অণুগল্প // রক্তাক্ত ভোর// সুমাইয়া করিম
কুয়াশায় ঢাকা ভোরে কাগজ কুড়াচ্ছে রতন, মাঝে মাঝে শীতে কেঁপে উঠছে, অনেক কষ্টের জীবন এই পথশিশুদের, শীতের সকালে ও জীবন থেমে নেই। রতনের বয়স ১১ বছর, সারাদিন কাগজ কুড়িয়ে বিক্রি করে, পথশিশুদের সান্ধ্যকালীন স্কুলে পড়ে ছেলেটা, বই পড়ে এখন অনেক কিছু জানে ছোট্ট রতন, ছেলেটা মেধাবী ও বটে, তাই ফরিদ ভাইয়ের খুব প্রিয় রতন। ফরিদ ভাই সান্ধ্যকালীন স্কুলের পরিচালক, সকল অনাথ শিশুদের ভাই, এই শিশুদেরকে নিয়ে অনেক ভাবে এই মানুষটা। কাগজ কুড়াতে কুড়াতে হঠাৎ ঝোপের মধ্যে রক্ত দেখতে পেলো রতন, হায় আল্লাহ এইহানে এত রক্ত কেন? মনে তো হইতাছে মানুষের রক্ত, বইতে পড়ছিলাম আমাগো দেশ আগে স্বাধীন আছিলো না, অনেক মানুষ যুদ্ধ করছে, জীবন দিছে, রক্ত দিছে তারপর আমাগো দেশ স্বাধীন অইছে। কিন্তু অহন তো আমরা স্বাধীন দেশে থাকি, তয় অহন মানুষের রক্ত ঝড়বো কেন? এহনো কি তাইলে আমাগো দেশে রাইতের আন্দারে যুদ্ধ অয়? ভাবতে ভাবতে দৌড়ে ফরিদ ভাইকে ডাকতে গেল রতন। সারাদিন অফিস করে সন্ধ্যায় পথ শিশুদের স্কুল পরিচালনা করে ফরিদ হাসান। তিনি দুই রুমের একটা ফ্ল্যাটে থাকে, ব্যাচেলর মানুষ কোনো ঝামেলা নেই। একরুমে নিজে থাকেন আর এক রুম অনাথ বাচ্চাদের জন্য বরাদ্দ, যখন যে সমস্যায় পড়ে এই সাদা মনের মানুষটা পাশে থাকেন। অনেকে আবার বস্তিতেও থাকে, কেউ মায়ের সাথে, কেউ থাকে আশ্রিতা হয়ে। যে যেখানেই থাকুক ফরিদ হাসানের অনুপ্রেরণায় মোট ১৫ জনের মত অনাথ, পথশিশু সান্ধ্যকালীন স্কুলে নিয়মিত পড়তে আসে। স্কুলটা ফরিদ হাসানের ভাড়া বাড়ির পাশেই একটা খালি জায়গায়, জায়গাটা একই বাড়িওয়ালার হওয়ায় এটার জন্য কোনো ভাড়া দিতে হয় না। রতন অসুস্থ মাকে নিয়ে এক বস্তিতে থাকে, রতনের মা বাসা বাড়িতে মাঝে মাঝে হাক ডাকে কাজ করে দিয়ে আসে, নিয়মিত কাজ করতে পারে না, হাঁপানির সমস্যা আছে মহিলাটার, শীতের রাতে ঘুমাতে পারে না, ছেলেটাও মায়ের পাশে বসে থাকে।
ফরিদ হাসানের দরজায় এসে রতন হাঁকাতে লাগলো, ভাইজান, ভাইজানগো দরজাটা খোলেন।
মাত্র ঘুম থেকে উঠে অফিসের জন্য তৈরি হচ্ছিল ফরিদ হাসান। দরজা খুলে দেখলো, রতন হাঁপাচ্ছে,
- কি হইছেরে রত্ন? হাঁপাচ্ছিস কেনো? (রতনকে ফরিদ হাসান রত্ন বলে ডাকে, উনি জানে রতন কতটা মেধাবী। রতনের মাঝে আসলেই রত্ন আছে।)
- ভাইজান, জলদি আহেন আমার লগে, দেইখা যান
- কি দেখবো? বলবি তো
- রতন ফরিদ হাসানের হাত ধরে দৌড়াতে দৌড়াতে তাঁকে ঝোপে নিয়ে আসলো
- ভাইজান দেহেন রক্ত, এহনো মনে অয় আমাগো দেশে রাইতের আন্দারে যুদ্ধ অয়।
ফরিদ হাসান হক চকিয়ে গেল, মানুষের রক্তই মনে হচ্ছে, তাজা রক্তের মতো লাগছে, রক্ত অনুসরণ করে ঝোপের ভিতরে যেতে লাগলো ফরিদ হাসান। আঁতকে উঠলো, এক যুবতী মেয়ের লাশ পড়ে আছে, মেয়েটিকে ধর্ষন করা হয়েছে, কুকুর রুপী ঘাতকেরা মেয়েটিকে গণধর্ষণ করে, ছুরিকাঘাতে হত্যা করে ফেলে রেখে গেছে, রক্তাক্ত নিঃসাড় দেহটা পড়ে আছে।
রতন বিভৎস লাশ দেখে ভয়ে কাঁপতে লাগলো, ফরিদ হাসান পুলিশকে ফোন দিল, পুলিশ চলে আসবে কিছুক্ষণের মধ্যে।
রতন চিৎকার করে বলতে লাগলো, - ভাইজান আমাগো দেশ কি অহনও স্বাধীন অয় নাই? আমাগো দেশের মানুষরা এহনো প্রাণ দেয় কেন?
ফরিদ হাসান অবাক চোখে, রতনের দিকে তাকালো, ঠিকইতো বলেছে, ছোট্ট এই নিস্পাপ ছেলেটা, আমরা স্বাধীন হলে, আমাদের মা-বোন এখনো কেনো সম্ভ্রমহানী হয়? এখনো কেনো আমাদের দেশে পৈশাচিক হত্যাযজ্ঞ চলে? কেনো দিনের শুরুটা হয় রক্তাক্ত ভোর দেখে?
আমাদের সর্বযুগের মহানায়ক, আমাদের বাঙালি জাতির পিতা দেশকে স্বাধীন করে দিয়ে গিয়েছেন ঠিকই কিন্তু আমরা কি রক্ষা করতে পারছি আমাদের স্বাধীনতা? না পারছিনা, তাই আজ একটি রক্তাক্ত ভোরের মাধ্যমে আমাদের দিন শুরু হয়। আমাদের জাগ্রত হতে হবে স্বাধীনতা রক্ষার প্রয়াসে, আবদ্ধ হতে হবে দেশ রক্ষার অঙ্গীকারে, প্রজ্জ্বলিত হতে হবে জাতির পিতার আদর্শে। তবেই আমরা রক্ষা করতে পারবো আমাদের স্বাধীনতা। রক্ষা করতে পারবো আমাদের দেশকে। সম্মিলিত কন্ঠে আজীবন বলে যেতে পারবো, “জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু। “