উপন্যাস।। জীবনে মরণে।। বিশ্বজিৎ বসু।। পর্ব এগারো
- উপন্যাস।। জীবনে মরণে।। বিশ্বজিৎ বসু
- উপন্যাস।। জীবনে মরণে।। বিশ্বজিৎ বসু।। পর্ব দুই
- উপন্যাস।। জীবনে মরণে।। বিশ্বজিৎ বসু।। পর্ব তিন
- উপন্যাস।। জীবনে মরণে।। বিশ্বজিৎ বসু ।। পর্ব চার
- উপন্যাস।। জীবনে মরণে।। বিশ্বজিৎ বসু।। পর্ব পাঁচ
- উপন্যাস।। জীবনে মরণে।। বিশ্বজিৎ বসু।। পর্ব ছয়
- উপন্যাস।। জীবনে মরণে।। বিশ্বজিত বসু।। পর্ব সাত
- উপন্যাস।। জীবনে মরণে।। বিশ্বজিৎ বসু।। পর্ব আট
- উপন্যাস।। জীবনে মরণে।। বিশ্বজিৎ বসু।। পর্ব নয়
- উপন্যাস।। জীবনে মরণে।। বিশ্বজিৎ বসু।। পর্ব দশ
- উপন্যাস।। জীবনে মরণে।। বিশ্বজিৎ বসু।। পর্ব এগারো
১২
বরযাত্রী দল কিছুদূর পথ পারি দিলে ঘনিয়ে আসে সন্ধ্যা। পালকি থামায় বেহারারা। সাথে সাথে বরযাত্রীরাও দাঁড়িয়ে পরে একটু বিশ্রাম নেবার জন্য। পালকির গতিতে হেঁটে তারাও তখন একটু ক্লান্ত। বিশ্রাম নিতে নিতে একটি হারিকেন জ্বালিয়ে নেয় বেহারা সরদার মতিলাল। যারা বেহারাদের সমান তালে হাঁটতে পারছিল না তারাও ইতিমধ্যে এসে পৌঁছায়। তারপর আবার সকলে নারায়ে তকবীর ধ্বনি দিয়ে রওনা হয় এক সাথে।
শীতের রাত, গ্রামের মানুষ তখন ঘরে ঢুকে গেছে। শুনশান নিরবতা। অনেক দূর থেকে শোনা যায় তকবীর ধ্বনি আর পালকির গান। ধ্বনি আর পালকির গান শুনে বোঝা যায় বিয়ের চলন যাচ্ছে। চলন যাবার ভাঁজ পেয়ে চলার পথে পাশের বাড়ি থেকে কেউ কেউ জিজ্ঞাসা করে, ও ভাই চলন কোথায় যায়?
– এক সংগে তিন চারজন উত্তর দেয়, রাজাপুর মুন্সি বাড়ি।
– ছেলে কে?
– গাফ্ফার চেয়ারম্যানের ছোট ছেলে বকুল।
উত্তর শুনে গ্রামবাসী উত্তর দেয়, মার হাবা, মার হাবা।
দুরের তকবীর ধ্বনি শুনে মেয়ে পক্ষ এসে দাঁড়িয়ে যায় গেটে। গেটের দুপাশে দুটি কলা গাছ, দেবদারু পাতা দিয়ে সুন্দর ভাবে মোড়ানো। উপরে বাঁশের ফ্রেমে খবরের কাগজ চিত্রালী সাঁটা। সেখানে ভেসে আছে ঢালিউডের নায়ক নায়িকার মুখ। তার উপরে হাতে কাগজ কেটে লেখা শুভ বিবাহ। শুভ বিবাহ লেখার দুই পাশে রঙিন কাগজ কেটে তৈরি কয়েকটা ফুল। ফ্রেমের নিচে পাতলা রঙ্গিন কাগজে ডিজাইন করে ঝুল কাটা, হালকা বাতাসে দুলছে। গেটের মাঝখানে একটা টেবিল। টেবিলের উপর একটি সাদা রঙের টেবিল ক্লথ। চার কোণে কুরুস কাঁটা দিয়ে তোলা সুন্দর ফুলের তোড়া। মাঝখানে সুন্দর গোলাকার ডিজাইন, দুটি ফুলের ডালে বসা দুটি টিয়া পাখি। ঠোঁটে ধরে রেখেছে একটি লাল রঙয়ের হৃদয়। টেবিলের উপর একটি প্লেটে বড় বড় চারটি মিষ্টি, পাশে একটি কাঁচের গ্লাসে জর ভরা। প্লেট দিয়ে ঢাকা। প্লেট এবং গ্লাস দু্টো এমনভাবে রাখা হয়েছে যাতে টেবিল ক্লথের মাঝে টিয়া পাখি দুটো পরিস্কার দেখা যায়।
তকবীর ধ্বনী দিতে দিতে পালকি এসে দাঁড়ায় গেটের সামনে। পালকি কাঁধ থেকে মাটিতে নামানোর পর মুরুব্বি বয়সের একজন এসে বরকে বের করে নিয়ে আসে পালকি থেকে। বর মুখে রুমাল দিয়ে আস্তে আস্তে হেঁটে আসে গেটের দিকে। বুকুলের দুই পাশে দাঁড়িয়ে পরে কলেজের দুই বন্ধু, বড় ভাই তোফাজ্জেল, অবিনাশ আর তপন। বরযাত্রীরা অর্ধবৃত্তাকার হয়ে দাঁড়ায় তাদের ঘিরে। পরস্পরের প্রতি ছালাম বিনিময়ের পর বকুলের এক বন্ধু জিজ্ঞাসা করে আপনারা আমাদের পথ আটকেছেন কেন? কনে পক্ষের একজন উত্তর দেয়,”No Bangla Here, only Engliah”। শুরু হয় ইংরেজি বচসা।
-Why did you make barrier on the way? বুকলের আরেক বন্ধু প্রশ্ন করে।
– You have to pay gate money. কনে পক্ষের একজন উত্তর দেয়। শুরু হয় বচসা।
– Gate money, why?
– Because it is our traditional custom. After gating this money from dulabhai, we will celebrate the ceremony by eating sweets.
-He is not your dulabhai, he is the king today. After married your sister you can call him dulabhai.
– Yes, he is the king today! We want to eat misti from King.
– That’s good, but you want to eat sweet from the King by making barrier on his way?
-Yes.
– Who is the king of Bangladesh now.
– General Ziaur Rahman.
বকুলের আরেক বন্ধু বলে উঠে, Wrong answer. পাশ থেকে কণে পক্ষের অন্য একজন উত্তর দেয় Justic Abu Sayem.
– That’s right, Can you stop him like this to eat Sweet? বর পক্ষ প্রশ্ন করে।
– Yes we can.
-You are the brave boy. But how much is you demand for misti.
– 200 taka.
– 200 taka, It is two much.
You bring only 4 misti. This is not sufficient for all of us. Your budget is 50 taka. With fifty taka you can buy 5 kg misti. বাদানুবাদের সময় কনের বড়ভাই আসে গেটে, হাক ছেড়ে বলে, এই তোদের এখনও শেষ হয় নাই, এদের যে আবার রাতেই ফিরে যেতে হবে, তাড়াতাড়ি কর। অবিনাশ তোফাজ্জেলের সাথে কানে কানে কিছু কথা বলে এগিয়ে যায় সামনে, তারপর ইংরেজিতে জিজ্ঞাসা করে, if you can say the english name of all materials used on this gate, we will give you 100 Taka. Agree?
একজন অতি উৎসাহী হয়ে বরে উঠে-Agree.
অবিনাশ তাকে বলে– Go ahead!
একজন বলে উঠে, how can he go ahead? There is table.
উত্তর শুনে হো হো করে হেসে উঠে বকুলের দুই বন্ধু । হো হো হাসি শুনে প্রশ্ন কর্তা বুঝে যায় সে কিছু ভুল করেছে। আরেকজন পাশ থেকে উত্তর দেয়। you stop, you stop.
যে ব্যক্তি নামগুলো বলতে রাজি হয়েছিল সে একে একে ইংরেজিতে বলতে থাকে নামগুলো; news paper, colour paper, glue, banana tree, bamboo and debdaru leave.
ছেলে পক্ষ চিৎকার করে উঠে দেবদারু বাংলা শব্দ, এটা ইংরেজি না। তোমরা হেরে গেছে টাকা পাবে না।
দেবদারুর ইংরেজি বলতেনা পেরে সে আস্তে করে কেটে পরে, অন্যরা মিস্টির টাকা ছাড়া গেট ছাড়বে না। তারা শুরু হৈচৈ চিৎকার। চিৎকার করে বলতে থাকে, মিষ্টি খাবার টাকা ছাড়া গেট ছাড়া হবে না। এমন সময় এগিয়ে আসে মানিক, সাথে বলাই। মানিক শুরু করে তার ইংরেজি। ছেড়ে দেয় ওর প্রথম বাক্য, প্যআং, প্যআং, প্যআং।
বলাই পাশ থেকে জিজ্ঞেস করে, এর বাংলা কি বলেন। মেয়ে পক্ষ এ ওর দিকে তাকাতাকি শুরু করে। তোফাজ্জেল, বকুল, অবিনাশ মানিকের ইংরেজি শুনে মিট মিট করে হাসতে থাকে।
মানিক আবার বলে,ভ্যা আ ফুইং, হুয়া বো ভুইং!
বলাই আবার জিজ্ঞেস করে এর বাংলা কি বলেন।
মেয়ে পক্ষ একই ভাবে এর ওর দিকে তাকাতাকি করতে থাকে। কেউ উত্তর দিতে পারে না।
এবার মানিক উচ্চস্বরে শুরু করে রচনা। ই তু মিটিং, বু বু চিটিং, কিং কং ফিটিং, ডিং ডাং বিটিং। তো হুম হোটিং। মেয়ে পক্ষ হা করে তাকিয়ে থাকে মানিকের দিকে। কোন শব্দই তাদের পরিচিত না। এমন সময় মেয়ের বড় ভাই এসে হাঁক ছাড়ে, এই তাড়াতাড়ি কর। গেটে কত টাকা দেয়া হবে সেটা বিয়ের পাকা কথার দিন ঠিক করা ছিল। তোফাজ্জেল মেয়ের বড় ভাইয়ের হাতের মুঠোয় একশ টাকার একটি নোট গুঁজে দেয়। সে টাকাটা হাতে নিয়ে বলে, এই নে টাকা পাইছি। এবার ছেড়ে দে। কেউ কেউ চিৎকার করে উঠে কত কত?
-সে উত্তর দেয়, এখন ছাড়, পরে বলবো।
সবাই হাততালি দিয়ে উঠে। কেউ একজন বরকে মিস্টি খাইয়ে টেবিল-বেঞ্চ সরিয়ে নিয়ে যায়। বলাই ধ্বনি দিয়ে উঠে নারায়ে তকবীর, উভয় পক্ষ এক সংগে উত্তর দেয়, আল্লাহু আকবার।
মহা আনন্দে সকলে ফিরে আসে বকুলের বউ নিয়ে ভোর রাতে।
১৩
বরযাত্রী থেকে ফিরে এসে অবিনাশ আর ঘুমায় নাই। একবারে দোকান সেরে দুপুরে বাড়ি এসে ভাত খেয়ে ঘুম। সন্ধ্যার একটু আগে নিশি এসে জাগিয়ে তোলে। নিশির সাথে আরো কয়েকজন প্রতিবেশী।
ঘর থেকে বের হয়ে বারান্দায় এসে বসে অবিনাশ। কথাটা প্রথমে তোলে নিশি।
একদিন পর বকুলের বৌভাত। গ্রামের প্রতিটি হিন্দু বাড়ি হতে একজন করে পুরুষের নিমন্ত্রণ। আমরাতো পোলাও মাংস খাবার নিমন্ত্রণ পেয়েছি, কিন্তু খাওয়া কি ঠিক হবে?
আর যারা খায়না তাদের জন্য চিড়া মুড়ি।
– দেখ, আমি ম্যাট্রিক পাস করার পর থেকে চেয়ারম্যান বাড়ি খায়। আমার কোন অসুবিধা নাই। তোমরা খাবে কি না খাবে সেটা তোমাদের ব্যাপার। যারা মাংস খায় তাদের জন্য পোলাও মাংস, যারা খাবেনা তাদের জন্য চেয়ারম্যান চিড়া মুড়ির ব্যবস্থা করেছে। আর আমিতো চিড়া মুড়ি আর ভাতের মধ্যে কোন পার্থক্য দেখি না। সবইতো ধান থেকেই হয়। অবিনাশ উত্তর দেয়।
– না আগে কখনো খাই নাইতো, তাই বাধে। আগন্তকদের একজন উত্তর দেয়।
– আগে খাই নাই একথাটা ঠিক না, মুসলমান বাড়ির জল ভাত আমরা কমবেশী সবাই খেয়েছি! যুদ্ধের সময় যখন গ্রাম লুট হয় তখনতো আমরা পালিয়ে প্রথম মুসলিম বাড়িতেই উঠেছিলাম। তখনতো আমরা খেয়েছিলাম। আমাদের কি জাত চলে গেছে।
– একই দিন গরু আর খাসি রান্না হবে। যদি মিশে যায়।
– আমার বিশ্বাস চেয়ারম্যান সাহেব এ ব্যাপারে সতর্ক থাকবে।
– একই দা ছুরি দিয়ে কাটবে।
– আরে গৌরীপুর বাজারে যে কসাই প্রতি শুক্রবার খাসির মাংস বিক্রি করে, সেই কসাই পরদিন মধুখালি বাজারে গরুর মাংস বিক্রি করে। আমরাতো বাজার থেকে খাসির মাংস কিনে খাই না কি? আমাদের বাড়িতে এক সময়ে মুরগির মাংস রান্না করা হতো না। এখন আত্মীয় স্বজন এলে একদিন মুরগি রান্না করে না খাওয়ালে চলে না। মোবারক আমাদের বাড়ির রাখাল, আমরা যে পাত্রে কচ্ছপের মাংস রান্না করছি, সেই পাত্রেইতো মুরগি রান্না করছি। মোবারকতো মুরগীর মাংস খাচ্ছে। দিন পাল্টে যাচ্ছে। দরকারে অদরকারে আমরো শহরে গিয়ে হোটেলে খায়। যে থালা-গ্লাস-বাটি-কাপে খায়, সেগুলো আগে কে ব্যবহার করেছে আমরা জানি? একদিন সময় আসবে যেদিন খাওয়া খাওয়িতে হিন্দু মুসলমান, ব্রাহ্মণ- শুদ্র কোন ভেদ থাকবে না।
আলোচনা এখানেই শেষ হয়ে যায়। অবিনাশ চলে যায় বাজারে। অন্যরা যার যার কাজে। পরদিন বিশাল জমজমাট আয়োজনে হয়ে যায় বকুলের বৌভাত। চেয়ারাম্যান সাহেব একটি গরু আর একটি খাসি জবাই দিয়েছিলেন। অবিনাশের সাথে তপনও গিয়েছিল নিমন্ত্রণ খেতে। এটা ছিল তপনের বাংলাদেশে খাওয়া শেষ নিমন্ত্রণ।
পরদিন সকাল বেলা তপন বিদায় নিযে চলে যায় অবিনাশের বাড়ি থেকে। ছল ছল চোখে বিদায় নেবার সময় তপন অবিনাশকে বলে, জীবন মরণ যুদ্ধ করে যে দেশ স্বাধীন করেছিলাম আজ মৃত্যুর ভয়ে সেই দেশ ছেড়ে আমাকে চলে যেতে হচ্ছে।