প্রবন্ধ।। চার বাঙালির নজরুল -।। জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত
কাজী নজরুল ইসলাম বাঙালির হৃদয়বাসী। এক নিঃশ্বাসে এই কথা বলার মুহর্তে ভাবতে হয়, কোন বাঙালির? কেননা তাঁর জন্মশতবর্ষপূর্তির পরবর্তীকালে এই রকম মনে হয়, যে বাঙালির হৃদয়ে তিনি আসীন তার চেহারা সর্বদা এক রকম ছিল না, সম্ভবত এখনও নেই। ‘মুক্তি’ কবিতাটি প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে পাঠকহৃদয় প্লাবিত না করে থাকলেও এর জন্যে দীর্ঘ সময় তাঁকে ব্যয় করতে হয়নি। তেরােশ’ ছয় থেকে ছাব্বিশ এই ছিল তাঁর অপেক্ষাকাল, তারপর মাত্র বাইশ বছর, এই বাইশ বছর সময়কালেই বাঙালির হৃৎসাম্রাজ্যের যৌবরাজ্যে অভিষেক হয় তাঁর। অথচ আশ্চর্য, তার পরের ত্রিশ বছরের সে কথা সর্বদা সেই বাঙালির মনে থাকে না এবং তারপরের অনধিক ত্রিশ বর্ষে যদিও আবার ফিরে আসেন তিনি কিন্তু একই মানুষের ঘরে নয়, এক চেহারার বাঙালির ঘরে তাে নয়ই।
এই সব কথা স্পষ্ট করা যাক। এক জীবনে কি কেউ বারবার ফিরে আসতে পারেন? নজরুল ইসলাম কিন্তু পেরেছিলেন। এই জীবনে ফিরে এসেছিলেন অন্তত দু’বার। খুব বেশি খুঁটিয়ে দেখলে বােধহয় বলা যায়, তিন বার। আঠারােশ’ নিরানব্বই থেকে প্রবাহিত তাঁর সাতাত্তর বছরের জীবনকে এমন স্পষ্ট তিনটি অংশে বিচ্ছিন্ন করা যায় যে, মনে হবে এক একটি জীবনাংশের দাবিদার যেন ভিন্ন ভিন্ন মানুষ। এমনকি মৃত্যুপরবর্তী এই চল্লিশ বছরেও যে নজরুল চলাচল করেন বাঙালির ঘরে তিনিও ভিন্ন একজন যাওয়া আসা তার ভিন্ন বাঙালির ঘরেই। জন্মপরবর্তী বিয়াল্লিশ বছরকে ধরা যায় তাঁর প্রথম জীবন। শৈশববাল্যপরবর্তীকালে যেমন ঘটে তেমনি ঘটেছিল তার জীবনেও শিক্ষাগ্রহণ, কর্মজীবন, গার্হস্থ্য জীবন- মােটা দাগেই এসব চিহ্নিত করা যায়। যদিও তাঁর জীবনধারণের পদ্ধতি, শিল্পসৃষ্টির অনন্য প্রক্রিয়া, কি গার্হস্থ্য জীবনের অচিরাচরিত উদাহরণ- এসব মােটা দাগের টানে ধরা পড়বার মতাে নয়। তবুও এটুকুই ছিল তার জীবন, সামাজিক মানুষের জীবন। তাঁর প্রথম জীবন। জগৎসভায় সকলের সঙ্গে বসে কাটানাে হাসি-কান্নার জীবন। শিল্পসৃষ্টির কাল। সাফল্য, সমাদর, স্বীকৃতি যেমন জুটেছিল এই সময়ে, তেমনি জুটেছিল অপরের বিদ্বেষ, বিদ্রুপ ও হিংসার হলাহল। ঐ বিয়াল্লিশ বছরের জীবনে এত কিছু ঘটেছিল বলেই হয়ত পরবর্তী ত্রিশ বছরের জীবনে পূর্বজীবন আর কোন ছায়া ফেলেনি।
উনিশশ’ বিয়াল্লিশ থেকে উনিশশ’ বাহাত্তর যে সৃষ্টিহীন অসুস্থ জীবন তার তা সর্বাংশে ভিন্ন এক মানুষের পরিচয়ে চিহ্নিত। অজ্ঞাত তিনি আর নন নিঃসন্দেহে কিন্তু সে কথা কারাে মনে থাকে না, এমনই অবহেলিত। কিন্তু শুভাকাঙ্ক্ষী গুণমুগ্ধ জন ছাড়া কাছে দাঁড়ায় না কেউ। অন্ধকারে নির্বাসিত আলােকাভিসারী কবির আরও গভীর অন্ধকারে প্রবেশ করার সময় এটি। ঐ সময়ে কোন কবিকে কেউ চেনে না। স্বাধীনতাপরবর্তী বাংলাদেশে ঘটেছিল তার আরেক জীবনে উত্তরণ। ফিরে এসেছিলেন যেন আবার জগৎসভায়। তাঁর এই তৃতীয় জীবনে ঘটে অনেক কিছুই, নির্মিত হয় এমন এক মানুষ যে ঐ সময়ে বােধধাদয় হলে ত্রিশ বৎসর পূর্বের নিজেকে আর চিনতে পারতাে না।
এই তাঁর তিন জীবন। খুব অনায়াসেই ভিন্ন ভিন্ন করে চিনে নেয়া যায়। আর অনায়াসেই শনাক্ত করা যায় ঐ তিন জীবনে তার চারপাশে ছিল যারা তাদের। তার জগতের, দেশের সমাজের মানুষদের। কবি কাজী নজরুল ইসলামের তিন জীবনের আত্মীয় তিন বাঙালিকে। কেননা, বড় বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ্য করতে হয়- নজরুলের তিন জীবনের তিন আদলের মতােই বদলে যায় ঐ বাঙালির চেহারাও। আর মৃত্যুপরবর্তীকালে? পেছনে ফেলে আসা শেষ এই চল্লিশ বছরে? আছেন কি নজরুল চিহ্নিত তাঁর পূর্ব কোন পরিচয়ে? আছেন কি স্থিত পূর্ববর্তী কোন বাঙালির হৃদয়াসনে অবিকল? চার বাঙালির নজরুল? সম্ভবত নয়। সৃষ্টিসুখী নজরুল এক বাঙালির নয়নমণি ছিলেন। অসূয়াপরবশ, বিদ্বেষী, সংকীর্ণমনা, ধর্মচেতা, কি সম্প্রদায়ভেদবৃদ্ধিতে আচ্ছন্ন যারা তাদের কথা মনে রেখেও একথা বলা যায়। এক দল বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে একবার কপর্দকবিহীন নজরুল শিয়ালদহ থেকে ট্রেনে গােয়ালন্দ এবং সেখান থেকে স্টিমারে ঢাকা এসেছিলেন কেবল তার পরিচিতির সুবাদেই। টিকিটের বদলে হারমােনিয়ামের সঙ্গে মেলানাে তার গলায় দুটি গানই রেলকর্মচারীর জন্য যথেষ্ট ছিল। সমাজের সর্বত্র তাঁর যাতায়াতের কথা জানা সকলেরই। মােহনদাস গান্ধী যখন তাঁর গান ‘ঘাের ঘাের ঘােররে. আমার সাধের চরকা ঘাের’ শুনে হেসে কুটিকুটি হয়েছিলেন তেমনি গুণমুগ্ধের আসরে দূরে বসে থাকা নজরুলকে কাছে ডেকে এনে বসিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। মূলত তাঁর রাজনৈতিক রচনা, তাঁর ব্রিটিশবিরােধিতা বৃহত্তর জনসমাজে তাঁকে পরিচিত করলেও, তাঁর কবিখ্যাতি, কি সুরসিন্ধুর পরিচয়ও এমন কিছু কম ছিল না। বেতার ও চলচ্চিত্রের জন্য অবিরল ধারায় রচিত ও সুরারােপিত তাঁর গানের খ্যাতি রসিক সমাজের বাইরেও ছড়িয়েছিল অনেক দূর- এসব সহজপ্রাপ্য তথ্য। তাঁর কণ্ঠস্বর, বেতারে কিংবা নানা জলসায় ছিল সকলের পরিচিত, এ-ও জানা। ‘উর্ধ্বগগনে বাজে মাদল’-এর সঙ্গে তালে তালে পা ফেলতাে সহস্র সহস্র কিশােরকিশােরী সারা বাংলায়, সে ঐ চল্লিশের কালেই।
কাজী নজরুলের দ্বিতীয় জীবনের সঙ্গে যে-বাঙালির জীবন জড়ানাে ছিল তার চেহারা বড় মলিন, ধূলিধূসর। প্রিয় কবির তৎকালীন চলাচলের খবর তারা খুব বেশি রাখেনি। বিয়াল্লিশের পরে নানা চিকিৎসকের সান্নিধ্যে কি চিকিৎসালয়ের বিছানায় যে কবির সময় কাটে বেশি, লেখার টেবিলে নয়, দুটি শব্দকে পাশাপাশি বিন্যস্ত করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছিলেন ক্রমে যে কবি তাঁর খবর অন্যেরা রাখবেই বা কেন? সুফী জুলফিকার হায়দার নজরুলের জীবনের এই পর্বের সঙ্গে খুব ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত ছিলেন। নজরুলের চিকিৎসার ব্যবস্থা কি সংসারের খরচ সংগ্রহের জন্যে তৎকালীন বাংলার প্রগতিশীল প্রায় সকলের সঙ্গেই দেখা করেছেন তিনি। শেরে বাংলা ফজলুল হক অথবা শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি, সকলের সঙ্গেই। তাঁর কথা: “আমি হক সাহেবকে বললাম সংবাদপত্রে কবির অসুখের সংবাদ কয়েকদিন আগে বেরিয়েছে, হয়তাে দেখেছেন, কিংবা শুনেছেন। কিন্তু কেউই এ ব্যাপারে কিছুমাত্র আগ্রহ দেখায়নি। কি অসুখ, কতটা খারাপের দিকে এমন কথাও কারও মুখে শুনিনি। আশ্চর্য! এ ব্যাপারে কোন মহল থেকে এতটুকুও সাড়া জাগেনি। কাজেই আপনি এর একটা কিছু ব্যবস্থা না করলে কোন উপায়ই দেখছি না। হক সাহেব বললেন, তুমি কাল সকালে আটটার সময় আবার এখানে এসে মনে করিয়ে দেবে। আজ আমি কিছুই করতে পারবাে না। হ্যা, কাল এসাে।” হক ডক্টর শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জিকে বলেছিলেন নজরুলের ব্যবস্থা করবার জন্য। শ্যামাপ্রসাদ জুলফিকার হায়দারের সঙ্গে কবির বাসায় তাঁকে দেখতে যান। কবির মধুপুরে কিছুদিন থাকবার ব্যবস্থাও তিনি করেছিলেন। “…মধুপুরে আমার একখানা নিজস্ব বাড়ি আছে। আমি শুধু থাকবার ব্যবস্থাই করতে পারবাে। বাদবাকি সব ব্যবস্থা এদেরই করতে হবে। কাজীদা তখন জড়িয়ে জড়িয়ে বললেন, আমার ইমিডিয়েটলি এক হাজার টাকা দরকার। “ডক্টর মুখার্জি বললেন, আমি অবশ্যই কিছু দিতে পারতাম। কিন্তু এখন তাে বেলা পাঁচটা। ব্যাংক বন্ধ হয়ে গেছে। তাই ভাবছি কি করা যায়। কবি তাে এক হাজার টাকা চাচ্ছেন এবং যা শুনলাম তাতে মনে হয় ঘরে কিছু নেই।” অপরের করুণাপ্রার্থী এই ছিল কাজী নজরুল ইসলামের দ্বিতীয় জীবনের প্রারম্ভ- বাঙালি সমাজেই । বিয়াল্লিশ-পরবর্তী বাঙালি সমাজেই। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় নজরুলকে ‘জগত্তারিণী’ পুরস্কার দেয় ১৯৪৫-এ। ভারত সরকার তাঁকে ‘পদ্মভূষণ’ উপাধি দেয় ১৯৬০-এ। রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৬৯-এ তাঁকে দেয় ডি-লিট উপাধি। কবির বােধক্ষমতা রহিত হবার পরের ঘটনা সে-সব। উনিশশ’ বাহাত্তরে দীর্ঘ বত্রিশ বৎসর পরে ঢাকায় আসেন নজরুল। এবং বলা যায় তখনই শুরু হয় তার তৃতীয় জীবন- আর এক বাঙালির মেলায়। সদ্যপ্রতিষ্ঠিত বাংলাদশ সরকারপ্রধান শেখ মুজিবুর রহমান কবির স্বাচ্ছন্দ্যের যথাসাধ্য ব্যবস্থা করেন। নজরুল দর্শনার্থীর অবিরল স্রোত দেখা যায় ধানমণ্ডিতে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাঁকে ডি-লিট উপাধি দেয়া হয় ১৯৭৩-এ। একুশের পদকও লাভ করেন তিনি। ১৯৭৫-এ। অভিযােগ করার আর কিছু থাকে না। একই সময়ে পশ্চিমবঙ্গের বামপন্থি সরকারের আনুকূল্যে নজরুল যেন পুনরায় প্রতিষ্ঠা পান। প্রতিষ্ঠিত হয় নজরুল একাডেমি। নজরুল চর্চায় উৎসাহ দেখা যায়। শুরু হয় নজরুল সঙ্গীত প্রতিযােগিতারাষ্ট্রীয় উদ্যোগেই। তাঁর গ্রাম চুরুলিয়াতে সাংবাৎসরিক নজরুল উৎসবের আয়ােজন করা হয়। মনে হয় তিনি প্রকৃতই আবার ফিরলেন সব বাঙালির ঘরেই। আসলেই কি তাই? সৃষ্টিক্ষমতা শেষ হওয়ার ত্রিশ বৎসর পরে, যেন শারীরিক মৃত্যুরও তিরিশ বছর পরে, এই যে নজরুল মনে হয় বাঙালির জীবনে আবার আসন পেতেছেন, তা কি যথার্থ? কিছু কিছু ব্যাপার স্পষ্ট দেখা যায়। যেমন নজরুল ইনস্টিটিউট কি নজরুল একাডেমির প্রতিষ্ঠা, তার জন্ম-মৃত্যু উৎসব পালন, নানা স্থানে নজরুল সম্মেলন, এমনকি প্রবাসেও- তাতে মনে হয় তিনি অবশেষে তাঁর যােগ্য স্থানটি পেয়েছেন। যদিও নজরুল সঙ্গীতচর্চার কিছু প্রসার ঘটা ছাড়া তাঁর রচনাবলি পাঠে বা প্রকাশে প্রচণ্ড আগ্রহ দেখা যায় না। কয়েক সহস্র কবিতা ও গানের বাইরে তিনটি গ্রন্থে সংকলিত আঠারােটি গল্প, তিনটি উপন্যাস, তিনটি নাটক এবং শিশুসাহিত্য ও প্রবন্ধাদি মিলিয়ে আরও বারােটি গ্রন্থ আছে তাঁর এই বাঙালির ক’জন সেইসব গ্রন্থ পাঠ করে? নজরুল কাব্যানুরাগীর সংখ্যা অবশ্য নগণ্য নয় কিন্তু তারা ‘সঞ্চিতা’র বাইরে খুব একটা খোঁজাখুঁজি করে না নজরুল কাব্যপিপাসা তৃপ্ত করার উদ্দেশ্যে। তাই ‘ফণিমনসা’, ‘সিন্ধুহিন্দোল’, ‘চক্রবাক ইত্যাকার গ্রন্ধের প্রচ্ছদটিও সকলের চোখে দেখা আছে বলে মনে করবার কারণ নেই। নজরুল ইসলামের গান একটি জনপ্রিয় প্রসঙ্গ অবশ্যই। তবুও প্রায় আড়াই হাজার গানের মধ্যে মাত্র গােনাগুনতি ক’টি গানই, সম্ভবত কয়েকশতও নয়, বারবার শােনেন নজরুলসঙ্গীতরসিক। আলােচিতও হয় সেইসব গান। কিন্তু সে আলােচনায় আগ্রহীর সংখ্যা অগণিত নয়। আবার সম্পূর্ণ অসাঙ্গীতিক কারণে অনেক নজরুলগীতি বর্জিত হয় কিছু শ্রোতা কর্তৃক। অথচ একসময় ছিল, নজরুল শিক্ষিত বাঙালির আসরে সর্বদা আলােচিত হতেন। যে কবির বারােটি গ্রন্থ সরকার বাজেয়াপ্ত করেন, যে সম্পাদকের পত্রিকার ছাপাখানায় পুলিশ তালা ঝুলিয়ে দেয়, কি কবিতা লেখার দায়ে যে কবিকে কারারুদ্ধ হতে হয় তিনি যে সমকালীন জনমানসে দেদীপ্যমান থাকবেন এ সামান্য কথা। কিন্তু জনচিত্তে তাঁর ঐ অবস্থান ঐ-সব কারণেই চিরকালীন হবে এমন ভাবা সঙ্গত নয়। সমালােচকরা বলেন, সমকালীন রাজনীতির যে চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য যা নজরুলের সময়ে ব্রিটিশ বিরােধিতার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল তা পরবর্তীকালে ব্যবহারযােগ্য নয়। বাংলাদেশের সৃষ্টিকালে নজরুলের বিদ্রোহী গান কিয়ৎপরিমাণে জনচিত্তে প্রেরণা সঞ্চার করলেও কংগ্রেস-তৃণমূল-সিপিএম-বিজেপি কি আওয়ামীবাজাদল-জাপার ডামাডােলে বর্তমান সময়ে সকলকে সমভাবে উদ্দীপিত করবে না। এই সময়ে ধরা যাক গত ত্রিশ চল্লিশ বছরে, নজরুল চর্চা-স্রোতটি মূলত প্রবাহিত এক ভিন্ন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে নজরুল ইসলামের ব্যবহারকে কেন্দ্র করেই। এখানে তার বিদ্রোহের বাণী নয়, কি প্রিয়ার খোঁপায় তারার ফুল নয়, এমনকি ফোলা পাল দোলা তরণীর কাণ্ডারীও নয়, এ সব কিছুই এখানে কাজে লাগে না, এখানে কাজী নজরুল ইসলাম’ এই নামটিই কেবল মুখ্য থাকে এবং এই নামধারী প্রয়াত মনুষ্যশরীরটিও। তাঁকে ঘিরে সৃষ্টি হয় কিছু অলীক তত্ত্ব, উদ্দেশ্যমূলক তথ্য ও রাজনৈতিক প্রয়ােজন। প্রকৃত কাজী নজরুল ইসলাম- কবি, গল্পকার, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, গীতিকার, সুরস্রষ্টা, সম্পাদক, রাজনীতিবিদ, অভিনেতা, গায়ক, প্রমীলার স্বামী, কৃষ্ণমােহাম্মদের পিতা কাজী নজরুল ইসলাম সেখানে যেন কেউই নন। তাহলে কি বিশেষজ্ঞদের কথা, “নজরুলের প্রতি আমাদের মনােভাবের পশ্চাত্বর্তী কারণটি কাব্যজাগতিক নয়, ভিন্নতর, এমনকি সেটি সর্বাংশে তাঁর প্রতি আমাদের ভালােবাসা থেকেও উদ্ভূত নয়” মেনে নেয়া চলে? তাঁরা যখন বলেন, “মানুষ ও শিল্পী হিসাবে কবি নজরুলের বিচার কখনােই শ্রেয়বােধ থেকে করা হচ্ছে। সেখানে সর্বদাই ধর্মীয় সাংস্কৃতিক চিন্তা ও ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতিবুদ্ধি এসে বাদ সাধছে”, তখন কি ঠিকই বলেন?
এখানে পশ্চিমবঙ্গের কথাও তােলা যাক। নজরুলের মৃত্যুর দু’দশক পূর্বের সাহিত্য, সংস্কৃতির ইতিহাস পর্যালােচনা করলে পশ্চিমবঙ্গে নজরুল চর্চার কোন উল্লেখযােগ্য নিদর্শন পাওয়া যায় না। বামপন্থি সরকারের উদ্যোগে গত পঁচিশ তিরিশ বছরেই যার প্রসার ঘটেছিল সেখানে। কিন্তু ভারতীয় রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িক শক্তির উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে নজরুলবিদ্বেষ প্রচারের চেষ্টা আবারও যে হবে না সে-দেশে এ ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া যায় না। কিছুকাল আগে নজরুল-জন্মজয়ন্তি পালনে বাধা দেয়া কি নজরুল একাডেমির পরিচালককে নির্যাতন করার যে-সংবাদ পাওয়া গিয়েছিল তাতে মনে হয় আবারও নজরুলকে সে-দেশে সাম্প্রদায়িকতার নিরিখেই বিচার করার চেষ্টা চলছে। অন্তত কিছু লােকের মধ্যে তাে বটেই। আর এক বাঙালি সমাজে। তাহলে কীভাবে আমরা বাঙালি সমাজে তাঁর পুনর্জীবন লাভের ঘটনাবলিকে বিচার করি? মহৎ স্রষ্টা- লেখক, কবি, শিল্পী বাঁচেন তার রেখে যাওয়া উত্তরাধিকারের মধ্যে। জনচিত্তে তার স্থায়িত্ব নির্ণয়ের অনপনেয় যে-চিহ্নটি তিনি রেখে যান সমাজচরিত্রে, তারই বিচারে। নজরুলও তেমন চিহ্ন রেখে গেছেন। শিল্প-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে কিন্তু তারও চেয়ে আরও বড় কিছু চিহ্ন রেখে গেছেন তিনি। যা স্পষ্ট দেখা যায় তাঁর জীবনের দিকে তাকালে, তাঁর শিল্পকর্মের দিকেও। সেটি হচ্ছে বাঙালি সমাজে ধর্মভেদবুদ্ধিহীন এক মিলিত, সমন্বিত সংস্কৃতির। যে সংস্কৃতির পরিচয়ে নিজেদের শনাক্ত করতে পারলে কত সহজে দূর হতাে বাঙালি জীবনের এক মহা অভিশাপ। দুঃখ এই, সেই চিহ্নের দিকনির্ণয়ে আমরা নিয়ত ভুল করি।