উপন্যাস

উপন্যাস।। জীবনে মরণে।। বিশ্বজিৎ বসু।। পর্ব তিন

লুট হওয়া দোকানটা নতুন করে দাঁড় করাতে অনেক পরিশ্রম করতে হচ্ছে অবিনাশের। আগে দোকানে একজন কর্মচারি ছিল, যুদ্ধের সময় পাক মিলিটারির ভয়ে পালিয়ে গিয়েছিল কিন্তু যুদ্ধ শেষে আর ফেরত আসে নাই। সে মারা গেছে না জীবিত আছে তা কেউ বলতে পারে না। যুদ্ধ বিধ্বস্ত দোকানে এখনও নতুন করে কর্মচারি রাখাও সম্ভব হয় নাই। হাটের দিন দুপুরের পর যখন দোকানে ব্যস্ততা বেড়ে য্য় তখন নিশি সাহায্য করে তাকে।
অতুল আর নিরুর প্রাইমারী স্কুল শেষ। দুজন সুযোগ হলেই সাহায্য করে দুজনের বাবাকে। অতুল বাবার সাথে দোকানে যায়। চাল-ডাল-তেল-লবন-মাপা, জিরা-হলুদ-লবণের পোটলা বাধা, দাম নেয়া, খুচরা ফেরত দেয়া শেখে।
নিশিকান্ত নিরুকে নিয়ে সে মাঝে মাঝে চৈতালি তুলতে যায়। স্বপ্ন দেখে ছেলেকে মাঠের কাজে নামিয়ে দেবে, তাতে কিছু বাড়তি আয় হবে। নিরু বাবার পাশাপাশি ঘোপে বসে ছোলা-মুশুরি-সরিষা তোলে। ফসল তোলা শেষ হলে নিশিকান্ত ছোট ছোট বোঝা তৈরি করে তুলে দেয় নিরুর মাথায়, নিরু মাথায় করে পৌঁছে দিয়ে আসে গেরস্থের বাড়িতে।
হাটের দিন মাঝে মাঝে নিরুও অতুলের সাথে দোকানে যায়। দুজন একসাথে সাহায্য করে দোকানে। সন্ধ্যার আগে অবিনাশ দুজনের হাতে দুই আনা করে পয়সা দেয়। দুজনে বিস্কুট, তিলে খাজা কিম্বা লজেন্স কিনে খেতে খেতে বাড়ি চলে আসে।
নিরু এখন বুঝতে পারে অতুলদের সাথে তাদের অর্থনৈতিক ফারাক। সে বুঝতে পারে অতুলরা ধনী, তারা দরিদ্র।  তার মনে মনে ইচ্ছা, সে হাইস্কুলে পড়বে। কিন্তু চিন্তা হয়, হাইস্কুলে পড়তে হলে টাকার দরকার হয়। প্রাইমারি স্কুলে সেটা লাগতো না। অতুলের বাবা বড়লোক। ওর হাই স্কুলে পড়তে অসুবিধা হবে না। আমার বাবা গরীর, সে হাইস্কুলে পড়ার খরচ যোগাবে কিভাবে।
একদিন মাঠে সরিষা তুলতে তুলতে নিরু বাবাকে বলে, বাবা আমি যদি তোমার সাথে স্কুল বন্ধের কয়েকদিন কাজ করি, তাতে যে টাকা হবে, তা দিয়ে আমার বই কেনা হবে না।
বিস্ফারিত চোখে ছেলের দিকে তাকায় থাকে নিশিকান্ত। তারপর বলে, বই কেনার টাকা হয়তো হবে, কিন্তু হাইস্কুলে পড়ার খরচ বেশি, মাসে মাসে স্কুলের বেতন দিতে হয়। সে টাকা আমি কোথায় পাব।
– আমি যে স্কুলে যেতে চাই বাবা। বাবার দিকে তাকিয়ে আকুতি জানায় নিরু।
নিশিকান্ত হাতের সরিষা মাটিতে ফেলে ছেলেকে বুকের কাছে টেনে নিয়ে বলে, আমরা গরীব মানুষ বাবা। হাইস্কুলে পড়ার জন্য অনেক টাকার দরকার হয়, এতো টাকা কোথায় পাব।
– আচ্ছা বাবা, প্রাইমারি স্কুলের মতো হাই স্কুলে কেন ফ্রিতে পড়া যায় না, হাই স্কুলটা সরকারি হলেতো ফ্রিতে পড়তে পারতাম!
– লেখাপড়া এখনও বড়লোকের জন্য বাবা, গরীবের জন্য না। নিশিকান্ত উত্তরে দেয়।
বাবার উত্তর পেয়ে চুপচাপ সরিষা তোলা শুরু করে নিরু। কিছুক্ষণ পর আবার প্রশ্ন করে, আচ্ছা বাবা স্কুলে মাসে বেতন কতো? যশোদা মা যদি বই কিনে দেয় আর আমি যদি পড়ার ফাঁকে ফাঁকে তোমার সাথে কাজ করি, তাহলে মাসের বেতন দিতে পারবো না?
– এখন স্কুলে বেতন কতো সেটাতো আমি জানিনা বাবা। নিশিকান্ত উত্তর দেয়।
– অতুল হাই স্কুলে ভর্তি হবে আমাকে বলেছে। যশোদা মা নিশ্চয় জানে স্কুলের বেতন কতো। আমি আজকে যশোদা মাকে জিজ্ঞেস করবো।
– ঠিক আছে তুই তোর যশোদা মাকে জিজ্ঞেস করিস। নিশিকান্ত অনুমতি দেয় ছেলেকে।
বাবার কথায় নিরু আশাবাদী হয়ে উঠে। জোড়ে জোড়ে সরিষা তোলা শুরু করে।

Series Navigation<< উপন্যাস।। জীবনে মরণে।। বিশ্বজিৎ বসু।। পর্ব দুই

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *