প্রবন্ধ

প্রবন্ধ।। বাংলা ভাষায় বিদেশী শব্দের প্রবেশ ও অত্মীকরণ।। ইলিয়াস ফারুকী

পৃথিবীর সকল কিছুর সৃষ্টির পেছনে মানুষের প্রয়োজন। অর্থাৎ মানুষের প্রয়োজনেই সৃষ্টির সকল কিছু। সুতরাং মানুষ ভাষাও সৃষ্টি করেছে তার নিজেরই প্রয়োজনে। পৃথিবীতে স্থান ও দূরত্বের কারনে ভাষার ভিন্নতা রয়েছে। পৃথিবীর আদিতে এক স্থানের মানুষের সাথে অন্য স্থানের মানুষের যোগাযোগ ছিলো না বললেই চলে। স্থান ভেদে প্রতিটা গুষ্টি নিজেদের ভাব প্রকাশের জন্য নিজস্ব ভাবে বিভিন্ন শব্দের সৃষ্টি করে। স্থান ভেদে যার ভিন্নতা ছিলো। এবং এভাবেই সৃষ্টি হয়ে স্বতন্ত্র ভাষাভাষি গুষ্টি। এবং পরবর্তীতে যখন বিভিন্ন গুষ্টিতে গুষ্টিতে পরস্পরের মধ্যে যোগাযোগ শুরু হয়ে, তখনই ভাষার পরিযায়িতা শুরু হয়ে। পরবর্তিতে দেখা যায়, যে ভাষা যত বেশী পরিযায়ি ভাষা গ্রহণ করেছে সেই ভাষাভাষি সম্প্রদায়ের জনগুষ্টি তত বেশী লাভবান হয়েছে। সে দিক থেকে চিন্তা করলে বাংলা ভাষার শব্দ ভান্ডার অনেক সমৃদ্ধ। কারণ বর্তমানে বাংলা ভাষার শব্দ ভান্ডারে রয়েছে এক লক্ষ পঁচিশ হাজার শব্দ।

বাংলা ভাষার শব্দ ভান্ডার যার মুল এবং আদি উৎস হলো কোল, মুন্ডা, পালি ও সংস্কৃত ভাষা পরবর্তী সময় বাংলা ভাষাতে ফার্সি, আরবি, পর্তুগিজসহ বিভিন্ন ভাষা থেকে ঋণশব্দ এবং পূন: ঋণশব্দ গ্রহণ করা হয়ে। যুগ যুগ ধরে বিভিন্ন ভাষা থেকে বাংলা ভাষায় বিভিন্ন শব্দের প্রবেশ বাংলা ভাষাকে সমৃদ্ধ করেছে। ১৩০০ বছরের বিবর্তনের ফলে বাংলা ভাষা বর্তমানে যে পর্যায় এসেছে তা বাঙালী জাতির ক্ষেত্রে এক যুগান্তকারী ইতিহাস। ড. মোহাম্মদ শহিদুল্লাহর মতে সপ্তম শতাব্দিতে চর্যাপদ নাম ধরে যে সাহিত্য চর্চার শুরু তা মুলত বাংলা সাহিত্যের পথচলা শুরু। মহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর আবিস্কার এবং পরবর্তীতে ড. সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়ের গবেষণায় প্রমানিত যে, চর্যাপদ যে ভাষায় রচনা হয়েছে তাই বাংলার মুল ভাষা যার সময়কাল সপ্তম শতাব্দী থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যে।

পৃথিবী আজ প্রায় ৩২ কোটি মানুষ বাংলা ভাষায় কথা বলে। যার মধ্যে বাংলাদেশেই যা অর্ধেক অর্থাৎ ১৮ কোটি মানুষ। বর্তমানে বিভিন্ন জনপদের জনসংখ্যার বিবেচনায় ৬৯০৯ টি ভাষায় বাংলার স্থান পঞ্চম।

বাংলা ভাষা পৃথিবীর জীবনী শক্তিসম্পন্ন অনন্য একটি ভাষা। পৃথিবীতে যে সকল ভাষা স্বতস্ফুর্ত ভাবে জীবন্ত সেই সকল ভাষায় অন্যান্য ভাষার অনুপ্রবেশ ঘটে উল্লেখযোগ্য ভাবে। বাংলা ভাষাও এর ব্যতিক্রম নয়। প্রথমত এই উপমহাদেশে অবিভক্ত বাংলার সময়কালে এদেশে অনেক জাতির শাসন শোষন ছিল। যার কারণেও বাংলা ভাষায় বিভিন্ন ভাষার অনুপ্রবেশ ঘটে। এবং ওই শব্দগুলো বর্তমানে বাংলা ভাষার স্থায়ী রূপ লাভ করে। আধুনিক সময় বিপুল সংখ্যাক অভিবাসী বাঙালীর কারণেও বাংলা ভাষায় এর প্রভাব পড়েছে। এছাড়াও বর্তমানে আন্ত:জাতীয় সাংস্কৃতিক বিনিময় এর প্রভাব উল্লেখ করার মতো।

বর্তমান অত্যাধুনিক বিশ্বের কোন ভাষাই স্বাতন্ত্র্য কিংবা তার মৈলিকতা বজায় রাখতে সক্ষম নয়। এর প্রধান কারণ সামাজিক জীবনে বিভিন্ন ভাষাভাষির মানুষের মধ্যে বিভিন্ন ভাবে মেলামেশার সুযোগ হওয়া। যেমন ভাবে ধরা যায় আন্ত ভাষা বৈবাহিক সম্পর্ক, বন্ধুত্ব, ব্যবসায়িক ও বিভিন্ন বিনিময় কার্যক্রমের কারণে এর প্রভাব পড়ে। এভাবেই ঘটে মৌলিক ভাষার সাথে অতিথি ভাষার সংমিশ্রন এবং এক সময় অতিথি ভাষা হয়ে যায় মূল ভাষার অঙ্গিঁভূত।

পৃথিবীর সকল ভাষাতেই অন্য ভাষার অনুপ্রবেশ ঘটে। শব্দকোষে এগুলো স্বাতন্ত্রতা পায়। ভাষার আধুনিকায়নে ও সম্প্রসারনে এ ধরণের শব্দের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। বর্তমান বিশ্বের সমৃদ্ধ ভাষার দিক থেকে বাংলা ভাষা একটি অন্যতম ভাষা। এর মোট শব্দ সংখ্যা প্রায় এক লক্ষ পঁচিশ হাজার যা পূর্বেই উল্লেখ করা হযেছে।

সুদীর্ঘ আটশত বছর ধরে এই উপমাহদেশের অবিভক্ত বাংলায় মুসলিম শাসনের কারণে এবং বাঙলার উপরে সকলের বিশেষ আগ্রহের কারণে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে আরবি ফারসি ভাষার প্রভাব ব্যাপক। ১২০৪ সালে যখন এদেশে মুসলিম শাসনের সূচনা হয় তখন এ অঞ্চলে আরবি ফারসি ভাষাও বিস্তার লাভ করে। ক্রমে রাজনৈতিক কারণে সম্রাট আকবর তার সেনাবাহিনীকে এক ভাষার কমান্ডে পরিচালনার প্রয়োজনবোধ করলে তৎকালীন উর্দু ভাষার উদ্ভব হয়। এখানে উর্দু ভাষা নিয়ে দু’একটি কথা না বললেই নয়। সম্রাট আকবরের সেনাবাহিনীতে ভারতবর্ষের বিভিন্ন ভাষাভাষির সৈনিক থাকায় তাঁর বিশাল সেনাবাহিনীর পরিচালনা করায় সমস্যা দেখা দেয়। মূলত তখনই তিনি আরবি, ফারসি ও সংস্কৃত ভাষার মিশ্রণে একটি নতুন ভাষার উদ্ভব ঘটান মূলত যা ছিল “উর্দি ওয়ালার ভাষা” উর্দি অর্থাৎ সৌনিক পোষাক। সেই থেকে ভাষাটির নাম হয় উর্দু।

সম্রাট আকবরের সময় থেকে সমাজের বিভিন্ন স্তরে আরবি ফারসির পাশাপাশি উর্দু শব্দের ব্যাপক ব্যবহার শুরু হয়। এছাড়া আইনী কাজে আদালতে আরবি ফারসি ও উর্দু ভাষার বেশ কিছু শব্দ সংযোগ করা হয়। যেমন ফারসি শব্দ অছিয়ত যার মুল বাংলা নির্দেশদানকারী, অজুহনামা অর্থাৎ মোকদ্দমার কারণ লিপিবদ্ধ করার কাগজপত্র। অদল বদল বা পরিবর্তন। আরবি শব্দ থেকে আসে অলিম যা বর্তমানে ওয়ালিমাহ হিসাবে বহুল ব্যবহৃত হচ্ছে। আসিলা বা বাহানা। আকনি বা আখনি যার মূল ছিল ইয়াখনী যা ফারসি ভাষা অর্থাৎ পোলাও জাতীয় খাদ্যকে বোঝায়। বর্তমানে সিলেট অঞ্চলে পোলাও এর ক্ষেত্রে “আখনি” বাক্যটি প্রচুর ব্যবহার হচ্ছে। এ ছাড়াও বাংলা ভাষায় এমন বেশ কিছু শব্দ রয়েছে যে গুলোকে অধিকাংশ লোকই জানে যে ওগুলো মুল বাংলা ভাষা। কিন্তু বাস্তবে ওগুলো বিদেশী শব্দ, যেমন সবুজ, ফসল, ফিতা, জমি বাংলা নয়ে। এছাড়াও মাস্তুল, তামাক, পেয়ারা,আলকাতরা, কাগজ, কাঁচি, শবরি আর তুফান এমন আরো অনেক শব্দ।

ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর “কলিকাতা কমলালয়” (১২৩০) গ্রন্থে খুব দুঃখ করেছিলেন বাংলা ভাষায় ফারসি শব্দের আধিপত্যে। তিনি চিহিৃত করেন যে কীভাবে ফারসি (ও আরবি) শব্দ বাংলা তৎসম ও তদ্ভব শব্দকে প্রতিস্থাপিত করেছে। তাঁর তালিকায় দেখা যায় ‘কল’, ‘কলম’, ‘কম’, ‘খরচ’, ‘খারাব’, ‘খুব’-এর মতো বহু শব্দ (যার বাংলা প্রতি শব্দ যথাক্রমে ‘যন্ত্র’, ‘লেখনী’, ‘অল্প’, ‘ব্যয়’, ‘মন্দ’, ‘উত্তম’) বাংলা শব্দের স্থান দখল করে।

‘গ্রেফতার’, ফারসি ভাষায় ছিলো ‘গিরিফতার’, ‘দেয়াল’ ফারসিতে ছিল ‘দিওয়াল’, ‘আয়না’ ফারসিতে ছিলো ‘আইনাহ্’, ‘মামলা’ ফারসিতে ছিলো ‘মুআমলাহ্’। আরো অনেক ফরাসি শব্দ তার রূপ বদলে বাংলা হয়ে গেছে।

‘কবুল’, ‘কলম’, ‘জৌলুস’, ‘তুফা’, ‘মরসিয়অ’, শব্দ গুলো এসেছে আরবি ভাষা থেকে। বাংলায় এদের উচ্চারণ বদলে গেছে। বাংলা অক্ষরে শব্দগুলোর মূল আরবি রূপ দেখানো একটু কঠিন। ‘কবুল’ এসেছে আরবি ‘কবূল’ থেকে। ‘কলম’ এসেছে আরবি ‘কলম’ থেকে। আরবি ‘জুলুস’ থেকে এসেছে ‘জৌলুস’, আরবি ‘টুফুন’ থেকে এসেছে ‘তুফান;। ‘মরসিয়া’ শব্দটি আরবি থেকে ফারসি হয়ে বাংলায় এসেছে। আরবিতে শব্দটি ছিলো ‘মরথিয়া’ ফারসিতে ও বাংলায় ‘মরসিয়া’। ‘কলম’ শব্দটি মূলে ছিলো গ্রিক। তখন তার রূপ ছিলো ‘করমোস’। আরবিতে হয় ‘কলম’। বাংলায় ‘কলম’। ‘টুফুন’ আসলে চীনা শব্দ। চীনা ‘তাইফাং’ জাপানিতে হয় ‘তাইফুন’, আরবিতে হয় ‘টুফুন’, ফারসিতে হয় ‘তুফান’। বাংলায় ‘তুফান’।

সুনীতিকুমার বলেছেন বাংলায় তুর্কি শব্দ চল্লিশটির বেশি হবে না। ‘আলখাল্লা’, ‘কুলী’, ‘কোর্মা’, ‘খাতুন’, ‘বেগম’, ‘লাশ’ তুর্কি শব্দ। ‘আলখাল্লা’ তুর্কিতে ছিলো ‘আল খালিক’। ‘কুলী’ ছিলো ‘কুলি’, তখন তার অর্থ ছিলো ‘ক্রীতদাস’। ‘কোর্মা, তুর্কিতে ছিলো ‘কওউর্মা’। ‘খাতুন’ ছিলো ‘খতুন;, ‘বেগম’ ছিলো ‘বেগুম’। ‘লাশ’ ছিলো ‘লাস’। কালক্রমে শব্দগুলো এখন বাংলা ভাষার নিজস্ব শব্দে পরিনত হয়েছে। কেউ বলে না দিলে এটা বুঝতে পারা কঠিন যে উক্ত শব্দগুলো বাংলা ভাষায় ঋণ করা বা অতিথী শব্দ।

বাংলা ভাষায় একশো থেকে একশো দশটির মতো আছে পর্তুগিজ শব্দ। আছে গুটিকয় ওলন্দাজ ও ফারসি শব্দ। ইংরেজি শব্দের কোনো হিশেব-নিকেশ নেই। দিন দিন ইংরেজি শব্দ অনুপ্রবেশ করছে বাংলায়। শুধু ঢুকছেই না; ইংরেজি শব্দ আমাদের বাধ্য করছে নতুন বাংলা শব্দ তৈরি করতে, যাতে আরো ইংরেজি ভাব প্রকাশ করতে পারি বাংলা শব্দে। বাংলা ভাষায় ইংরেজি শব্দ অগুনতি। এর সঠিক হিসাব উল্লেখ করা কঠিণ।

‘আনারস’, ‘পিস্তল’, ‘ছায়া’, ‘কামরা’, ‘বালতি’, ‘পেঁপে’, পর্তুগিজ শব্দ। ‘আনারস’ পর্তুগিজে ছিলো ‘অননস’। ‘পিস্তল’ ছিলো ‘পিস্তোল’। ‘সায়া’ (মেয়েদের পোশাক) পর্তুগিজে ছিলো ‘সইঅ’। ‘কামরা’ ছিলো ‘কমর’। ‘আলমারি’ পর্তুগিজে ছিলো ‘আরমারিও’। ‘পেঁপে’ ছিলো ‘পপইঅ’ মেয়েদেও পরিধেয় ‘কামিজ’ ছিলো ‘কামিসা’, ‘বারান্দা’ ছিলো ‘ভারান্দা’, ‘বালতি’ ছিলো ‘বালদে’ ইত্যাদি।

১৩৫২ইং সাল থেকে ১৫৭৫ইং সাল পর্যন্ত বাংলায় তুর্কি শাসন আমল যে সময়কে ”শাহী বাংলা”র আমল বলা হতো। সেই তুর্কি শাসন আমলে বেশ কিছু তুর্কি শব্দও বাংলায় অনুপ্রবেশ করেছে যেমন তুর্কি ভাষায় কোরমা, ছকমক বাংলায় চকমক, দেদে বাংলায় দাদা, নানী, বাবা, বাবুর্চি ইত্যাদি শব্দ বাংলা ভাষায় স্থায়ি আসন গেড়েছে।

কিছু কিছু ক্ষেত্রে বাংলায় জাপানি শব্দও অনুপ্রবেশ করেছে, যেমন বাকা থেকে বোকা, চা, সুনামি, মাঙ্গা, রিক্সা জাপানি ভাষায় রিকিশা এ সব গুলো শব্দই জাপানি ভাষা থেকেই আসা।

বাংলা ভাষায় আগত আরবি, ফারসি, উর্দু শব্দের সংখ্যা তেমনভাবে অনুমান করা কঠিন। ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর ১৯৫৮ সালে লেখা “বাঙ্গাঁলী ভাষার ইতিবৃত্তি” গ্রন্থে আরবি, ফারসি, তুর্কি শব্দের সংখ্যা দুই হাজারের বেশি বলেছেন। আর হিন্দি উর্দু শব্দের কথা তিনি তার “বাঙ্গালা সাহিত্যের কথায় “দ্বিতীয় খন্ড ১৯৬৫) বলেছেন যে, মুসলমানি দোভাষী পুঁথি সাহিত্যেই এ হিন্দি শব্দের প্রয়োগটা বেশি হয়েছে। বাংলায় সর্বনাম ও ক্রিয়াপদে ঐ হিন্দি উর্দুর প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। হিন্দু, মুসলিম উভয়ই তাদের পুঁথি রচনায় হিন্দি, উর্দু মিশ্রিত ভাষা ব্যবহার করেছে।

বিংশ শতাব্দীতে কাজী নজরুল ইসলাম ব্যাপকভাবে ফার্সি ও উর্দু শব্দ তার সাহিত্যে ব্যবহার করেন। বিশেষ করে মুসলমান সাহিত্যিকদের লেখায়ই আরবি ও ফারসির ব্যবহার বেশি দেখা যায়। এ ক্ষেত্রে কবি জসিম উদ্দিন, ফররুখ আহমেদ, বন্দে আলী মিয়া সহ আরো অনেকেই ছিলেন। পক্ষান্তরে হিন্দু সাহিত্যিকের মধ্যে সংস্কৃতির প্রভাবই বেশি লক্ষণীয় এর পাশাপাশি ইংরেজি শব্দতো রয়েছেই। এক্ষেত্রে বঙ্কিমচন্দ্র, শরৎচন্দ্রের কথা উল্লেখযোগ্য।

ড. গোলাম মকসুদ হিলালী তাঁর “”Perso Arabic Elements in Bengali” গ্রন্থে আরবি ফারসিজাত শব্দের সংখ্যা ৫১৮৬টি বলে উল্লেখ করেন। তাঁর মৃত্যুর পর ১৯৬৬ গ্রন্থটি ড. এনামুল হকের সম্পাদনায় বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত হয়। কিন্তু তিনি তাঁর নিজের লেখা “রচনা শিক্ষা” গ্রন্থে আরবি ফরাসি শব্দের সংখ্যা ৫০০০ উল্লেখ করেন। কোন কোন ভাষা বিজ্ঞানী এ সংখ্যা প্রায় ৯০০০ বলে উল্লেখ করেছেন।

বর্তমান অভিধানটিতে প্রায় আট হাজার সাতশত ভুক্তি রয়েছে। তার মধ্যে বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত আরবি ভাষায় ভুক্তির সংখ্যা ৪০০০টি. ফারসি ভাষা ৪৫০০টি এবং উর্দু ভাষার সংখ্যা দুই শতাধিক।

বেশ কিছু শব্দ নিয়ে মতভেদ রয়েছে। যেমন “বাহাদুর” শব্দটা কেউ বলেন তুর্কী থেকে কেউ বলেন ফরাসি থেকে। উর্দু অভিধানে শব্দটিকে ফরাসি শব্দ হিসেবে দেখানো হয়েছে।

এছাড়াও ১৯০৫ সালে বঙ্গঁভঙ্গ প্রচেষ্টার পর থেকেই পূর্ববঙ্গঁ ও পশ্চিমবঙ্গঁ হিসাবে একটা বিভেদ শুরু হয়ে যায়। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর বাংলা ভাষার রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় নতুন একটি প্রভাবের বিস্তার ঘটে।

তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান বা পূর্ব বঙ্গে বাংলা ভাষা নিয়ে বিপ্লব ঘটে যায়। তখনকার রাষ্ট্রযন্ত্র বাংলা নিয়ে বিভিন্ন রকম ষড়যন্ত্র শুরু করে। বাংলাকে উর্দু অক্ষরের বর্ণমালা দিয়ে লেখার প্রবর্তণ করার চেষ্টা চলে যার ফলশ্রুতিতে ১৯৪৭-৭১ এর মধ্যে বাংলা সাহিত্যে পাকিস্তানের প্রভাবে আরবি এবং উর্দু শব্দের অনুপ্রবেশের আধিক্য লক্ষ করা যায়।

আরবি/ফার্সি/ উর্দু দেশী বিকল্প শব্দ
খরগোশ শশারু
বাজ সাঁচাম/সরচান
শিকার আথেট
নালিশ গোহারি
বিদায়/আল-বেদে মেলানি
জাহাজ বুহিত
হাজার দশশ
নাশতা প্রাতরাশ
গোছল স্নান
গুস্সা গোস্সা বা রাগ

অধিকাংশ বিজ্ঞরা মনে করেন বাংলাদেশের ভাষার ক্ষেত্রে আরবি শব্দ অনুপ্রবেশ খুবই স্বাভাবিক। কারণ বাংলাদেশের পঁচাশি ভাগে মানুষই মুসলমান। ছোট বেলা থেকেই কোরআন, নামাজ, কালামে অভ্যাস্ত। একই সাথে প্রায় এক কোটির ও বেশি বাংলাদেশী নাগরিক জীবন ও জিবীকার কারণে মধ্যপ্রাচ্যে বসবাস করেন। তাই স্বাভাবিক ভাবেও বাংলাদেশের বাংলায় আরবির প্রভাব লক্ষ্য করা যায়, তবে ইদানিং সচেতনতা বাড়ার কারণে কিছুটা হলেও এর প্রভাব কমছে।

বাংলা ভাষার ভান্ডারে তৎসম, অর্ধ-তৎসম, তৎভব শব্দই সংখ্যায় তুলনামূলক ভাবে বেশি, দেশি বা বিদেশী শব্দ কম। তৎসম বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত সংস্কৃত শব্দ। ‘তৎ’ মানে তার অর্থাৎ সংস্কৃতের, ‘সম’ মানে তুল্য। অতএব যে শব্দগুলি কোন রকম পরিবর্তন ছাড়াই বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত হয় সেগুলিই তৎসম শব্দ। এ অর্থে ‘তৎসম’ শব্দের প্রথম দেখা যায় দন্ডীর (আনুমানিক ৮ম শতকের প্রথমভাগ) কাব্যাদর্শে। তিনি প্রাকৃত ভাষার উল্লেখ প্রসঙ্গে যেসব শব্দ সংস্কৃত ও প্রাকৃত উভয় ভাষায় একই রকম, সেগুলিকে বলেছেন তৎসম। বাংলা ভাষায় তৎসম শব্দের ব্যবহার প্রচুর রয়েছে।

প্রাক আর্য যুগে বাংলার আদি অধিবাসীদের ভাষার কিছু কিছু শব্দ বাংলা ভাষায় অনুপ্রবেশ করে, যেগুলিকে বলা হয় দেশি শব্দ যেমন; পেট, ডোঙ্গা, ঢিল, কুলা ইত্যাদি। আর বৈদিক ও সংস্কৃত থেকে প্রাকৃতের মাধ্যমে যে শব্দগুলি অনুপ্রবেশ করে সেগুলিই খাঁটি বাংলা শব্দ। সমাজের নিম্ন শ্রেণীর লোকেরা এগুলি ব্যবহার করত, কিন্তু দশম শতকের পূর্ব পর্যন্ত সাহিত্যে এ শব্দগুলো ব্যবহার হতো না। মধ্যযুগে এ ভাষায় এক বিশাল সাহিত্য সৃষ্ট হলেও আধুনিক যুগের লেখকরা বাংলা ভাষার সীমিত শব্দসম্ভার নিয়ে কাব্যচর্চায় স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেননি। তাঁরা সংস্কৃত থেকে প্রচুর শব্দ বাংলা কাব্যচর্চায় ব্যবহার করেন। কারণ, প্রাচীনকাল থেকে সংস্কৃত ছিল এদশের ধর্ম, দর্শন ও সাহিত্যের বাহন এবং এ ভাষার শব্দগুলি গুরুগম্ভীর ভাব প্রকাশের উপযোগী।

উনিশ শতকের শুরুতে উইলিয়াম কেরি কলকাতার ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে বাংলা বিভাগ শুরু করেন। এবং সর্বস্তরে বাংলাকে গ্রহন যোগ্য করতে সংস্কৃত পন্ডিতদের দ্বারা উপযুক্ত পাঠ্য পুস্তক রচনার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। ফলে সংস্কৃত পন্ডিতদের কারণে তখন বাংলা ভাষায় প্রচুর তৎসম শব্দ অনুপ্রবেশ করে এবং ক্রমশই এ সংখ্যা বাড়তে থাকে। বর্তমানে সাধু বাংলায় তৎসম শব্দের সংখ্যা ৭০ ভাগেরও বেশি এবং চলিত বাংলায় শতকরা ৪০-৪৫টি। একজন প্রতিষ্ঠিত লেখকের রচনার শতকরা ২৫টি শব্দই তৎসম। যাদের রচনার মাধ্যমে তৎসম শব্দ ব্যাপকভাবে বাংলা ভাষায় প্রবেশ করে তাঁরা হলেন রামরাম বসু, ঈশ^রচন্দ্র বিদ্যাসাগর, মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার, মাইকেল মধুসূদন, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ। বাংলা ভাষায় সংস্কৃত শব্দের এ ব্যবহার-প্রক্রিয়াকে কেউ কেউ ‘সংস্কৃতায়তন’ বলে অভিহিত করেন।

বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত তৎসম শব্দগুলিকে দুভাগে ভাগ করা যায়: সমোচ্চারিত ও অসমোচ্চারিত। প্রথম শ্রেণীর শব্দগুলি হুবহু সংস্কৃতের মতো লিখিত ও উচ্চারিত হয় যেমন: নারী, নদী, ভ্রাতা, বধূ ইত্যাদি। আর দ্বিতীয় শ্রেণির শব্দগুলি সংস্কৃত অনুযায়ী লিখিত হলেও উচ্চারণে কিছুটা পার্থক্য ঘটে, যেমন; বৃক্ষ, পদ্ম, ভস্ম ইত্যাদি। এছাড়া আরও কিছু সংস্কৃত শব্দ সামান্য বিকৃতভাবে বাংলায় ব্যবহৃত হয়, যেগুলিকে বলা হয় অর্ধ-তৎসম শব্দ, যেমন; চন্দর <চন্দ্র, বাদ্যি <বাদ্য, মিষ্টি <মিষ্ট, সত্যি< সত্য ইত্যাদি।

অষ্টাদশ শতাব্দিতে দেখা গেছে বাঙ্গালী উত্তেজিত হলে উর্দু ভাষায় গালমন্দ করত যেমন হারামজাদা, মাদার…….. কিন্তু বাংলাদেশে কিন্ডারগার্টেন বা ইংরেজি শিক্ষার প্রভাব বাড়ার সঙ্গেঁ সঙ্গেঁ শব্দগুলো ইংরেজি শব্দ দ্বারা প্রতিস্থাপিত হলো। যেমন, সাটাপ, ইডিয়েট, স্ক্রাউন্ডেল ইত্যাদি। আবার কঠিন উচ্চারণ গত কারণেও কিছু কিছু বাংলা শব্দকে ইংরেজি শব্দ প্রতিস্থাপন করেছে যেমন, মোবাইল একটা ইংরেজি শব্দ অথচ এর বাংলা “ভাম্র্যমান আলাপ যন্ত্র”

আবার কিছু আঞ্চলিক ভাষায়ও আরবি ও উর্দু শব্দের প্রভাব দেখা যায় যেমন। চিটাগাং, এদিকে যাও, হয়ে গেছে, ইন্দি যঅ যা একটি বিশুদ্ধ আরবি শব্দ। আবার সিলেটি ভাষায় মনে রেখো, হয়ে যায় ইয়াদ রাখিও, যা উর্দু শব্দ।

বৃটিশ শাসনের পূর্বে বাংলায় ফার্সি বা আরবি শব্দের ঠাসাঠাসি ছিল। কিন্তু বৃটিশ শাসনের সময়ে ধীরে ধীরে অনেক আরবি বা ফার্সি শব্দ বাংলা ভাষা থেকে সরে যায় সেখানে ইংরেজি শব্দ তার অবস্থান দখল করে যেমন, কেদারা হয়ে যায় চেয়ার। পানীয় পাত্র হয়ে যায় গ্লাস যা ইংরেজি শব্দ।

বিশ্বের যে কয়টি ভাষায় সাহিত্য চর্চা করা হয় তার মধ্যে অন্যতম ভাষা হলো বাংলা। বাংলা ভাষা বিকাশের ইতিহাস ১৩০০ বছরেরও অধিক পুরোনো। গত সহস্রাব্দির সূচনা লগ্নে পাল এবং সেন সাম্রাজ্যের প্রধান ভাষা ছিল বাংলা। সুলতানি আমলেও রাজ দরবারে অন্যতম রাজ ভাষাও ছিল বাংলা। মুসলিম সুলতানদের পৃষ্ঠপোষকতায় গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্য কর্মও বাংলায় রচিত হয়। আরাকান রাজসভায় বাংলা সাহিত্যের ছিল জমজমাট আসর । আলাউলের “সিকান্দারনামা” তাও বাংলায় রচিত।

২০০৯ইং সালে যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক সংস্থা “ইনষ্টিটিউট অব লিঙ্গুঁইষ্টিকস“ সংস্থার গবেষণার ফলে দেখা যায় পুরো পৃথিবীতে ছোট বড় সমস্ত জাতি সত্ত্বা মিলিয়ে মোট ভাষার সংখ্যা ৬৯০৯ টি। ২০১৮ইং সালের এথনোলগ এর ২১তম সংস্করণ অনুসারে বাংলাদেশে মোট ভাষার সংখ্যা ৮১ টি।

ভাষাবিদ সুকুমার সেন তাঁর তথ্য ও গবেষণার ভিত্তিতে বাংলা উপভাষার শ্রেণী বিন্যাস করেছেন। তিনি পশ্চিম বঙ্গঁ ও বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের বাংলা ভাষার উচ্চারণের ভিত্তিতে ভাষাকে পাঁচ ভাগে ভাগ করেছেন।

১) রাঢ়ী উপভাষা
২) বাঙ্গাঁলী উপভাষা
৩) বরেন্দ্রী উপভাষা
৪) ঝাড়খন্ডী উপভাষা
৫) রাজবংশী উপভাষা

উপরল্লিখিত ভাষা সমুহের মধ্যে বাংলা অপভ্রংশ, তৎসম অর্ধ-তৎসম, তদ্ভব শব্দের পাশাপাশি আঞ্চলিক ভাষায়ও বিভিন্ন ভাবে অনেক বিদেশী শব্দের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। যেমন চিটাগাংগের ভাষা, ও বদ্দ নো যাইবা অর্থাৎ বড় ভাই যাবেন না, এখানে ও এবং নো এ দুটো শব্দই ইংরেজি থেকে আসা।

যা প্রতিনিয়ত ব্যবহৃত হয়ে তা পরিবর্তন এবং পরিবর্ধণশীল। ভাষার ব্যপক ব্যবহারও ঠিক তেমনি। যে ভাষা যত বেশী চর্চা হয়ে তার প্রবৃদ্ধিও তত বেশী। এই বাংলায় এক সময় বিভিন্ন জাতির দীর্ঘ উপনিবেশ ছিলো। সে সকল উপনিবেশ শাসকদের দীর্ঘদিন শাসনের কারণে তাদের ভাষা থেকে অনেক শব্দ বাংলা ভাষায় নিজের স্থান করে নেয়। এবং পরবর্তীতে ব্যাপক ভাবে বিশ্বায়নের কারণে অনেক ভিনদেশী ভাষার শব্দ বাংলাভাষায় প্রবেশ করে এবং নিজের স্থায়ী আসন লাভ করে।

হাজার বছর পূর্বে চর্যার বাংলা এবং এখনকার বাংলা যেমন এক না। তেমনি হয়ত হাজার বছর পরে বর্তমান বাংলায়ও আরো অনেক পরিবর্তন আসবে এবং এটাই স্বাভাবিক। যে ভাষা যত গতিশীল সে ভাষা তত বেশী সমৃদ্ধ। কে জানে প্রতিনিয়ত পরিবর্তনের এই প্রক্রিয়ায় হয়ত বাংলাই হয়ে উঠবে পৃথিবীর এক নম্বর ভাষা।

যাদের নিকট কৃতজ্ঞ।

ড. মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ। ভাষা ও সাহিত্য (১৯৩১)
ড. হুমায়ুন আজাদ। কতো নদী সরোবরে। (১৯৮৭)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *