নাট্টোপন্যাস।। জলের ভেতর জলের বিসর্জন।। ড. মুকিদ চৌধুরী।। পর্ব নয়
- নাট্যোপন্যাস।। জলের ভেতর জলের বিসর্জন।। ড. মুকিদ চৌধুরী।। পর্ব ছয়
- নাট্যোপন্যাস।। জলের ভেতর জলের বিসর্জন।। ড. মুকিদচৌধুরী।। পর্ব দশ
- নাট্যোপন্যাস।। জলের ভেতর জলের বিসর্জন।। ড. মুকিদ চৌধুরী।। পর্ব এক
- নাট্যোপন্যাস।। জলের ভেতর জলের বিসর্জন।। ড. মুকিদ চৌধুরী।। পর্ব সাত
- নাট্যোপনাস।। জলের ভেতর জলের বিসর্জন।। ড. মুকিদ চৌধুরী।। পর্ব চার
- নাট্যোপন্যাস।। জলের ভেতর জলের বিসর্জন।। ড. মুকিদ চৌধুরী।। পর্ব পাঁচ
- নাট্যোপন্যাস।। জলের ভেতর জলের বিসর্জন।। ড. মুকিদ চৌধুরী।। পর্ব তোরো
- নাট্টোপন্যাস।। জলের ভেতর জলের বিসর্জন।। ড. মুকিদ চৌধুরী।। পর্ব আট
- নাট্টোপন্যাস।। জলের ভেতর জলের বিসর্জন।। ড. মুকিদ চৌধুরী।। পর্ব নয়
- নাট্যোপন্যাস।। জলের ভেতর জলের বিসর্জন।। ড. মুকিদ চৌধুরী।। পর্ব তিন
- নাট্যোপন্যাস।। জলের ভেতর জলের বিসর্জন।। ড. মুকিদ চৌধুরী।। পর্ব দুই
- নাট্যোপনাস।। জলের ভেতর জলের বিসর্জন।। ড. মুকিদ চৌধুরী।। পর্ব এগারো
- নাট্যোপন্যাস।। জলের ভেতর জলের বিসর্জন।। ড. মুকিদ চৌধুরী।। পর্ব বারো
- নাট্যোপন্যাস।। জলের ভেতর জলের বিসর্জন।। ড. মুকিদ চৌধুরী।। শেষ পর্ব
রাধারমণ–সংগীত
ভোমর কইয়ো গিয়া/ শ্রীকৃষ্ণ বিচ্ছেদে রাধার অঙ্গ যায় জ্বলিয়া।
ও ভোমর রে, কইয়ো কইয়ো আরও ভোমর কৃষ্ণরে বুঝাইয়া।
ও ভোমর রে, না খায় অন্ন, না খায় জল, নাহি বান্দে কেশ
ঘর থাকি বাইর হইলা যেমন পাগলিনীর বেশ।
ও ভোমর রে, উজান বাঁকে থাকো রে ভোমর, ভাইটাল গাঙে থানা
চোখের দেখা মুখে হাসি কে কইরাচে মানা।
ও ভোমর রে, ভাইবে রাধারমণ বলে মনেতে ভাবিয়া
নিভিয়া ছিল মনের অনল কে দিল জ্বালাইয়া, ভোমর কইও গিয়া।
রাত গভীর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হাওয়ার বেগ বাড়তে থাকে। ননী ঘরে ঢুকেই জলপাত্রটি খাটের পাশে রাখতে যাবে, এমন সময় শংকর এক প্রকার জোর করেই তার হাত থেকে পাত্রটি ছিনিয়ে নিয়ে ঢক ঢক করে জল খেতে শুরু করে। তার জল খাওয়ার ভঙ্গিতে ফুটে ওঠে সে কতটা ভয়ানক তৃষ্ণার্ত, একই সঙ্গে তার দেহ-খিদেও প্রবলভাবে জাগ্রত হতে থাকে। ননী কোনও কথা না বলে শংকরের দিকে চুপচাপ তাকিয়ে থাকে। আশ্চর্য হয়েই তাকাল, মানুষের মর্যাদাবোধের আর বাঁচার ইতিহাসের দ্বন্দ্ব যেন তার দৃষ্টিতে ধরা পড়ে। ননী বলল, তারপর… তারপর কী হল?
অত্যন্ত মুখ গম্ভীর করে আড়ম্বর-সহকারে চিন্তা করতে লাগল শংকর। কিছুক্ষণ পরে বলল, আজ এই পর্যন্তই থাক্। আর বকবক করতে ইচ্ছে হচ্ছে না।
ননী বলল : মহাজন, গল্পটি শেষ করুন। আমার চোখে একেবারেই ঘুম নেই।
ননীর গল্প শোনার আগ্রহ সম্বন্ধে প্রশ্ন করার সময় এখন নয়, একথা শংকর যে একেবারে বোঝে না তা নয়, কিন্তু যা অগোচরে আছে তাকে বলপূর্বক আলোড়িত করে তার মধ্য থেকে হঠাৎ একটা ঝঞ্ঝা আবিষ্কারের সম্ভাবনায়, সে স্বভাবত তাতে কিছুমাত্র আগ্রহবোধ করল না, তাই বলল : কাল শোনাব। এখন শুতে যাব।
পাংশু মুখে হাসি টেনে এনে ননী বলল, তোমার স্বভাবটা ভীষণ সন্দিগ্ধ। তাই বলছি, আগে গল্পটি শেষ করুন, তারপর অন্য কথা।
ননীর কথার কোনও উত্তর দিল না শংকর, বরং ভাবতে লাগল : একটি সামান্য মানুষ এই ভাটিদেশের সাধারণ জীবনের কত দুর্মর আত্মসম্মানের চিক্কণ সুতো আঁকড়ে বেঁচে থাকতে চায়। ভাটিদেশের দারিদ্র্যের রূঢ় আঘাত থেকে কি কখনও ভাটির জল মানুষকে রক্ষা করতে পারে? যত মমতাই থাক্ অন্তরে, তবুও পারে না; হয়তো-বা পারবেও না। তাই হয়তো চমকে উঠল শংকর। আর এই চমকে ওঠার পরমুহূর্তেই তার হৃদয়ে দরদ ঘনীভূত হতে লাগল। এই আকুলতা তার কাছে এমন কিছুই নয়, অন্তত প্রেম তো নয়ই বটে। এই নির্মমতার বাস্তবতায়ই সে বলে উঠল : তাহলে শোন্, বউদি এই বাড়িতে আসার পর তার কাজের শেষ ছিল না। আমার মা ছিলেন বৃদ্ধ ও অসুস্থ, তাই তিনি সারা সময়ই বিছানায় পড়ে থাকতেন। তার কাঁথা-কাপড় বদলানো, কেচে দেওয়া, খাওয়ানো-দাওয়ানো সবই করত। তার কাজের কি শেষ ছিল?
ননী বলল, সব কাজই কি বউদি একা করত?
ননীর মনের ভেতর যমুনা ও মেঘনার মতো দুই চিন্তাধারা প্রবাহিত হচ্ছে। দুটির কল্লোলধ্বনি এক সঙ্গে মিশে তার মনকে মুখর করে তোলে। বিশ্বরঙ্গভূমি যেন সমস্তই নিস্তব্ধ। বারকয়েক ননী জানালা দিয়ে উঠোনের এক পাশে তুলসীর ছায়া, আর-এক পাশে শুভ্র জোছনাররেখা দেখল। যা নিত্য, যা শান্ত, যা শব্দবিহীন সীমাবিহীন, যা আরম্ভ এবং অবসান উভয়ই, তার মধ্যে কোনও দ্বন্দ্ব নেই, দ্বিধাও নেই—ননীর সমস্ত অন্তঃপ্রকৃতি বিগলিত হয়ে তার মধ্যে পরিব্যাপ্ত হতে লাগল। ননীর ওপর দৃষ্টি রেখেই শংকর বলল, আমাদের মতো চাষাভুষারা কি রায়বাহাদুরের মতো ভৃত্য রাখতে পারত? তাছাড়া বউদির এসবের প্রয়োজনই ছিল না। সে ভীষণ কর্মঠ নারী। এক হাতেই সারা সংসারটি সামালে নিত।
একথা শোনামাত্র ননীর ক্লান্ত শরীর শিউরে উঠল। হঠাৎ একটা আশঙ্কা থেমে থেমে তার হৃৎপিণ্ডকে চেপে ধরতে লাগল। মনে পড়ল : সংসারের রণক্ষেত্রে কমলিকার বিরুদ্ধে কি সংগ্রাম করতে হবে? এই-যে আকাশ, তার কোনও চিন্তারেখা নেই, জোছনার মতো চাঞ্চল্যও নেই; রাত্রি যদিও নিস্তব্ধ শান্ত, আর রাত্রির প্রকৃতি দিবসের কর্ম সমাধান করে বিশ্রামে বিলীন—তবুও এই সংসারের মানুষগুলোকে সঠিকভাবে বোঝার অন্ত নেই, দ্বন্দ্ব-সংঘাতে, বাধায়-বিঘ্নে এই সংসারের মানুষগুলো সব সময়ই তরঙ্গিত।
দুশ্চিন্তার মধ্যেও রমেশের মনে এই প্রশ্নের উদয় হল। কিছুক্ষণ পূর্বে ননীর অন্তঃপুরের মধ্যে যে একটি শাশ্বত সম্পূর্ণ শান্ত মূর্তি দেখা দিয়েছিল, তা ক্ষণকাল পরে, জীবনের জটিল বাস্তবতায় ক্ষুব্ধক্ষুণ্ণ হয়ে দেখা দিল। ননীর কণ্ঠে, তাই হয়তো প্রকাশ পেল : আমিও কি কম কর্মঠ? শুধুই কি শুয়ে-বসে খাই?
শংকর বলল : আরে ধ্যাৎ, তোর কথার যা ছিরি! আমি কী বলি আর আমার সারেন্দা বাজায় কী! থাক্, আর গল্প বলার ইচ্ছে নেই। শুধু শুধুই ফোড়ন কাটিস।
ননী বলল, আর ফোড়ন কাটব না, কখনই না, আপনার দিব্যি!
শংকর বলল, এই পর্যন্ত কতবার দিব্যি কাটলি!
ননী বলল, এবার সত্যি সত্যি কাটলাম। আপনি দয়া করে গল্পটা শেষ করুন।
গালে হাত দিয়ে ননী গল্প শুনছে আর ভাবছে : স্বপ্ন সেও দেখতে ভালোবাসে। মানুষের জীবনে সহস্র সম্ভাবনার কথা তার চিন্তাচেতনায় যেন উদয় হতে থাকে। অনুভব করতে থাকে শংকরই তার মানব, তার আকাশের একমাত্র নক্ষত্র। কড়ির স্বপ্নবন্যায় নিমজ্জিত শংকরের দৃষ্টির অতল তলে ম্লান প্রেমস্বপ্ন সঞ্চারিত হয়ে মৃদু আলোড়ন সৃষ্টি হতে দেখে ননী। এই মৃদু প্রেমস্বপ্নের বিদ্যুৎবাহী অনুভূতির তরঙ্গে তার দেহে জেগে ওঠে ম্লান-উল্লাস। তার কাছে স্পষ্ট হয়ে ধরা দিতে থাকে, প্রতি-রোমকূপে শিহরণ-তোলা শংকরের সোহাগের না-বলা ভাষাবর্ণ ও প্রত্যয়ী স্বপ্নকণিকাগুলো।
ধীরে ধীরে এক সময় খণ্ড-চাঁদ বাঁশবনের আড়ালে নেমে গেল। ভাটিদেশের রাত্রির কালিমা ঘনীভূত হল—আকাশ যদিও বিদায়োন্মুখ আলোকের আলিঙ্গনে পাণ্ডুবর্ণ।
শংকর ও ননী যখন গল্প করছে ঠিক তখনই কমলিকা তার স্বপ্ন ও প্রেম থালায় সাজিয়ে ঘনশ্যামকে খেতে দিল। ঘনশ্যামের দৃষ্টিতে শুধুই বিস্ফারিত হচ্ছে বাস্তবতা—মানুষের বেঁচে থাকার জটিল জটলা—লাঙলের চেয়ে শরীরই যেন সত্য, গা-গতরে সংগ্রামই যেন সুস্পষ্ট, অথচ নিষ্ফল ব্যর্থতা আকস্মিক মাথার মধ্যে গরগর করতে থাকে, অসহায় ভঙ্গিতে থরথর করে কেঁপে ওঠে কমলিকার সমস্ত দেহ, যেন মহাবিক্ষোভে। স্বামীর শুকনো বিধ্বস্ত চেহারা দেখে চমকে ওঠে, বলে : কী হল, কিছুই যে খাচ্ছ না! আমার রান্না বুঝি সুস্বাদু হয়নি?
ঘনশ্যাম নিশ্চুপ।
ঘনশ্যামের আয়ত চক্ষু দুইটির আকুল উদাসীনতার কারণ কী কমলিকা জানে না। না-জানলেও সে তার হৃদয়াবেগ ধরে রাখতে পারল না। না-বুঝেই বিমূঢ় স্বরে জিজ্ঞেস করল, কথা বলছ না কেন? তোমার কী হয়েছে, স্পষ্ট করে বলো তো! আমার সঙ্গে কথা বলতে কি কেউ মানা করেছে তোমাকে?
ঘনশ্যাম মুখ তুলে দ্রাবিত স্বরে বলল : হায়-রে রসবতী, রসিকতা করার এখন সময় নয়। রায়কুটির থেকে ডাক এসেছে। অতিরিক্ত খাজনা চাইছে। আমার মনে হয়, এবার আর ঘরে ফসল তোলা হবে না। কত কষ্টে চাষ করে এমন ফসল ফলিয়েছি, যা দেখে নায়েব মহাশয়ের মাথা ঘুরে গেছে। কড়ির জন্য তৃষ্ণা বেড়ে গেছে। রসবতী, আমি পারব না, কোনও মতেই পারব না, আমার এই সোনার ফসল তার হাতে তুলে দিতে পারব না। প্রাণ থাকতে, অন্যায়ভাবে খাজনা দিতে আমি পারব না।
একথা শুনে কমলিকার মস্তকে যেন আচম্বিতে বজ্রাঘাত হল। যার জন্য এত শ্রমস্বীকার করেছে, সেই ফসলের দর্শন পাবে না, ভাবতেই কমলিকার মন যেন হতাশার অন্ধকারে ডুবে গেল। তবুও নিজেকে সামলে নিয়ে আকুল হয়ে বলল : তুমি ভেবো না, লক্ষ্মীটি। দেখো, একটা-না-একটা উপায় বের হবেই। এখন একটু শান্ত মনে মুখে অন্ন মুখে তুলে নাও। পেটে ক্ষুধা থাকলে মাথাও ঠিকমতো কাজ করে না। এত বিচলিত হওয়ার কোনও কারণ নেই। এর আগেও তো অনেক সমস্যায় পড়েছি, দুজনে মিলে সেগুলো সামাল দিয়েছি, এখনও দেব। তাই অনুরোধ, মুখে অন্ন তুলে নাও।
ঘনশ্যামের মন কমলিকার সান্ত্বনার বাণী গ্রহণ করছে না। তার মন পাথরবৎ, উদাস হয়ে আছে। সে ভাবছে : অতঃপর কী করবে। কী করা কর্তব্য। সহসা ঘনশ্যাম দৃঢ় হয়ে উঠল। বলল : আমি মরে যাব তবুও অন্যায়ভাবে খাজনা দিতে আমি পারব না। নায়েব মহাশয়ের যা ইচ্ছে তা করুক গিয়ে। মেরে ফেলুক, তবুও আমি তার হাতে আমার সোনার ফসল তুলে দিতে পারব না।
কমলিকা অবাক হয়ে অতি সম্ভ্রমের সঙ্গে বলল : না, না, এমন কথা মুখেও এনো না। তুমি পাশে থাকলে আমি সব কষ্ট সহ্য করতে পারি। তোমার জন্য আমি সারা দিন খেটে মরতে পারি। শত কষ্ট ভোগ করতে পারি।
ঘনশ্যামের ওষ্ঠদ্বয় কী যেন অভিমানে কাঁপছে, তার নয়নে যেন কী গোপন বেদনা আঁকা হয়ে রয়েছে। সূক্ষ্ম বেদনা তার মনোবীণার তন্ত্রীতে অনুরণিত হচ্ছে। একটি দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বলল : মরে যাব, তবুও অতিরিক্ত খাজনা দেব না।
ঘনশ্যামের গালায় থ্যাঁতলানো মৃদুত্রস্ত কণ্ঠস্বর শুনে কমলিকার পায়ের তলায় যেন অন্ধকার ছিটকে পড়ল। শিউরে ওঠে। শ্বাস ঘন হয়ে ওঠে। তারপর সে ভয়ে ও অভয়ে গায়ের কাপড় সযত্নে দেহের ভাঁজে ও অভাঁজে জড়িয়ে নিয়ে, ঘনশ্যামের বাঁ-হাতটি আলতোভাবে চেপে ধরে বলল : আমি তোমাকে ছাড়া এই জীবনে বাঁচব না। তুমিই আমার রক্ষক। আমার ভাগ্যের রশি। তুমিই আমার একমাত্র আশ্রয়স্থল।