।…
হারানো যায়নি তাকে কবিতার কয়েকটি ছড়ানোর যুদ্ধ করা যাক:
হারানো যায়নি তাকে, থেকে গেছে না থাকার পাশে
এমন বিষয় এঁকে বড় বেশি বেদনার মতো
যৌক্তিক সীমানা নেই, জন্ম-মৃত্যু সব একাকার
গাছের পাতার ফাঁকে আলোছায়া ছোট্ট করে হাসে…
দুটি কবিতার উদ্ধৃতিতে রোমান্টিকতার পাশাপাশি তার অক্ষরবৃত্তের সহজ প্রবহমানতা আর প্রকৃতি মানুষকে তার কিছুটা পরিচয় তুলে ধরা গেল তার কবিতার লিরিক প্রবণতা প্রশংসনীয় এসো হে জীবন শিরোনামের কবিতায় জীবন বিষয়ে দার্শনিকের মত উক্তি আছে শেষ দুটি চরনে কিন্তু তার পাশাপাশি ঝুলিয়ে দেয় না
হুহু মাঠ। নদীপাড়ে ভাঙা সেতু। পাশে একা গাছে
নুয়েপড়া ডাল। উড়ু উড়ু শাখা। ফুল ফুটে আছে
থাকতে পারে কারো কারো অসাফল্য বৃত্ত আহরণে
সেও কিন্তু পদ্য দেখে চাঁদ ওঠে আধপোড়া মনে…।
আবহমান কাব্য ঐতিহ্য ধারণ করেও এই কবি আধুনিক যুগ- যন্ত্রণা তার কবিতায় উৎকীর্ণ করতে সক্ষম হয়েছেন। প্রতীক আর গীতিময়তা তার কবিতার প্রাণ। আপাত সরল বাক্যের অন্তরালে মাঝে মাঝেই ঝিকিয়ে ওঠে বাচ্যার্থ ছাড়িয়ে যাওয়া ভাবার্থের বহুমাত্রিকতা। প্রেম নিসর্গ-প্রকৃতি তথা রোমান্টিকতা ফারুক মাহমুদ এর প্রধান প্রবণতা হলেও সমকালীন সমাজ, সভ্যতা, মানুষের যাপিত জীবনের সঙ্কট তার কবিতায় ফুটে উঠেছে। এমনকি চলমান করোনাকালীন নির্মম বাস্তবতাও।
তার কবিতা প্রসঙ্গে দুই অগ্রজ কবির মন্তব্যের শরণ নেওয়া যেতে পারে: ফারুক মাহমুদের শ্রেষ্ঠ কবিতার ফ্ল্যাপে কবি রফিক আজাদ এর লিখিত উক্তি সংকলিত হয়েছে। তার ভাষ্য: যে কজন অনুজের কবিতা আমার পছন্দ তাদের মধ্যে ফারুক মাহমুদ অন্যতম। ফারুকের হাতে ছন্দের ব্যবহার খুব সহজ এবং সাবলীল। কারও নজর তা এড়ায় না। আমিও আনন্দের সঙ্গে এটি লক্ষ করি। শব্দ ব্যবহারেও সে অত্যন্ত পারদর্শী। শব্দের ওজন তার জানা। সচেতন পাঠক তা লক্ষ করতে বাধ্য হন।”
একই ফ্ল্যাপে রফিক আজাদের সমসময়ের কবি সিকদার আমিনুল হকের মুগ্ধতাপূর্ণ মন্তব্য উল্লেখ করা যেতে পারে: “সত্তর দশকের কবিদের মধ্যে ফারুকের একান্ত উচ্চারণ, নিভৃত শব্দমাধুর্য ও ভাবুক সংকল্প আমাকে প্রথম থেকেই মুগ্ধ করে। এই দশকের(সত্তর) অন্যতম প্রধান কবি তিনি। প্রেমিকতায় বিষন্ন ও ছায়াচ্ছন্ন উচ্চারণের বিপরীতে একটি দ্রোহী সমাজমনস্কতা মনে করিয়ে দেয় জীবন এবং কবিতা আলাদা কিছু নয়। একদিকে ভাবুকতা, উল্টোপিঠে স্থিতধী নির্মাণের অক্লান্ত পরিশ্রম, আরো পরিষ্কারভাবে বলা যায় আলো ও অন্ধকারকে একসঙ্গে নিয়ে বাঁচার নামই জীবন। উপরন্তু অভিজ্ঞতাকে অনিবার্য ও শিল্পীত করার নামই সৃষ্টি।… কবি ফারুক মাহমুদের নির্জন উত্তরণ ও কাব্যসিদ্ধি দেখে যেতে পারলাম।… আমার পক্ষে বাস্তবিকই এটি বড় প্রশান্তি।”
কবিতা অন্তপ্রাণ ফারুক মাহমুদের কবিতা প্রসঙ্গে ইতিবাচক এই অভিমতের অবতারণা এ কারণে যে, কবিতার জন্য তার নিষ্ঠা এবং নিরলস সাধনাটুকু অনুধাবন। এই অভিমত সাম্প্রতিকও নয়, অনেক আগের। অগ্রজ কবিদ্বয় প্রয়াত হয়েছেন বহুবছর আগে।
যা-ই হোক, ফারুক মাহমুদ জীবনের সাফল্যের মানদণ্ডই বিবেচনা করেন কবিতা তথা শিল্পকে। হয়তো সে কারণেই তার “শ্রেষ্ঠ কবিতা” শুরু হয় “কবিতার ক্লান্তি নেই” শিরোনামের কবিতা দিয়েই:
বধির বিদ্যার বোঝা টেনে টেনে অবসন্ন কতদূর যাবে!/তারচেয়ে আকাশের তালাগুলো একে একে খুলে দিতে থাকো/ যেদিকে দুচোখ যায় স্বপ্ন আঁকো__সনির্বন্ধ__ ছোট পরিসরে/অসম্ভব হবে কেন? চলার সাফল্য থেকে কিছু কিন্তু পাবে/ কবিতার ক্লান্তি নেই। যখন বিপন্ন কাল__ দাঁড়ানো সে জানে/ শিল্পের সুযোগ্য পথে শুভরাত্রি শুভদিন ঠিক বয়ে আনে।”
কবিতার ভেতর দিয়ে সমাজের শুভাশুভ পর্যবেক্ষণ যে কবির আরাধ্য, সে কবির মনোজগৎ যে কবিতাময় হবে, সেটাই স্বাভাবিক। এ প্রসঙ্গে ‘পকেট’ শিরোনামের প্রতীকী কবিতাটির উল্লেখ করা যায়। নানা রকম লোভ লিপ্সার প্রতীকী পকেট প্রসঙ্গে যখন তিনি উচ্চারণ করেন: ‘… ওরা কিন্তু চক্ষু কর্ণে একমুখী নয়/ আকৃতি-প্রকৃতি ভিন্ন__ উট ঘোড়া গাধার স্বভাব’_ তখন চিনতে অসুবিধা হয় না এসব পকেটের মালিকদের। আরো পরিষ্কার হয়ে যায় যখন তিনি বলেন: ‘সব
পকেটের দাবিভাষা অভিন্ন একক:/ ‘স্বার্থের সকল ডাঙ্গা লিখে দাও আমাদের নামে’।
ফারুক মাহমুদের কবিতায় সামাজিক অসঙ্গতি অর্থনৈতিক অসাম্যসহ নানারকম ক্লেদকালিমার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এবং ব্যঙ্গ-বিদ্রূপও আছে। কিন্তু সব ছাপিয়ে রোমান্টিকতাই হাত উঁচু করে বারবার।
কাঙ্ক্ষিত শব্দের জন্য প্রকৃত কবির অন্বেষণ নিরন্তর বহমান। নৈঃশব্দ্য আর শব্দের অনুষঙ্গে লেখা তার একটি কবিতার কয়েকটি পঙক্তি উদ্ধৃত করলেএই রোমান্টিকতার স্বরূপ উপলব্ধ হতে পারে’ :…যার জন্য দীর্ঘ দীর্ঘ প্রতীক্ষা আমার/ কোনকিছু না দেখার মতো পিছনে তাকিয়ে একবার সেই মেয়ে যদি দ্রুত চলে যায়/ তার সে নিঃশব্দ চরণের ধ্বনি বুকে তুলে রাখি/ তবে ‘শব্দ’ যে আমার অতিশয় প্রিয়/ এ কথা বলায় আমি মুখচোরা নই।’
ফারুক মাহমুদের কবিতা এবং তার সঙ্গে পরিচয় প্রায় চার দশকের অধিক কালের। শুধু কবিতার জন্য নিরন্তর সংগ্রাম করেছেন, দুঃখের কণ্টকাকীর্ণ ইট-কাঠের এই নগর- জঙ্গলে নিঃসঙ্গতার মধ্যে নিজেকে সপে দিয়েছেন। আমার উপলব্ধি এই: ব্যক্তি মানুষটিকে ছাপিয়ে গেছে তার কবিতা। সনেট আমাদের কবিতা থেকে বলতে গেলে তিরোহিতই ইদানিং!
সবাই সফলভাবে লিখতেও পারেন না। তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘পাথরের ফুল’ এ যেমন এই আঙ্গিকের কবিতা পেয়েছি,
তেমনই সাম্প্রতিক কবিতায়ও এই প্রবণতা উজ্জ্বলভাবে ধরা আছে। কবিতায় তার স্বাছন্দ্য প্রধানত অক্ষরবৃত্ত এবং সমিল রচনায় বলেই মনে হয়েছে। যদিও অন্যান্য ছন্দের কবিতা বিরল-দৃষ্ট নয়। অনেক কবিতায় মধ্যমিল-অন্ত্যমিল যেন অবচেতন থেকে চলে এসেছে, এক রকম লিরিসিজম সৃষ্টি করেছে তার কবিতায়।
তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ পাথরের ফুল থেকে ‘বীজের আশ্বাস’ কবিতাটির কয়েকটি চরণ তুলে ধরা যাক:
এঁকেছে বৃষ্টির ছবি, প্রাণী পণ্য পাথরের ভাষা/ জলের জরায়ু থেকে জন্ম নেয় আগুনের ঝাঁক/ চুমুর প্রপাতচিহ্ন মুগ্ধতায় দীর্ঘ ফিরে আসা/ জ্যেৎস্নার মুখর ভাষা, বাস্তবতা, চক্ষু পুড়ে খাক’__
না ছোট- পরিসর লেখায় উদ্ধৃতি বড় করার সুযোগ নেই। তার ছন্দ-প্রকরণ এবং সাংকেতিকতার পরিচয় আগে তাকে না পড়া পাঠক হয়তো এরই মধ্যে পেয়ে গেছেন। কবি ফারুক মাহমুদ আমার সতীর্থ কবি, দীর্ঘকালের সহযাত্রী। তার ব্যাক্তিসত্তা যত জানি, তার চেয়ে বেশি জানি তার কবিতা। জন্মদিনের প্রাক্কালে একজন কবিকে নিয়ে ব্যক্তিগত স্মৃতির জাবর কাটার চেয়ে তার সৃষ্টি নিয়ে কিছু বলা বা লেখা শ্রেয় বোধ করি এবং সেটাই জন্মদিনে তার জন্য বড় উপহার হতে পারে।
‘আগুনে আপত্তি নেই’ গ্রন্থের নাম কবিতার মতোই প্রবল রোমান্টিক, ফারুক কবিতার নানাপথ পরিভ্রমণকরে চলেছেন। কবিতায় তিনি গল্প লিখেছেন,যাকে বলে কাব্যগল্প, মহাভারতের নারী
চরিত্র নিয়ে গত কয়েক বছর ধরে লিখে চলেছেন মহাভারতের প্রেম সিরিজ কবিতা।
ফারুক মাহমদের কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা ১৩-১৪টি। এত স্বল্প পরিসরে তার কবিতার যথার্থ বিশ্লেষণ সম্ভব নয়। শুধু তার দীর্ঘ কাব্যপথের রেখা চিত্র এঁকে দিলাম। যে কবিতা দিয়ে শুরু করেছিলাম সেখানে ফিরে গিয়ে জন্মদিনে বলতে পারি: ‘কল্যাণমুখী হে সততা, তুমি বাড়ি যাবে চলো/ তোমার জন্য বিরল জ্যেৎস্নাধোয়া মুগ্ধ দুয়ার পথ চেয়ে আছে…।’
আমরাও বলি, জন্মদিনের আনন্দ দুয়ার ডাকছে তোমাকে কবি।