কবিতা

সুমাইয়া বিনতে শওকত এর কবিতা

সুমাইয়া বিনতে শওকত পেশায় একজন চিকিৎসক, শিক্ষক, কবি, অনুবাদক এবং সমাজ সেবক। করোনাকালের লকডাউনে সবাই যখন হাত গুটিয়ে গৃহবন্দি, তখন তিনি রাজধানী ছেড়ে মফঃস্বল শহরে মানব সেবায় নিবেদিত। সারাদেশে যখন মৌলবাদীদের আস্ফালন, তখন তিনি তাঁর লেখায়, চিন্তা-চেতনায়, কর্মে প্রতিবাদী। মুক্তমনা সুমাইয়া অপ-সংস্কৃতি বিরোধী নানা ভাবে সোচ্চার এবং সাহসী।

জীবননান্দীয় ধারার এই কবির কবিতায় এক ধরণের নির্জনতা আর রোমান্টিকতা প্রতিফলিত হয়। তিনি নারীবাদী নন; মানবতাবাদী। তবে নারীদের আত্মনির্ভশীল করার ক্ষেত্রে তাঁর ভাবনা কবিতায় লক্ষণীয়।

নিচের কবিতা ক’টি পাঠের পর সুরাইয়ার কাব্য ধারার ধারণা মিলবে বলে বিশ্বাস।

শফিক নহোর

মেয়ে

মেয়ে, আয়নায় দাঁড়িয়ে নিজের চোখের জল নিজেই দেখ,
তোমার চেয়ে পরম মমতায় তোমাকে কেউ দেখবেনা।
গভীর দৃঢ়তায় নিজেকেই আকরে ধরো,
স্নেহের স্পর্শ করো নিজেকেই তোমার দু’হাতে।
নিঃস্বার্থ বন্ধু হও নিজের, নির্ভরতা খোঁজ তোমাতেই।
তোমার মন কি চায়, বোঝার দায় নেই কারো-
তুমি যা চাও, যেখানে নিজেকে দেখতে চাও-
সেটা পূরণের দায়ও তোমার।
যদি তুমি বোঝ বৈচিত্র্যময় পূর্ণ জীবন কী?
যদি তুমি বুঝতে চাও পৃথিবীর রহস্য কী?
যদি তুমি যাপন করতে চাও, সাহসী হও।
লোকের শেখানো রাস্তায় নেই-
তোমার সফলতা, তোমার পূর্ণতা।
একা বাঁচতে, উপভোগ করতে শেখো
বিচিত্র জীবন চিনতে শেখো একা মনভ্রমণে,
স্বার্থপর হয়ো না, নিজের জগত গড়ে নাও।
ভেঙে পড়োনা মেয়ে, দেখো অদূরেই বাতিঘর
তোমার মতোই বিবর্ণ বসন্ত পার করছে ; ঠিক
তোমারই আরেক সত্ত্বা, একদিন ভূমধ্যসাগরের নীলে
সাদা ডানা মেলে দেবে পরিযায়ী পাখিরা-
বসন্ত সাজবে; রঙে-গন্ধে, বিপুল সম্ভারে
তোমার, তোমাদের জন্য।
বিশ্বাস হারিয়ো না মেয়ে, অযত্নে বেড়ে ওঠা
বুনোফুলের ঘ্রাণও যত্ন করে নেয় কেও কেও,
বোঝে তার অমূল্য অকৃত্রিমতা।
দু’হাতে ‘ফরগেট মি নট’(ফুল) নিয়ে অপেক্ষা করে
একাকী ল্যাম্পপোস্টটার নীচে;
অনেক যত্নে, জড়িয়ে দিতে, তোমার খোঁপায় ।
সে এক এমন দীপ্তি, আলোকিত করবে তোমাকে,
তোমার উঠোন, চাঁদের মতোন নির্ঝরিনী।
নয় সে মধ্যাহ্নের গনগনে লাল সূর্যের উত্তাপ।
তারও আজন্ম সাধ, শরীর নয়-
মানবিক তোমাকে পাঠ।

দূরত্বই অমরত্ব

চাঁদের লুকোচুরিতে ছিল একটি আকাশ-
কোটি কোটি নক্ষত্রেরা পরম মমতায় আমার পাশে,
কিছুটা নামহীন শব্দ চয়নে হৃদয় গহীনে- কালপুরুষ তুমি!
জন্মান্তরের এ প্রেম আমাদের,
মনে হয় এখনো জীবন্ত, প্রাণপ্রাচুর্যে ভরপুর
ভালোবাসার কিছু গান!
ভালোবাসায় খোঁজও না অপরাধ।
আমাদের প্রাণের অংশ তারা, আমারই প্রাণের স্পন্দন।
হে নক্ষত্ররাজী, এমন গভীর- করুণ পূর্ণ ভালোবাসায়
পূর্ণ যে তোমার হৃদয়, কেউ কি জানে?
কেউ এই চোখে এইভাবে কোনোদিন তোমাকে দেখেছে? দেখতে পেরেছে?
তোমার এমন আলোর প্রাচুর্যে কেউ কি কেঁদেছে?
কেউ কি মনে মনে রাখে তোমার শেষ বিদায়ের খবর!
অথচ এই মানুষের ভালোবাসায় তুমি-
জ্বলে জ্বলে নিঃশেষ হও প্রতিদিন,
প্রতিদিনই জন্ম দাও নতুন প্রাণ এ মহাবিশ্বে।
হে তারকারাজী, দূরে আছো বলেই
তোমার প্রেম মহৎ, অমলিন চিরন্তন।
এই দূরত্বই তোমাকে দিয়েছে অমরত্ব।
তোমার মতো কেই বা ভাবতে পেরেছে এমন!
কেই বা পারতো অসাধ্য সাধন!
কাছে এলে থাকতো এই রহস্যময়তা? এই শুভ্রতা?
যেদিন আমার তোমার মাঝে আকাশ ছাড়া
কেউ থাকবে না, সেদিন বুঝবে আমি তোমার কে।
তুমি চিরকাল দূরেই থাকো নক্ষত্র –
কিন্তু তবুও থাকো, শুভ্র থাকো, ঝিলিমিলি থাকো!
আর দিন রাত্রির আলো খেলায় মেতে থাকো আমাদেরই মতন।

পরাবাস্তবতা

উল্টোনো বাটির মতো নীল কাঁচের আকাশ,
আর একটিমাত্র উজ্জ্বল করুন চাঁদ।
সফেদ বিছানাতে ফেনিল সমুদ্রপাড়ে শুয়ে শুয়ে
আমার একমাত্র সম্পদ, এই দুঃস্প্রাপ্য-
চাঁদের মালিকানা আমি তোমায় দিয়ে দিলাম।
আজ থেকে এই চাঁদ তোমার, বা তুমিই এই চাঁদ!
শুভ্র মেঘবালিকার মতো তোমাকে ঘিরে আবর্তন,
অকারণে ছুঁয়ে দেবার অজুহাতে- স্পর্শের আজন্ম স্বপ্ন,
হতে হতেও হয়না, ঘুম ভাঙলেই মিলিয়ে যায়,
এমন এক পরাবাস্তবতা।
এ রাত-এ জোছনা তবুও তোমার স্পর্শ নিয়ে আসে,
নিয়ে আসে তোমার সুপ্রাচীন সৌরভ।
এখানে বয়ে চলা দখিনা বাতাস তোমার বার্তা নিয়ে আসে,
তোমার গুঞ্জরণ; তুমি প্রজাপতি হয়ে বসো-
আমার ত্বকে, চুলে, চিবুকে।
এই বিস্তীর্ণ চরাচরে, জোছনার সমুদ্রের মাঝখানে
আমি একা শুধু তোমায় নিয়েই থাকি।
কখনো বৃষ্টির ছন্দ আমাকে তোমার গান শোনায়।
আমরা পাহাড়ে একটি কুড়েঘর বাঁধি; কাঠ, ফুল দিয়ে
শীতের রাতে একই কাপের কফি দুজনকে উষ্ণ করে।
ঐ পাহাড়ের ঘরে আমাদের বয়স বাড়েনা,
জোছনার ফুল দিয়ে নিজেদের সাজাই, সাজি।
এই জোছনা কথা বলে, মনের খুব গভীরে কথা বলে
চুপিসারে অনেক কথা, তোমার মতোই-
অনেক নিঃশব্দ কথারা আমাকে ঘিরে।
এই হাসনাহেনার মৌসুমে, বন্ধু তোমায় দিলাম ছুটি।

স্মৃতি

এই উত্তরের হাওয়ায়,
বিস্তস্ত্র হয় নাগরিক জীবন আমার।
এক লহমায় ছুটে যাই আমি,পাহাড়ের শ্যামলিমা’য়,
নির্জন মৌন পাহাড়ে একদিন নির্ঝরিণী হয়েছিলাম।
তুমি, হ্যাঁ, তোমাকে পেয়েই।
এক সমুদ্র পাহাড়ের নীলাভ মৌনতায়,
আমাদের গানের প্রতিধ্বনি পাখিরা শুনছিল।
মনে আছে?আমাদের কত দুষ্টুমির স্বাক্ষী, তোমার বাইসাইকেলটি!
কত প্রাণোচ্ছল দুপুরকে আমরা বিকেল করেছি,
নরম রোদে, গাছের ছায়ায় শেষ করেছি এক-একটি বই, আমাদের আনন্দ উপাখ্যান।
পিঠের উপর পিঠ জড়িয়ে দেখেছি আকাশে মেঘেদের চলাচল।
বুনোফুল দেখলেই থেমে যেতে তুমি;
ফুলগুলো খোঁপায় জড়িয়ে মাতাল হতো;
আমার চুলগুলো, ঝর্ণার অমৃতধারায় আমাদের স্নান।
হেঁটে হেঁটে দূরের গ্রামে চলে যেতাম দুজন,
যেখানে মেঘবালিকারা চুমু আঁকে পাহাড়ের কপোলে,
কুয়াশাগুলো আমায় জড়িয়ে রাখতো তোমার মায়ায়।
দিগন্তজোড়া আমাদের চোখে নেমে আসতো বিষন্ন সন্ধ্যা পাশাপাশি বসে।
মোমের মায়াবতী আলোয় উষ্ণ হতো রাতগুলি;
আমাদের আন্তরিকতায়।
প্রতিটি দিন, প্রতিটি রাত কাটতো নিস্তরঙ্গ অনুভবে, অপার্থিব পূর্ণতায়।
ছুটে চলা মেকি জীবন, ব্যস্ততার সমাহার
ছিল না আমাদের সে সময়ে।
আমাদের ফুসফুস হতোনা আক্রান্ত;
বিষাক্ত ধোঁয়ায় ক্ষণে ক্ষণে।
অনুভব, অনুভূতির মূল্য ও সময় দুটোই এখন কম
সভ্যতা প্রাচুর্য দিয়েছে, দেয়নি প্রশান্তি।
বরং কেড়ে নিয়েছে সম্পর্ক, মূল্যবোধ।
শুধু যেন রয়ে গেছে স্থির সেই বাইসাইকেল।
হয়ত খানিকটা জং ধরা, তাতে কি! স্মৃতির পরতে পরতে তার লেশমাত্র নেই।
সেই ক্রিং ক্রিং ধ্বনি, মনে পড়ে সুশান্ত সে সময়, মনে পড়ে;
আজো খুব মনে পড়ে….।

একটি জোনাকি আমাকে পথ দেখালো

সবুজে ঘেরা একটি পথ-
খই ফুলের মতো নক্ষত্রকালো আকাশের নীচে,
জোনাকিফুলের সবুজ ঘন কালো অরণ্য।
শুধু আমি, আমি, আমি, ঝর্ণার মতো বহমান নির্জনতা,
আর সেই জোনাকি!! তার মহুয়া মাতাল সুর!!
ক্রমশ অরণ্যে আমি বিলুপ্ত হলাম,
জোনাকির গভীরতায় মায়ার অতলে হারালাম।
অবাস্তব এই পৃথিবী, অদেখা এই জীবন-
দৃশ্যমান জীবনের চেয়েও অধিক সত্য।
সত্যের চেয়েও অধিক সুন্দর!
মেঘের মতো সুখী, শুভ্র, নিঃশঙ্ক-
ভরহীন, ইউটোপিয়ান, সুবাসিত।
উপহার দিলো এক অরণ্য জোনাকি আর
এক কল্পনার রাজ্য-
শেখালো রঙতুলি ছাড়াই আকাশে আঁকতে
প্রিয় অবয়ব যখন যেখানে খুশী,
তার সুর যেন মুনলিট সোনাটা, বিটোফেন
ফিফথ সিম্ফনি – চাঁদকে করে আলোকিত।
মেঘে মেঘে, বাতাসে বাতাসে সে ভেসে ভেসে বেড়ায়।
আমি তার সুবাস পেতে থাকি আনমনে,
বৃষ্টিতে-জোছনায়, আমার একাকীত্বে।
হঠাৎ হঠাৎ দারুন অসময়ে আমাকে চমকে দেয়
যেমন প্রাণের গভীরে কোন সকরুন বিষাদ,
আজন্ম লালিত সলজ্জ কোন সাধ,
সামনে এসে দাঁড়ায়।
জোনাকি আমাকে শুধুই পথ চেনালো,
আমি এখন রাজকুমারী এ অরণ্যের,
কল্পছবিও পারি আঁকতে।
তবে সৌন্দর্য্য ক্ষণস্থায়ী বলেই সুন্দর!
যেমন জোছনা এক রাত্রির জন্য বলেই,
বৃষ্টি এক মুহূর্তের জন্য বলেই সুন্দর।
সে এখন তার সোনালি দ্বীপের দেশে,
শত কোটি জোনাকি থেকে, ঐ আলো
যে বেশী মায়াবী, কিভাবে তাকে বোঝাই
দিন কাটে না, রাত কাটে না-
মেঘবালিকা, তারই অপেক্ষায়।

২ thoughts on “সুমাইয়া বিনতে শওকত এর কবিতা

  • Mist.Eti khondoker

    nice

    Reply
  • Md Rafiquzzaman

    Congraculation

    Reply

Leave a Reply to Mist.Eti khondoker Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *