আমি কখনো ঘৃণা করতে শিখিনি।। অনুবাদ : সরকার আবদুল মান্নান

ডিক গেগোরি (Dick Gregory, 1933- 2017)

আমার ঘরে, আমার পরিবারে আমি কখনো ঘৃণা করতে শিখিনি। লজ্জিত বা অপমানিত হওয়ার কারণও কখনো ঘটেনি। স্কুলে যাওয়ার পর আমি ঘৃণার মুখোমুখী হই, অপমান ও লজ্জার মুখোমুখী হই। তখন কত হবে আমার বয়স? সাত। সাতের বেশি নয়। মেয়েটির নাম হেলেন থাকার। ছোট একটি মেয়ে হেলেন। চুল বেনি করা। হালকা পালকের মতো স্বচ্ছন্দ। স্বপ্নের মতো সুন্দর। আর আচরণে বিস্ময়কর আভিজাত্য। মিষ্টি। স্কুলের ছেলে-মেয়েদের মধ্যে হেলেন সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন, সবচেয়ে স্মার্ট।

আমার কখনো কখনো মনে হয়, হেলেনকে দেখার জন্যই আমি স্কুলে যাই। স্কুলে যাওয়ার সময় সুন্দর করে চুল আচড়াই, আর একটি পুরনো রুমাল হাতে নিই। রুমালটি মেয়েদের। কিন্তু আমি হাতে নিয়ে যাই যাতে হেলেন কখনই দেখে না যে, আমি হাত দিয়ে নাক পরিষ্কার করছি।

ভীষণ ঠান্ডা। পানির কলগুলো সব জমে গেছে। বাসায় পানি নেই। কিন্তু তবু আমি প্রতিদিন বিকেলে মোজা ধুই। সার্ট-প্যান্ট ধুই। একটি বালতি নিয়ে আমি সোজা চলে যাই বেন-এর মুদি দোকানে। তার সোডা মেশিনে বালতিটি পুরে দিই। এতে  কিছু বরফ বালতিতে জমা হয়। সেই বরফ গলিয়ে আমি মোজা ও সার্ট-প্যান্ট পরিষ্কার করি। সেই শীতে আমি বেশ কয়েক বার অসুস্থ হয়ে পরি। ঠান্ডা ও নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হই। কেননা, জামা-কাপড় শুকানোর আগেই সূর্য অস্ত যেতো।

পরদিন সকালে সেই সব অর্ধ শুকনো অর্ধ ভিজা মোজা ও সার্ট-প্যান্ট পরে আমাকে স্কুলে যেতে হতো। ওই এক সেট মোজা ও সার্ট-প্যান্ট ছাড়া আর কোনো পোশাক আমার ছিল না।
সবাই হেলেনকে ভালোবাসতো। সবার ভালো লাগার কিছু না কিছু হেলেনের মধ্যে ছিল। সে ছিল আমাদের প্রত্যেকের  আকাক্সক্ষর প্রতীক। আমি ভালোবাসতাম তার উদারতা, সৌন্দর্য ও খ্যাতিকে। হেলেন যখন আমাদের বাড়ির সামনের রাস্তা দিয়ে হেটে যেত, তখন আমার ভাইয়েরা চিৎকার করে বলত, ওই যে ওই। দেখ, হেলেন যাচ্ছে। আর আমি তখন টেনিস বলটি আমার পেন্টে ঘষতাম আর ভাবতাম, চুলগুলো যেন খুব ঊগ্র না দেখায় এবং আমার

পরনের সাদা সার্টটি যেন সুন্দর দেখায়। এই সব ভাবতে ভাবতে আমি দ্রুত রাস্তায় নেমে যেতাম। সেই শৈশবেই আমি জানতাম, আমার অবস্থান কোথায়। তাই আমি হেলেনের খুব কাছে যেতাম না। সে পিটপিট করে আমার দিকে তাকিয়ে  বলত, হ্যালো! এই ‘হ্যালো’-টুকু আমার মধ্যে অসাধারণ এক অনুভূতি সৃষ্টি করত। আমি অভিভুত হয়ে পড়তাম। কখনো কখনো তার বাড়ি পর্যন্ত আমি তাকে অনুসরণ করতাম, আর তার পথের বরফ সরিয়ে দিতাম। বন্ধুত্ব করতে চেষ্টা করতাম হেলেনের মামা ও চাচার সঙ্গে। তার বাবা আছেন। জেনেছি, তিনি ভালো চাকরি করেন।

আমার মনে হয়েছিল পরবর্তী গ্রীষ্মের মধ্যে হেলেনের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি হবে। আমি তাকে আমার করতে পারবো। কিন্তু এ সময় ক্লাসরুমে বাজে কিছু ঘটনা ঘটল। আর সেই ঘটনার পরবর্তী বাইশটি বছর হেলেনের মুখটি আমার অস্তিত্বের সামনে ঝুলে থেকেছে। স্কুলে ড্রাম বাজিয়ে আমি যে খ্যাতি কুড়িয়েছি সেটা হেলেনের জন্য। মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়িয়ে আমি যখন সুর মূর্ছনায় দর্শকদের অভিভুত করতাম এবং প্রসংশায় সিক্ত হতাম তাও হেলেনের জন্য। আর প্রার্থনা করতাম, হেলেন যেন আমার গান শুনতে পায়। এ সবই ছিল উনিশ বছর বয়স হওয়া পর্যন্ত, যখন আমি কিছু করিনি এবং প্রচুর অর্থভিত্তের মালিক হইনি। সেই দিন ক্লাসে হেলেন ছিল। আমার সেই চরম লজ্জা আর অপমানের দিনে। বৃহষ্পতিবার। ক্লাসের শেষ বেঞ্চিতে আমি বসেছিলাম। চক দিয়ে বেঞ্চটিতে বৃত্ত আঁকা ছিল। অপয়া হতভাগ্য সেই সিটটিতে বসেছিলাম আমি। শিক্ষক ভেবেছেন আমি বোকা আর বেয়াদপ আর অপদার্থ। বানান করতে পারি না। পড়তে পারি না। অংক পারি না। বোকার হদ্দ। শিক্ষক কখনই বুঝতে চাইবেন না যে তুমি খুব ক্ষুধার্ত। সকালে নাস্তা খেতে পাওনি। খিদের জ্বালায় তুমি পড়ায় মনোনিবেশ করতে পারছ না। তোমরা হয়তো দুপুরের খাবারের কথা ভাবছ। দুপুরের খাবার তো হবেই। কিন্তু সেই খাবার কি সত্যি সবার আসে? আসে না। সে ক্ষেত্রে একজন ক্ষুধার্ত শিশু হিসেবে তুমি অন্য শিশুদের খাবারে কামড় বসাতে পার। এই বয়সের তুমি আমি কারোরই প্যাস্টি বানাতে পারার কথা নয়। প্যাস্টিযুক্ত খাবার বানানো তো দূরের কথা। কিন্তু আমি চেষ্টা করেছিলাম। রুমের পিছনে বিশাল জারে রাখা প্যাস্টি কয়েক চামচ তুলে খেয়েছি। এগুলো রীতিমতো অখাদ্য।
গর্ভবতী মেয়েরা সাধারণত এই অভুতপূর্ব স্বাদ আস্বাদন করে থাকে।

আমার জীবনে সবকিছুই ছিল অভূতপূর্ব, দুর্লভ। বিস্ময়কর দারিদ্র্য নিয়ে আমার ছিল নিত্য বসবাস। ধুলো আর দুর্গন্ধময় জীবন, কনকনে ঠান্ডায় হাড় কাঁপানো জীবন, এক বস্ত্রে নিত্যদিন কাটানোর জীবন এবং বাধাহীন এতিম জীবন─ এই সব নিয়ে আমার যে জীবন-অখাদ্য পেস্টির স্বাদ সেখানে মন্দ নয়। শিক্ষক ভেবেছিলেন, আমি গোলমাল পাকানোর ছেলে। রুমের সামনে থেকে তিনি সবাইকে দেখেছিলেন। আর দেখছিলেন পিছনের চক দিয়ে গোল দাগ দেওয়া সিটে বসে আছে একটি কালো ছেলে। বদমাইশ ছেলে। গন্ডগোল পাকানোর ছেলে। কাছে-পিঠের সবাইকে সে খোঁচাচ্ছে, উত্যাক্ত করছে। আমার মনে হলো তিনি দুষ্ট ছেলেটাকে দেখছেন না। ভুল করে দেখছেন আমাকে। দিনটি সেই বৃহষ্পতিবার। আগের দিন ছিল নিগ্রোদের বেতন পাওয়ার দিন। আর শুক্রবার হলো আকাশে ঈগলদের উড়ে বেড়ানোর দিন। শিক্ষক প্রত্যেক ছাত্র-ছাত্রীকে জিজ্ঞাসা করছেন, তাদের বাবারা সমাজের দাতব্য ফান্ডে কত ডলার দিয়েছেন। শুক্রবার রাতে প্রত্যেক শিশু বাবার কাছ থেকে টাকা পেয়ে থাকে। আর সোমবারে তারা সেই টাকা স্কুলে নিয়ে আসে।

জুতা পরিষ্কার করে, কাগজ বিক্রি করে আমি কিছু ডলার পেয়েছিলাম। ঠিক তখনই আমি সিদ্ধান্ত নিই, আমার জন্য সবার আগে একজন বাবা দরকার। সোমবার পর্যন্ত অপেক্ষা করার ধৈর্য আমার নেই। হেলেনের চেয়ে বেশি গর্ব করার মতো একজন বাবা ক্রয় করতে হবে আমাকে। আমি কাঁপছিলাম। ভয়ে মৃত্যুদশা আমার। শিক্ষক হাজিরাখাতা খুললেন এবং নামের অদ্যাক্ষর ধরে ডাকতে শুরু করলেন।
“হেলেন খুকার?”
“বাবা বলেছেন, তিনি দুই ডলার পঞ্চাশ সেন্ট দিয়েছেন।”
“খুব ভালো হেলেন। খুব খুব ভালো।” শিক্ষক খুব খুশি হলেন। প্রাণ খুলে প্রসংশা করলেন। আমি কিছুটা স্বস্তি বোধ করছিলাম। হেলেনের বাবা তাকে যা দিয়েছেন আমার কাছে তার চেয়ে সামান্য বেশি আছে। দশ সেন্ট করে তিন ডলার এবং আরও পঁচিশ সেন্ট।
আমি পকেটে হাত দিলাম এবং টাকাগুলো বের করে রাখলাম। আর কখন আমার নাম ডাকবেন তার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। সবার নাম ডাকা শেষ হলো এক সময়। কিন্তু আমি অবাক হয়ে দেখলাম আমার নাম না ডেকেই শিক্ষক খাতাটি বন্ধ করে দিলেন। আমি উঠে দাঁড়ালাম এবং হাত উঁচু করলাম। “কী হলো মেম? আপনি আমার নাম
ভুলে গেছেন?”

তিনি বোর্ডের দিকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন। আর রাজ্যের বিরক্তি নিয়ে বললেন-
“রিচার্ড, তোমার সঙ্গে খেলা করার সময় আমার নেই।”
“আমার বাবা বলেছেন, ——–তিনি——।”
“বস রিচার্ড, তুমি ক্লাসে ডিস্টার্ব করছ।”
“আমার বাবা বলেছেন, তিনি পনের ডলার—-।”
শিক্ষক আমার দিকে তাকালেন। তিনি ক্ষিপ্ত। পাগল প্রায়।
“রিচার্ড, আমরা অর্থ সংগ্রহ করছি তোমার জন্য। তোমার প্রতি দয়া দেখানোর জন্য আমাদের এই আয়োজন। তোমার বাবা যদি পনের ডলার দিতে পারেন তা হলে তো রিলিফ নিয়ে তোমার কোনো কাজ নেই। তাই না।”
“জি, মেম। টাকাগুলো আমি এখনই পেয়েছি। এই কিছুক্ষণ আগে। বাবা আমাকে দিয়েছেন। বলেছেন আমি যেন।”
“আরও কিছু?”

আমার কথা শেষ করতে না দিয়েই শিক্ষক অবজ্ঞা আর কৌতুকের সঙ্গে জানতে চাইলেন। তখন তার নাসারন্ধ ফোলা, ঠোঁট কম্পমান পাতার মতো হালকা এবং চোখ বিষ্ফারিত।
বললেন তিনি, “আমরা জানি, তোমার কোনো বাবা নেই। তুমি এতিম।”
হেলেন আমার দিকে তাকাল। তার চোখ জলে ভরা। আমার অসহায়ত্ব তাকে বেদনা-ভারাক্রান্ত করেছে। কিন্তু আমি
আর তার দিকে তাকাতে পারলাম না। আসলে আমিও তখন কাঁদছিলাম।
“বস রিচার্ড।”

আমার অত্যন্ত শ্রদ্ধাভাজন এই শিক্ষক। সর্বদাই আমার মনে হতো তিনি আমার প্রতি সদাশয় আস্থাশীল। শুক্রবার ক্লাস শেষে আমাকে তিনি ডেকে নিতেন এবং ব্লাকবোর্ড পরিষ্কার করার জন্য বলতেন। আমার জন্য এটা ছিল খুই আনন্দের। আমি খুব রোমাঞ্চ ও প্রেরণা বোধ করতাম। নিজেকে খুব গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হতো। আমার এও মনে হতো যে, আমি যদি ব্লাকবোর্ড পরিষ্কার না করি তাহলে পরবর্তী সোমবার ক্লাস ঠিকমতো চলবে না।
“বস রিচার্ড”।
আবার বললেন শিক্ষক। আমি বসলাম না। অপমানে, লজ্জায় দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে বাইরের দিকে হাঁটা দিলাম।
শিক্ষক জিজ্ঞাসা করলেন-
“কোথায় যাচ্ছো, রিচার্ড?”

আমি তাঁর কথায় কর্ণপাত করলাম না। তারপর দীর্ঘদিন আমার আর স্কুলে যাওয়া হলো না। অপমানের সঙ্গে, লজ্জার সঙ্গে সেই আমার প্রথম পরিচয়। এখন এই পরিণত বয়সে এসে দেখি অপমান সর্বত্র। সমস্ত পৃথিবীটাই আমার সেই ক্লাসরুমের ভিতরে ঢুকে গেছে। সেদিন আমার শিক্ষক যে অপমান আমাকে করেছিলেন, পৃথিবীর সকল মানুষ যেন সেই অপমানের মুহূর্তগুলো দেখেছেন, অনুভব করেছেন। আমার জন্য, আমার করুণ পরিণতির জন্য দুঃখ পেয়েছেন।

এখন আমি বুঝি, বিপন্ন শিশুদের জন্য ক্রিসমাস ডিনার কী ও কেন। শিশুদের জন্য সম্মান? ভালোবাসা? দয়া? না। তার কিছুই নয়। সবাই জানে এ শুধুই করুণা। কেননা, এই ডিনার শিশুদের জন্য নয়─ বিপন্ন শিশুদের জন্য। অভাবগ্রস্ত শিশুদের জন্য। এতিম শিশুদেও জন্য। উত্তরীয় পরিহিত তিন হাজার শিশুর সাজ-সজ্জার অন্তরালে শুধুই লজ্জা আর অপমান বিরাজ করে। কেউ যখন তোমাকে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যেতে দেখবেন, তখন ভাববেন, রিলিফ দেওয়া হচ্ছে কোথায়? কেননা যে উত্তরীয় তোমাকে পরিয়ে দেওয়া হয়েছে তা খুবই আরামদায়ক এবং খুবই দৃষ্টিনন্দন। কিন্তু তা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি পাওয়ার গাউন নয়─ রিলিফ নেওয়ার গাউন। আমি যখন সেই গাউন পরে কটেজ সিট্রিটের সরু গলির নোংরা আবর্জনার ভিতর দিয়ে হেঁটে আসছিলাম তখন আমার মামা আমাকে ভর্ৎসনা করে এবং চড়চাপড় লাগায়।

আজ আমি বুঝি, জীবনের সেই শৈশবগুলো। অসংখ্য অপমান আর লজ্জার ভিতর দিয়ে আমাকে পেরোতে হয়েছে। দিনের শেষে আমি যখন বিনের দোকানে যেতাম সেখানে আমার জন্য অপেক্ষা করত লজ্জা, করুণা। পচা পিচ ফলগুলো আমি যখন চেয়ে নিতাম তখন লজ্জা আমাকে গ্রাস করত। মিসেস সিম্মন্স এর কাছ থেকে যখন আমি এক চামিচ চিনি চাইতাম তখন লজ্জায় জড়সড় হতাম। আর রিলিফের ট্রাকটি যখন করুণা নিয়ে আসত, তখন আমার মনে হতো লজ্জা আর অপমান ধেয়ে আসছে। আমি বিপর্যস্ত বোধ করতাম। আমি এই ট্রাকটিকে যারপর নেই ঘৃণা করতাম। অপমানের চলন্ত স্তূপটি দেখলে আমি ঘরের ভিতরে  লুকিয়ে থাকতাম। তাপর একটি সরু ও নোংরা পথ ধরে হাঁটতে শুরু করতাম। আমি জানতাম না কোথায় যাচ্ছি, কেন যাচ্ছি। যে সব লোক হোয়াইট ইট সপে কেনাকাটা করতে যেত, তারা কেউই আমাকে দেখতে পেত না এবং এত বছর পর আজও আমার কানে স্পষ্ট ধ্বনি-প্রতিধ্বনিত হয় শিক্ষক সেই মর্মবিধারী উক্তি, ‘আমরা সবাই জানি, তোমার কোনো বাবা নেই।’

সেই সব দিনের কথা মনে পড়লে কিছুক্ষণের জন্য এখনো আমি অসাড় হয়ে পড়ি। নিজেকে বিপর্যস্ত ও বেদনাকাতর মনে হয়। কত সময় যে আমি এই যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে কাটিয়েছি, তার কোনো হিসাব নেই। তারপর এক দিনের কথা। মদ্যপ ও ছন্নছাড়া জীবনে অভ্যস্ত একজন মানুষের সঙ্গে দেখা হয়। রেস্তোরায় এদের বলে উইনো। সারাদিন আমি ব্যস্ত ছিলাম─ জুতা পালিশ করা আর পত্রিকা বিক্রি করা নিয়ে আমার ব্যস্ততার শেষ ছিল না। দিনের শেষে আমার পকেটভর্তি টাকা। পনের সেন্টের এক কৌটা লঙ্কা, পনের সেন্টের একটি বার্গার, পাঁচ সেন্টের একটি পেপসি ক্যান এবং দশ সেন্টের একটি চকলেট কেক নিয়ে আমি তখন খেতে বসছিলাম। এমন সময় বৃদ্ধ উইনো রেস্তোরায় ঢুকলেন। আমি এই সর্বস্বান্ত মদ্যপ ও ছন্নছাড়া লোকগুলোকে ভালোবাসি। কেননা তারা চিরকাল অপমানিত হয়, চিরকাল নিজেকে অপমানিত করে। কিন্তু কাউকে কখনই অপমান করে না, কষ্ট দেয় না। বৃদ্ধ উইনো কাউন্টারে গিয়ে ছাব্বিশ সেন্ট মূল্যের খাবার অর্ডার দেন। তিনি এতটাই হা করে খাচ্ছিলেন যা সত্যি দেখার মতো, উপভোগ্য। খাওয়া শেষ হলো। এখন বিল পরিশোধের সময়। বৃদ্ধ লোকটি পকেটে হাত দিয়ে টাকা উধাও হয়ে যাওয়ার ভান করলেন না।
তিনি শুধু বললেন, ‘আমার কাছে টাকা নেই।’
রেস্তোর মালিক উইলিয়ামস চিৎকার করে বলল, ‘টাকা না থাকলে কোন সাহসে তুই আমার রেস্তোরায় খেলি। খাবার কি আমি টাকা দিয়ে কিনি নাই?’
উইলিয়ামস কাউন্টার থেকে বেরিয়ে আসে এবং বৃদ্ধের টেবিলে জোরে আঘাত করে। এক পর্যায়ে সে বোতল দিয়ে বৃদ্ধের মাথায় আঘাত করে। তারপর সে সিঁড়ির দিকে পিছিয়ে যায় এবং বৃদ্ধের মাথা থেকে রক্ত ঝরতে দেখে। কিন্তু উইলিয়ামস থামে না। সে বৃদ্ধকে লাথির পর লাথি মারতে থাকে। আমি রক্তার্ত অবস্থায় বৃদ্ধকে দেখতে পাই। তার মুখ রক্তে ছেয়ে আছে। এগিয়ে গিয়ে আমি কিঞ্চিৎ ক্ষোভের সঙ্গে বলি, ‘দিন, ছেড়ে দিন বৃদ্ধকে। অনেক হয়েছে। ছাব্বিশ সেন্ট আমি দিচ্ছি।’

উইনো উঠলেন। ধীরে ধীরে তিনি নিজেকে বেঞ্চের উপর স্থাপন করলেন। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে কাউন্টারের কাছে গেলেন। কিছুক্ষণ চেষ্টা করলেন স্থির হয়ে দাঁড়াতে। তারপর রাজ্যের ঘৃণা নিয়ে তিনি আমার দিকে তাকালেন।
বললেন, ‘আপনার ছাব্বিশ সেন্ট রাখুন। ছাব্বিশ সেন্ট দান করার সময় পেরিয়ে গেছে কিছুক্ষণ আগেই। ছাব্বিশ সেন্টের জন্য আমি অনেক দিয়েছি।’

বৃদ্ধ বের হয়ে যাওয়ার জন্য হাঁটতে শুরু করলেন। আমাকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময় আমার কাঁধে হাত রেখে বললেন, ‘ধন্যবাদ বাছা। এখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। তুমি আগে দাওনি কেন?’
আমি অস্বস্তি বোধ করছি। অন্যকে সাহায্য করার জন্য এতটা বিলম্ব করা নিশ্চয় উচিত হয়নি।


[রিচার্ড ক্লাস্কটোন গেগোরি। ডিক গেগোরি নামে বিখ্যাত। ১২ই অক্টোভর, ১৯৩২ সালে তিনি আমেরিকার মিশৌরিতে জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৯শে আগস্ট, ২০১৭ সালে মৃত্যুবরণ করেন। পিতৃহীন গেগোরি চরম দারিদ্র্যের মধ্যে শৈশব অতিবাতি করেন। এক জীবনে তিনি রাজনীতিক, বর্ণবাদ বিরোধী কর্মী, কৌতুকাভিনেতা, স্যাটায়ারিস্ট, লেখক, চিত্র নির্মাতা এবং আরও বিচিত্র পরিচয়ে পরিচিত ব্যক্তিত্ব।]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *