মহির মারুফ-এর কবিতা

বৈপ্লবিক আসক্তি

পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে।
মহাবিশ্ব সংকুচিত হতে হতে পরিণত হবে কৃষ্ণবিবরে।
লুব্ধক ল্যাম্পের মতো নিভে যাবে।
জ্বলে উঠবে আমার লাইটার আর ঠোঁটে চেপে রাখা সিগারেট।
ললিপপের মতো গোলাপি ফুসফুস, ফকফকা সাদা দাত, মোলায়েম ঠোঁট-
এমন কর্পোরেট শরীর নিয়ে আমি মরতে চাই না।
বাথরুমের কমোড উপচে মনুষ্য বর্জ্য ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়বে।
দেয়াল ঘেঁষে প্রসাবের ঘ্রাণ।
মুখে লেগে থাকা বমির তেতো স্বাদ।
আর ঠোঁটের কোনে একটু জ্বলন্ত তামাক।
সবকটি বন্দুকের নল যখন আমার দিকে তাক করা থাকবে।
নির্বিকার ভঙ্গিতে আমি সিগারেট বের করবো।
ঠোঁটের বাম কোণ থেকে ডান কোণে যাতায়াত করবে ফিল্টার।
যতটুকু শ্বাস নেওয়া যায়, সবটুকু টেনে নিয়ে-
বুকে মেঘের মতো স্নিগ্ধ নিকোটিনের স্থান দিয়ে-
চিৎকার করে বলবো- ‘শুয়ারের বাচ্চা গুলি কর।‘ 

টিকে থাকা

আমি শেষ কবে ইলিশ শুঁকেছি-
পাতে তেলাপিয়ার লেজ নিয়ে আর মনে পড়ছে না।
এখানে সপ্তাহের শেষে একবেলা করে-
তেলাপিয়া মাছ।
দুই দিন শাকান্ন, মসুরের ডাল।
দুই দিন ডিম ভূনা।
কখনো পুরনো আলু দিয়ে, কখনো কেবল মশলা মাখানো।
দুই দিন কেবল কুঁচো চিংড়ি দিয়ে ফুলকপি, শালগম, করল্লা ভাজি।
আর প্রতিবেলা মোটা চালের ভাত।
এখানে সকালের খাবার ব্যবস্থা নেই।
এক কাপ চা আর সস্তা একটি সিগারেট।
দুপুরের ফেরবার ফুরসত নেই।
দুপুরের মিলের টাকা বেচে যায়।
দুটা সিগারেট ভাতের বিনিময়ে বিনে পয়সায়।
সন্ধ্যায় বাতি জ্বালাবার কিছু নেই।
ঘরে ফেরবার তাড়া নেই।
পথে পথে মানুষ গুনে, নানা রঙের বাতি দেখে,
গাড়ি ঘোড়ার সাওয়ার দেখে, সাহেব দেখে,
যখন এসে পৌছাই এই ঘুপচিতে-
ততক্ষণে দুপুরের ভাত হিম শীতল জাউয়ের মতো জমাট বেধে থাকে।
থালের লাল শাক মনে হয় ঠান্ডা জমাট বাধা মাসিকের থকথকে রক্ত।
খেতে খেতে আঙুল সাহেবি ধুতির মতো কুঁচকে আসে।
তবু কপাল কুচকায় না।
এই এক বেলাই তো ভাত।
বেচে থাকার সামগ্রী এই এক বেলার আহার।
শরীর এলিয়ে শোয়ার সাথে সাথে নাকে এসে জানান দেয়-
নর্দমার অস্তিত্ব।
টিনশেড ঘরগুলোতে কর্তারা ফিরে আসে।
শুরু হয় খিস্তিখেউড়। শিশুর আর্তনাদ।
তারপর রাত বাড়ে।
এরা হয়তো কেউ কাউকে চুমু খায় না।
এরা হয়তো আনন্দে শিৎকার করে না।
এদের হাসিগুলো কান্নার মতো শোনায়।
এদের উল্লাসগুলো আর্তনাদের মতো শোনায়।
এখানকার আকাশে শেষ কবে চাঁদ উঠেছিলো-
কেবল ঈশ্বর জানেন।
অতিকায় ইমারতের ছায়ায় গড়ে ওঠা এইসব অচ্ছুৎ নিম্নবর্গের চাঁদ দেখার শখ জাগে না।
সূর্যের আলো এই অবধি এসে পৌছায় না।
এই গলিতে চোখে পড়বার মতো গাছ নেই।
আগাছা আছে। পুরনো ইটে শ্যাওলা জমে আছে।
বৃক্ষের রুচি হয় নি এই মাটিতে জন্ম নেবার।
আমার রুচিবোধের প্রশ্ন ওঠে না।
আমি বেচে আছি। শ্বাস নিচ্ছি।
এইতো অনেক।
আমি মুঠোফোন বিক্রি করে-
দুই প্যাকেট সিগারেট কিনেছি।
একদিন মোরগ পোলাও খেয়েছি।
একদিন রিক্সায় বড় বাবুদের বাসার সামনে দিয়ে ঘুরে এসেছি।
একদিন একটি গোলাপ কিনে পাপড়ি ছিড়েছি।
ঘুম না আসলে আমি হেঁটে হেঁটে টঙের দোকানে যাই।
বেশ কিছু টাকা বাকি পড়ে আছে দোকানে।
দোকানী বাকিতে সিগারেট দিতে চায় না।
শেষ রাত অবধি বসে থাকলে গালাগাল করতে করতে,
পাঁচ টাকার একটি সিগারেট হাতে দিয়ে ঝাঁপি নামিয়ে শুয়ে পড়ে সে।
আমি এক পা ভাঙা বেঞ্চিতে কাঁপতে কাঁপতে সিগারেট ধরাই।
আমার কানের কাছে কুয়াশা এসে জমাট বেধে থাকে।
চুলে শিশির জমে।
আমার হাড্ডিতে হাড্ডিতে আন্দোলন হয়।
সামনে অতি আরামে পাটের চট পেচিয়ে ঘুমিয়ে থাকা কুকুরটাকে দেখে হিংসে হয়।
আমার শরীরে পাটের চট পেচিয়ে দেয়ারও কেউ নেই।
আমি শেষ কবে কেঁদেছি আমার মনে নেই।
শেষ কবে কষ্ট পেয়েছি তাও মনে নেই।
জলের ভেতর মাছের যেমন জলতেষ্টা পায় না।
আমারও তেমনি।
আমি কাক ডাকার আগেই উঠে পড়ি।
কাকের সংসার আছে।
পালক দিয়ে জড়িয়ে রাখার পত্নী আছে।
ডানার নিচে ঘুমিয়ে থাকা ছানা আছে।
একটি ঘর আছে।
আমার আছে অফিসের তাড়া।
হেটে হেটে চলে যাই বহুদূরে।
বাহনের বাড়তি ভাড়া বইতে হয় না।
অফিসের সময়ে দেরি হয় না।
মাসের মাইনেটুকু পাঠিয়ে দেই বায়বীয় ঠিকানায়।
তারপর আবার সেই পুরনো রুটিন।
বহুদিন আগে তুমি জানতে চেয়েছিলে-
কি চাই আমার!
আমি তোমায় চেয়েছিলাম।
বিদ্রুপের হাসি ঠোঁটে চেপে বলেছিলে-
তুমি বাদে অন্য কি?
আমি অহমিকায় আত্মহারা হয়ে বলেছিলাম-
আর কিছু নয়। আর কিছু নয়।
হয় তুমি। নয়তো আর কিছু নয়।
আজ এতকাল পরে এসে মাসের শেষে মনে হয়-
এই শীতে একটি সোয়েটার চাওয়ার দরকার ছিলো।
রাত বাড়লে মনে হয় এক প্যাকেট সিগারেট চাইলে মন্দ হতো না।
ভাতের থালার সামনে বসলে মনে হয়,
এক বেলা বাসমতি চালের সাথে রাজহাঁসের মাংস খেতে চাইলেও হতো।
হাঁটার সময় মনে হয় এক জোড়া চামড়ার স্যান্ডেল চাইলে খুব একটা দোষ হতো না।
আজও যখন রাত বাড়ে, ফাঁটা ঠোঁট ফেটে রক্ত ঝরে-
মনে হয় আর কিছু না হোক,
অহমিকার আস্তরণ থেকে বের হয়ে-
একটি চুমু চাইতে পারতাম আমি!

প্রস্তাব

তুমি কি বুঝতে পারছো আমি দিনকে দিন রবীন্দ্রনাথ হয়ে উঠছি?
আমার মগজে কলমে কাগজে বিপ্লব হয়ে যাচ্ছে।
আমার হাত ধরে জন্ম হতে চলছে নতুন এক যুগের।
তুমি কি বুঝতে পারছো এক শতাব্দী পরে আরেক রবীন্দ্রনাথ জন্ম নিতে চলছে-
এই নষ্ট মাটিতে।

এখন সিদ্ধান্ত তোমার!
তুমি এক কিংবদন্তীর সাথে নিজেকে জড়াবে-
নাকি বাংলার চিরচেনা গৃহিণী হয়ে কাটিয়ে দিবে-
বাকি পঁয়ত্রিশ বছর!
আমি তোমায় কিচ্ছু দিতে পারবো না বটে-
তবে কিছু শব্দের সংসারে, কবিতার কঙ্কনে-
তুমি রয়ে যাবে-
যতকাল রবে বাংলা সাহিত্য। যতকাল রবে দোয়েল। সবুজ মাটি আর সফেদ রবীন্দ্রনাথ।

তুমি মরে যাবে আগে কিংবা পরে-
হয়তো কোন শীততাপনিয়ন্ত্রিত কক্ষে নয়-
গোটা দশেক দাসীর সেবা পেয়ে নয়-
স্বামীর আদিখ্যেতা মাখানো সোহাগ পেয়ে নয়-
এক অভাবী কবির আধপেটা অসহায় গিন্নি হয়ে।

কিন্তু যুগে যুগে তোমায় ব্যবচ্ছেদ করবে ইতিহাস-
ইতিহাসের উদরে তুমি বেচে রবে সহস্র বছর-
যতকাল আমি বেচে রবো কিংবা আমার কবিতা।

তোমায় দেখে আগাম কোন তরুণী সাহস পাবে-
বাউন্ডুলে কোন কবির হাত ধরে সব সীমাবদ্ধতা ছিড়ে ফেলতে।
তোমায় দেখে বিপ্লব জন্ম নিবে।
এই নষ্ট মাটিতে আর প্রেম নিয়ে ব্যবসা হবে না। বেশ্যাবৃত্তি হবে না।
কেবল আবেগের আবাদ হবে এই উর্বর জমিনে।

এখন সিদ্ধান্ত তোমার!
একজন আমলার স্ত্রী হয়ে বাকি পঁয়ত্রিশ বছর জেলখানার মতো দমবন্ধ ফ্ল্যাটে কাটিয়ে দিবে-
নাকি একজন কবির মুকুট হয়ে বেচে থাকবে আরও তেইশ হাজার বছর।

তুমি কি ভাবতে পারো-
এক রাষ্ট্রীয় দাস তোমাকে পাবার জন্যে নান্দনিক হবে।
হয়তো কোন একদিন আমার কবিতার কোন এক লাইন শুনিয়ে নিজেকে জাহির করার চেষ্টা করবে।
আফসোস হবে না তখন? তুমি বিহ্বল হয়ে পড়বে না?

আমি তোমাকে বিব্রত করতে চাচ্ছি না-
চলে যাওয়ার স্বাধীনতা তোমার আছে।
তবে এটুকু কি জানা উচিত না?
আমি তোমার প্রস্থানে মদ খেয়ে মধুসূদন হয়ে যাবো!
তুমি কি হেনরিয়েটা হয়ে আমাকে উদ্ধার করবে?
নাকি রেবেকার মতো অভিমানে দূরে সরে যাবে?
নাকি তুমি আমার ব্যাপারে একেবারেই নির্বিকার-
অনেকটা লাবণ্যের মতো?

জীবনানন্দ হাসপাতালের বেডে পড়ে আছে-
ভেঙে গেছে তার বুকের পাঁজর।
ট্রামের নিচে আহত কবি- আহত স্বপ্ন।
পিসতুতো বোনের প্রত্যাখ্যান, স্ত্রীর অবহেলা।
অবশেষে সমুদ্র নয়- পাহাড় নয়- হেমলক নয়
কলকাতার ট্রাম লাইনের নিচে পড়ে আছে-
বনলতার স্রষ্টা- বিস্ময়কর বিরহের আদিকবি।

তুমি কি চাও আমি এভাবে মরে থাকি?
এই নোংরা শহরের রাস্তায়-
আমার মগজ- রক্ত- পদ্য- প্রেম ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকুক!
তুমি কি চাও একজন রবীন্দ্রনাথ এভাবেই মরে যাক-
তোমায় না পেয়ে?

এখন সিদ্ধান্ত তোমার!
তুমি কি এ যুগের রবীন্দ্রনাথের কাব্যলক্ষ্মী হবে-
আমার কবিতার আজাদীয় আবেগ হবে-
আমার শব্দে রুদ্রের রোদন হবে-
একটি যুগের এথেনা-সরস্বতী হবে?

নাকি আচলে চাবি বেধে রাখা-
কোমরে কুঁচি গেঁথে রাখা-
খোঁপায় চুল বেধে রাখা-
একটি অদৃশ্য দাসত্বে থাকা-
মিথ্যে সুখের ঘোমটা পড়া এক আমলার ওজনদার স্ত্রী হবে?
যে মরে যাওয়ার আগেই মরে যাবে বহুবার।
প্রিয়তমা আমি তোমায় বিব্রত করতে চাইছি না,
তবে-
এই সাহিত্যিকের বুকে সবটুকু অধিকার তোমার।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *