কবিতা।। দিলারা হাফিজ।। ফেব্রুয়ারি কবিতা উৎসব সংখ্যা
একুশের ঠিকানা
একুশ আমার মায়ের ঠিকানা,
জন্ম-সরোবর পেরুতেই
পোস্টবক্স নম্বরসহ পেয়েছি খুব সহজেই
সে এক মায়াবী ইতিহাসের অঙ্কুর—
যেন রোদ-বৃষ্টির তুমুল অভিযান,
মায়ের এই ঠি কানায় প্রথম চিঠি এসেছিলো
১৫ মে তারিখ, ১৯৫৪ খৃস্টাব্দে
—-তা প্রায় ছয় দশকেরও আগে
সরাসরি হক-ভাসানীর যুক্তফ্রন্টের
ঐ রাজসিক মন্ত্রীসভা থেকে…
আজ মনে পড়ছে,কত কত স্বপ্নের ইস্তেহার তখন পূর্ববঙ্গে—
একুশ দফার দাবী ছিলো অমিত প্রাণের ডাক,
সময়ের সামান্য নুন-ভাত যদিও—-তবু—-ত-বু-য়ো
জলপুটির মতো লাফাচ্ছিলো সে আনন্দ আমাদের,
স্বপ্ন আর অধিকার মিলেমিশে নিরঙ্কুশ বিজয় রচনা করেছিলো সেদিনের যুথবদ্ধ এই যাত্রা,
খুব বেশি কিছু চায়নি তো খণ্ডিত বাংলা,
লাহোর প্রস্তাবের মধ্যেই ছিলো পূর্ববঙ্গের ন্যায্যতা,
স্বায়ত্তশাসন এবং তার পূর্ণতা,
আর ছিলো মায়ের মুখের বাংলাকে
রাষ্ট্রভাষার সমান মর্যাদা আসীনের দাবী,
ভাষা কেড়ে নিলে,বাঙালি জাতির কী থাকে বাকী
বলুন তো?
এই প্রতিবাদে রফিক,জব্বার,শফিউর,সালাম,বরকত,
রক্তজবার মতো রাঙালো রাজপথ
সোনাভাই রফিক আমার,
প্রতিবেশি ‘পারিল’গাঁয়ে জন্ম নিয়ে
উজ্জ্বল করেছিলো মানিকগঞ্জের কৃতি-মাটি
আহা, সেই মাটিতে আমিও পা রেখে কত হেঁটেছি
উর্দু-ভাষার জায়-জঙ্গল উজিয়ে যে-পথের রেখায়
উদ্ভাসিত প্রথম তাদের রক্তচ্ছাপ,
অভিমানমাখা মায়ের মুখে বাংলা-বলার অধিকার,
সেই পথে আজো প্রেরণা কুড়াই
স্বপ্ন-সংগ্রামের অমূল্য বীজধান কুড়াই…
আজো মনে পড়ে, বাঙলা মায়ের সূর্য সন্তানেরা
যেদিন বুকের রক্ত ঢেলে দিলো—-১৪৪ ধারা ভেঙে-চুরে
সেদিন মায়ের বিষণ্ন বুকে
থোকা থোকা ঝরেছে পলাশ
একুশের গানের সুরে কেঁদেছে ছেলেহারা মা,
সেদিন সেই দিনটিকে‘শহীদ দিবস’বলতে পারবো না?
ঐ একটি দিনের জন্যে সাধারণ ছুটিও কি
চাইতে পারবো না? তাই কী হয়?
কী এমন বেশি ছিলো এইটুকু চাওয়া-পাওয়া?
মহান ভাষা-শহীদের স্মৃতির মিনার উঠে যাবে
বাংলার মাটি ফুঁড়ে আকাশ-কুঞ্জে
বাঙালির স্মৃতি-সত্তা-ভবিষ্যৎজুড়ে যে মিনার
আত্ম-পরিচয়ের একমাত্র অভিজ্ঞান,
তার নির্মিতি ও স্মৃতিকাঙ্ক্ষা
বাঙালির অধিকারেও থাকবে না—তা কী করে হয়?
দুই.
এক পক্ষ কালের স্বল্প আয়ু নিয়ে জন্ম মাত্রই
নতুন মন্ত্রীসভা মৃত্যুর কলাপ-কূজনে
হারিয়ে গেলো বিলুপ্ত এক ইতিহাসের পাতায়,
নমিত দুঃখের নদীতে ডুবে গেলো সুখের তরী—
পাকি জেনারেল গোলাম মোহাম্মদ
শাসনতন্ত্রের ভোজবাজি দিয়ে কু-চক্রজালে সহসাই
তরুণ নেতা শেখ মুজিবকে আবদ্ধ করেছিলো
জেলখানার জটাজালে,গর্জে ওঠা এক নবীন সিংহ পুরুষ,
তিন.
শোষণের সিঁড়িবিহীন কূটচাল,এবং স্বৈরাচারের
ক্লেদাক্ত ইতিহাস কখনো পারেনি দীর্ঘ থেকে দীর্ঘ হতে—
বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন তাই রচনা করেছিলো
নতুন আলের পথ-দিশা
জাতির মুক্তির সনদ,বাঙালির বাঁচার
অপর এক নাম, ছেষট্টির ছয়দফা—
স্বৈরশাসক আইয়ূব খানের কালোদশকের
অব্যাহত নিপীড়নে যা ছিলো মূলত
বাঙালি চেতনার অগ্নি-বিস্ফোরণ;
আসাদের রক্তাক্ত শার্ট উড়িয়ে
উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান এসেছিলো
কাল-বৈশাখির দুরন্ত ঝড়ের বেগে
একাত্তর এসেছিলো বায়ান্নোর দীপ্তিময় পথ বেয়ে
অমিত সাহস আর ভালোবাসার অস্ত্র বুকে নিয়ে
পরিশেষে মহান স্বাধীনতা এলো তিরিশ লক্ষ
শহীদের রক্ত ও আত্ম বিসর্জনে…
দুলক্ষ মা-বোনের স্মৃতি সন্তাপে—-
মায়ের শাড়ির আঁচল কেটে তৈরী হলো
লাল সবুজের পতাকা
স্বাধীন সার্বভৌম স্বদেশ হলো বাঙালির—
স্থপতি যার সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি,জাতির পিতা;
একুশে ফেব্রুয়ারির প্রভাতফেরী আজ নব উদ্যমে
গাঙ্গেয় ব-দ্বীপ থেকে ভাসিয়েছে তরী নয়া ইতিহাসের ঘাটে;
পৃথিবীর দেশে দেশে হাজারো মাতৃভাষা-ভাষি
একুশের পতাকাতলে ঐক্যবদ্ধ আজ
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা নামে!
স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তি
যখন দুয়ারে দাঁড়িয়ে…