কবিতা।। মজিদ মাহমুদ ।। ফেব্রুয়ারি কবিতা উৎসব সংখ্যা
দশম দশা
প্রেমের সূচনাতে হারিয়ে ফেলেছি সকল মুদ্রা
তার অনির্দেশ্য ইঙ্গিতে করেছি গৃহত্যাগ
আমাকে ছেড়ে গেছে গোত্রের স্বজনেরা
জানি না ভগ্নস্বাস্থ্য পুনরুদ্ধারের আছে কি উপায়
আর কেনই বা তার দরকার
পাড়ার শিশুরাও আমাকে করে না গ্রাহ্য
দু’একটি ঢিলও ছুড়েছে আমার দিকে
পাগলের সাথে সবারই সম্পর্ক মজার─
মানুষের পৃথিবীতে─ সে থাকে অন্য দুনিয়ায়
অবশ্য যার জন্য আমার এই দশা
তাকেও দিই না দোষ
ভালোবাসা তো একান্ত নিজেরই জন্য
যদি আমার আহব্বানে সে দিত সাড়া
যদি পূর্ণ হতো মিলনের সাধ
তাহলে তো এখানেই শেষ প্রেমানন্দের
মল্লিনাথ বলেছেন─ প্রেমের দশটি সোপান
দৃশ্যের সুখ─ প্রেমের প্রথম ধাপ
দ্বিতীয়তে রয়েছে─ মিলবার সাধ
ক্ষুধামন্দা, স্বাস্থ্যহানি এসবও প্রেমের পর্যায়
আমার অবস্থান এখন অষ্টম ধাপে
সংসারীরা যাকে প্রেমোন্মাদ বা মজনু বলে ডাকে
আমি নিজেও ভুলে গেছি এ দশার কারণ
শরীর দিয়ে শরীর ছোঁয়ার ক্ষমতা হারিয়েছি
এখন শুধু পৌঁছে যেতে চাই চরম প্রান্তে
বারংবার মুর্চ্ছা যাচ্ছি, বেঘোরে দেখছি−
যুদ্ধে কর্তিত সৈনিকের শিরস্ত্রাণ তুলে নিচ্ছে
এক রোরুদ্যমান রমণী
হয়তো আমি চলে এসেছি প্রেমের চূড়ান্ত পর্বে
যদিও মানুষ তাকে মৃত্যু বলে জানে
তবু পেয়ালা ভরার এই তো সময়
আমি এখন উঠে যাচ্ছি দশম ধাপে…
নিষ্কামী
তুমি ঠিকই জানো, তোমার তো জানারই কথা
আজ অনেক লিঙ্গের মাঝে বিপন্ন আমি
অথচ এই লৈঙ্গিক পরিচয় ছিল আমাদের খেলা
আমরা যখন পানির পিচ্ছিল ঘাটলায় জেগে উঠছিলাম
যখন আমাদের ছিল প্রোটোজোয়া কাল
তখনো হয়নি শুরু আমাদের হ্যাপ্লয়েড বিভাজন
শরীরের মেয়োসিসগুলো তখনো ছিল মাইটোসিসের সাথে
আপন কোষের আড়ালে আমরা তখন স্বমেহনরত
সেই তো ছিল আমাদের সম্পূর্ণ আনন্দের কাল
তুমি বা আমি; আমি বা তুমি− এর কোনো লিঙ্গান্তর ছিল না
তখন আমরা ছিলাম, সম-বিষম-উভকামী
আমাদের শয়ন, উপবেশন কিংবা পদব্রজ
হিমালয়শৃঙ্গের গলিত তুষার-তরঙ্গের সাথে
পতিত হয়ে তোমাকে তুলে নিচ্ছিলাম কোলে
কখনো তুমি নিচে, কখনো আমি
শরীরের ভারে নুব্জ, আবার জরায়ুতে গেছি মিশে
হয়তো এসব তুমুল উত্তুঙ্গু মিলনের কালে
আমার সুপ্ত অহংকার তোমকে হারিয়ে ফেলেছিল
যদিও চন্দ্রিমা রাতে আমরা কাছে এসেছিলাম
যদিও আমরা হারিয়ে ফেলেছিলাম অন্ধকার গুহায়
তবু দিনের আলো আমাদের মিলতে দেয়নি
অথচ এখনো যারা তাদের লিঙ্গকে পারে চিনতে
তারা হয়তো সমকামী, তারা হয়তো এখনো আছে
ঈশ্বরের উদ্যানে
তাদের অযৌনজনন, পক্ষপাতহীন মিলন
কেবল মিলনের আনন্দের তরে
কিন্তু যে আমি তোমাকে হারিয়ে ফেলেছিলাম
হয়তো শরীরের চিহ্ন রেখায় ছিল দৃশ্যত অমিল
সেই তুমি যখন আমার সঙ্গে মিলিত হও
তখনই তো আমি হয়ে উঠি অভিন্ন পূর্ণ মানুষ
তখন আমরা পরিণত হই নিষ্কাম কর্মে
তখন দৃশ্যত কামের আড়ালে পারে না দেখতে
আমাদের বিভাজন রেখা
লাশ নামাবার গল্প
প্রথমে আমার দেহ কবরস্থ করেছিলেন আমার পিতা
নিজের আনন্দে রেখে এসেছিলেন কোনো এক মহিলার প্রকোষ্ঠে
সে নারীও বেশিদিন পারেননি করতে বহনের যন্ত্রণা
অসংখ্য লাশের সঙ্গে আমাকে করলেন সমাহিত
একদিন সেই সব মৃতদেহ আবার আমায় ধরাধরি করে
শুইয়ে দিলেন মৃত্তিকার গর্ভে
একটি গর্ভ থেকে আরেকটি গর্ভে, একটি কবর থেকে আরেকটি কবরে
পিতাদের অনুগামী হয়ে পুত্রদের আগে− আমি কেবর ভ্রমণবিলাসী
আমার হাতে ধরা কবিতার পান্ডুলিপি, ভ্যান-ভিঞ্চিদের চিত্রকর্ম
বিশ্বখ্যাত স্থপতিদের সমাধিস্থল সাজাবার কলা
আর আমাদের ঈর্ষা, খ্যাতিমান হওয়ার কৌশল
কিংবা রূপবদলের তাড়না
গিলোটিনে যেসব শরীর হয়েছিল দু’ভাগ
ফাঁসির উদ্বন্ধন নিয়েছিল কেড়ে যাদের বাতাস
অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার পর- তারা এখন হেঁটে যাচ্ছে
আরেকটি কবরের দিকে
বলাৎকার কিংবা প্রেমের প্রস্তাবনা তো একটি কবরের
অনুসন্ধান ভিন্ন নয়
আমাদের পৃথিবী কেবল লাশ নামাবার গল্প।
কৃপণ
যখন তুমি ষোলতে ছিলে−
তখন কাউকে কিছু দাওনি
এমনকি ভিক্ষুক পয়সা চাইলেও
সংকোচে গুটিয়ে যেতে নিজের ভেতর
ছাব্বিশেও তুমি অনুরূপ কৃপণ
ষোলতে ভাবতে, নেবার নিশ্চয় কেউ আছে
যার জিনিস সে নেবে দেবারই বা কি আছে
যে নেবে সে রাজার মতো আসুক
ছিনিয়ে নিয়ে যাক নিজের সাহসে
তুমি ছিলে ভিক্ষায় অনুকম্পাহীন
রাজা দুষ্মন্ত যেভাবে মৃগয়ায় এসে
শকুন্তলাকে করেছিল অপহরণ−
দাতা ও গ্রহিতার অনুকম্পা
তোমার মর্যাদার বিপরীত
কিন্তু পৃথিবীতে সবাই তো আর
তোমার মতো যুবরাজ্ঞী নয়
দখল ও বশ্যতা ছাড়া
আর কোনো অধিকার তোমার সহজাত নয়
তবু জেনে রেখ, ভিক্ষাও পৃথিবীর এক আদি পেশা
কিছু মানুষ নিশ্চয় আছে কৃপার কাঙাল
তুমি যা দেবে নির্দ্বিধায় তুলে নেবে সে
না দিলে থাকবে অপেক্ষায়
তোমার সিংহ দরজার বাইরে
তোমার অঢেল সম্পদের ভাঁড়ার থেকে
একটি কানাকড়ি যদি অবজ্ঞায় দাও ছুঁড়ে
সেই হতে পারে তার শ্রেষ্ঠ পাওয়া।