উপন্যাস

উপন্যাস।। জীবনে মরণে।। বিশ্বজিৎ বসু

রাজধানী ঢাকা থেকে শত মাইল দুরের গ্রাম বিল গৌরীপুর। আমলা তনয়া স্রোতস্বিনী গৌরী তার আপন সৌন্দর্যে বয়ে গেছে এ গ্রামের পাশ দিয়ে। নদীর পূর্ব পাড়ে প্রাচীন কালের গৌরী মন্দির, মন্দিরের সামনে গৌরী মেলার মাঠ। মাঠের অপর পাড়ে বিল গৌরীপুর হাইস্কুল। পাশ দিয়ে জেলা পরিষদের রাস্তা, সোজা চলে গেছে গ্রান্ট ট্রাঙ্ক মহাসড়কে। ‌স্কুলের পিছনেই প্রাচীন কালের বিল গৌরীপুর হাট।
লোকশ্রুতি আছে, প্রাচীনকালে পদ্মা বিধৌত আমলা গ্রামে বাস করতেন এক ব্রাহ্মণ। তাদের ঘরে ছিল এক দাসী, নাম গৌরী। গৌরী ছিল মিষ্টভাষী, পাড়া-পড়শী সকলের সাথে ছিল তার সদ্ভাব। কাজেকর্মে দক্ষতা দেখিয়ে সে জয় করেছিল বাড়ির সকলের মন।যে কারণে ব্রাহ্মণও ছিলেন গৌরীর প্রতি খুশি।
একদিন সকালে ব্রাহ্মণ গঙ্গাস্নানে রওনা হবেন, তখন গৌরী এসে ব্রাহ্মণের দিকে একটি ফুল এগিয়ে ধরে বলল, বাবু ফুলটি আমার নামে গঙ্গায় দিয়ে দিবেন। ব্রাহ্মণ ফুলের দিকে তাকিয়ে মনে মনে ভাবলেন, এ এমন কি আর কাজ! গৌরী আমাদের জন্য এত কিছু করে আর ওর জন্য একটি ফুল গঙ্গায় দিতে পারব না! ব্রাহ্মণ ফুলটি হাতে নিয়ে আঁচলে বাঁধলেন।
বাড়ি থেকে ছয় মাইল দূরে পদ্মায় সেই ঘাট। ব্রাহ্মণ মাঝে মধ্যেই সেখানে যান গঙ্গাস্নান করতে, আবার দিনে দিনেই ফিরে আসেন। ব্রাহ্মণীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে দুর্গা দুর্গা বলে ঘর থকে বের হয়ে ব্রাহ্মণ দেখলেন বেলা একটু বেশীই হয়ে গেছে। মনে মনে ভাবলেন, গঙ্গাস্নান শেষে আবার বেলাবেলি ফিরে আসতে হবে। ভেবেই দ্রুত পায়ে চলা শুরু করলেন ঘাটের দিকে।
কিছুদূর পথ যাবার পর জীবন সংসারের নানা ভাবনা এসে ভর করতে শুরু করে ব্রাহ্মণের মাথায়। সংসারের ভাবনা, জজমানের ভাবনা, গঙ্গা-পদ্মার ভাবনা, স্ত্রী-পুত্র-কন্যার ভাবনা, পাপ পুণ্যের ভাবনা আরো কত কিছু। ভাবতে ভাবতে ব্রাহ্মণ যখন পদ্মার ঘাটে গিয়ে পৌঁছান তখন সূর্য দক্ষিন দিকে হেলে পড়েছে। ঘাটে পৌঁছে ব্রাহ্মণ আবার সে সূর্যর দিকে তাকিয়ে দেখলেনে না সময়মতই পৌঁছতে পেরেছেন। তিনি সেখানে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিলেন; তারপর মহাভক্তি নিয়ে গঙ্গাস্নান করে রওনা দেন বাড়ির দিকে।

অর্ধেক পথ ফিরে আসার পর ব্রাহ্মণের মনে পরে গৌরীর দেয়া ফুলের কথা। তিনি দাঁড়িয়ে পড়েন পথের মাঝে।  কিংকর্তব্যবিমূঢ় ব্রাহ্মণের মনে অনুশোচনা তৈরি হয়, তিনি নিজেকে ধিক্কার দিতে থাকেন; ভুলে গেলাম, আমি ভুলে গেলাম! গৌরী আমাদের জন্য এতকিছু করে, আর তার এইটুকু কাজ আমি করে দিতে পারলাম না, ভুলে গেলাম! তার হয়ে মাত্র একটি ফুল গঙ্গায় দিতে ভুলে গেলাম।
আত্মানুশোচনায় ব্রাহ্মণ আবার ফিরে রওনা দেন পদ্মার দিকে। কিন্তু কয়েক পা হাঁটার পর কি মনে দাঁড়িয়ে পড়েন এবং চারিদিকে তাকাতে থাকেন। এসময় তার চোখে পড়ে গোরুর খুড়াকৃতির একটি গর্ত আর তার মধ্যে একটু জল। ব্রাহ্মণ একটু আশ্চর্যই হলেন, শুকনো খটখটা রাস্তায় গোরুর খুড়ের গর্তে জল! মনে মনে ভাবলেন, কি জানি এ হয়তো মা গঙ্গারই খেলা। তিনি পদ্মায় ফেরার চিন্তা বাদ দিয়ে এই জলেই ফুলটি ভাসাতে ‍সংকল্প করলেন।
ব্রাহ্মণ মহাভক্তি নিয়ে জলের সামনে বসে, ফুলটি হাতে নিয়ে, চোখ বুজে গঙ্গামন্ত্র পড়ে, কপালে ছোঁয়ালেন। এরপর ফুলটি যেমনি জলে দিতে উদ্যত হলেন, অমনি জলের ভিতর থেকে এক মনমৌহিনী আলোকময় নারী মূর্তি বের হয়ে হাত বাড়িয়ে দিল ব্রাহ্মণের দিকে। কিংকর্তব্যবিমূঢ় ব্রাহ্মণ ফুলটি তুলে দেন সেই হাতে। ব্রাহ্মণের হাত থেকে ফুলটি নিয়েই অন্তর্ধান হয়ে গেল সেই মনমোহিনী মুর্তি। ব্রাহ্মণও সংগে সংগে জ্ঞানশুন্য হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন।

জ্ঞান ফিরে এলে ব্রাহ্মণ ছুটলেন বাড়ির দিকে আর চিন্তা করতে লাগলেন, মানুষ সারা জীবন কত ঝাঁপি ঝাঁপি ফুল গঙ্গায় দেয়, কখনও এমন হয়েছে শুনি নাই। আর গৌরীর দেয়া একটি ফুল এতটুকু জলে দিতেই গঙ্গা স্বয়ং আবির্ভূতা হয়ে সেটা গ্রহণ করলেন। এ গৌরী নিশ্চয় কোন সাধারণ মেয়ে নয়; ও স্বয়ং লক্ষী। এতদিন আমার ঘরে দাসী হয়ে আছে, অথচ আমি তাঁকে চিনতে পারি নাই। আজ হতে আমি অবশ্যই গৌরীর পুজা করবো।
ব্রাহ্মণ বাড়িতে এসে দেখলেন গৌরী ঘর ঝাড়ু দিতে ব্যস্ত। তিনি লুটিয়ে পড়েলেন গৌরীর পায়ে আর অনুনয় বিনয় করে বলতে লাগলেন, মা গৌরী তুই আমাকে রক্ষা কর, আমাকে ক্ষমা কর, আমি তোকে চিনতে পারি নাই। তুই সাক্ষাৎ লক্ষ্মী! আজ হতে আমি তোর পূজা করবো মা। আমাকে ক্ষমা কর মা, আমাকে রক্ষা কর।
দাসীর পায়ের উপর ব্রাহ্মণকে এভাবে পড়ে থাকতে দেখে ব্রাহ্মণীতো রেগে আগুন। চিৎকার করে বলে উঠলেন, ছিঃ ছিঃ ছিঃ, কি হচ্ছে এসব! বাড়ির মধ্যে নষ্টামী।
কথায় বলে বড়ির গিন্নীর রাগ ঝাড়ে দাসীর উপর, দাসী তার রাগ ঝাড়ে ঝাঁটার উপর। ব্রাহ্মণকে কিছু না বলে ব্রাহ্মণীরও সব রাগ তখন গিয়ে পড়ে গৌরীর উপর। উগ্রমূর্তি ধারণ করে শুরু করে গালাগাল আর মারধোর শুরু হরে গৌরীকে। গালাগাল আর মারধোরে অতিষ্ঠ হয়ে গৌরী হাতের ঝাড়ু মেঝেতে ছুড়ে ফেলে বের হয়ে যায় বাড়ি থেকে।

বাড়ি থেকে বের হয়ে গৌরী চলা শুরু করে দক্ষিণে। ব্রাহ্মণও বাড়ি থেকে বের হয়ে দৌঁড়াতে শুরু করে গৌরীর পিছে পিছে। গৌরী হাঁটে, ব্রাহ্মণ দৌঁড়ায়, কিন্তু কিছুতেই গৌরীকে ধরতে পারে না। ব্রাহ্মণ চিৎকার করে ডাকতে থাকে; গৌরী থাম, গৌরী মা! থাম। আমি তোর পূজা দেব, তুই থাম। কিন্তু গৌরী থামে না, হাঁটতে থাকে আমলা বিলের পাড় দিয়ে।
হঠাৎ আমলা বিল হতে উঠে আসে একটি জলের ধারা। ধারাটি গৌরীর পদচিহ্ন অনুসরণ করে প্রবাহিত হতে থাকে পিছু পিছু। জলের ধারা দেখে ব্রাহ্মণ কিংকর্তব্যবিমুঢ় হযে পরে। সে আরো জোড়ে চিৎকার করতে থাকে, গৌরী থাম, গৌরী মা! থাম। ‌গৌরী থামে না। জলের ধারাটি ধীরে ধীরে চওড়া হয়ে ব্রাহ্মণ আর গৌরীর মাঝ দিয়ে প্রবাহিত হতে থাকে। এক পাড়ে গৌরী, আরেক পাড়ে ব্রাহ্মণ। এক সময়ে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে, অন্ধকারে দৌঁড়াতে গিয়ে ক্লান্ত ব্রাহ্মণ পা পিছলে পড়ে যায় জলের ধারার পাশে, ফেটে যায় তার মাথার খুলি এবং সেখানেই সে মারা যায়।
দূর থেকে ব্রাহ্মণকে মাটিতে পড়ে যাওয়া দেখে গৌরী একটু থামে। জলের ধারাও তখন সেখানে দাঁড়িয়ে কুন্ডলী পাকাতে থাকে। কুন্ডলীর তোড়ে সেখানে তৈরি হয় একটি জলাধার। কিছুক্ষণ থেমে গৌরী আবার চলা শুরু করে দক্ষিণে। জলের ধারাটি জলাধার থেকে উঠে এসে আবার চলতে থাকে গৌরীর সাথে দক্ষিণে।

গৌরীর নামানুসারে এই জলের ধারার নাম গৌরী নদী। এক সময়ে প্রমত্তা পদ্মা এসে হাত বাড়িয়ে দেয় গৌরীর দিকে। গৌরী হয়ে ওঠে স্রোতস্বিনী, একুল ওকুল ভেঙ্গে গৌরী এগোতে থাকে মহাসুমুদ্রের দিকে। গৌরী চলার পথে যে জলাধার তৈরি হয়েছিল, সেটার নাম হয় মাথা ফাটা বিল। ব্রাহ্মণের মাথা ফাটা থেকেই এই নাম। এখানেই পরবর্তীতে তৈরি হয় গৌরী মন্দির। আর এলাকার নাম হয় বিল গৌরীপুর।
এরপর কতযুগ গিয়ে এসেছে পালযুগ। তারপর সেন যুগ, বাদশাহী যুগ, বৃটিশ যুগ, পাকিস্তান যুগ; এখন বাংলাদেশ। গৌরী নদী আর বিল গৌরীপুরের এই লোককাহিনি শত শত বছর ধরে আজও গৌরী নদীর প্রবাহমান ধারার মতো মানুষের মুখে মুখে প্রবাহমান।
ভরা বর্ষায় মাথা ফাটা বিল আর গৌরী নদীর জল যখন মিলে মিশে একাকার হয়ে যায়, তখন বিল গৌরীপুরকে মনে হয় সুমুদ্রের বুকে ভেসে থাকা একখানা ছোট দ্বীপ। কামার, কুমার, জেলে, তাঁতি, তেলি, মালি, কৃষক, বৈদ্য, বণিক, ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় মিলে গৌরিীপুরকে পরিণত করেছিল একটি স্বয়ং স্ম্পূর্ণ গ্রামে, পরিণত হয়েছিল লক্ষ্মীর ভান্ডারে। লোকে বলতো গৌরী স্বয়ং নিজ হাতে গড়ে তুলেছে গ্রামটিকে। গৌরীপুরের নাম ছড়িয়ে পড়েছিল চতুর্দিকে, হয়ে উঠেছিল এতদ অঞ্চলের বড় ব্যবস্যা কেন্দ্র। এখানে উৎপাদিত পণ্য নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে রপ্তানী হতো সারা দেশে। সোম আর শুক্রবার হাটের দিন পণ্য নিয়ে হাজির হতো আশেপাশের বিশ গ্রামের মানুষ। গঙ্গা, পদ্মা, গড়াই, মধুমতি দিয়ে বড় বড় ঘাসি নৌকায় চড়ে মহাজনেরা আসতো গৌরীর ঘাটে। বোঝাই করে কিনে নিয়ে যেত ধান, গম, পাট, তিল, তিসিসহ নানা ধরনের পণ্য।

বছরের লক্ষী পূর্ণিমার দিন হতে ‌এখানে শুরু হতো গৌরী মেলা, আর শেষ হতো রাস পূর্ণিমায়। দুর দুরান্তের মানুষ পসার নিয়ে হাজির হতো এ মেলায়। কৃষ্ণনগরের পুতুল, রংপুরের সতরঞ্জী, সাতৈরের শীতল পাটি, ঢাকার জামদানি, টাঙ্গাইলের তাঁত, ধামরাইয়ের কাঁসা, কিনা পাওয়া যেত এ মেলায়। দূর-দূরান্ত থেকে সুত্রধরেরা নৌকা বোঝাই করে নিয়ে আসতো খাট-পালঙ্ক-আলমারী। মাস ভরে চলতো যাত্রা আর কবি গানের আসর।
জীবনযাত্রার পরিবর্তনের সাথে সাথে গৌরীপুর এখন অনেক বদলে গেছে। সহস্র বছরের নানা রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের সাথে সাথে পাল্টে গেছে এখানকার জনমিতি। গৌরীর বুকে এখন বড়বড় বালির স্তূপ। সেখানে এখন ঘাসি নৌকার দেখা মেলা ভার। মেলার মাঠের অপর পাড়ে তৈরি হয়েছে হাই স্কুল। হাটের পাশাপাশি প্রতিদিন সকাল বিকাল বসে বাজার, সারাদিন থাকে মানুষের কোলাহল। দুর-দুরান্তের মানুষ এই বাজার হয়েই যাতায়াত করে জেলা সদর কিম্বা রাজধানীর দিকে।
তবে পুরানো দিনের সেই ঐতিহ্য বহন করে লক্ষ্মীপুজায় এখনও মেলা বসে, চলে সপ্তাহব্যাপী। গৌরী মন্দিরের পাশে অস্থায়ী মন্দিরে প্রতি বছর অনুষ্ঠিত হয় দূর্গা পুজা। পুজা উপলক্ষে এখনও মাঝে মাঝে আয়োজন হয় সৌখিন যাত্রা পালার।

Series Navigationউপন্যাস।। জীবনে মরণে।। বিশ্বজিৎ বসু।। পর্ব দুই >>

One thought on “উপন্যাস।। জীবনে মরণে।। বিশ্বজিৎ বসু

  • Harish Rudra

    চমৎকার লিখা।

    Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *