ফারুক নওয়াজের দশটি ছড়া-কবিতা

আঁকতে আঁকতে

আঁকাই আমার শখ;
আঁকতে বসে আঁকি যদি
একটি পাহাড়, একটি নদী
শাদা ডানায় উড়ে যাওয়া
ধবধবে এক বক-
শেষ হয়ে যায় আঁকা যখন
অবাক লাগে ভারী-
তাকিয়ে দেখি আমার মায়ের
সবুজ রঙের শাড়ি।…

বইপ্রিয় বউ

বন্ধু আমার আমলা কিন্তু হাস্যরসিক স্বভাবে…
লিখেটিখে বহু বই ছাপালেন উচ্চপদের প্রভাবে।
হাসান প্রচুর যেখানেই যান
পান খেয়ে খেয়ে ওষ্ঠ রাঙান
যদি বলি ‘বউ বিগড়ে যাবেন পান খেতে নেই ওভাবে’-
‘বউ করে পান, আমি খাই পান’… বলেন কথার জবাবে।

সেদিন বিকেলে আড্ডা জমিয়ে
কথা হচ্ছিল বইপড়া নিয়ে…
তিনি বললেন, ‘আমার বউ-ও বই ভালোবাসে অতিশয়’-
সবাই বলল, ‘বইপ্রিয় বউ না হলে কবির ক্ষতি হয়।’
হাহা করে হেসে বললেন তিনি;
‘ক্ষতি তো আমার হয় প্রতিদিনই…
বউ যে আমার… বই ভালোবাসে… তবে সেটা হলো চেকবই!’
তার কথা শুনে ভাবলাম আমি এই নিয়ে ছড়া লেখবই!

চালু

ইমান আলীর খালু
লোকটা বেজায় চালু
ভাত না খেয়ে খান যে শুধু
গরম গরম আলু।

মাংস-মাছের মূল্য চড়া
চালের ভিতর কাঁকর ভরা
চা ও চিনির দাম শুনে তার
জ্বলে মাথার তালু;
তাই তো তিনি চিনির বদল
দিব্যি চিবান বালু-
লোকটা বেজায় চালু।

নতুন কবি

সবাই কবিতা লেখে
আমি কেন বাদ:
নামকরা কবি হব
আমি আমজাদ।

‘কাগজ’ এর সাথে আমি
‘মগজ’ মিলাই
দুইহাতে অফুরান
ছড়া লিখে যাই।

মিল যদি না-ই দিই
হবে কি তাতে!
গদ্য কবিতা লিখে
চেঁচাব রাতে।

কাগজে ছাপবে নাম
কী যে আহ্লাদ
নতুন কবি যে আমি
আলি আমজাদ।

এই আমাদের দেশ

এই আমাদের দেশরে ভায়া দেশ আমাদের প্রাণ..
ভেদ জানি না বৌদ্ধ হিন্দু মুসলিম ও খ্রিস্টান..
বর্ণ-শ্রেণি, জাত বা কুলের ধার ধারি না কেউ..
একটি জাতি একবাঙালি এক-সাগরের ঢেউ।

হাজার বছর– দূর অতীতে পেছন ফিরে চান…
পুবের পাড়ায় উলুধ্বনি, পশ্চিমে আজান..
পোষ-পাবনে, ঈদ-পুজোতে, জলসা-হরিনাম..
জাত-বেজাতের গিটটু ছিড়ে মিশতো সারা গ্রাম।

মধ্যিখানে কষ্ট গেছে, দীর্ঘ নাভিশ্বাস..
মুখোশপরা শয়তানেরা ভাঙালো বিশ্বাস।
দুশো বছর ব্রিটিশ শাসন, দু-যুগ পাকিস্তান..
এক-বাঙালির হৃদয় ভেঙে করেছে খান-খান।

সেই অভিশাপ মুক্ত হলো যুদ্ধে পেলাম জয়..
কান্ডারি তার শেখ মুজিবুর কালজয়ী বিস্ময়।
জাত-ভেদাভেদ, বর্ণ-শ্রেণি—ভাঙল সকল খেদ—
যার খুশি সে কোরান পড়ুক, পড়লে পড়ুক বেদ।
নতুন দেশের নতুন স্বপন, নতুন গানের সুর…
সুরের সুধায় উথাল-পাথাল বঙ্গসমুদ্দুর।
হায়রে সে-সুর করতে মলিন চারটি বছর পর..
জাতির পিতার জীবন কাড়ে ঘৃণিত খচ্চর।

আবার দেশে আসলো নেমে ধুসর কালো দিন..
পশুর স্বভাব অসুরগুলো উচালো সঙ্গিন।
দুঃসময়ের আধার ছিড়ে সূর্য ওঠে ফের..
এগিয়ে এলেন শক্তিময়ী—কন্যা মুজিবের।
দুঃখশেষে উড়ছে যখন অগ্রগতির পাল—
ঠিক তখনই ঘাপটি মারা দুষ্টুরা দেয় ফাল।

আবার শুরু ধর্মধারী বর্মধারীর দল..
রামদা তুলে থামিয়ে দিতে চাচ্ছে জাতির বল।
পাষণ্ডরা অণ্ড তুলে যতোই মারুক ফাল..
এই বাঙালি ঝেটিয়ে তাড়ায় সব ভুয়ো জঞ্জাল।
এক বাঙালির সোনার ভূমি সোনার বাংলাদেশ..
ধর্ম নিয়ে ফালতুবাজি করলে হবে শেষ।

যার-যা মতো সে-সে থাকো-; লাকুম-দীনকুম..
পল্টিবাজি করতে গেলে ভাঙবে না আর ঘুম।

আমাদের দিন

আমাদের দিন সূর্যরঙিন আলোঝলমল সোনালি সকালগুলো
মাঠের গন্ধ পাটের গন্ধ দাপানো দুপুর উড়োনো পথের ধুলো
তাতানো রোদের ক্লান্তি ঘোচাতে হাতছানি দিতো বিশাল বটের ছায়া
মায়ের শাড়ির পাড়ের মতন কাছে টেনে নিতো রুপোলি নদীর মায়া।
রবিশস্যের ফাঁকা মাঠে রোজ বিকেল হলেই ঘুড়ি-ঘুড়ি খেলা শুরু
সন্ধ্যা পেরুলে ঘরে ফিরে যেতে বাবার শাষানি ভেবে বুক দুরুদুরু
আমাদের দিন কখনো স্বাধীন কখনোবা ছিলো বাবার শাসনে বাঁধা
অঙ্কে-ভূগোলে অবহেলা বলে স্যারের বকুনি, আস্ত একটা গাধা!
দুষ্টু বোনের মিষ্টি চিমটি, অমনি চেঁচিয়ে মাথায় তুলেছি বাড়ি
ঢেঁকিশাল থেকে মায়ের হাঁকারি, দাঁড়া তোকে আজ দেখাছি হতচ্ছাড়ি!
আমাদের দিন সোনামোড়া দিন, আদরে শাসনে মাখা সেই দিনগুলো,
খর্করে দিনে পাগল বাতাসে উড়ে উড়ে যেতো কাপাসগাছের তুলো।
শীতের সকালে খোলাছাদে বসে মুড়ি খেতে খেতে রোদ পোহানোর মজা;
আমাদের দিন সুখি অমলিন ভাবিনি কখনো কেবা রাজা কেবা প্রজা।
সেই দিনগুলো সেদিনের মতো এই দিনগুলো হয়তো রঙিন আরো;
তবু সাদামাটা সেদিনের সাথে এদিনের কেউ তুলনা করতে পারো!

রাতের কবিতা ০৬

মাঝরাতে কাল বুকের উপর গীতবিতান খুলে–
নিসর্গপাঠ আধেক রেখে ঘুমিয়ে গেছি ভুলে।
মাথার কাছের শার্সি দিয়ে উদাস হাওয়া এসে..
আনল স্বপন চোখের পাতায় নিবিড় ভালোবেসে।
উড়িয়ে নিলো স্বপ্ন আমায় শ্যামল নিসর্গতে..
পাখির গানে বনের সবুজ উঠল দারুণ মেতে।
মেদুর হাওয়া বকুল ফুলের সুবাস আনে বয়ে..
মনটা গেল আকুল ব্যাকুল উদাস উদাস হয়ে।

দখিন বনে জোনাক জ্বলে, ডাকল পুবে ঝিঁঝিঁ..
মউল বনে উপচে পড়া চাঁদের আলোয় ভিজি।
নেবুফুলের গন্ধ পেয়ে পা বাড়ালাম ডানে..
এ-দিক গেলে ও-দিক আবার অচিন মায়ায় টানে।
শালবনে ঠিক ডাকল পেঁচা, পিয়াল বনে কুহু..
ছলকে ওঠা এত আবেগ কোথায় রাখি উহু!

অশোক ফুলের লালের লীলা, গন্ধরাজের সাদা..
সবুজ পাতার ছায়ায় মায়ায় লাগাল চোখে ধাঁধা।
বনটা জুড়ে মায়ার খেলা, ছায়ার আদর মাখা..
এত মায়ায় মনটা আহা যায় না ধরে রাখা!
হঠাৎ বনের প্রান্ত থেকে গান এলো কার ভেসে..
তাকিয়ে দেখি রবি ঠাকুর দাঁড়িয়ে আছেন এসে।
একটু ছুঁয়ে দেখব তাকে– দৌড়ে যেতেই এ-কী..
কোথায় তিনি? দু’চোখ মেলে ভোরের শোভা দেখি।

ঝিলকে ওঠে ঈদের কারুকাজ

ইলিকঝিলিক রোদের খেলা ঝাবুক পাতাতে
রোদ ফুরোতেই টাপুরটুপুর ব্যাঙের ছাতাতে
চাঁদ ছিলো কাল রূপ-রুপালি মেঘের আড়ালে
ছড়িয়ে দিলো খুশির জাদু দৃষ্টি বাড়ালে।

কিসের খুশি কিসের খুশি… কিসের ডামাডোল?
চাঁদটি দেখে খুশির তোড়ে বাজায় মামা ঢোল
ঘাড় দুলিয়ে হাসেন দাদু ঝিলকে ওঠে সুখ
মায়ের কোলে দোলেন খুকু বাড়িয়ে দিয়ে মুখ।

কিসের হাসি… কিসের খুশি… কিসের হুলুস্থূল?
উটকো হাওয়ায় উড়ছে সুখে বুবুর মাথার চুল
খোকন নাচে মন খুশিতে বকম বকম বাক
ঈদের খুশির বার্তা নিয়ে চাঁদ দিয়েছে হাঁক।

আপাং পাতা হাওয়ায় দোলে, ইমলি দোদুল দুল
মউল বনে ছড়িয়ে পড়ে মনবাহারি ফুল
ঝিলমরিচের ক্ষেত মাতালো ভুরুই পাখির ঝাঁক
আকাশ থেকে আসলো ভেসে ঈদ মোবারক ডাক!

ঈদের খুশি উছলে পড়ে, আয় রে সবাই আয়
মনে-মনে এক হবো সব আলোর ঝলোকায়
ধনী-গরীব… আমির-ফকির… থাকবে না ভেদ আজ
চারদিকে আজ ঝিলকে ওঠে ঈদের কারুকাজ!

জীবন মানে রঙের খেলা

সাদা মানুষ কালো মানুষ রক্ত সবার লাল
একেক মানুষ একেক রঙে মুগ্ধ চিরকাল
সবুজ মানে নিসর্গ আর লাল মানে বিপ্লব;
জীবন মানে রঙের খেলা; রঙিন ফুলের টব।

সাদা মানুষ কালো মানুষ মনটা রঙে রঙ
রঙ যদি না থাকতো মনে ধরতো মনে জং।
রঙের জাদু মনকে টানে, মন রাঙা-পঙ্খী…
জানতে হবে তোমার আমার মন–টানা রঙ কী।

সবুজ রঙের শার্টটি পরে দাঁড়িয়ে ছিল নুর…
তাই দেখে হায় মনটা নীলার পাগলী সমুদ্দুর!
শিউলি পরে হলদে কামিজ; মানায় চমৎকার…
কিন্তু হারা রঙটি দেখে মনটি টানে তার।

নাহার ঘায়েল কমলা রঙে, নীল রঙে কুলসুম;
স্বপ্নে মেরুন ম্যাক্সি দেখে হারাম রবের ঘুম।
লালের টানে মুক্তামনির লাফায় বুকের ভাঁজ;
বেগুন রঙে টাশকি খেয়ে উল্টে পড়ে নাজ।

আকাশবরণ পাঞ্জাবিতে হয় কাজরী শেষ ;
গোলাপ রঙের আকর্ষণে পাগল অমরেশ!

এই দুনিয়া রঙের ভুবন; রঙের লিপিস্টিক…
রঙ না হলে জীবন হতো ধূসর মরু ঠিক।

বাবা তো বাবাই

মাকে নিয়ে এক কবিতা লিখেছি বলে
বুকে মা আমাকে জড়িয়ে খেয়েছে চুম…
খুশিতে আমার চোখ ভিজেছিল জলে
মায়ের কোলেই আবেগে নেমেছে ঘুম।

বাবা ফিরেছিল আরো রাত করে ঘরে
মায়ের মুখে সে কবিতাটা শুনে হেসে
বলেছিল বাবা ‘লিখলি কেমন করে
এমন কবিতা লিখতে পারে কে দেশে!’

পরদিন বাবা হাসিমুখে ঘরে ফিরে
একটি নতুন সোনালি কলম এনে-
হাতে দিয়ে বলে মৃদুস্বরে ধীরে ধীরে
‘বাবার কবিতা আসে নাকো তোর ব্রেনে?’

হাসি, হেসে বলি, ‘লিখব, লিখব ঠিকি
সেরা কবিতাটি লিখব তোমাকে নিয়ে।’
খুশিতে বাবার মুখ করে ঝিকিমিকি
কত যে আদর করল দুহাত দিয়ে।

তারপর কত বছর গিয়েছে চলে
কত যে কবিতা লিখেছি জানি না নিজে-
বাবা নেই আজ-এই কথা মনে হলে
নীরবে হঠাৎ দুই চোখ আসে ভিজে!

কত যে কবিতা লিখেছি আহারে তবু
তোমাকে নিয়ে যে লিখতে পারিনি বাবা…
বাবার কবিতা লেখা যায় বলো কভু
বাবাকে যায় কি কবিতার মতো ভাবা?

বাবা তো বাবাই, প্রাণের সত্য তুমি
নিত্য তোমাকে অনুভব করি প্রাণে-
বাবা তুমি ছাদ, আশ্রয়দাতা ভূমি
মা যে হলো মায়া, টানে যে স্নেহের ঘ্রাণে।

৬ thoughts on “ফারুক নওয়াজের দশটি ছড়া-কবিতা

  • এপ্রিল ৭, ২০২০ at ৯:১১ অপরাহ্ণ
    Permalink

    যদিও ছড়া।তবুও বেশ বড় বড় লেখাগুলো একটানে পড়া যায়।ধন্যবাদ ও অভিনন্দন কবিকে।ধন্যবাদ সম্পাদক মহোদয়কে

    Reply
    • এপ্রিল ২০, ২০২০ at ৫:৩২ অপরাহ্ণ
      Permalink

      মুগ্ধপাঠ।অসম্ভব শক্তিমান ছড়াকার ফারুক নওয়াজ।তাঁর জন্য নিরন্তর প্রার্থনা।তাঁর সোনার কলম অমরত্ব লাভ করুক।

      Reply
  • এপ্রিল ৭, ২০২০ at ১১:১৮ অপরাহ্ণ
    Permalink

    চমৎকার ছিলো সবগুলো লেখা

    Reply
  • মে ১২, ২০২০ at ৭:৪০ অপরাহ্ণ
    Permalink

    অনন্য কাব্যশৈলী!

    Reply
  • ডিসেম্বর ১২, ২০২০ at ১০:৩০ অপরাহ্ণ
    Permalink

    Very good. Keep doing it.
    Thanks.

    Reply
  • জানুয়ারি ২৯, ২০২১ at ৭:৪৪ অপরাহ্ণ
    Permalink

    অনন্য সব লেখাগুলি। ভীষন মুগ্ধতা জানালাম।

    Reply

Leave a Reply to শাহানারা ঝরনা Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *