কবিতায় জেগে ওঠা নতুন চর মতিন বৈরাগী: মৃধা আলাউদ্দিন
নদী দেখলেই তোমাকে মনে পড়ে
উজানের আছাড়িপিছাড়ি তমস্যায়
তুমি নদী হয়ে গ্যাছো…
ভালো নেই আমি, আমাদের লাল-নীল প্রজাপতিগুলো…
সবাই চলে গেলেও আমি জেগে থাকি একা
জেগে থাকি রাত জাগা পাখির মতো;বিমূর্ত বেদনায়…
এরকম আরো অনেক পঙ্ক্তিতে বিবৃত হয়েছে কবি মৃধা আলাউদ্দিনের কবিতা– বলা যায় নতুন কাব্যের প্রয়াস। ‘উজানের’ অর্থাৎ বৈরীতার তিত-তিক্ততায় নদী যেমন মরে যায় তার সচলতা শীর্ণ হয়ে পড়ে, তার উচ্ছ্বলতা উধাও হয়ে এক নদী যেমন হারায় দিশা তেমনি নানা প্রতিকূলতা জীবনকে করে সীমিত, অর্থহীন কঙ্কাল মানুষ, আশাহীন এক ভবিষ্যতের; অর্থ ও বোধহীন করে জীর্ণ নদীর মতো এক অচেনা অস্তিত্ব। মৃধা একই সাথে প্রেম-ব্যথা, দ্রোহ ও রোমান্টিক ধারার কবি, তার কবিতায় অন্তর্গত এক প্রেমের বিবৃতিই বেশি মাত্রা আবেগায়িত হয়েছে কাব্যভাষার মোড়কে। সে কেবলই একটা গতানুগতিকতার মধ্যে সীমিত থাকেনি বরং অন্তর্মানসীর কষ্ট-দুঃখ-বেদনারাজি সমাজের যে সামাজিক অসঙ্গতিরই উপাদান থেকে সংক্রমিত এবং তা যে ভালোবাসাময় জীবনকে আর সহায়তা দেয় না, অর্থাৎ স্বাভাবিকতার মধ্যে যে অস্তিত্বকে নির্মাণ করে না কবির লেখায় মনোযোগ দিলে সেই সত্য দৃশ্যমান হয়ে ওঠে।
‘শুঁড়িখানার নরম দেহ, কাবাব ভুনা,
আদিরসের নিষ্প্রয়োজন
কান্নাভেজা জীবনে আজ আমার দেখি সবার আগে বিষ প্রয়োজন।’
কাব্যভাষায় এই তরুণ কবি ধীরে ধীরে যে পারঙ্গম হয়ে উঠেছে তা তার কবিতাই বলে দেয়। মৃধার নির্মাণ করা উপমা, উৎপ্রেক্ষা এবং বৈপরীত্যও অনেকখানি স্বতন্ত্র করেছে আমাদের। ‘বেহায়া বাতাস উড়াচ্ছে চুল’, ‘জলের বিছানা’, ‘পাথর প্রেমিক’, ‘অমীমাংসিত কোনো সৌন্দর্য’ ও ‘সামনের শীতে মানুষ রৌদ্র হয়’ ইত্যাদি নির্মাণ তার কল্পনাশক্তিকে চিহ্নিত এবং শনাক্তযোগ্য করে।
মানুষের সকল কাজ সামাজিক এবং যৌথ। স্বতন্ত্রতার মধ্যেই যৌথ জীবনের স্বাতন্ত্র্যতা। ব্যক্তি এবং ব্যষ্টির যেমন দূরত্ব রয়েছে, রয়েছে নৈকট্যও। সকল সৃষ্টি স্বতন্ত্র ব্যক্তির কিন্তু সকল সৃষ্টির প্রয়োজনীয়তা সমাজের। সৃষ্টিতে অভিজ্ঞতা লাগে, অভিজ্ঞতা পূর্বজ এবং সামাজিক। এর মধ্য দিয়েই পরিবর্তনগুলো ঘটে এবং প্রতিটা পরিবর্তনে নতুনদের ভূমিকা থাকে খুব ছোট্ট, খুব সাধারণ কিন্তু এই সাধারণের মধ্য দিয়ে তরুণরা এমন কিছু উপাদানের সৃষ্টির করেন যা পূর্বকে আরো নতুন করে এবং দিক পরিবর্তনের যাত্রায় যুক্ত করে। সন্ধান দেয় জমিন বা নতুন চরের।
‘সামনের শীতে মানুষ রৌদ্র হবে’ বইটির কবিতাগুলো পড়ে আমার মনে হলোÑ এই তরুণ আগামীতে তার প্রকাশে এমন কিছু সংযোজন করবেন যা তাকে পরবর্তী সময়ের কবি বলে শনাক্তকরণে আর কোনো দ্বিধা থাকবে না। প্রস্তুতি পর্বে তার প্রকাশগুলো দিশাযুক্ত হয়ে বিষয় নির্বাচন ও রূপের সমন্বয়কে উজ্জ্বল করে তুলতে তেমনটা না পারলেও, কবিতার গঠনশৈলীতে তার স্বাতন্ত্র্য আছে। আছে ভাষা প্রয়োগের দারুণ দক্ষতা।
এসো আমরা চলে যাই
জনান্তিকে, রাস্তায়,
টর্নোডো, টাইফুন ছেড়ে
জৌলুসপূর্ণ রৌদ্দুরে…
… … …
তুমিতো আমার কাছে
আদি আয়নার মতো
সাত রং, ষড়ৈশর্য্য
এরকম আরো অনেক নির্মিত পঙ্ক্তি তার কবিতাগুলোতে রয়েছে। মৃধা কবি এবং কবিতার প্রস্তুতি পর্বে তার আন্তরিকতা আমাকে এই প্রতীতি দেয়, সে আগামীর উত্থানপর্বে দক্ষতার স্পষ্টতা তৈরিতে পারঙ্গম হবেন। তার কবিতায় জেগে ওঠা নতুন চরের ঘ্রাণ পাওয়া যায়। …কবিতা মূলত বিষয় ও রূপের নির্মাণ যার ভেতর বহুর উপস্থিতি কবিতাকে পাঠক গ্রাহ্য করে। মৃধার কবিতায় সমাজের রোগশোক, ভালোবাসা ও রঙের বিমূর্ততার অনুষঙ্গগুলো শনাক্ত করা যায়। কবি মৃধা আলাউদ্দিনের জন্য আমাদের শুভ কামনা।
কবিতায় মনকে বিষয়রূপী করেন কবি, আবার বিষয়কে মনোরূপী মন লাগোয়া করে উপস্থাপনও করেন কবি। স্বাভাবিক পর্যায়ে একজন পাঠক যতক্ষণ না বিষয়ে বিস্তৃত হয়ে বিচরণ করতে অপারগ থাকেন কিংবা দলবাজি বা সুবিধাবাজির মোহে মোহাক্রান্ত হয়ে গ-িবদ্ধ পাঠের অনীহাকে পাঠলগ্ন করেন তখন তার কাছে কবিতার মূল অনুনন্মোচিত থাকে। কারণ কবিতায় যে ভাষা ব্যবহৃত হয় তা বাহুল্যবর্জিত এবং প্রচলিত অর্থকে দর্শন অভিজ্ঞতার নিকটবর্তী করে। তাই কবিতার দৃশ্যমানতায় যে স্থিতি একজন সাধারণ পাঠকের কাছে, একজন অনুসন্ধানী পাঠক আবিষ্কার করেন ভিন্ন কিছু যা তার ভেতর থেকে দেখা। আর তখনই কবিতা হয়ে ওঠে বর্ণিল নানা রঙা পেখমমেলা ময়ূরের মতো। যদিও একটি কবিতাকে ভেতর থেকে দেখা এবং বাহির থেকে দেখায় এই পার্থক্য তা কিন্তু ভাষার বিভ্রমাত্মকতার কারণেই। কারণ ‘ভালোবাসা’ একটি শব্দ বহুল চর্চিত ব্যবহৃত এবং দয়িত-দয়িতার প্রগাঢ় উচ্চারণ। কিন্তু এখানে শব্দটি অন্যকোনোভাবে কবিতায় ব্যবহৃত হয়ে এই দুইয়ের ব্যবহারের সীমাকে অতিক্রম করে বিশ^ময়তার রূপ উপস্থাপন করে একজন পাঠকের কাছে। যখন কোনো কবি বলেন ‘আমরা একত্রে আছি বইয়ের পাতায়’ তখন কেবল একজন পাঠক এবং একটি বইয়ের সীমায় উপস্থিত থাকে না পঙ্ক্তিটি বরং পরস্পরতাকে পাঠ অর্থাৎ উপলব্ধি করা, স্মরণ করা, স্মৃতিকে আরো স্মৃতিময় করে চিরময়তার দিকেই তার অর্থকে প্রসারিত করে প্রস্তর অন্তর বিগলিত করার এক অনুভূতির আবেশ ছড়িয়ে এবং অন্তরঘন প্রেমের আস্বাদ এনে দেয় পাঠকের মনে। অথচ ভাষার সাধারণ আচরণে এই পঙ্ক্তিতে ব্যবহৃত শব্দগুলো আমাদের প্রতিদিনের এবং কোনো শব্দই গুরুগম্ভীর নয়, অর্থ নিষ্কাশনে অভিধানেও যেতে হয় না, আবার প্রত্যেকেরই রয়েছে চলমান অর্থ, কিন্তু তার কোনোটাই আর সামগ্রিকতায় ছিন্ন হয়ে নেই; হয়ে উঠেছে এমন এক অনুভূতি যাকে পাঠক অনুভব করতে পারেন নিজের মধ্যে যৌক্তিক পাঠাবেগে। সে কারণে কবিতার পাঠককে কবিতা উপলব্ধির প্রশিক্ষিত অভ্যাস গড়ে তুলতে হয়। যেমন : দর্শনকে বুঝতে হলে দর্শন পাঠ ও পাঠপ্রশিক্ষণ আবশ্যক। এ হলো কবিতা নিয়ে বিশেষ বলা, তাই বলে কি সাধারণ পাঠে কবিতা নিষিদ্ধ হবে? উত্তর সরাসরি না, প্রতিটা মানুষের কতোগুলো সাধারণ বোধজ্ঞান আছেÑ যা সে লাভ করেছে সামাজিক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে, যেমন তার জন্মের পর মা-বাবা প্রতিবেশী, রাষ্ট্র ও সমাজ তাকে যে জ্ঞান পাঠে সামর্থ্য দিয়েছে তা সবার ক্ষেত্রেই ঘটে কমবেশী। কিন্তু বিশেষ কিছু ব্যক্তির মেধা ও মন আবেগে থাকে। থাকে রসায়নের ভিন্নতায়ও। সে ক্ষেত্রে অধিক মননশীল পাঠক একটি কবিতা যেমনভাবে বিস্তৃত করে পাঠে নেবেন কিংবা অন্য যেকোনো বিষয়ে, অন্য পাঠক নেবেন বিবৃতির বিস্তৃতির আবেগ থেকে, গভীর থেকে হয়তো নয়। এখানেই কবির সঙ্গে দুই ধারার পাঠকের পরিচয় ঘটে তার অজ্ঞাতে এবং দুই রকম অর্থদ্যোতনায় বিলীন হয়ে যায়। আমাদের আজকের আলোচিত কবি মৃধা আলাউদ্দিন পাঠককে অর্থদ্যোতনা, নান্দনিকতা ও যমজ শব্দে বিলীন করতে সক্ষম হয়েছেন-
‘দেহভরা পাকা ফলে আজ তনুদেহখানি চিনি
আমারে ছুঁয়েছো যেনো কামনার রসে-জলে চিনি।’
দার্শনিক হাইডেগারের মতে ‘ধারণাগত বিশ্লেষণ বাস্তব অস্তিস্ত সম্বন্ধে যথার্থ ধারণা দেয় না, তিনি মনে করতেন অস্তিত্বের মধ্য দিয়ে আমরা সত্তার কাছাকাছি যেতে পারি।’ কবিতায় আনন্দ তার বাস্তব সত্তা অনুসন্ধানে। প্রাত্যহিক জীবনের কথাবার্তায় কবিতার শরীর গঠিত হলেও এতে থাকে এমন কতগুলো অর্থদ্যোতক পঙ্ক্তিমালা যা জীবনের বাস্তবতাকেই অনুসন্ধিৎসু মনোবৃত্তিকে আকর্ষিত করে, যদিও তা সকল পাঠকের ক্ষেত্রে ঘটে না কারও কারও ক্ষেত্রে বিরাজমান থাকে। আর তখনই কবিতাটি একটা সার্থকতাকে স্পর্শ করতে পারে। হাইডেগার বলেন ‘কবিতা নতুন ভাষার সৃষ্টি করে কারণ কবিতায় দার্শনিকতা রয়েছে তিনি মনে করতেন দর্শনকে যুক্তি ও যুক্তিবিদ্যার বিপরীতে একটি নতুন চিন্তাপদ্ধতি গড়ে তুলতে হয়। তবে এ কাজে দার্শনিকের নিকটতম বন্ধু হলো কবি।’ হাইডেগার দর্শন ও কাব্যকে অনেক কাছাকাছি বলে মনে করতেন। কবিতার শুরু হয় ভাষাহীন অবস্থা থেকে যেমন একটি শিশুর জীবন শুরু হয় আগামীর বাস্তবতার শূন্যতা থেকে এবং তারপর নানা সময়ের বাস্তবতা তার আয়ত্তাধীন হয় কবিতাও শুরু হয় ভাষাহীনতা থেকে এবং শেষাবধি তাকে ভাষার মধ্য দিয়ে ভাষাকে গড়ে নিতে হয় যাকে বলে মসৃণ শব্দাবলি ‘টেন্টড ল্যাংগুয়েজ’ বোধ উপযোগী নতুন অর্থের দ্যোতকতা নিয়ে ভাষার ভুবনে এবং ছুঁয়ে দেয় পাঠকের মন। তাই কবিতা ভাষাহীন অবস্থা থেকে ভাষায় উত্তরণের একটি ক্রিয়া যা সামগ্রিকতায় আমাদের দৈনন্দিনতাকে ছাপিয়ে চিন্তার অগ্রগামীতাকে স্পর্শ করে এবং নতুন চিন্তার উৎস হয়ে ওঠে। তাই কবি ও পাঠক একটি কবিতার মধ্যে অনেক দূরের এবং আবার অনেক কাছের হয়ে উঠতে পারেন। মৃধার কবিতা পাঠককে দূরে নয়; কাছেই টেনে নেয়
‘এবঙ একদিন ভালোবাসার নামাবলি, নতুন টুলটুলে টোপর ও শিশিরের অজ রঙিন রেশম গায়ে দিয়ে উড়ে গেল পাখিটা। ভুল করে, রাতের আঁধারে চলে গেল দক্ষিণের চিরহরিৎ পাতা ঝরা প্রান্তরে।’/উড়ে উড়ে অস্থির, এলোমেলো ও শ্রান্তরসে আবারো দিকভ্রান্ত হয়ে যাচ্ছিল পাখিটা…। নদীর চারপাশ, আকাশের ওপারে নীলাকাশ; অদেখা ভুবনে ঘুরে ঘুরে সবুজ প্রান্তরে ফিরে এলো উদ্ভান্ত পাখিটা।
অতীতের মানুষ যেমন মানুষ আর বর্তমানের মানুষও মানব প্রজাতিরই ধারাবাহিকতায় কিন্তু এর মধ্যে যে বিরাট পরিবর্তন তা আকার আকৃতিতে নয়, বরং চিন্তার ক্ষেত্রে বদলানো জীবনযাত্রার ক্ষেত্রে, অভ্যাস ও রুচির ক্ষেত্রে, জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে। স্বাভাবিক যে কবিতাও সময়ের বিবর্তনে তার গঠনে অতীতের নানন্দিক বিষয়াবলির মধ্যে সীমাবদ্ধ বা সীমিত নয়। দয়িত-দয়িতার পারস্পারিক কামনা বাসনাতে সীমিত ও নয়। আজকের কবিতা সত্যকে অনুসন্ধানের এবং উপলব্ধির ভাষায় উপস্থিত হয়েছে। আজকের আনন্দ কেবল অতীতের সামন্তীয় সমাজের যৌনতা, দৈহিক চাহিদাকে সম্বল করে বিষয়গত হবার সীমার সীমাবদ্ধ নয়, বরং আকাক্সক্ষার উচ্চতম রূপবিকাশে মননবদ্ধ। আজকের কবিতায় বিষয় যৌথ হয়ে যায় সমাজ রাজনীতিকে সাঙ্গীকরণের মাধ্যমে, নতুন মানুষের নতুন চাহিদা তৈরি এবং পরিপূর্ণ করার তাগিদে। তাই কবিতা বিপ্লবের, বিদ্রোহের, মন-বিকাশের, সমাজ রাষ্ট্র পরিবর্তনের হাতিয়ার হয়ে মানুষের চাহিদাকে শিল্পের মোড়কে উপস্থাপন করে। অন্তত মৃধার দ্রোহের কবিতা আমাদের তাই বলে-
‘এখন কি কিছুই করতে পারে না ওআইসি আরব লিগ অথবা ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন?
ওরা কি বোবা, নিথর, নিস্তব্ধ নীরবে দাঁড়িয়ে থাকা স্টাচু অব লিবার্টি?
হাস্যকর লেনিনের মূর্তি?
নাকি ওরা পেন্টাগন ও টুইন টাওয়ারের মতো ধ্বংসের ধোয়া
যা বরাবরই মিশে যেতে পছন্দ করে বৈষম্যময় নিষ্ঠুর পর্দার আড়ালে।
তবে ধ্বংস হোক জাতিসংঘ, তার সমস্ত অনুচর।
ব্যাঙের ছাতার মতো ধ্বংস হোক ওদের সভ্যতা,
হেরে যাক বসরাই গোলাপের কাছে লাল, শাদা, প্রাচুর্যময় সবুজ গোলাপ…
প্রতারক পিতার মতো ধ্বংস হোক পৃথিবীর পচা ডিম অথবা এই জাতিসংঘ।
বুশ-ব্লেয়ার-শ্যারন কি একেকজন পিতা?
না, পিতা নয় ওরা ধ্বংসের প্রাচুর্য এবং অবশ্যই ওরা নিমিজ্জত হবে হুতামায়।
তুমি জানো হুতামা কি? হুতামা আল্লাহর প্রজ্বলিত অগ্নি;
যা জ্বালিয়ে রাখা হয়েছে এবঙ লাগামাত্রই হৃৎপি- পর্যন্ত পৌঁছে যায়।’
নিছক ছন্দ দোলা আর পরজীবনের বিবৃতি নয়, বরং অস্তিত্বকে পুনঃস্থাপনের হাতিয়ার হয়ে এক বিদ্রোহের রূপায়ন। তাই কবিতায় থাকে নতুন জীবনের অনুসন্ধান, জীবনযাত্রার সাদৃশ্য-বৈশাদৃশ্য, থাকে চিন্তার বিস্তৃতময় প্রাঙ্গণ, উল্ফন, আকস্মিকতা, থাকে হটকারিতা এবং বিজ্ঞান ও ইতিহাস চেতনা। চেতনার বিদ্রোহ নানাভাবে বিস্তৃত থাকে আজকের কবিতায়, অভ্যাস ও রুচির বিরুদ্ধে থাকে বিদ্রোহ। এভাবেই একটি কবিতা ভাষাহীন অবস্থা থেকে সচল একটি ভাষাকে উপজীব্য করে চিন্তার বৃত্তকে ছেদ করে। এসব বয়ানে টেক্সটগুলো কখনও কখনও এলোমেলো হয়ে উঠতে পারে। কিন্তু কবির বুননে তার একটি সংহতি থাকে কবিতার মধ্যেই, আর সেটাই হয় কবিতাটিতে প্রবেশের চাবি। কখনও কখনও দেখা যায় ভাষ্যগুলো আসছে পরম্পরাহীন। কিন্তু সামগ্রিক কাঠামোতে তা ফুটে আছে পঙ্ক্তি হয়ে অর্থকে দ্যোতিত করছে গঠনের মাত্রায়। গঠন ক্রিয়ায় এজন্য কবিকে মনোযোগী হতে হয় এবং পাঠককেও সূত্রগুলোর একীভূত করণ ক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। নিছক ফ্যান্টাসিও যে ফ্যান্টাসি নয় বরং কবির অন্তরগত বিদ্রোহ তাকে নিজ অনুভূতি দিয়ে অনুভব করে নিতে পারলে কবিতাটির আনন্দকে একজন মনোযোগী পাঠক কবিতাকে জেগে ওঠা নতুন চরের মতো আয়ত্তে নিতে পারেন-
‘হে নদী! অশ্বারোহী আপেল
গাছের রৌদ্র ছেড়ে দেবো
এবঙ অভিন্ন ভ্রণ, খুলে যাবে খাল
খালের খোল,
খৈয়াম-
যেনো সামনের শীতে, শীত মানুষ রৌদ্র হয়
ঝরনা হয় পৃথিবীর অর্ধেক।’
সঙ্গত কারণে ভাষাহীন অবস্থান থেকে কবিতা ভাষাসূত্রকে অবলম্বন করে শরীর বুনন করে এবং ভাষার মধ্য দিয়ে নতুন দিগন্তে উপনীত হয়। তাই কবিতা যেমন কবির সৃষ্টি তেমনি পাঠকেরও। কারণ পাঠোদ্ধারের মধ্য দিয়ে পাঠক কবিতাকে নতুন করে নতুনভাবে রচনা করেন। মৃধার দোঁহাগুচ্ছ পাঠক মহলে নন্দিত হবে বলেই আমাদের দৃঢ় বিশ্বাসমিনার থেকে ডাক দিয়ে কয় আয়রে সাকি দ্বার খুলে দে শুঁড়িখানার/জীবনযুদ্ধে ছুটবে এখন মানুষগুলো- চাল কল এবং গুঁড়িখানার।
২. হঠাৎ দেখি হুর-পরি না কারা যেনো নূপুর কিংবা নুড়ি নাড়ায়/গভীর রাতে একলা আমি বেহেড মাতাল কাঁপতে ছিলাম শুঁড়িখানায়।
৩. মধ্য রাতে শুঁড়িখানায় এমন করে দিলে যখন হাত ছেড়ে/নীল ব্যথাতে বুকের ভেতর শব্দ হলো যেমন করে কাঠ চেড়ে…।
৪. জীবন কেনো যায় না ধরা, যায় না ধরা- নারীর দেহ নদীরে/আমার কথা বলব সবি শুঁড়িখানায় খোদারে পাই যদিরে।
৫. নর্তকীদের নূপুর কিংবা ঢোলের রঙে যাচ্ছি নেশায় গড়িয়ে/রাত ফুরায়ে ভোর হয়েছে, কাঁপছি আমি পড়ছে আলো ছড়িয়ে।