গদ্য// বুদ্ধিজীবী শুনছেন কি? //কাজল রশীদ শাহীন


তৃতীয় বিশ্বের রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও বুদ্ধিবৃত্তিক সংস্কৃতির মধ্যে অদ্ভুদ এক সাদৃশ্য বিদ্যমান। এখানে
রাজনীতিবিদদের মতো বুদ্ধিজীবীরাও শোনেন কম, বলেন বেশি, পালন করেন কদাচিৎ কিংবা দৈবাত।
এসব ভূগোলের বুদ্ধিজীবীরা নিজেদের সধর্মের মানুষকেও মূল্যায়ন করতে শুধু কার্পণ্যবোধ করেন না, জেনে-
বুঝে কিংবা না জেনে বুঝে বড় রকমের ছলচাতুরীর আশ্রয় নেন, উপেক্ষার বাণ ছোঁড়েন এবং নানা রকমের ট্যাগ
লাগিয়ে প্রকৃত প্রতিভাবানদের আড়াল করেন, কিংবা হতোদ্যম করার বাসনায় মত্ত থাকেন কেবল একা নন
গোষ্ঠীসহযোগে প্রতিষ্ঠানের বদৌলতে।
এদের এ খাসলতের কারণে এখানে মহৎ প্রতিভা বিকাশের পথ সর্বদায় কণ্টকিত। মজিদ মাহমুদকে পাঠান্তে
এ প্রসঙ্গের অবতারণা ঘটল। কিন্তু কেন তা বোধ করি,যারা তার বহুমাত্রিক সৃষ্টির সঙ্গে পরিচিত কিঞ্চিত
হলেও তাদের কাছে পরিষ্কার, যৌক্তিক ও বাস্তবসম্মত।
কবিতা কী, শব্দের পর শব্দ বসালেই কি কবিতা হয়ে যায়, নাকি সেই কবিতা দাগ কাটে মনোভূমিতে, কালের
আখরে পায় একটু ঠাঁই? কবিতাকে মাইকেল মধুসূদন দত্ত দেখেছেন এভাবে, কে কবি কবে কে মোরে? ঘটকালি
করি, শবদে শবদে বিয়া দেই যেই জন।’
কবির সংজ্ঞায় জীবনানন্দ দাশ একেবারে স্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট, সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি।’
কাব্যবিশারদ, পণ্ডিতজন, হরফচষা অধ্যাপকেরা কবিতায় খুঁজে ফিরেছেন গৎবাঁধা কিছু প্রকৃতি ও ধরন-ধারণ,
যার সবটাই ব্যাকরণের সূত্র মেনে লেফট-রাইটের মুখস্থপ্রীতিতে-মন্দ অভ্যাসে-কুতর্কে আর বদ
বাহাদুরপনায় জারিত, বহুলচর্চিতও বটে।
হালফিলের কিংবা চিরায়ত এই বাস্তবতার সহজ বাজিমাতের কারণেই বুঝি, বাংলা ভাষা কাকের চেয়ে কবির
সংখ্যা বেশি হওয়ার ঝুঁকিতে ভুগছে ধুঁকছেও বটে।
অবশ্য সর্বজনে বাক্যটা আদৃত ও সম্মোহিত, ঢাকায় কাকের চেয়ে…।’ যদিও আমরা ভুলি না কখনও
জীবনানন্দের অমেয় কথন, সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি।’ কিংবা কেউ কেউ’ নন বড়োজোর এক-দু’জন
কবি। কিন্তু স্তুতিপ্রিয় জাতির তকমা আমাদের তনু-মন ও মস্তিষ্কে স্থায়ীভাবে থাকার কারণেই বোধ করি
আমরা এক-দু’জন’ কবিকে সেভাবে বুঝি না-চিনি না-জানি না, এমনকি যে মর্যাদা-সম্মান ও সম্মাননা তাদের
প্রাপ্য তা দেয় না কিংবা দেওয়ার চেষ্টাও করি না।
মজিদ মাহমুদ কি সেই এক-দু’জন কবির উষ্ণীষধারী-বিরল-ব্যতিক্রমী এক সৃজন প্রতিভা? সহযোগ প্রশ্ন
হাজির ও সাপেক্ষ উত্তর তালাশের লক্ষ্যে সংক্ষিপ্ত পরিসরের এই লেখা।
কবিতায় মজিদ মাহমুদের উচ্চারণ কেমন ও কোন অভিঘাতের মাইলফলক রাখতে সক্ষম হয়েছে তার উদাহরণে
পড়ে নিই কয়েকটি কবিতার অংশবিশেষ। তিনি লিখেছেন, উদাহরণ এক : একদিকে নবুয়ত অন্যদিকে পুত্রের
মায়া/আমি পুত্রের মায়া চাই/আমার পুত্র আজ ডুবে যাচ্ছে গজবের জলে/সেই জলে আমি নৌকা চালাব/এক জোড়া
মানুষের নমুনা নিয়ে!/তোমার নতুন স্বর্গ গড়ার স্বপ্নে আমার কোনো ভালোবাসা নেই/আমি মানুষের পিতা/মানুষ
আমার ভাই/নবুয়তের লোভ দেখিও না/তোমার কিশতি থেকে নেমে যেতে একটুও দেরি হবে না’ (পুত্র ডুবে যাচ্ছে)।
উদাহরণ দুই : আমি এক মুক্তিযোদ্ধাকে চিনি/যুদ্ধে যার একটি পা খোয়া গেছে/এখন এক পায়ে লাফিয়ে
চলে/আগে তাকে দেখলে কষ্ট হতো/আমাদের স্বাধীনতা তার একটি পা নিয়েছে/বর্তমানে সে পঙ্গু
মুক্তিযোদ্ধা/এখন তাকে দেখলে অন্যরকম মনে হয়/ভাবি, মানুষকে চলতে গেলে/সামনে এগুতে গেলে তো/এক
পায়ের ওপর দাঁড়াতে হয়/অন্য পা সবসময় উপরে উঠে থাকে/দুপায়ে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষ এগুতে পারে
না/মুক্তিযোদ্ধাকে তো অনেক দূর যেতে হবে। (মুক্তিযোদ্ধা)
উদাহরণ তিন : আমার মার্কসবাদী বন্ধুদের অনেকেই এখন এনজিও কর্মী/ কেউ দলবদল করে নাম ক্ষমতাসীন
দলে লিখিয়েছেন নাম/ অনেকেই মোটা অঙ্কে বেতন পান। কেউ বাড়িগাড়িও করেছেন/খুব ভালো, তাদের জীবনে
সত্যিই মার্কসবাদ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে/ভালো থাকার জন্যই তো সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন/কিন্তু আমরা যারা
তারুণ্যে মার্কসবাদ করিনি/ ছিলাম বুর্জোয়া রাইটিস্ট প্রগতি-বিরোধী’!/এখন তারাই

প্রোলিতারিয়েত/মার্কসবাদী বন্ধুরা আগে আমাদের ঘৃণা করতো/লালবই পড়িনি বলে মূর্খ ভাবতো/এখন
অনেকেই একই পার্টি করি, একই নেতার অধীন/কিন্তু এখনো তদের পঙ্ক্তিতে বসতে পারি না/চটাং চটাং
সাম্যের কথা বলে/ কারণ সবার জানা, কিছু লোক সমানের চেয়ে বেশি/লালবই মানেই বুদ্ধিজীবীর ডায়েরি/এখন
গোপনে লালবই পড়ি। তবে সবই পুরনো/আমাদের বন্ধুদের শেলফ থেকে পরিত্যক্ত এসব বই/ফুটপাতে নিয়েছে
আশ্রয়। সোভিয়েত ভেঙে গেছে/মাও সেতুংয়ের দেশে হয়েছে পুঁজির বিকাশ/ রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতা নেই, তাই
বেওয়ারিশ সর্বহারা/বইগুলোও এখন ছিন্নভিন্ন প্রোলেতারিয়েত/তবু মার্কসবাদ মানেই শ্রমিক
অসন্তোষ/মালিকরা মন খুলে হাসতে পারে না/মার্কসবাদ মানে অলাভজনক পাটকলগুলো বন্ধ না
হওয়া/আইএমএফ, বিশ্বব্যাংকের উন্নয়ন খায়েশ প্রশ্নবিদ্ধ হওয়া/মার্কসবাদ মানেই মরার আগে অন্তত
হাত উত্তোলন করা। (আমার মার্কসবাদী বন্ধুরা)
মজিদ মাহমুদের কবিতার চুলচেরা বিশ্লেষণে অবতারণ ঘটে অজস্র প্রসঙ্গের, কবিতার ব্যাখ্যা ও
পর্যবেক্ষণে যেমনটা করা হয়ে থাকে। মজিদ মাহমুদের ব্যতিক্রমীতা হলো, তার চিন্তার অভিনবত্ব ও প্রশ্ন
করার স্বকীয় অভ্যাস ও দুর্দান্ত সাহস। লক্ষ্যণীয় বৈশিষ্ট্যে ও বিশিষ্টতায় তিনি কতটা ঋজু ও নিজস্ব পথ
তৈরির মধ্য দিয়ে ভিন্নমাত্রার পথিক তা স্পষ্ট হয় উপর্যুক্ত উদাহরণে।
মজিদ মাহমুদ কবিতায় নিজেকে উপস্থাপন করেছেন সমকালের বিরলপ্রজ এক প্রতিভা হিসেবে। কবিতার
প্রচলিত সংজ্ঞায়ন ও পোস্টমর্টেমে বেশিরভাগ কবি যখন এক ও ঝাঁকের কই, তখন তিনি কতটা ভিন্নস্বরে
অনন্য তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ হলো তার মাহফুজামঙ্গল’ কাব্যগ্রন্থ। যেখানে তিনি ঐতিহ্যকে ধারণ করে
নতুনধারা ও ভাবনার সূচনা ঘটিয়েছেন, তারপর বাকিটা ইতিহাস, যা মাহফুজামঙ্গল’কে শুধু জনপ্রিয় করেনি,
বাংলা সাহিত্যে স্বতন্ত্র মর্যাদার স্মারকবাহী করেছে।
ওই গ্রন্থের আলোচিত দুটি কবিতা এক্ষণে স্মরণীয়। এবাদত কবিতায় মজিদ মাহমুদ লিখেছেন : মাহফুজা
তোমার শরীর আমার তছবির দানা/আমি নেড়েচেড়ে দেখি আর আমার এবাদত হয়ে যায়/তুমি ছাড়া আর কোনো
প্রার্থনায়/আমার শরীর এমন একাগ্রতায় হয় না নত/তোমার আগুনে আমি নিঃশেষ হই/ যাতে তুমি হও
সুখী/তোমার সান্নিধ্যে এলে জেগে ওঠে প্রবল ঈশ্বর/তুমি তখন ঢাল হয়ে তার তির্যক রোশানি ঠেকাও/তোমার
ছোঁয়া পেলে আমার আজাব কমে আসে সত্তর গুণ/আমি রোজ মকশো করি তোমার নামের বিশুদ্ধ বানান/কোথায়
পড়েছে যেন তাসদিদ জজম/আমার বিগলিত তেলওয়াত শোনে ইনসান/তোমার নামে কোরবানি আমার
সন্তান/যূপকাঠে মাথা রেখে কাঁপবে না নব্য ইসমাইল/মাহফুজা তোমার শরীর আমার তছবির দানা/ আমি
নেড়েচেড়ে দেখি আর আমার এবাদত হয়ে যায়। (এবাদত)।
ফরহাদ মজহারও লিখেছেন এই নামীয় একটি কবিতা, যদিও সেটি বায়সিকতায় মজিদ মাহমুদের এবাদত’ এর
অনুজ বলি, ও টগরফুল ফুটিলি কি বঙ্গে গুলিস্তাঁয়/ জিব্রাইল ফেরেশতার সফেদ পায়ের ভাষা লয়ে/পাপড়ির
শুভ্রতায়; আমি তোকে পেয়ে/এবাদতে বসেছি পুষ্পোদ্যানে ফুলে ফুলে নতজানু হয়ে/শর্করাদানার মতো ফুটিলি কি
ফুল প্রাণেশ্বরী/আলো হয়ে এই বঙ্গে? রোশ্নিতে ভরে অন্তর।/অতো ফর্শা কোথা পেলি? দুনিয়ার নানা
বাগিচায়/ আছে নানা ফুল কিন্তু কেউ নয় বঙ্গীয় টগর।/জায়নামাজের স্থান আজ আমি বিছাবো
পুষ্পের/অন্তস্থল লক্ষ্য করি; পাপড়িগুলো তস্বির মতো/গুনবো যেন নিরানব্বই নামে ফের পৃথিবীতে/ফুল ও
পাপড়ির ধর্ম পুনর্বার হয় প্রচারিত/ রোজ হাশরের দিন তুই তবে সাক্ষ্য দিস ফুল/সুন্দরের এবাদতে কেটে যায়
কবির জিন্দেগী।’
‘কুরশিনামা’ মজিদ মাহমুদের কবিতা, জাকির তালুকদারের উপন্যাস। এখানেও মজিদ মাহমুদের কুরশিনামা
জ্যেষ্ঠতায় এগিয়ে। কুরশিনামায় মজিদ বলেন : ঈশ্বরকে ডাক দিলে মাহফুজা সামনে এসে দাঁড়ায়/আমি
প্রার্থনার জন্য যতবার হাত তুলি সন্ধ্যা বা সকালে/সেই নারী এসে আমার হৃদয়মন তোলপাড় করে যায়/তখন
আমার রুকু/আমার সেজদা/জায়নামাজ চেনে না/সাষ্টাঙ্গে আভূমি লুণ্ঠিত হই/এ মাটিতে উদ্গম আমার
শরীর/এভাবে প্রতিটি শরীর বিরহজনিত প্রার্থনায়/তার স্রষ্টার কাছে অবনত হয়/তার নারীর কাছে অবনত
হয়/আমি এখন রাধার কাহিনী জানি/ সুরা আর সাকির অর্থ করেছি আবিষ্কার/নারী পৃথিবীর কেউ নও
তুমি/তোমাকে পারে না ছুঁতে/আমাদের মধ্যবিত্ত ক্লেদাক্ত জীবন/মাটির পৃথিবী ছেড়ে সাত তবক আসমান
ছুঁয়েছে/তোমার কুরশি/তোমার মহিমার প্রশংসা গেয়ে/কী করে তুষ্ট করতে পারে এই নাদান প্রেমিক/তবু তোমার

নাম অঙ্কিত করেছি আমার তছবির দানা/তোমার স্মরণে লিখেছি নব্য আয়াত/আমি এখন ঘুমে-জাগরণে জপি শুধু
তোমার নাম।
একটু কোশেশ করে জাকির তালুকদারের কুরশিনামা’র সুচনাভাগ দেখে নেওয়া যেতে পারে, তাহলে ফারাকটাও
বোঝা যাবে ঢের। তিনি লিখেছেন : ফাল্গুনের রাত। জ্যোৎস্না ফুটি ফুটি করছে। কাজেই অন্ধকার তেমন জেঁকে
বসতে পারছে না। তবু হ্যাজাক বাতির ব্যবস্থা করা হয়েছে। ইস্কুল মাঠের মাঝখানে কয়েকটি চৌকি ফেলে মঞ্চ
বানানো। … আজ পুরাণকথা বলবে ফকির আলি কথনিয়া। যেহেতু সে পুরাণকথার মধ্যে গানও গায় দু-চার কলি,
তাই লোকে তাকে সহজ করে ডাকে বয়াতি। ফকির আলি জানে, তাঁর গুরুভাইরা জানে, সে বয়াতি নয় কথনিয়া। তবু
মানুষকে জনে জনে ভুল শুধরে দিতে যাবার কি দরকার! … ফকির আলি তাঁর পুরাণপাঠ শুরু করে প্রথমে বন্দিব
আমি নাম নিরঞ্জন/যাহাতে হইল ভাই যোগের সৃজন॥/তবে ত বন্দিব সিদ্ধা হানিফা জনন্ধর।/যোগ মধ্যে বন্ধ
সিদ্ধা গোর্খ হরিহর॥/হানেফা বন্দিব আর বানিজে ভাদাই। মছলন্দি সিদ্ধা বন্দ নামেতে মিন্যাই॥’
শুধু কি কবিতায় কথাসাহিত্যেও মজিদ মাহমুদ নতুন চিন্তার খোরাক জোগান। মেমোরিয়াল ক্লাব উপন্যাসে
আমরা যে দীর্ঘ যাত্রার বর্ণনা দেখি, তা তো শুধু বিস্ময় নয়; এই প্রশ্নও হাজির করে যে, এত নীরবে কীভাবে
এত শক্ত প্রশ্ন হাজির করা যায় : তার (বিলুর) বড় ফুফুর বাড়িতে এ ধরনের একটা ঘটনা ঘটেছিল। আকলিমা
নামে তাদের একটি কাজের মেয়ে ছিল। বয়স তেরো/চৌদ্দ বছরের বেশি হবে না। আকলিমা কেবলই বড়দের
সালোয়ার কামিজ পরতে শুরু করেছে। তার আগেই আকলিমার পেটের মধ্যে একটি মানবশিশু বড় হচ্ছিল। আর
বাচ্চাটি ভূমিষ্ঠ হওয়ার আগের দিন পর্যন্ত কেউ বুঝতে পারেনি আকলিমা একজন চোরাই গর্ভবতী। সে
(আকলিমা) জানে না এ সন্তান তার পেটের মধ্যে কী করে এলো। অকথ্য যন্ত্রণা ও নির্যাতন সইতে হয়েছিল
আকলিমাকে। … যদিও বিলু কুমারী মাতা মেরীর গল্প জানত, আকলিমা জানত না; জানলে বলতে পারত, এ শিশু
তাকে দান করেছে। ঈশা আলাইহেস সাল্লামের মা মরিয়ম ঈশ্বরের পবিত্র আত্মা দ্বারা গর্ভবতী হয়েছিলেন।’
মজিদ মাহমুদের প্রশ্নের ভঙ্গিটাও বেশ চমৎকার। প্রশ্ন না করেও কীভাবে অভিঘাত রচনা করা সম্ভব, তার
উৎকৃষ্ট সাক্ষ্যে মজিদ মাহমুদ মস্ত বড় এক জাদুকর। রবীন্দ্রনাথ যেমন বলেছিলেন, অনেক কথা যাও যে
ব’লে কোনো কথা না বলি।’ মজিদ মাহমুদ সবই বলেন; কিন্তু তার বলার ভঙ্গিটা সত্যিই অভিনব। একারণেই
সাধারণ দৃষ্টিতে কিংবা স্রোতমুখী যাত্রা ও ভাবনায় তার নির্যাস পাওয়া দুরূহ-অসম্ভবও বৈকি। কিন্তু
সেটাকেই যদি আমরা গভীরভাবে-প্রজ্ঞার মিশেলে দেখার চেষ্টা করি তাহলে আমরা হয়তো কেবলই বিস্মিত
হবো এমন নয়, স্তম্ভিত-বিমূঢ় হওয়ার পাশাপাশি সাহসের সৌন্দর্যে মুগ্ধও হবো। মজিদ মাহমুদের কথাসাহিত্য
একারণে তার কবিতার মতোই সৃজন-মননের অন্য এক উচ্চতার সন্ধান দেয় অন্যলোকে অবগাহনের শিল্পীত
পরশে হাজির করে আগুনের পরশমণির ঐশ্বর্য ও স্নিগ্ধতা।
মজিদ মাহমুদের প্রবন্ধও চিন্তাজাগানিয়া-গতানুগতিকতার চেনা আবহ থেকে বেরিয়ে নতুন দীপ্তিতে উদ্ভাসিত
আলোকময়। প্রবন্ধের বিভিন্ন বিষয়ে তার আগ্রহ সহজাত হলেও সেখানে শ্রম-নিষ্ঠা-মেধা-মনন ও সাধনার
সমন্বয় ঘটেছে একে অপরের পরিপূরক হিসেবে। ফলে, ব্যক্তির ভেতরের আলো ও ঐশ্বর্যকে তিনি যেমন
আলাদাভাবে চিহ্নিত করেন, তেমনি ব্যক্তির বাইরের যে কোনো বিষয়কেও তিনি বিশ্লেষণ করেন
অনুপুঙ্খভাবে-নানারূপে-প্রভূত জিজ্ঞাসাযোগে প্রয়োজন-অপ্রয়োজনের সাপেক্ষে। তার প্রবন্ধ কখনোই
একরৈখিক নয়, এবং প্রবন্ধের মোড়কে তিনি রচনা হাজির করেন না। প্রবন্ধ সাহিত্যের বিভিন্ন বিষয়ে তার
সাবলীল-সহজ ও চিত্তচর্চিত গতায়াত, তাকে প্রাবন্ধিক হিসেবেও সমাসীন করা যায় পৃথক মর্যাদায় ভিন্ন
এক পাদপ্রদীপের আলোয়।
কাজী নজরুল ইসলামকে নিয়ে তিনি দীর্ঘদিন ধরে গবেষণাপূর্বক নজরুল পাঠে যুক্ত করেছেন ভিন্নতর ভাবনার
রসদ। তার মূল্যায়ন নজরুলকে নতুন করে চেনা ও জানায় অতীব গুরুত্বপূর্ণ এক উপাদান। ডিরেজিওকে নিয়ে
লিখেছেন চিত্তাকর্ষক এক প্রবন্ধ ছোট কলেবরের একটা লেখাও যে চিন্তার প্রচলিত অভিঘাত থেকে বেরিয়ে
এসে নতুন এক পথের দিশা দিতে পারে তার অনুপম এক সাক্ষ্য।
দেবেশ রায় মজিদকে চিন্তাসখা আখ্যা দিয়ে তার প্রবন্ধ সাহিত্যকে দেখেছেন এভাবে : কড়ি ও পয়সা শব্দের
যেমন বিলুপ্তি ঘটেছে, ঠিক টাকা শব্দটিরও দৃশ্যগত পরিবর্তন বা বিলুপ্তিঘটা আগতপ্রায়। টাকা একটা সময়ে
দৃশ্য সংখ্যাতত্ত্ব হিসেবে থেকে যাচ্ছে; রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতিতে ব্যাংকিং ব্যবস্থায় সেই হিসাব আজ রক্ষিত
হচ্ছে যে ব্যক্তি এই টাকার মালিক সে তার চেহারা দেখতে পাচ্ছে না কিংবা দেখা দরকার হচ্ছে না। এমনকি

টাকা বিনিময় মাধ্যম হলেও একজন ব্যক্তির কাছে এর সঠিক মূল্য অজানা থেকে যাচ্ছে।’ (ভাষার অর্থনীতির
শাব্দিক তাৎপর্য) … এই ব্যাখ্যা আমি অন্যত্র পড়েছি বলে তো মনে পড়ছে না। যাকে বলা হয় ব্যবহার থেকে
শব্দের স্থায়ী তৈরি হয়ে ওঠা; মজিদ মাহমুদ আমাদের জানালেন, সেই প্রক্রিয়ারই প্রয়োগে অব্যবহার থেকে
শব্দের স্থায়ী অর্থ ঘুচে যাওয়া। কতটা ভবিষ্যৎ দৃষ্টি নিয়ে তিনি এখনকার ভাষা-ব্যবহারের ভবিতব্য নির্ণয়
করেছেন ও ভাষাতত্ত্বকে এক নতুন জায়গায় এনে ফেলেছেন। আমার মনে হচ্ছিল তখন শব্দ তার বস্তু ও
ব্যবহারিক অর্থ হারিয়ে মিথিক শব্দে বদলে যায়’ (মজিদ মাহমুদ : চিন্তাসখা দেবেশ রায়)
মজিদ মাহমুদ প্রবন্ধ সাহিত্যকে উচ্চকিত করেছেন চিন্তার অভিঘাতে তিনি শুধু ব্যক্তি বা বিষয়ের বর্ণনা
হাজির করেননি, ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ-পর্যবেক্ষণে মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন নতুন নতুন আলোচনা ও
দৃষ্টিভঙ্গি জারি রেখে। তুলনামূলক আলোচনা যেমন করেছেন, তেমনি সিদ্ধান্তেও নানাদিক উন্মোচনের চেষ্টা
করেছেন। ফলে, তার প্রবন্ধ সাহিত্যে উন্মীলন ঘটেছে ব্যক্তি ও বিষয়ের গভীর-গভীরতর বীক্ষণের নির্মোহ
এক চিন্তাবিশ্ব।
মজিদ মাহমুদের এই চিন্তাবিশ্ব। শুধু সাহিত্য-সংশ্লিষ্টজন নয়, এর বাইরের নানা খাত ও উপখাতের মানুষের
জন্যও রয়েছে তাৎপর্যপূর্ণ বারতা। তিনি যেকোনো জিনিসকে ছোট পরিসর, আরোপিত অবয়ব কিংবা কূপমুণ্ডুপ
দৃষ্টিকোণ থেকে নয়, বৃহৎ ও বহুমাত্রিকভাবে দেখা-বোঝার পদ্ধতিগত কৌশলরপ্ত করেছেন, যার মধ্যে
জাতীয়-আন্তর্জাতিক বোধ যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে সমকালে এবং সমকালকে ছাড়িয়ে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি।
আর এসবের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে প্রজ্ঞার সাহস। ফলে, মজিদের মাহফুজামঙ্গল, মেমোরিয়াল ক্লাব, নজরুল
গবেষণা, বিকল্প ভাবনা, আপেল কাহিনী, গোষ্ঠের দিকে-সৃজন ও মনন ভুবনের সবই এই ইহজাগতিক পৃথিবীর
চিন্তাবিশ্বে সাহসী এক অভিঘাত তৈরি করে।
এ অভিঘাত বিশ্বকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে দেশকে মর্যাদাবান করার লক্ষ্যে মানুষের মনুষ্যত্বকে
জাগ্রত করার অভিপ্রায়ে কতটা জরুরি ও অপরিহার্য এক মন্ত্র তা বোধ করি বুঝতে আমরা অনমনীয়,
অপারগ, অক্ষম। এ কারণে বাংলা ভাষার সৃজন-মননভূমে মজিদ মাহমুদ সমকালের এক-দু’জন প্রতিভার
অন্যতম হয়েও স্বল্পালোকেই রয়ে গেছেন। অথচ আমাদের জন্যই মজিদ মাহমুদকে পাঠ করা দরকার।
মজিদকে পাঠ না করলে, ঈশ্বর আর মাহফুজা কোথায় মেলে আর কোথায় মেলে না, আমরা জানব কীভবে? পিতার
কাছে কী বড়, যখন সন্তান ডুবে যায়, যখন বেথেলহামের এ ঘটনা কি আজও ঘটে যাচ্ছে না, মরিয়মের সেই ঘটনা
তো প্রতীকী ছিল কুমারীমাতাকে রক্ষার বারতা। তাহলে সেই প্রতীকী উদাহরণ কেন উপেক্ষিতই থেকে যায়?
মজিদ মাহমুদকে না জানলে আমরা কি মার্কস নিয়ে গর্ব করার বিদ্যাটা আরেকটু ভালো করে জানতে পারব,
জানতে পারব এক পায়ে দাঁড়ানো মুক্তিযোদ্ধার গৌরবটা কোথায়। বুদ্ধিজীবী শুনছেন কি, মজিদ মাহমুদের
ক্ষেত্রে এই সত্যই কিন্তু উচ্চারিত হয় অনিবার্যভাবে আমাদের শিল্পভুবনকে এগিয়ে নিতে মজিদ মাহমুদের
চিন্তাবিশ্বকে পাঠ ও অবলোকন করা অনিবার্য এক বাস্তবতা, যা থেকে উল্টো হাঁটা-না চেনা-না বোঝার
অভ্যাস আত্মঘাতের শামিল ও সমূহ লজ্জার।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *