মিলু শামস এর একগুচ্ছ কবিতা

ঝিম ধরা দুপুর

তোমাকে মনে পড়ার দীঘল ক্ষণগুলো
শিউলি ঝরার মতো
মৃদু লয়ে ডেকে আনে অতীত
জ্যোৎস্নায় ভিজে যায়
বিবর্ণ শরীর;
তুমি এক ঝিম ধরা দুপুর
বিষন্ন করোটিতে
বিঁধে থাকো
শিমুলের কাঁটা,
স্মরণের রক্ত ক্ষরণ
ঢেকে দেয় সময়
হিসাবের খাতা।

নদী হয়ে যায়

তোমাকে ভোলার সিদ্ধান্তটি
মুহূর্তে নদী হয়ে যায়
কুল কুল বয়ে গিয়ে মেশে
বর্ষায় জলমগ্ন লোকালয়ে
কী করে ভুলি তোমায়
ভোলার সিদ্ধান্ত নিতেই
এমন ছড়িয়ে গেলে?

সন্ন্যাসী ছায়া

এই যে চলে যাওয়া
পেছনে অলস পদচ্ছাপ রেখে
এ এক অর্থহীন কুহকের ডাক;
ফসলের ক্ষেত, সবুজ প্রশাখার ভিড়ে
সন্ন্যাসী ছায়া জাগে
সরুপথ, একতারা হাতে
নদীঘাট বালুতট
নিঃসীম চরাচরে।

গন্তব্য

যতদূর গেলে ছোঁয়া যায় তোমায়
আমি ততদূর যাবো,
বিশ্বাস করো
একটাই গন্তব্য
এ জীবনে;
ভালোবাসা ছাড়া
আর কোনো পথে
হাঁটতে শিখিনি আজও।

প্রতীক্ষা

গোধূলির সূর্য
শেষ বেলায়
আকাশকে পরায়
টকটকে লাল টিপ
জাকারবার্গের উন্মুক্ত বইয়ের
মার্জিনে তেমনি জ্বলো তুমি
গাঢ় সবুজ দ্বীপ।
স্পর্শের বাইরে দুই-ই
তবু কী নিবিড় প্রতীক্ষা আগামীর।

আগত

দিনক্ষণ মেনে চলুক
সামাজিক মানুষ,
আমি তো সামাজিক নই
সমাজের ঘেরাটোপে
আগত এক চিরকালের,
নিয়মনিষ্ঠ মানুষের ভিড়ে
ভান করে টিকে থাকা
বেঁচে থাকার নামে।

মধ্যাহ্নের ট্রেন

অসময়ে দল বেঁধে চলে গেল তারা
পুবের জানালা ঘেঁষা
নুয়ে পড়া বাঁশ ঝাড়ে
বসেছিল চিরচেনা
লক্ষ্মী প্যাঁচা,
ঢেঁকি ছাঁটা চাল ছিল
অড়হর ডাল, সরষের তেলে
সাজানো ভাঁড়ার
ভাঁড়ারের গায়ে লেখা
‘ভুলনা আমায়।’
একটানা ডেকেছিল
পুরনো তক্ষক, দহলিজে
তবু তারা ফিরল না
কোনো পিছু টানে
দল বেঁধে চলে গেল
মধ্যাহ্নের ট্রেনে।

সব ঢেউয়ের সংজ্ঞা হয় না

পাগলপারা সব ঢেউয়ের সংজ্ঞা হয় না
শহর গ্রাম উপবন ভাসিয়ে
তারা বয়ে যায় শুধু।
এসব যাওয়ায়
মেহগনী পাতার মতো ফুটে থাকে
জীবন, উজ্জ্বল প্রাণবন্ত। মূলত এদের
গায়েই লেগে থাকে
উপক‚লের নতুন সঙ্কেত
দূর দূর দ্বীপে, চর জাগা নবীন মাটিতে।
কোনও কোনও আঙিনার
জলভরা দীঘিও উড়ে যায়
পূর্ণিমা রাতে, বাসন্তী ফুলের মতো
ঘ্রাণ ছড়ায়
ওই সব ঢেউয়ের বাগানে।

হেসে ওঠো জীবনের রোদে

কামিনী ফুলের মতো শুভ্র দুপুর
ঝরিয়েছ দু’চোখে তাই, বুভুক্ষু প্রান্তর হাসে
নোনা রোদে। কুহক দ্বীপে হারিয়েছিলে পথ
ময়ূরপঙ্খী বাঁধা ছিল উজান স্রোতে;
কার জীবন যাপন করে এতোকাল ছিলে শাপগ্রস্ত,
ভালোবাসা সন্ন্যাস নিয়ে পড়েছিল অবেলায়।
আজ সম্বিৎ ফিরে পেলে যদি, কাকে তুমি দেখো
রাজকুমার? জাদুকরী আয়না ফেলে দাও
তুলে নাও আতশী কাচ; আঁজলা ভরেছে
সোঁদা সোঁদা রাঙা ফুল, চোরাবালি টান
উবে গেছে, চন্দন সুবাস ওঠে দেহের কপাটে।
সাতমহলায় চাঁদের আঁচলে ঢাকা মুখ
বিরহের প্রস্তর ঠেলে জেগে আছে
কতকাল, শীর্ণ শরীরে তার সজল প্রেমের স্রোত;
গতভালবাসা হেঁটে এলো এই ভৈরবী ভোরে
সাত সমুদ্র তেরো নদী পাড়
এখানে নোঙর ফেলো, করো জীবনের চাষাবাদ।

সন্ধ্যার সুর

জানালা গলে বাতাস এসে নুয়ে
দিচ্ছে তাকে আলতো করে ছুঁয়ে
সন্ধ্যা আকাশ ভার হয়েছে ভীষণ
তার কি এখন আছে সেসব স্মরণ?
মেহেদী হাতে কার ঘরে সে রেখেছিল পা
আকাশগাঙে ভাসিয়েছিল স্বপ্ন রঙিন না,
কী উন্মাতাল দিন ছিল সংসারে
অনেক জীবন ছিল তাকে ঘিরে।
মেঘের পরে মেঘ ভেসে যায় দূরে
আধখানা সুর ওড়ে তেপান্তরে
হুইল চেয়ারে জীবন এখন বাঁধা
খুঁজে বেড়ায় হারিয়ে ফেলা পুরনো সেই গাথা
খসে গেছে জীবন থেকে বাঁধনগুলো তার
আশ্রমের এ যাপন এখন নিঃসঙ্গ একার।
সময় যাচ্ছে বয়ে নিজের মতো
ফিরতি পথে কোনোকালে আর সে ফেরেনাতো।

One thought on “মিলু শামস এর একগুচ্ছ কবিতা

  • মে ৬, ২০২০ at ৮:৫৫ অপরাহ্ণ
    Permalink

    অনবদ্য কবিতা। শুভেচ্ছা কবি।

    Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *