অণুগল্প।। জল্লাদ।। ফারহানা নীলা

রাতটা নিকষ কালো নয়। মিয়া বাড়ির পুকুরে নারিকেল পাতার ফাঁকে উঁকি দেয় চাঁদ। মুসল্লিরা সব নামাজ শেষে ঘরে ফিরে গেছে। ঘরগুলোতে ধীরে ধীরে নীরবতা গেঁড়ে বসে। দু একটি ঘরে তবু মিছে শোরগোল। অশ্রাব্য কিছু কথা কানের পর্দায় বাড়ি খেয়ে ফিরে গেছে বাতাসের কাছে। এই পথ বহু চেনা তবু আজ ভীষণ অচেনা লাগছে। সন্ধ্যা নাগাদ এখানে পৌঁছেছে তারা মিয়া। যেখানে নিজেদের ঘর ছিল সেই জায়গাটাও কেমন বদলে গেছে। কত বছর পর গ্রামে এলো? হিসেব কষে মনে মনে তারা মিয়া। চেয়ারম্যান খুন হলো। কে বা কারা খুন করে লাশটা ফেলে রেখে গিয়েছিল ইন্দারার পাশে। বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে আছে মজনু চেয়ারম্যান। মুখটা খানিক হা করা। রক্ত চুইয়ে নাকি গড়িয়ে পড়ছে? সকালের আলো ফুটতেই তারা মিয়া মাঠে যায়। ইন্দারার পাশে কুকুরের হাঁকডাক শুনে এগিয়ে আসে তারা মিয়া। ততক্ষণে বাড়িগুলো জেগে ওঠে। লোকজন জড়ো হতে থাকে ইন্দারার পাশে। মজনু চেয়ারম্যানের বাড়িতে তখন বিলাপের সুর। পুলিশের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে হিমসিম খায় তারা মিয়া। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে প্রশ্ন করছে।সন্দেহের তীর তাক করা। মজনু চেয়ারম্যানকে খুনের দায়ে ধরে নিয়ে গেল তারা মিয়াকে। পরিবারের কারো এই আইনি লড়াই করার সামর্থ্য নেই।নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে পারেনি তারা মিয়া। জেল হাজতে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হলো। প্রথম প্রথম কষ্ট হতো। এরপর পাষান হতে শিখে নেয় তারা মিয়া। মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার জন্য প্রথমে সহযোগী ছিল। এরও অনেকদিন পর নাম হয় জল্লাদ তারা মিয়া। ফাঁসির আসামীর ফাঁসি কার্যকর করতে ডাক পড়ে। মাঝেমধ্যে নিজের হাত দুটো নাড়াচাড়া করে। ” কী রে কতজন?” ” আর কতজন?”ক্রুর হাসিতে কে যেন বিদ্ধ করে।পাগলের মতো খোঁজে তারা মিয়া ” কে? কে ওখানে?” জল্লাদ জীবন নিয়ে পালাতে পারেনি বলে যেদিন তাকে মুক্ত করে দেওয়া হলো,সেদিন জেলগেটে বসে গন্তব্য কোথায়? এই প্রশ্নের কাছে বারবার হেরে গেছে। স্টেশনে বসে দেখেছে কত কত মানুষ। তাদের কাউকে চেনা মনে হয়নি। জীবনটাকে বাদামের খোসার মতো মনে হলো। বাতাস উড়িয়ে নেয় কোথায়? কে জানে? গ্রামের মানুষ কেউ চেনেনি এই মানুষটাকে। যে সময় গড়িয়ে গেছে, সেই সময় পিছে ফেরে না। ইন্দারাটা নেই। নেই সেই বিশাল কড়ই গাছটা। বাড়ির আশেপাশে ঘোরে। অথচ কী ভীষণ অচেনা এরা? কোথায় যাবে? কার কাছে পরিচয় দেবে? সারাদিন খাওয়া হয়নি।পকেটে কানাকড়ি নেই। মিয়া বাড়ির পুকুরে চাঁদের ছায়া।এই চাঁদটা আগেও ছিল ঠিক এমনই। ছোটবেলায় কতদিন চাঁদের পিছু নিয়েছে বন্ধুদের সাথে। আজ চাঁদটাকে বাগে পেয়েছে তারা মিয়া। ঝুপ করে একটা শব্দ। জলের সাথে ভেঙে ভেঙে যায় চাঁদ। প্রাণপণে হাতড়ে তন্নতন্ন খোঁজে সেই পরিচিত চাঁদের ছায়া। ফজরের নামাজের জন্য ওযু করতে আসে মুসুল্লিরা। একটা লাশ ভেসে উঠেছে ফুলেফেঁপে। একজন জল্লাদ জীবন নিয়ে পালিয়ে গেছে। কেউ চেনে না এই আগুন্তককে। তার জন্য কেউ কাঁদেনি। শুধু রাত হলে নিকষ আঁধার ফুপিয়ে ফুপিয়ে জল মাপে। জল্লাদ জীবন কতটা ভারি? সেটা মাপে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *