দীর্ঘকবিতা।। মিছামিছি নদীর তীরে বেলা-অবেলাগুলো।। অনিরুদ্ধ আলম
আহা কেমন হয় মিছামিছির নদী! প্রভাবহীন রাজকুমারীর মতো একটি নীল হংসলতা লাজুকতাবশত প্রিয়সখা রুপোলি ঝরনাকে কখনো বলে নাই তার রাজবংশের গল্প। কোথাও কোনো বৃংহতি ছাতিম ফুলের গোপন অভিসার হয়ে ঘাসের ডগায় লুটিয়ে পড়ল। ঢ্যাঙা কাকতাড়ুয়াদের বস্তি কি শুধুই শস্যের মালভূমি?
তুমি ধূ ধূ লাবণ্যকে নদীর আত্মা বলে বিবেচনা করার পক্ষপাতী। পাহাড়পুরের তল্লাটে অমন লাবণ্য দেখেছি শিমপাতার কাঁপনে, মোরগঝুঁটির শীর্ষদেশে, ফাগুনে-বোনা পটলের দোলকে, ডহর রাতে শাদাকালো সপ্তর্ষিমণ্ডলের আলোতে।
জাঁকালো পাখিরা হরিকেলি দিগন্তে ফিরে এলে, শূন্যে-বিগলিত নীলাক্ত বিন্যাস পরিপূর্ণ আকাশ হয়ে নেমে এসেছিল। তেলচিটে কাগজে লেখা সাইকেলে বিশ্বভ্রমণের নিরীহ পরিকল্পনা পকেটে নিয়ে গাঁয়ের মুয়াজ্জিন খাঁখাঁ দুপুরে হেঁটে গঞ্জে যায়। ঘুণে-ধরা কাঠের একটি বিবর্ণ ভূ-গোলক হলেও তা তার চাই। দামে না-কুলোতে পেরে বরাবরের মতো খালি হাতে ফিরে আসে ঘরে।
দৃশ্যান্তরে অশতিপর বটগাছের ছায়াতে গুম-হওয়া ভাঙাবেঞ্চির বিপরীতে পড়ে আছে একজোড়া পরিত্যক্ত জুতো। যেন একজন যথার্থ পর্যটকের অপেক্ষায় দিন গুনছে। আকাঙ্ক্ষা একটাই– সেই আগন্তুকের পদতলে আশ্রয় নিয়ে ঘুরে বেড়াবে কুয়োকাটার সমুদ্রসৈকত। এভাবে অনমনীয় কোনো স্বপ্ন আরেকটা অনন্য দিনের জন্যে বেঁচে থাকে লোকাচারের দ্বিধা-থরোথরো কান্তারে।
কী এক-দুরারোগ্য মোহের বিপাকে কেবলই মনে হয়– গুহাবাসী মানবের গড়া পাথরের বাটিতে পান করি নিরহঙ্কার পাহাড়ের প্রস্রবণ! মৌরলা মাছের সন্তরণ থেকে চুরি করে নিই একটুকরো নির্বিঘ্নতা। রোদ্দুর কি শারদ সর্ষেফুলের এক-পশলা খামার? শামুকের মতো নির্বাক বেলাভূমির সূক্ষ্মরেখা বেয়ে ভবঘুরে হয়ে যাব হরিতকীর প্রান্তরে। ফার্নের পাদদেশ ছুঁয়ে অদিতি-প্রবণ ঝোরার ঝরোকা ছেয়ে সবুজ আলোরা নীহারিকা হয়ে সাজায় স্বপ্নঘন হরিতকী-বন।
এ কেমন নাগরিক গুঞ্জন? আকাশের গুণে চাঁদ ঝলমল করে না। কুপিবাতির ক্ষীণ আভায় ঈর্ষান্বিত আঁধাররা চিরকালই পুড়ে ছারখার। মেষ রাশির নদী আর মীন রাশির মাঠ– এ দু’ জনের গলাগলি প্রসঙ্গে ধনু রাশির ধুলোদের কানাকানি চলে, ‘বিচক্ষণতা পাললিক মৃত্তিকারই নামান্তর।’
নিরন্তর শ্যাওলা-ধরা কোনো স্মৃতি হিজল গাছের মতোই স্মরণের দেরাজে পুষে রাখে নিঃসঙ্গ একটি নীড়। নিস্তব্ধ রাতে কামার-পাড়াজুড়ে উচ্চারিত ঢাকের সাড়া এখনো অপ্রাসঙ্গিক মর্মে পূর্ণিমার ব্যাকুলতা ছড়ায়। তোমার মুখে উচ্চারিত ‘ধন্যবাদ’ ধবনিটি আমার হৃদয়-সরোবরে একটি রক্তাভ পদ্ম হয়ে ফুটে রইল। নিমেষে এক পাল-তোলা নায়ে নীলিমান্তরে বেরিয়ে পড়ি ভালোলাগার সুখদ অহংকারে ভর করে। অনুরোধ– তোমার সুচারু আঁজলাতে কখনো তুলে নিও না সে-ফুল। চীনের পাঁচিলের ব্যাপ্তি নিয়ে একা থাকার স্বর্গীয় বাসনা এখনো আমাকে দিনের পর দিন তাড়িত করে।
ঝরঝরে বহুভুজ-ট্র্যাজেডির চতুরঙ্গে গোপনকথা হিসেবে প্রসিদ্ধ পুরনো বান্ধবীদের সাবেক আলাপচারিতা ক্ষেত্রবিশেষে বিধ্বস্ত নগরীর আস্বাদ হিসেবে ধরা দেয়।
ভাষাজ্ঞানহীন অন্তত একটি আনকোরা ফাঁদ আমাদেরকে প্রতি মুহূর্তে প্রলুব্ধ করে চলেছে। ইতিহাসনির্ভর যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলা জাতীয় ঐতিহ্যের নিষ্ঠ পৃষ্ঠপোষক। কাঠের ঘোড়াও হয়ে ওঠে যুদ্ধংদেহী। আমরা আমাদের সমস্ত সত্তা দিয়ে সুখশিকারে ব্যস্ত। চা-বাগানের নির্মোহ মালিকদের বৈদগ্ধে বশবর্তী বিজ্ঞজনেরা বলেন, ‘সুখ তো সোনার হরিণ। কাঁকর-বিছানো পথে ওর পিছূ ছুটে লাভ নেই।’
লাভালাভের ব্যাপারটা কি সব সময় নৈশবিদ্যালয়ের সঙ্গতিতে পরিশীলিত? প্রাতিষ্ঠানিক আর পাঁচজনের মতো আমিও হয়ে পড়ি পরশ্রীকাতর।
হায়রে চরাচরজুড়ে এত ছোটা! হরিণ থাকে বনে। বন কেটে উজাড়। পাহাড়? তাও কেটে সেখানে গড়ে উঠেছে হাইওয়ে। ডলফিনদের লাস্যময়ী সারকাস দেখানোর স্টেডিয়ামটা তো হতে হবে পাহাড়ের সর্বোচ্চ চূড়ায়। তা না হলে আমোদী পর্যটকরা তেমন আকর্ষণ বোধ করবে কেন?
নদী ভরাট করে বানানো হচ্ছে জলধি-রক্ষণাবেক্ষণ পর্যবেক্ষণ-কার্যালয়। ম্যালথাসের ভ্রুকুটি উপেক্ষা করে ঘাসের ময়দানজুড়ে বৃত্তাকারে শাণিত হয়েছে সবুজ গালিচার অনিন্দ্য করিডোর। বর্ণিল পাথরে গড়ে উঠেছে এক স্বর্গ-উদ্যান। পৃথিবীর প্রাচীনতম ঘাসের প্রজাতিরা এখানে বেঁচে আছে প্লাস্টিক প্রতিমাতে। ছুঁয়ে দিলেই মনে হবে, জুরাসিক যুগের বাঁশপাতারা তোমাকে অভিবাদন জানানোর জন্যে ওখানে অনন্তকাল ধরে অপেক্ষা করছে।
মোহন্ত পাতকুয়োর চৌহদ্দিতে কারো প্রস্থান পুনর্জন্মে বাঁচে। প্রস্তুতিপর্বের তুমি হেসে কুটিকুটি হও। আর আমি আলটপকা সংলাপ-ভোলা অসহায় মঞ্চঅভিনেতা মাত্র। যেন দোর্দণ্ড লাবণ্যময়ী রানি ভবানীর মুখোমুখি ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছি। তীব্র আকাঙ্ক্ষা নিয়ে অপেক্ষা করি– কখন নেমে আসবে আব্লুস-কালো যবনিকা। অভিমানে ঠোঁট ফুলিয়ে অভিযোগ করলে, ‘তুমি লুকোচুরি খেলতে বড্ডো ভালবাসো। কিন্তু মোটেও জানো না কীভাবে একটি জলজ্যান্ত সিঁড়ির পেছনে লুকিয়ে থাকতে হয়। শুধু আমার বেলাই যত অবহেলা।’
সেই ভোরবেলা থেকে সাঙ্গু উপত্যকার সকল চশমার দোকানে আজ জন্মান্ধদের ভিড় লেগেই আছে। পঁচাত্তর বছর পরে ফিরে আসছে আবারো হ্যালির ধূমকেতু। সামাজিক যোগাযোগ-মাধ্যমে টাইফুন-অনুনয়ে রটে গেছে খবরটা রাতারাতি। সন্ধ্যারাতে রঙিন চশমা পরে ধূমকেতুর বর্ণিল পুচ্ছের দিকে তাকালে অন্ধরা ফিরে পাবে দৃষ্টিশক্তি।
আসক্তি-বঞ্চিত ভক্তি কি অতিথি পাখিদের ঝটিকা সফর? পাথারে প্রোজ্জ্বল কনৌজ পাথরগুলো পানকৌড়ি হল। পানকৌড়িরা সারাদিন নেপালের তরাই অঞ্চল থেকে বয়ে-আসা ঢেউদের ডাকনাম জেনে নিতে অনবসর ক্ষণ উদযাপন করছে। উড়াল প্রজাতির কিছু পাতা পুথির মালা জাতীয় সংবেদনশীলতায় বাসা বাঁধে নীল-নীল হাওয়াটে রোদ্দুরে। তেমনি করে ভালোলাগা-বর্গীয় একটি মেয়ে সুকন্যা অবলীলায় কোন পরমার্থে ডাউনট্রেনের মতো আমার হৃদয়ে সূচনা করে সুললিত জংশন?
ভাঙা লণ্ঠনের অপূর্ণাঙ্গ আলোর মানচিত্রে পুরনো প্রেমপত্র নবীন হয়ে উঠলে, পদাবলি বুঝি কেবল আঁকিবুঁকি-রেখাসর্বস্ব স্মৃতিমঙ্গল? উত্তরের তালদিঘি আর দখিনের বেলতলা তো একই সূত্রে গাঁথা। ভাবি– পুরনো ছবি এবং নতুন বাঁশির মধ্যে নিগূঢ় সাদৃশ্য একটাই। ওরা উভয়ই সন্ধ্যার শিষ্যত্ব গ্রহণ করতে আষাঢ়ের শেষ বৃষ্টিবিন্দুটির ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে সদাপ্রস্তুত। মাঠের মুঠিতে কতটুকু শস্যদানা থাকলে তিলপরিমাণ পাখি দ্বীপান্তরে যায় না?
বিনয়াবনত সন্ধ্যার ঘটনায় বিকেলের অভিনন্দন উবে যেতেই মনে পড়ল– কখনোসখনো গোমতীর মমতা দীঘল ঘাসবনের খরস্রোতা উদাসীনতার প্রতিরূপ। এখনো অজানা মহীপালের দিঘিতে জোছনাজলে সেতারের গীত এঁকে দেয় কোনো নিরুপমা ললিতা। এ কেমন পাশাখেলা, যে-খেলায় সকল পক্ষই অভ্যাসবশে জিতে যায়? পরাঙ্মুখতার পাপড়ি মেলে মায়াবতীর অভিমানে তিস্তাময় অশ্রু বসতি গড়ে প্রপাত নামের চোরাগোপ্তা দহনে। তেমন উপকূলের সারল্যে সুশোভিত ঝড়ে আন্দোলিত হতে দেখি অনুভূতির কয়েক দিস্তা ভাগ্যহীন ঝাউগাছকে।