রণজিৎ গুহ এর কবিতা
ভোরের ঠিকানা
অন্ধকার মানেই আলোর অভাব, এ বড় খল কথা।
খণ্ডহরে জেগে থাকে স্বর্ণকলস। সময়ের জলছবি। আবডালে সুপ্ত বীজ।
পতঙ্গ কলতানে প্রাণের বৈভব।
এখানেই শুরু করা যায় ঘুমভাঙানিয়া গানের মহড়া।
আলো বড় প্রগলভ হয়ে পড়ে ঔজ্জ্বল্য অহঙ্কারে।ছায়ার নির্মিতিতে ত্রুটি থেকে যায়। অন্ধকার প্রতারণা করে।
তবুও অন্ধকার মানেই আলোর অভাব, এ বড় অসত্য উচ্চারণ।
অন্ধকার এবং অন্ধকারেই জীবিত প্রত্যাশা। আসিছে প্রভাত।
প্রস্তুতি
পারাপারের সব ব্যাবস্থা এখন হাতের মুঠোয়
আমার এপাশে জল তলের আলোকজ্জ্বল সুড়ঙ্গ
বাম পাশে ছয়লেন দীর্ঘ উড়ালপুল
বুক পকেটে উড়ো জাহাজের কনশেসনাল টিকিট
অত্যাধুনিক জলযান তৈরী,মাঝি মাল্লারদের সাথে
আমার অঢেল সখ্যতা।
সব ব্যবস্থা পাকা। গেলেই হয় এবার ওপারে
আর কে না জানে ওপারেতেই সর্বসুখ।
এপারে কৃষ্ণতুলসি, পুত্রবধু সন্তান সম্ভবা,
প্রয়াত স্ত্রীর নিজের হাতে লাগানো জামরুল গাছ,
লিটু ঘোষের ঘরে তৈরী ঘিয়ের সুবাস।
শাড়ীর পাড়ের সুতো দিয়ে মায়ের সেলাই করা কাঁথা মুড়ি দিয়ে এইসব ভাবতে ভাবতে
দেরী হয়ে গেল।
সব ট্রেনতো সমান তালে চলে না।
সব আয়োজন শেষে আড়মোড়া ভেঙ্গে
এবার রওনা হব সাগর পারে
কবিতা আসরে।বন্ধুরা পৌঁছে গেছে আগেই।
এপারেই যাবৎ যাপন
এযাবৎ পারাপার করেনি কেউই। ফিরতি পথে নিয়ে আসেনি হাত চিঠির আশ্বাস; এপারে লেবুগন্ধ লেপে নিলে ওপারে পাওয়া যাবে দাড়িম্ব ফুলের নির্যাস। তবু তুমি আছ ওপারে তোমার বসবাস।এপারেতে লোকমুখে এরকমই তুমুল বিশ্বাস।
এপারে ইচ্ছে যাপন। কেউ বিষন্ন উদাস। কিংবা বনানীর আলোছায়ায় বনভোজনের সুখ বিলাস।ঈর্ষার আনাচে কানাচে অনুতাপের শুদ্ধ মন। স্নেহ আছে। সপ্তরথী ত্রস্ত থাকে অভিমন্যু স্মিত হাস্যে জীবনের গান গায়। ফিরিব না আর।
এপারে এমনই জীবন। মুক্তির আকাংখায় জড়ায় বন্ধন।
ওপারেতে তুমি ন্যায়দণ্ড হাতে সমুজ্জ্বল। নিক্তিতে মেপে নাও শশ্যের পরিমান। আক কষে মৃতদের শোনাও শাস্তি ও প্রশস্তির নিদান।
রসে বশে কৌতুকে বপনে সৃজনে লালনে এপারেতে অহো মহাজীবন রচে প্রজন্মের নিশ্চিত অভিজ্ঞান।
ভীতদের মৃতদের চন্দন বাতাসে বেত্রাঘাতে শুদ্ধাচারী করে তোল ওপারেতে তুমি এমন শুনেছি।
এপারে ভালভাসার সামিয়ানায় মাভৈ মন্ত্রে সবার আমন্ত্রন।
জীবনে মরণে এপারেই আমার শুদ্ধাশুদ্ধ শয়ন বিহার।
মৃত্যু যদি যায় ওপারে সুখে রেখ যদি থাকো
যদিও এযাবৎ কেউই করেনি পারাপার।
কতটুকু পেলে
ঠিক কতটুকু পেলে
নিজেকে আর এলেবেলে মনে হয় না
একবার মেপে নিতে পারলেই
শ্বাস স্বাভাবিক ছন্দ ফিরে পায়।
একবার আনত হলে
প্রয়োজনের সংজ্ঞা বদলে যায়
আকাশ আটকে যায় ঘেরা বারান্দায়
অভিসন্ধির আদলে।
অঙ্গীকার নেই এখন
অঙ্গীকার ছিল তটভূমি ধরে চলে যাব সমুদ্র সীমানায়
সন্তানের মুখচেয়ে ফিরেছি
থেকে গেছি এজন্ম পরিচিত বদ্ধ জলায়।
অঙ্গীকার ছিল পৌষালি অগ্নিকুণ্ড ঘিরে সারারাত বন্ধু সমারোহ
মদিরা শরীরে মাখিয়েছে ছাই
প্রভাতে খোয়ার ভেঙ্গে দেখি কেউ নেই নষ্ট আবহ।
অঙ্গীকার ছিল রাজপথে বয়ে যাবে আমার স্বেদ ও শোনিত
অনিবার্য্য বিস্ফোরক রাস্ট্রবিপ্লবে
বাতায়ন বন্ধ রেখে একাকী হয়েছি কবিতায় প্রাণিত।
অঙ্গীকার ছিল চুম্বনে চুম্বনে কাটাব অতি দীর্ঘসময়
শরীর কৌতুক নিজস্ব নিয়মে চলে
নিদ্রাতুর নিস্তরঙ্গ শুয়ে আছি স্খলন ব্যস্ততায়।
এখন অঙ্গিকার নেই আছি তবু স্বপ্ন বিভ্রমে