উপন্যাস

উপন্যাস।। জীবনে মরণে।। বিশ্বজিৎ বসু।। পর্ব বারো

১৪

অতুল আর নিরু দুজনের রেজাল্ট ভাল হচ্ছে। শিক্ষকরা সকলেই আশাবাদী। এরা দুজন ভাল রেজাল্ট করে স্কুলের নাম উজ্জল করবে। সময় সুযোগ হলে নিরু মাঠের কাজের বাবাকে সাহায্য করে। হাটের দিনে অতুলের সাথে দোকানে সহযোগিতা করে অবিনাশকে। নিশিকান্ত লক্ষ্য করে এখন স্কুলের শিক্ষকসহ অনেকেই এখন আর নিশে বলে না; বলে নিশিদা। নিশিকান্ত অনুভব করে ছেলের জন্যেই আজ লোকে তাকে একটু সম্মান দিচ্ছে। নিশিকান্তের এখন বুক ভরা স্বপ্ন ছেলেকে নিয়ে। ছেলের জন্য একদিন সে বুক ফুলিয়ে আত্মসম্মান নিয়ে চলতে পারেব। সে প্রতিদিন ছেলেকে নিয়ে স্বপ্ন দেখে আর রমার জন্য প্রাণ ভরে আশির্বাদ করে।
বকুলের বিয়ের সপ্তাহ দুয়েক পর একদিন সকালে দোকানে যাচ্ছে অবিনাশ। নিশিকান্ত বাড়ি থেকে হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে আসে অবিনাশের দিকে। নিশিকান্তকে এগিয়ে আসতে দেখে দাঁড়ায় অবিনাশ। এগিয়ে এসে বলে নিশিকান্ত, তোর সাথে একটু আলাপ ছিল অবিনাশ।
অতুল মনে মনে ভাবে, রোজই কত বিষয় নিয়ে আলাপ হয়। হাসি ঠাট্টা হয়। নতুন আবার কি আলাপ। নিশিকান্ত মাথাটা নিচু করে চোখের জল সামলাতে চেষ্টা করে। অবিনাশ ভাবে কি এমন ঘটালো যে নিশির চোখে জল।
গামছা দিয়ে চোখের জল মুছতে মুছতে নিশিকান্ত  বলে, আমি ইন্ডিয়ায় চলে যাব অবিনাশ।

– বলিস কি? অবিনাশ আকাশ থেকে পরে।
– হ্যাঁরে অবিনাশ। যেটুকু মান সম্মান ছিল সেটুকুও তো শেষ করে দিলো।
– কেন, কি হয়েছে?
– কাল মোকা আমারে ডেকে বলে, গরুর মাংস খেয়ে ফেলেছ, জানাজানি হলে তোমার স্বজাতিরা তোমারে একঘরে করে দেবে। তার চেয়ে এক কাজ করো, মোসলমান হয়ে যাও।
– এতো বড়ো অপমানজনক কথা। কিভাবে খাওয়ালো! অবিনাশ জানতে চায়।
– বকুলের বিয়েতে ও খাবার পারস করেছিল। আমাকে নাকি ও সেদিন গরুর মাংস খাইয়ে দিয়েছে। আমিতো খাবার সময় কিছু বুঝি নাই। আমি যখন খাচ্ছিলাম তখন একবার ওর দিকে চোখ গিয়েছিল, দেখি ও দুরে দাঁড়ায়ে আমার দিকে তিাকিয়ে মিটমিট করে হাসছে। হাসির মধ্যে শয়তানি ছিল, কিন্তু তখন বুঝতে পারি নাই সে হাসি আমাকে লক্ষ্য করে। আর সে হাসির মানে কি?
– তুই কখন নিমন্ত্রণে গিয়েছিলি!
– সন্ধ্যার একটু আগে। মাঠ থেকে বাড়ি এসে তারপর গিয়েছিলাম।‌
– সাথে আর কেউ ছিল না।
-না সে সময় আমি একাই ছিলাম। 
– এতো ভীষণ খারাপ কথা। চেয়ারম্যানের কাছে বলা দরকার। শত হোক নিমন্ত্রণতো সেই দিয়েছিল।
–  বলে কী লাভ! বিষ্ঠাকে ছাই চাপা দেয়াই ভালো। নইলে গন্ধ ছড়ায়।
– তাই বলে এরকম ধর্ম ডাকাতি কাজ কি মেনে নেয়া ঠিক।
– তোর কিছু হবেনা অবিনাশ। কিন্তু সকলের সামনে আমাকে এই বোঝা বয়ে বেড়াতে হবে। বাপ ঠাকুরদারা কোনদিন মুসলমান বাড়িতে খায় নাই। দিন পাল্টে গেছে, তুইও বললি এখন এই জাত ধর্ম বিচার করার দিন না। আমি ভাবলাম ঠিকেই তো। কিন্তু কেউ এমন একটা কাজ করবে ভাবতেও পারি নাই।
-এখনতো আমারই অপরাধী মনে হচ্ছে। অবিনাশ উত্তর দেয়।
-তোর আর কি দোষ। তুইতো জোড় করিস নাই।
– মোকাটা সব সময়ই এরকম। অকাম কুকাম করা ওর সারা জীবনের অভ্যাস। বাপও যেমন ছিল ও তেমন হয়েছে। তা তোর দেশ ছাড়তে হবে কেন। অন্যায়তো করেছে মোকা। তুইতো কিছু করিস নাই।
– নারে আমি এ অপমানটা মেনে নিতে পারছি না। গরীব বলে আজ ও আমাকে এতবড় অপমান করতে পেরেছে। আজ যদি আমার অর্থ সম্পদ থাকতো তাহলে এই অপমানটা করতে পারতো না। এখানে থাকলে ভবিষ্যতে হয়তো আরো বড় ধরণের অপমান হতে হবে।
– তাই বলে দেশ ছাড়তে হবে?
– মাটির টান ছাড়া আমারতো আর কোন পিছুটান নাইরে অবিনাশ। মা বাবা মরে গেছে। জমি জমা কিছুই নাই। এখানেও কাজ করে খেতে হয়, ওদেশেও কাজ করে খেতে হবে। থাকবার মাত্র ঐ ভিটেটুকু। ভিটেডা তুই রেখে দে অবিনাশ। আমি কাল রাত্তিরে ঘুমাবার পারি নাই। ছেলেটাও বড় হয়ে এরকম অপমানিত হবে। তার চেয়ে ওপাড়ে চলে যাওয়াই ভাল।

নিশির কথা শুনে চুপ হয়ে যায় অতুল। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে রাতে আয়, আমাকে একটু ভাববার সময় দে। নিরুর যশোদা মার সাথেও একটু আলাপ করি। চল আমার সাথে বাজারে চল।

– নারে বাজারে যাবার ইচ্ছে করছে না। কেন যেন মনে হচ্ছে সবাই আমার দিকে তাকিয়ে মিটমিট হাসছে। রাতে আসবো।  তুই পারলে ভিটেটার জন্য কয়ডা টাকা দিস।  কাল সকালে আমাকে আর পাবি না।
– এত উতলা হোসনে নিশি। একটু ধৈর্য ধর। দুই দিন সময় নে। রাতে আয়। একটা বুদ্ধি বের হবে।

অতুল দোকানে চলে যায়। নিশি কাজ কাম বাদ দিয়ে ঘরে গিয়ে শুয়ে থাকে বিছানায়।

১৫

দুপুরে দোকান থেকে বাড়িতে আসে অবিনাশ। খাবার সময় রমার কাছে প্রসঙ্গটা তোলে। তোমাকে বলেছিলাম রমা, নিরুকে এভাবে এত আদর দিওনা, কষ্ট পাবে।

– এখন একথা বলছো কেন?  কি হয়েছে? রমা জিজ্ঞাসা করে।
-নিশি ইন্ডিয়ায় চলে যাবে।

কথাটা শুনে আকাশ থেকে পরে রমা। বলো কি! কি এমন হলো।

– ওর মন ভেঙ্গে গেছে। চেয়ারম্যানের ছেলের বিয়েতে মোকা ওকে নাকি গরুর মাংস খাইয়ে দিয়েছে। এখন ওকে চাপ দিচ্ছে মোসলমান হবার জন্য।
– বলো কি! এতো সর্বনেশে ব্যাপার। কিন্তু এর জন্য দেশ ভিটে ছাড়বে নাকি। না জেনে সাপের বিষ খেলেও কিছু হয় না।‌
– পদে পদে অপমান হতে হবে সেই ভয়ে ও আর এখানে থাকতে চায় না।
– তাহলে নিরু।
-নিরু ওদের সাথে যাবে। এটাই স্বাভাবিক।
–  না! বলে উঠে দাঁড়ায় রমা। ওকে আমি যেতে দেব না। ও আমার ছেলে। আমি ওর যশোদা মা।
– শান্ত হও রমা। ওটা ওদের সন্তান। তোমাকেতো বলেছিলাম। ভবিষ্যতে কষ্ট পাবে। রাতে নিশিকে আসতে বলেছি। দেখি বুঝিয়ে সুজিয়ে যাওয়াটা ঠেকানো যায় কিনা।

রাতে আসে নিশিকান্ত, সাথে পদ্ম আর নিরু। নিরু দৌঁড়ে এসে জড়িয়ে ধরে ওর যশোদা মাকে। গলা জড়িয়ে ধরে বলে, আমি ইন্ডিয়া যাব না যশোদামা, তুমি আমাকে রেখে দাও।
রমার চোখে ঝর ঝর জল গড়িয়ে পরে। আঁচল দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে পদ্মকে বলে, পদ্মদি ওকে নিয়ে যেও না। আর তোমরাই বা কেন যাবে? অজানা সাপের বিষ খেলেও দোষ নাই। যে তোমাকে গোপনে হাবিজাবি খাইয়েছে অপরাধ করেছে সে, তুমিতো অপরাধ কর নাই। যে বিষ খাওয়ায় অপরাধী সে, যে খায় সে না!
পদ্ম কোন কথা বলে না, চোখ দিয়ে জল বেরিয়ে আসে, আঁচল দিয়ে মুছতে থাকে।
নিশি উত্তর দেয়, অপরাধ করি নাই ঠিকই বৌদি, অপমানিত হয়েছি। গরীবের একমাত্র সম্পদ তার আত্মসম্মান। এ অপমানের বদলা নেবার ক্ষমতা আমার নাই। আর আমার মনে হয় ওরা সবাই আমার দিকে তাকিয়ে মিটমিট করে হাসছে। এভাবে কিছুদিন থাকলে আমি পাগল হয়ে যাব। আমাকে চলে যেতেই হবে বৌদি। তোমরা বাধা দিও না।
রমা আর কোন কথা বলে না। মনে মনে ভাবে যে চলে যেতে চায় তাকে ঠেকানো যায় না। জোড় করে বুকের মধ্যে চেপে ধরে নিরুকে। অবিনাশ একটু চুপ থেকে বলে, নিরুকে রেখে যা নিশি, তোরা ওখানে গিয়ে কোথায় উঠবি, কি করবি, কিছু ঠিক নাই। তাছাড়া নিরুও যখন যেতে চাচ্ছে না। ও এখানে লেখাপড়া করুক। তারপর যখন তোরা একটু পায়ে দাঁড়াবি তখন নয় ওকে পাঠিয়ে দেব বা এসে নিয়ে যাবি। ভালই হবে। ও ওর যশোদা মার কাছে ভালই থাকবে।

অবিনাশ যে এরকম প্রস্তাব দিবে রমা, পদ্ম কিম্বা নিশিকান্ত কেউই ভেবে উঠেতে পারে নাই। স্বামীর প্রস্তাব শুনে রমা যেন বুকে বল পায়। সে পদ্মর হাতটা নিজের হাতের মুঠোর মধ্যে নিয়ে বলে, হ পদ্মদি, ও আমার কাছে ভালই থাকবে। আর দেখেনা কত মানুষ ছেলেমেয়েদের মানুষ করার জন্য হোস্টেলে রেখে পড়ায়। সেরকম নয় নিরু আমার কাছে থেকে পড়াশোনা করলো। কি নিরু বাবা তুই আমার কাছে থাকতে পারবি না।

– হ্যাঁ, আমি পারবো। রমার বুকের মধ্যে মাথা রেখে উত্তর দেয় নিরু।

নিশি অবিনাশের হাত ধরে বলে, ভগবান তোর মঙ্গল করুক। কিন্তু নিরুর মা কি ওকে ছাড়া থাকতে পারবে?
পদ্ম মা হিসেবে বুঝতে পারে রমা নিরুকে কতটা ভালবাসে। এখন তাকে কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হবেন। একদিকে বাৎসল্য প্রেম অন্য দিকে ছেলের ভবিষ্যত। একবার ভাবে এই নাড়ি ছেঁড়া একমাত্র ধন রেখে সে কিভাবে বাঁচবে। আবার ভাবে সন্তান ভাল ভাবে খেয়ে পড়ে বড় হবে সেটাও দরকার। ছেলেমেয়েদের মানুষ করে গড়ে তোলা বাবা মায়ের দায়ীত্ব। সন্তানের ভালোর জন্য মা বাবা কত কিছু ত্যাগ করতে পারে। ছেলের ভালোর জন্য ঝড় বৃষ্টির মধ্যে বসুদেব নিজেই কৃষ্ণকে রেখে এসেছিল যশোদা মায়ের কাছে। আমাদের অনিশ্চিত গমনে ছেলের ভবিষ্যত আরো অন্ধকার হতে পারে। কোথায় থাকবো, কি করবো কোন কিছুই জানিনা। ছেলেটি অন্তত খেয়ে পড়ে ভাল থাকবে। লেখাপড়াটাও হবে। কোন কথা না বলে শুধু ভাবতে থাকে আর চোখেন কোণা দিয়ে ঝর ঝর করে জল পড়তে থাকে।

-নিরু মায়ের চোখের জল মুছতে মুছতে বলে, তুমি কেঁদো না মা। আমি যশোদা মার কাছে ভাল থাকব।

রমা পদ্মর হাত ধরে বলে, আমি কথা দিলাম পদ্মদি, নিরুকে আমি এখন যে রকম দেখি সব সময় সেরকমই দেখব। ও অতুলের সংগেই লেখাপড়া করবে। যশোদার কাছে কৃষ্ণ কি খারাপ ছিলো, বলো?

– অবিনাশ রমার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলে, হ নিশি ওকে রেখে যা। ভিটেটা বিক্রি করিস না। ওটা থাক তোর যদি কোনদিন মনে হয় ফিরে আসার, তখন এসে ভিটেটাতো পাবি। নরেনকে দেখ, যুদ্ধের সময় চলে গিয়েছিল, যুদ্ধ শেষে সবাই ফিরে এলেও ও আসে নাই। ভেবেছিল ওখানেই থেকে যাবে। এতদিন পর ও ফিরে এসেছে। ভিটেটা ছিল দেখে ওখানে ঘর তুলে আছে। দেখ দুই ছেলেকে নিয়ে এখন ভালো আছে। আর নিরু যদি এখানেই থেকে যায় তাহলে ওর জন্য একটু মাটি রইলো।

নিশিকান্ত কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে বলে, আমারতো কিছু টাকা দরকার। ওই ভিটে ছাড়াতো আর কিছু নাই। বডারে দালালরা নাকি জন প্রতি একশ টাকা নেয়। দুইজনে দুইশ টাকা, সেই সাথে যতদিন কাজ না পাই ততদিনতো কিছু খেয়ে বেঁচে থাকতে হবে।

– তুই ভিটের জন্য কত টাকা চাস। অতুল জানতে চায়।
– দশ শতাংশের ভিটে হাজার দুইয়েকের বেশিতো পাব না।
– ঠিক আছে আমি তোরে দুই হাজার টাকা দিচ্ছি। ভিটে আমি নিরুর জন্য কিনে রাখলাম। অবিনাশ ঘর থেকে দুই হাজার টাকা বের করে এনে দেয় নিশিকান্তের হাতে। নিশিকান্ত টাকাটা কপালে ছুইয়ে পদ্মর হাতে দিয়ে বলে, ভোরে কেউ জাগার আগে আমি গ্রাম ছাড়বো।

অবিনাশ জিজ্ঞেস করে, কোথায় কিভাবে কার সাথে বর্ডার পার হবি ঠিক করেছিস। বডারে ধরা পড়লে কিন্তু মহাবিপদ। আম ছালা দুটোই যাবে। কিছুদিন জেল খেটে আবার ফিরে আসতে হবে।

-হ্যাঁ ঠিক করেছি, প্রথমে গিয়ে পদ্মদের বাড়িতে উঠব। তারপর রবি দাসের সাথে যোগাযোগ করে বর্ডার পার হবো।

ঠিক আছে, সাবধানে যাস, কোথায় গিয়ে উঠিস জানিয়ে চিঠি দিস। রবিদাসের হাতে দিলেই আমি পাব।
কিছুক্ষণ কোন শব্দ নেই। কারো মুখে কোন কথা নাই। অবিনাশ মনে মনে ভাবতে থাকে, আবার শুরু হলো, গত সপ্তাহে চলে গেল তপন, এস সপ্তাহে চলে যাবে নিরু। আরো কতজন যাবে কে জানে? নিরবতা ভেঙ্গে নিশিকান্ত বলে, আমি এখন উঠিরে অবিনাশ। বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে পদ্মকে বলে, চলো উঠি।
নিশির কথায় উঠে দাঁড়ায় পদ্ম। নিরব নিথর কাঠের পুতুলের মতো। ওদের সাথে উঠে দাঁড়ায় নিরু, রমা আর অবিনাশ। পদ্ম নিরুর হাতটা রমার হাতের মধ্যে গুজে দিয়ে বলে, কৃষ্ণকে তার যশোদা মায়ের কাছে রেখে গেলাম রমাদি। আমি জানি ও আমার চেয়ে তোমার কাছে ভালো থাকবে।
রমা আবারো বলে, আমি কথা দিলাম পদ্মদি, নিরুকে আমি এখন যে রকম দেখি, সব সময় সেরকমই দেখব। কোনদিন দুই চোখ করবো না। ও অতুলের সংগে বড় হবে, লেখাপড়া করবে।

Series Navigation<< উপন্যাস।। জীবনে মরণে।। বিশ্বজিৎ বসু।। পর্ব এগারো

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *