গদ্য।। অদ্বৈত মারুতের কবিতাঃ দিগন্তের হিল্লোল।। বাবুল আনোয়ার
অদ্বৈত মারুত কবিতা লিখছেন প্রায় দেড় যুগ ধরে। লেখালেখির ক্ষেত্রে সময়ের পরিমাপ খুব জরুরী নয়। তবে এক্ষেত্রে একজন লেখক শিল্পীর মগ্নতার ব্যাপারে ধারণা লাভ সহজ হয়। কবিতা তো এক নিবিড় উপলদ্ধি, বোধ ও অন্বেষণের নিরন্তর বিষয়। সহজে সবকিছু কবির দখলে আসে না। দখলে নিতে হয়। ধারণ করতে হয় যাপিত দিনকালের মধ্যে দৃশ্যমান – অদৃশ্যমান অনেককিছু। আলো- ছায়ার পথ ধরে অবিরাম দীর্ঘ অভিযাত্রায় শামিল হতে হয় কবিকে। এভাবে কবি তার প্রার্থিত গন্তব্যে পৌঁছে যেতে পারেন। সবাই যে পারেন তাও নিশ্চিত নয়।
অদ্বৈত মারুত এ সময়ের একজন নিবিড় কবি, লেখক। সাহিত্যের নানা শাখায় তার লেখালেখি। নিরন্তরভাবে তিনি লিখছেন। লিখছেন কবিতা,গল্প, ছড়া। তার লেখালেখি, মনোযোগ, সৃষ্টিশীলতা নিয়ে কিছু বলার তাগিদ অনুভব করি। কারণ তিনি এক্ষেত্রে স্বাচ্ছন্দময়, স্বপ্রতিভ।কবিতার ক্ষেত্রে আশা জাগানিয়া এক নাম। এখন পর্যন্ত তার তিনটি কবিতাগ্রন্হ প্রকাশিত হয়েছে।’ নিস্তরঙ্গের বীতস্বরে’ তার প্রকাশিত প্রথম কবিতাগ্রন্হ। প্রকাশিত হয় ২০১০ সালে। দ্বিতীয় কবিতা গ্রন্হ ‘স্বর ভাঙার গান’ প্রকাশিত ২০১৫ সালে।তৃতীয় কবিতাগ্রন্হ ‘ জলমাতালের মুখ ‘ প্রকাশিত হয় ২০২১ সালে। কবিতা, ছড়া, শিশুতোষ গল্প নিয়ে তার প্রকাশিত গ্রন্হের সংখ্যা ১৫।
অদ্বৈত মারুতের কবিতা সময়, বোধ ও শিল্পের চমৎকার সমন্বয় বলা যায়। জন্মসূত্রে গ্রামীন পরিবেশে বেড়ে উঠেছেন তিনি। দেখেছেন প্রকৃতির বিষয় বৈচিত্র। সাধারণ মানুষের নিত্য জীবনযাপন। এ পরিবেশ ও আবহ তার জীবন ঘিরে সব সময়। মননে মিশে আছে মাতৃভূমির রূপ-লাবণ্য, বর্ষার অবিরল বৃষ্টির ধারা, ফসলের মাঠে দোল খাওয়া বাতাসের হিল্লোল। তেমনি আছে চৈত্র-খরার তাপদাহ। বেঁচে থাকার জন্য সংগ্রাম, হাহাকার ও স্বপ্নময়তার হাতছানি । স্বাভাবিকভাবেই তার প্রভাব, প্রতিফলন তার কবিতায় সহজে প্রতিভাত হয়। লক্ষ করা যায় শব্দের সম্ভারে :
‘ফিরেছ তো সঙ্গে নিয়ে আকাশ ভর্তি মেঘ ;
নিমেষ চোখে করেছ
বালিবাঁধ ভেঙ্গে জলের বন্দনা;
হয়েছ বিনাশীও…
অনাবাদে ধানীজমি তাই হয়েছে উজার
তোমারই আগুন দাঁতে।
(দ্বিধাগ্রস্ত, নিস্তরঙ্গের বীতস্বরে)
দুঃখ- কষ্ট, আনন্দ হাসি গান নিয়ে এ জীবন। তবে এর অনেক কিছু সম্পর্কে আমরা অবগত নই। চিহ্নিত কষ্ট, হাহাকারও দৃশ্যমান হয় না সবসময়। তবে কবি, শিল্পী, সংবেদনশীল হৃদয় তা ধারণ করতে পারে। অদ্বৈত মারুত উপলদ্ধি করেন তা কবি হৃদয়ের স্বরূপে, শব্দের বুননে :
‘ভয়, সতত সংশয় মনে
প্রতিদিন শোকের স্মৃতিচিহ্ন নিয়ে যারা
ফিরে আসে ঘরে/
প্রতিদিন ভোগহীন দেহ যাদের পীড়িত
করে অনাহুত /
ওরা আমাদের স্বজন-মা বোন,
নিকটাত্মীয় কেউ কেউ
——
প্রজাপতি, ফুল আর বিষণ্নতা আজ
তাদের সঙ্গী যেন
(মার্চ ২০০৯- তিন, নিস্তরঙ্গের বীতস্বরে)
অদ্বৈত মারুত কবিতায় লোকজ শব্দাবলীর সংযোজন ও বিন্যাসে তৎপর। শৈল্পিক পরিচর্যায় তিনি আন্তরিক। তার সঙ্গে যোগ হয় আধুনিক বোধ ও মনস্কতা। কবিতায় বিশেষ করে চিত্রকল্প সৃষ্টিতে এ কবির দক্ষতা লক্ষ করার মতো। সব কিছু দেখেন তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ও গভীর মননশীলতায়। কখনো বা তার কবিতায় বিরূপ অভিজ্ঞতা, বেদনা ছায়া ফেলে। বহমান বৈরিতার বিরুদ্ধে জেগে ওঠেন কোমল স্বরে। অনুভব ও জাগরণে তার সৃষ্টির ফল্গুধারা প্রবাহিত হয়। কবিতায় তার প্রকাশ ঘটে :
‘আঁধারের বনে জমে উঠেছে ঘোর
ইরৌসের ছুঁড়ে দেওয়া তীরে
যেদিকে তাকাই, শুধুই কাম কাম গন্ধ
ভরে উঠেছে আজ পাতাবন ঘিরে।
তবে গুলি ছোঁড়ার আগে বন্দুক দেখে
নেওয়া ভালো।
(পরামর্শ, স্বর ভাঙার গান)
‘ জলমাতালের মুখ’ কাব্যে তিনি তুলনামূলকভাবে সংযত। এ সংযম তার কবিতার বিষয় নির্বাচন, আঙ্গিক ও অনুষঙ্গের ক্ষেত্রে। তবে বৈরী সময় ও অস্হিরতার ছাপ লক্ষ করা যায়।
যেমন দেখা যায়ঃ
– প্রগাঢ় রোদ্দুর ঠেলে ছুটে এলে নাগরিক বিষধর সাপ-/
দহনের প্রজ্ঞাপনে মরে ফের জেগে উঠি কারো আশ্বাসে/
অন্তঃপুর – জটিলতায় তবু হয় না মাছ- সংলাপ/
অথচ নদীর পাশে থাকি আঁকাআঁকি করি সবজিতে ; ঘাসে –/
অথচ করাতে ফালি করে কেউ মাটিতে ফেলেছে এ হৃদয়/
প্রতিদিন ফোঁটা করে ঝরে পড়ছে রক্ত; বিস্ময় — / ( একা, জলমাতালের মুখ)
অথবা
ধেয়ে আসছে বান,ভুল পথে পৃথিবীর সকল
অসংগতি–
গ্রাস করে আমাদের নিয়ে যাবে কোথায়?
প্রগতির পথে মৃত্যুর এ এক ভয়াল অগ্রগতি।
(অসংগতি,জলমাতালের মুখ)
এভাবেই মারুত কবিতার মগ্নতায় ডুবে থাকেন। শব্দের দ্যোতনায় রাত জাগেন নানা অনুষঙ্গের ব্যাপ্তি নিয়ে। তার কবিতা হৃদয়ে নাড়া দেয়,অনুভূতিকে জাগিয়ে তেলে। কবিতায় তার বাহুল্য শব্দের ব্যবহার নেই। সাবলীল গতি ও বলার ভঙ্গি তার কবিতাকে প্রাণময় করে তোলে। সেই সাথে ছন্দ ও মাত্রাও ঠিকঠাক মতো এসে যোগ হয়। শিল্পের সম্ভারে কবিতা নির্মাণ পর্ব চলে। তবে মারুতের সবগুলোই যে কবিতা হয়ে উঠেছে তা বলা যাবে না। তার বোধের সাথে পর্যবেক্ষণের সমন্বয় আরও গভীর হওয়া দরকার। সবশেষ বলা যায়,অদ্বৈত মারুত এ উন্মাতাল সময়ে কবিতায় আশার আলো জ্বালিয়েছেন। তার কবিতার অন্তরঙ্গ আবাহন পাঠককে কাছে টানে,রঙ ছড়ায় আনন্দ, অনুভব ও বিষাদময়তায়। প্রকাশিত কাব্য তিনটিতে কবির গভীর ও প্রসারিত জীবনবোধের অনুরণন স্পষ্ট হয়ে উঠে। এক ধরণের মুগ্ধতা,বিহ্বলতা মারুতের কবিতা জুড়ে সর্বত্র।
জন্ম সিরাজগঞ্জ জেলার দত্তবাড়ি গ্রামে। ১০ ডিসেম্বর ১৯৮০। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সংস্কৃত সাহিত্যে মাস্টার্স। শৈশব থেকে শুরু তার লেখালেখি। পেশা সাংবাদিকতা। কবি অদ্বৈত মারুত কবিতার আলো- আঁধারের পথ ধরে চলা এক দুরন্ত সৃষ্টিমগ্ন প্রাণ।