অনুকূল বিশ্বাস এর গল্প অন্য পুজো
অন্য পুজো
একরাশ প্রত্যাশা নিয়ে রাত শেষে ভোর হয়। ভগ্ন কুঁড়ে ঘরে হ্যারিকেনের ক্ষীণ আলোয় বালিশে মাথা রেখে ঘুমোনোর আগে ভোরের প্লানটা করেই নিতে হয় ঝন্টুকে। না হলে যে পরের দিন বাড়ির সকলকে উপোস করে কাটাতে হবে।শরতের আকাশে বাতাসে যখন পুজো পুজো গন্ধ,চারদিকে ঢাকির বাদ্যিতে কান ব্যতিব্যস্ত, নতুন পোষাকে বাহারী সাজে ছোটো বড় সকলে এক মন্ডব থেকে আরেক মন্ডবে ছুটছে, নতুন পোষাক,নতুন ভাবনা,নব আঙ্গিকে বাঁচার অঙ্গীকার নিয়ে সবাই যখন ব্যস্ত— তখন ঝন্টু ব্যস্ত কোনো বিল ,ঝিল,পুকুর কিংবা শহরের চরম অস্বাস্থ্যকর বিষাক্ত ড্রেনের জমা জলের জলাশয়ে জন্মানো কচু গাছ বা হ্যালন্চ শাক তোলার কাজে। তাই দূর্গাপূজা আর নতুন পোষাক ঝন্টুদের জীবনে স্বপ্ন, আর নব আঙ্গিকে বাঁচা ! সে তো দুঃস্বপ্ন।তাঁদের জীবনে একটাই আঙ্গিক –পেট পুজো , দুবেলা দুমুঠো অন্নের সংস্থান হলেই তাঁদের সব পুজো হয়ে যায়।
তাঁর ছেলেটি যখন এমন নতুন পোষাকের আবদার করে কিংবা খেলনা বন্দুক কিনে দেবার বায়না ধরে — ঝন্টু ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলে ‘সোনা ওগুলো বড় লোকরা পরে,আমাদের জন্য দূর্গাপূজা নয়’। তখন ছেলেটি পাল্টা প্রশ্ন করে ‘বড় লোক কারা হয় বাবা’? আবেগ বিগলিত ঝন্টুর গলা দিয়ে কথা বের হয় না।তবুও ছেলের প্রশ্নের উত্তরে বলে ‘ ঐ যে রাস্তা দিয়ে যাঁরা নতুন নতুন পোষাক পরে পুজোয় আনন্দ করে বেড়াচ্ছে তাঁরাই বড়লোক সোনা ‘। ঝন্টু কথা গুলো শেষ করে ছেলের চোখের সামনে অশ্রু সংবরণ করতে পারে না ,তাই তাকে বলে ‘দ্যাখ তো রান্না ঘরে তোর মা কি করছে’? ছেলের সামনে চোখের জল আটকালেও সে নিজের কাছে তো আটকাতে পারেনা । বাবা হিসেবে ছেলেকে দূর্গাপুজোয় নতুন পোষাক কিনে দিতে না পারা যে কতটা বেদনাদায়ক ঝন্টু নিজেকে দিয়ে তা উপলব্ধি করে। মাঝে তার মনে হয় এমন জীবন ঈশ্বর না দিলেই ভালো করতেন। যে জীবনে সন্তানের সর্বনিম্ন চাহিদা পূরণে বাবা অক্ষম এমন জীবনের কোনো মানে হয়না।
প্রতিদিনের মত পুজোর পাঁচটা দিনও ঝন্টুকে কচুগাছ তুলতে হয়।কয়েক ঘন্টা অমানুষিক পরিশ্রম করে সে গুলো ভ্যানে তুলে সকাল সকাল বেরিয়ে পড়ে সে।যথারীতি পরিচিত পাড়ায় পাড়ায় ঘুরতে থাকে সে। ঝন্টু সেই পরিচিত গলায় হাঁক পাড়ে ” বাবু–কচু নেবেন কচু”? প্রতিদিনের ন্যায় আজও তাঁর হাঁক রাস্তা পেরিয়ে বাড়ির অন্দরমহলে পৌঁছে যায় ।পরিচিত পাড়ায় কিছু পার্মানেন্ট খরিদ্দার আছে তাঁর। যাঁরা প্রতিদিন একটি করে কচু কেনেন তাঁর কাছ থেকে। অন্যদিনে ঝন্টুর হাঁকে বাড়ির সদর দরজা হাট করে খুলে যায় , সে বুঝতে পারে বাবু কচু নেবেন বলে এসেছেন ।কখনো কখনো বাবু এসেই জিগ্যেস করেন “হ্যাঁ রে ঝন্টু ,আজকের কচুতে গলা কুটকুট করবে না তো ? গত পরশুর কচুটা বেশ ছিল,মিষ্টি মিষ্টি –একটুও গলা কুটকুট করেনি ।কিন্তু আগের সপ্তাহের কচুটা একদম ভালো ছিল না তোমার বৌদি তো রেগে আগুন হয়ে গিয়েছিল’।এসব পরিচিত ঘটনায় ঝন্টু অভ্যস্থ।দরদামে কখনোই ঝন্টুর সঙ্গে কোনো খরিদ্দারের সমস্যা হয় না।ঝন্টু খরিদ্দারকে ভগবানের স্বরূপে মানেন।সে মনে করে তাঁর দুবেলা অন্নের সংস্থানের জন্যই ঈশ্বর ওনাকে তাঁর কাছে পাঠিয়েছেন।
কিন্তু আজ তাঁর হাঁক শুনে পরিচিত দরজা গুলো আর খুলছে না।কেউ যেন তাঁর কথা আজ শুনতে পাচ্ছেন না। বন্ধ দরজার দিকে হা করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে হতাশায় চোখমুখ বিমর্ষ হয়ে যায় তাঁর। একটু একটু করে সামনের দিকে এগিয়ে চলে সে। কিন্তু প্রত্যাশা পূরণের পারদ ক্রমশ নিম্নগামী হতে হতে তলানীতে এসে ঠেকে। একটা সময় পরিচিত পাড়া ফেরী শেষ হয়ে যায় কিন্তু একটি কচুও বিক্রি হয় না । তারপর কি করবে সে ভেবে পায় না।বাড়িতে খালি হাতে যাওয়া যাবে না ।বউ ও ছেলে তাঁর পথ চেয়ে বসে আছে কখন সে চাল-সবজি নিয়ে ফিরবে।হতাশ ঝন্টু ঠিক করে নতুন কোনো পাড়ায় যাবে আজ।কচু বিক্রি যে তাঁকে করতেই হবে।শরতের দুপুরে গ্রীষ্মের প্রখর তাপে ক্লান্ত শরীর সাথ না দিলেও তাঁর ভ্যান নতুন নতুন পাড়ায় ফেরী করে বেড়ায় । কিন্তু দূর্গাপুজোর সময়ে সকলে পরিবার ও আত্মীয় স্বজন নিয়ে আনন্দ উৎসবে মাতয়ারা ।কারো ই সময় বা ইচ্ছে নেই ঝন্টু রাস্তা দিয়ে কি বলতে বলতে যাচ্ছে।ফলে এবারও ঝন্টুর প্রাপ্তি শূণ্য।তাঁর হতাশাগ্রস্থ ক্লান্ত শরীর আর চলছে না।কিন্তু খালি হাতে বাড়িও ফিরতে পারছে না।তাই আশার শেষ প্রদীপ প্রজ্জ্বলনের প্রত্যাশায় জনবহুল রাস্তার পাশে ভ্যান থামিয়ে বিশ্রাম নিতে থাকে।প্রখরতাপে ক্লান্ত শরীর ও মন আর চলছে না।তাই ভ্যানের উপর রাখা কচুর উপর সে ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুমোনোর আগে সে মনে মনে ভাবে যদি কেউ এসে ঘুম থেকে ডেকে তুলে বলে ‘ও ঝন্টু– দুটো কচু দে তো দেখি ‘।
অনুকূল বিশ্বাস।মালদহ। পশ্চিমবঙ্গ।ভারত।