ঈদসংখ্যার ছোটগল্প অসমান্তরাল-হামীম কামরুল হক
সকালে উঠেই খুদের ভাত আর একটা ডিম ভাজা হলে ইরতিজার আর কিছু চাই না। লোভারও সারাদিন খাওয়াদাওয়া নিয়ে কোনো আদিখ্যেতাও নেই। ও রান্নাবান্নায় খুব ভালো নয়। বান্ধা কাজের বুয়া আছে। তার রান্নাও ভালো, পরিষ্কারপরিচ্ছন্নতাও ভালো। অবশ্য এর জন্য বাড়ির একটা ফস্ন্যাটে বলতে গেলে বুয়ার ও তার ছেলের জন্য ছেড়ে দিয়েছে। মাসে ভালো বেতন দেওয়া হয়। আর তারা যা খায়, ওরাও তা—ই পায়।
দেশে লোভা এখন এক বাপের এক কন্যা। বড় বোন শোভা অস্ট্রেলিয়া চলে গেছে । ইরতিজা খুব ফন্দি করে বিয়েটা করেছে, তাও নয়। দুয়ে দুয়ে চার মিলে গেছে বলেই হলো। সে ছেলে ভালো। বড় বেতনের চাকরি করে। দেশবিদেশে যাওয়া আসা আছে, কিন্তু স্বভাবে এক ফোঁটা কালি নাই। ঘটক যখন বলেছিল, শুনেই ইরতিজা মনে মনে এক চোট হেসে নিয়েছিল।
তবুও ইরতিজা যথেষ্ট ভরসা করার মতোই মানুষ। অন্তত এখন নিজেকেও সে এমনটাই ভাবতে চায়। ছয়তলা বাড়ির দোতলাসহ, আপাতত মেয়ে ও মেয়ের জামাই পেয়ে গেছে। শ্বশুর অবসর নেওয়ার একদম গ্রামের বাড়িতে। সেখানে চারদিক ঘিরে বাগান। বাড়ির পেছনে পুকুর। তাদের দেখা শোনার জন্য দুটো পরিবার তাদের সঙ্গেই থাকে। শহরের বাড়ি মেয়েদের নামে দিয়ে তিনি, বিরাট এক গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রির জেনারেল ম্যানেজারের জীবন কাটিয়ে বড় অংকের ব্যাংক ব্যালেন্স করেছেন। হজম শক্তি ভালো। রাতে দারুণ ঘুম হয়। টাকা, ভালো হজম আর ঘুম─ এই তিনটা বাকি জীবনে ভালোমতো কাজে লাগাতেই বলে তার গ্রামে যাওয়া।
শোভা ও তার বর ছেলেমেয়েদের জন্যও আসলে দোতলাটা থাকে। একটা ঘর বুয়া ও তার ছেলের জন্য।
সন্ধ্যায় লোভাকে এক কাপ চা বানাতে পারো,─ বলেই তার মনে হলো লোভাকে বলা ও না—বলা এক।
লোভা বলে, আজ হঠাৎ চা!
ইচ্ছা করছে।
ইরতিজার কোনো নেশা নেই। কোনো ড্রাগের তো প্রশ্নই ওঠে না, মদ—সিগারেটও দূরের কথা, সে চা পর্যন্ত খায় না।
লোকজনের কত রকমের নেশা থাকে। কেউ বই পড়ে, কেউ ঘুরে বেড়াতে ভালোবাসে, কেউ পর্নো দেখে; আর যাই হোক ফেসবুক হোয়াসঅ্যাপ ইনস্টাগ্রাম বা মেবাইলে কত কিছু যে থাকে, তার একটা নিয়ে মেতে থাকারও কোনো ব্যাপারাদি ইরতিজার নেই। ফেসবুকে এখন কোনো একাউন্ট পর্যন্ত নেই।
লোভা মাঝে মাঝেই বলে, তোমার সঙ্গে মিশে মিশে আমিও তোমার মতো হয়ে গেছি। আচ্ছা, নেশা ছাড়া কোনো মানুষ হয়? তুমি সত্যি করে বলোতো তোমার গোপন কোনো নেশা নেই?
ইরতিজা মাথা খুবই শান্তভাবে ডানে বামে নাড়ায়।
কোনো নেশা নেই?
ইরতিজার মুখে হাসির হালকা ঢেউয়ে খুশির নৌকার ভাসছে।
লোভা বা লাভলি আক্তার লোভার বোন বিউটি আক্তার শোভার আনা সম্বন্ধে ওদের বিয়েটা হয়েছিল বছর সাতেক আগে। সংসারে তেমন কোনো ঝামেলা নেই।
ইরতিজাকে মাঝে মাঝেই লোভা বলে, আমাদের সংসারটা খুব পানসে, তাই না!
কেন?
কেন, আবার! তুমি তো ঝগড়াও করতে পারো না। কোনো চ্যাত নাই, ভ্যাত নাই! ধ্যাত! বলে লোভা যেন রাজ্যের বিরক্তি নিয়ে উঠে যায়।
আরেকদিন বলে, আমাদের সংসারে সবচেয়ে বড় সমস্যা কী জানো?
কী?
আমাদের সংসারে কোনো সমস্যাই নেই।
তোমার কি সমস্যার খুব দরকার?
লোভা ছোট্ট করে কিন্তু দ্রুত গতিতে ওপরে—নিচে থুতনি নাচায়।
বাইরে থেকে জলের মতো সহজ মনে হলেও, ইরতিজা মাহমুদ আসলে তত সহজ মানুষ নয়। আগে তো একেবারেই ছিল। এখন যে, সহজ মানুষের ভান ধরে আছে, তাও বলা যাবে না।
যদিও লোভা কেন, তারও আগে ইরতিজা বেশ কয়েকজনের মুখে শুনেছিল─ সে কেমন? সে হলো: রাস্তায় কোনো লোকের যদি কোনো কিছু জানতে হয়, আর এক পাল লোক যদি সামনে পড়ে, আর তার ভেতরে যদি ইরতিজা থাকে, তবে ওই লোকটা সবার আগে, তার কাছেই কিছু জানার জন্য এগিয়ে আসবে।─ একদিকে তারা এটা ঠিকই বলে। ইরতিজার মুখে সাদাসিধা লোকের একটা ভাবতো আছেই; আর যেহেতু চশমা পরতে হয়, তো চশমা এই ভাবটা আরো বাড়িয়ে দেয়।
ইরতিজার জীবনের কয়েকটা প্রশ্ন সুতপাকে ঘিরে ভাঙে—গড়ে। আসলে সে কী চেয়েছিল? নিজের দুটো গোপন সম্পর্কের জ্বালা যন্ত্রণার কথা ভাগাভাগি করতেই কি ইরতিজাকে তার দরকার হয়েছিল? সে কি সুতপার প্রেমে পড়ে যায়নি?
সুতপা আরেকটু হলে সমস্যায় ফেলে দিত কিনা কে জানে! এসব তো আর লোভাকে বলা যায় না। তছাড়া লোভার সঙ্গে এই প্রসঙ্গে আলাপ ওঠারও কোনো কারণও নেই। লোভা যদিও বহুবার জানেত চেয়েছে, সে জীবনে কটা প্রেম করেছে? আসলেই কি বিয়ের আগে সে কিছু করেনি! তাহলে এত কায়দাকানুন কোথা থেকে সে শিখল! পর্নো দেখে না বই পড়ে?
সুতপার সময়টায় ইরতিজা পাগলের মতো বুঝতে চেষ্টা করছিল─ সুতপার টান থেকে সে সরে আসতে পারছে না কেন? যদিও সুতপা বলেছিল, সে ইরতিজাকে খুব ভালো বন্ধু মনে করে। কিন্তু কোনোভাবেই তার সঙ্গে প্রেম বা শরীরী ঘনিষ্টতায় জড়াতে পারে না। একদিন তো সরসারি বলে: তোমার সঙ্গে আর যাই হোক সেক্স করার কথা আমি কল্পনাও করি না।
এখন ইরতিজাও বোঝে বিষয়টা আসলে তার জন্য অল্প দিনেরই ছিল। সাময়িক সমস্যা যাকে বলে। তবু সেই অল্প কটা দিনে সুতপার জন্য ইরতিজা বিধ্বংসী টান বোধ করেছিল। নিশ্চয়ই সুতপার সঙ্গে যেকয়েকটা ঘটনা, অতি সামান্য হলোও ঘটেছিল, সেগুলি ভুলে যাওয়ার মতো নয়। মেদেমাংসে ভরা, থলথলে শরীরের, বাল্কি ধরনের সুতপাকে এত চাইত কেন?
একদিন অফিস শেষ হলে তাকে সুতপা একটা চায়ের দোকানে নিয়ে যায়। তার বরটা মোটা একটা লোক। অফিসে আগের একটা লোক, ডাক নাম শিখু, ভালো নাম শিহাবুদ্দিন মণ্ডল তার সঙ্গে একটা দলের সঙ্গে ভারতে বেড়াতে গিয়ে আলাদা কেবিন নিয়ে জার্নির টানা দুইদিন লেপ্টেলটকে ছিল।─ এই দুয়ের কোনোজনই শেষ অব্দি তাকে সুখী করতে পারেনি। আচ্ছা আমি কি নিমফো একটা?─ চা—বার নামের দোকানে সেদিন আলাপ করতে করতে, অবলীলায় নিজের যৌনজীবনের ব্যর্থতার কথা বলছিল সে। আর সেসময় টেবিলের তলা দিয়ে বার বার সুতপা ইরতিজার পায়ে তার পায়ের বুড়ো আঙুলের ডগা দিয়ে অদৃশ্য সরল ও অসরল রেখায়, মানে আঁকাবাঁকা ছোট ছোট ঢেউ খেলানো রেখায় টানছিল। ইরতিজাও অভাবিত এই কাজের একইভাবে প্রত্যুত্তর দিয়েছিল। পায়ে পায়ে পালা করে অনেকক্ষণ চলেছিল সেই খেলা।
জীবনে কোনোদিন টেবিলের তলা দিয়ে এমন কাহিনি তার হতে পারে, সে কল্পনাও করেনি। আরো আশ্চর্যের যে সে তখনও একা থাকত। বিয়ে করেনি। লাভলি আক্তারের সঙ্গে দেখা হয়েছিল এরও তিন চার বছর পর।
সেই বিকালে, চা—বারে, পাশে বসে থাকা আরেকটি জুটির নারীটিকে দেখেই ইরতিজা চিনতে পারে। সাদাশাড়ি, গলায়—কানে মাটির গয়না। কপালে বড় লাল টিপ। পা থেকে মাথা অব্দি পরিপাটি সৌম্য সাজ। একটু চৌকোমতো ভারী মুখটা কী মায়া!
অনেক আগে দুই শিল্পী, এদের একজন মঞ্চ ও টিভি অভিনেত্রী, আর অন্যজন একজন পেইন্টার। দম্পতির যুগল জীবন নিয়ে একটা প্রতিবেদনের জন্য সে আসিফ ফয়সলের সঙ্গে ওঁদের বাসায় গিয়েছিল। ওই সময়ের ইরতিজা ‘প্রজ্জ্বল বাংলাদেশে’ কাজ করত। অফিসের একটা নিউজলেটার ছিল। আসিফ ফয়সল ছিল এর প্রধান প্রতিবেদক। যেমাত্র শুনে মঞ্জুরেখা মিত্র ও তরুণ মিত্রের কাছে যেতে হবে। সে ইরতিজাকে খরব দেয়। খবর দেওয়ার কয়েকটা কারণও আছে। এক, ইরতিজার নিজের গাড়ি আছে। সেই গাড়ি করে লালমাটিয়া থেকে টিকাটুলিতে যাওয়া আসার কাজটা সহজ হবে। দুই, ইরতিজা তখনও মঞ্জুরেখার বিরাট ভক্ত। টিভিতে যেদিন মঞ্জুরেখা মিত্রের নাটক, সেদিন আর কোনো কথা নেই। শত কাজে মত ব্যস্ততায় সে ওই নাটক দেখে ছাড়বে। অনেকদিন মঞ্জুরেখার হট ছবি খুঁজেছে, পায়নি। অথচ কী গড়ন, কী আবেদনই না ছিল মঞ্জুরেখার! তখন কে জানত, আজ সেইসব নাটক প্রায় কমবেশি সব ইউটিউবে পাওয়া যাবে। তো ওই মঞ্জুরেখাকে সামনাসামনি দেখার জন্য সেও প্রতিবেদকের সঙ্গে চলে যায়। ঘণ্টা দেড়েকের মতো সাক্ষাৎকার চলে। পানপাতার মতো ঢলঢল কী লাবণ্যময় মুখটা, এত কাছ থেকে দেখা, মঞ্জুরেখার। বার বার তার ব্লাউজ উপচে পড়া বিপুল স্তন, আর তার গভীর গিরিখাত, ততধিক গভীর নাভীর দিকে চোখ চলে গেলেও নিজেকে সামাল দিয়েছিল ইরতিজা।
মঞ্জুরেখা টিভির চেয়ে সামনাসামনি বরং আরো সুন্দর। বিশেষ করে মুখটা─ কিশোরীর মতো! এমন সুন্দর সৌম্য মুখ দেখলে মন পবিত্র হয়। যদিও মঞ্জুরেখার গড়নগঠন সবমিলিয়ে খুবই আবেদনময়ী─ সোজা কথায় সেক্সি। ওমন মুখের সঙ্গে, এমন শরীর─ ঠিক যায় না, খাপ খায় না; আর তা—ই ঝামেলা পাঁকিয়ে দেয়। এজন্যই বোধ হয়, ইরতিজার এত প্রিয় ছিল। মুখ ও শরীরের দারুণ বেতাল, এই কনট্রাস্ট, বিপুল বৈপরীত্যটা।
লোভা মঞ্জুরেখার মতো তত ঢলঢল সুন্দর না হলেও বেশ একটা নদগদে ঢলোঢলো ব্যাপার আছে। মানুষের শরীর এত নরম কোমল হয়! লোভাকে না পেলে ইরতিজার জানা হতো না।
মঞ্জুরেখা ও তরুণ─ স্বামীস্ত্রী দুজনেই বার বার একজন চিত্রশিল্পীর নাম বলছিলেন, যার জন্যই তারা আজ চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় এসে প্রতিষ্ঠিত হতে পেরেছে। সেই চিত্রশিল্পীর মেয়েই হলো ওই টিভি অভিনেত্রী, যাকে সুতপার সঙ্গে চা—বারে দেখামাত্র সে চিনেছিল।
সে ও সুতপা ঢোকার অল্পক্ষণ পরেই ওই টিভি অভিনেত্রী সঙ্গের পুরুষলোকটি বেরিয়ে যায়। এরও প্রায় দশ বছর পর, প্রায় আড়ালে চলে যাওয়া অভিনেত্রীর আত্মহত্যার খবরে পত্রপত্রিকা, ফেসবুক, ইউটিউব কয়েকদিন মেতে ওঠে। নেটিজানদের নতুন করে ওই অভিনেত্রী সম্পর্কে আগ্রহ বাড়ে। সেই থেকে বেরিয়ে আসে তার অজানা জীবনের আরো আরো গোপন তথ্য। বিচিত্র পুরুষের স্বাদনেওয়া, বিচিত্রসব নেশার জন্যই কোনো মিডিয়ায় সে আর টিকতে পারেনি। একটার পর একটা বিয়ে ও বিচ্ছেদ। বাবার বিপুল সম্পত্তির জন্য কোনো কিছুর অভাব ছিল। কাউকে পাত্তা দিত না ওই অভিনেত্রী।
ইরতিজা অবশ্য এখন অনেকদিন ধরে কোনো সামাজিকযোগাযোগ মাধ্যমে নেই। কোনো রিউমারে গুজব রটনা ঘটনা নিয়ে আগেও তার খুব আগ্রহ ছিল না।
লোভা হরদম তার ফেসবুক পেইজে দুজনের ছবি দেয়। ইরতিজাকে কোথায় জোর করে ধরে নিয়ে গেলে তবে সে বেড়াতে যায়। আবার সে ঘরকুনো তাও বলা যায় না। অফিসের জন্য নানান দেশে তাকে কাজের কাজে যেতেই হয়। এখন সে একটা সংস্থার প্রধান গবেষণা কর্মকর্তা বলে এটা আরো বেড়েছে।
তুমি আসলে কী বলো তো?
কী মানে?
বুঝি না।
কী বোঝো না।
এই যে, না ঘরকুনো বা ভবঘুরে─ কোনোটাই তো নও।
আমি সংসারী মানুষ।
তারও বা প্রমাণ কী?
কী রকম প্রমাণ চাও?
লোভা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে ইরতিজার একটা বাহু জড়িয়ে ধরে। গলায় আহ্লাদ এনে বলে, এ্যাই চলো না, আমরা ডাক্তারের কাছে যাই।
ডাক্তারের কাছে কেন?
ওমা আমাদের বাবু লাগবে না! সাত বছর তো অনেক মজা লুটলে!
ওওওও!
ইরতিজা যেন খুব মজার কথা শুনলো। ‘ও তাই বলো, এটা কোনো ব্যাপার’ কথাটা সংক্ষেপে ‘ও’ শব্দটা টেনে দিয়ে সারল।
চলো, তোমাকে বাবু দিয়ে দিই।
এই দিনের বেলা!
কেন দিনের বেলা বাবু দেওয়া নিষেধ!
ধুরো ঘোড়ার ডিম! বলেই লোভা একটা ঝমটা দিয়ে চলে যায়।
ইরতিজা খুবই হালকা হেসে রিসার্চ পেপারটা উল্টে যেতে থাকে।
আজ ছুটির দিন। সকাল থেকেই পেপারটা দেখছে। অফিসের গবেষণা—বিভাগের দায়িত্বে দিনে দিনে নিজেকে প্রমাণ করেছে ইরতিজা।
গবেষণার বিষয়গুলি খুঁটিয়ে দেখার জন্য, ইরতিজার শান্ত পক্ষপাতিত্বহীন মন, সবখানেই এত নির্লিপ্ত হয়ে এল কি না ইরতিজা জানে না। শহরে ক্রমবর্ধমান বিচ্ছেদ ও তালাকের মামলা নিয়ে ওদের দপ্তর তিনটি তিন ধরনের গবেষণার কাজ জমা পড়েছে। গ্রামে তালাকের সংখ্যা বলে শহরের চেয়ে বেশি! এটা হলো আরো চমকপ্রদ ফাইন্ডিংস।
ইরতিজার একান্ত বাধ্য না হলে অফিসের কাজ বাসায় নিয়ে আসে না। আর বাসার চিন্তা একদমও অফিসে করে না।
তিনটা রিসার্চ আর্টিকেলেই স্বামী—স্ত্রী বিচিত্র সম্পর্কের কেসস্টাডি দেওয়া─ প্রত্যেকটাই আরব্যরজনীর গল্পের মতো টানটান। পরকীয়া তো আছে। ধর্ষণ, খুন, মাদক, নিষিদ্ধ ব্যবসা─ কোনো কিছু বাকি নেই। এর ভেতরে পরকীয়ার কেস পড়তে পড়তে ইরতিজা নড়ে চড়ে ওঠে।
লোভার মতো কানায় কানায় ভরা শরীরের মেয়ে দেখেই ওর এক ঘনিষ্ট বড় ভাই বলেছিল, এই বৌ ঘরে রেখে তুই কি আসলে শান্তিমতো অফিস করতে পারিস?
অশান্তিটা কী নিয়ে থাকবে?
কেন বুঝিস না! আহা এমনও তো হতে পারে, তুই স্বামী হিসেবে ভালো, আর কেউ সময়কাটানোর লোক হিসেবে তোর চেয়ে ভালো। হতে পারে না?
তা পারে।
তখন?
তখন কী!
পরকীয়া।
হোক।
মেনে নিবি?
ধরা না পড়লে সবাই সাধু।
বৌ পরকীয়া করবে? করলে করবে। টের পেলে বলব, আমাকে বাদ দাও। যাকে ভালো লাগে, তার সঙ্গে যাও। এবং… আচ্ছামতো শোও। পরের কথাটা, চ—বগীর্য় শব্দে, হঠাৎ মুখপিছলে বেরিয়ে এসেছিল।
এটা বলেই ইরতিজার হঠাৎ সুতপা, নাজরিনা, তামান্না, বেলোরা, বেণুকার কথা মনে হলো। সে কতটা সাধু ছিল? সুতপার সঙ্গটাই সবচেয়ে বেশি চেয়েছিল বলেই হয়ত একেবারেই পায়নি। নাজরিনা তার জন্য পাগল ছিল, সেই বুঝেও বুঝেনি। বেলোরা শুরু থেকেই খালি গায়ে ঢলত। আর বেণুকার সঙ্গে সব কিছু শেষ হওয়ার পরও বেণুকা বলেছিল, ‘তোমাকে অনেক ভালোবাসি বলেই তোমাকে বিয়ে করব না।’─ এর পরের কথাটাও বলেছিল কোনো রকম না থেমে।─ ‘আমার একটা সম্বন্ধ এসেছে। আমি রাজি হলেই কানাডা চলে যেতে হবে।’
সেদিনই ইরতিজা প্রথম টের পেয়েছিল, তার কিছুতেই কিছু আসে যায় না। জগতে যেকোনো সময়, যেকোনো কিছু ঘটতে পারে, যেকারো সঙ্গে, যেকোনো স্থানে। বেণুকার কথায় সে কেবল শান্তমতো চোখ তুলে তাকায়। বেণুকা ইরতিজাকে এত শান্ত দেখে নিজেও বলেনি─ ‘তোমার খারাপ লাগছে না? তাহলে তুমি তো আমাকে ভালোবাসো নি!’─ এসব না বলে, একটু সময়ের জন্য ওপর প্রতিক্রিয়া দেখেই বলে, আমি জানি তুমি বিষয়টা সহজভাবে নেবে। আমাদের ভেতরে তো কোনোকিছুই বাকি নেই। অনেক মজা করেছি আমরা। মজার কোনো কিছুই বাকি রাখিনি। বাকি কেবল বিয়েটা করে, বাচ্চাকাচ্চা বা সংসারের খুঁটিনাটি নিয়ে ঝগড়াবিবাদটা, হয়ত হতো! অবশ্য তুমি যে মানুষ, তোমার তো কোনো কিছুতেই কিছু আসে যায় না।
্ইরতিজার একবার কেবল মনে হয়েছিল, বেলোরাই বোধহয়, সে কেমন সেটা সবচেয়ে অল্পকথা বলেছিল। বলেছিল, তুমি হলে: ‘‘জীবনে যা—ই ঘটুক/ বলবেন, ও আচ্ছা।’’ ─এই ধরনের লোক, ঠিক বলিনি? কিন্তু বলেনি, এটা কদিন আগে বেলোরা ওর বান্ধবীর বাসার বসার ঘরে, টিটেবিলের তলায় থাকা এক গাদা বইয়ের ভেতরে ‘গন্দমফুল’ নামের কবিতার বই থেকে পড়েছিল।
বইটি পড়ে সে বেশ উত্তেজিত ছিল। তার উত্তেজনা দেখে বান্ধবী বলে, কীরে ইরতিজার কাছে যাবি নাকি! এমন ছটফট করছিস!
আরে না।
সঙ্গে সঙ্গে বলতে পারেনি, ইরতিজা কেমন?─ এত দিনে সে আসলে ধরতে পারল। আর সেই জন্য ভেতরে বাইরে টগবগ করে ওঠাটা লুকাতে পারছে না।
তাহলে?
বেলোরা বইটা তুলে ধরে বলে, এটা পড়ে শেষ করলাম।
ওনার তো খুব নাম এখন। তিনি এসময়ের সবচেয়ে আলোচিত, পঠিত কবি। বিপুল জনপ্রিয়ও বলা যায় ওনাকে। তো তোর এত উত্তেজনার কারণ?
কয়েকদিন পর আবারও বান্ধবীর বাসায় গিয়ে বইটা আরেক দফা পড়ে। লেখাগুলি পড়তে পড়তে এই যে এটা,─ বেলোরা নয় নম্বর পৃষ্ঠাটা ওই লেখাটার ওপরে আঙুল রেখে বলে, এত দিনে ইরতিজা কী আমি বুঝলাম।
ওই পৃষ্ঠায় আরো একটা কথা, তার ভালো লেগেছিল: ‘‘আলো শুধু পথ দেখায় না, / কোথাও যে পথ নাই, তা—ও দেখায়।’
এটা নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ কথা বলে ওর বান্ধবী।
এ কথাটা কিন্তু ধাঁধার মতো। ‘কোথাও’ না কি ‘কোথায়’ বা ‘কোথায় কোথায়’, তারপর ‘যে’─ এটা এটাকে দারুণ মোঁচড় এনে দিয়েছে। তাহলে কি কোথাও পথ নেই? বা কোন কোন রাস্তা দিয়ে আমি যাাবো না─ সেটাই আলো ফেলে দেখে নেওয়া যায়?
এসব নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ কথা হয়েছিল। এর কদিন পরেই ইরতিজার সঙ্গে সময় কাটিয়ে বেলোরা কথাটা বলেছিল।
বেলোরা আগে একবার বিয়ে করেছিল। তখন ওর ‘সিঙ্গেল মাদারে’র জীবন। বলেছিল, বিয়ে করতে ভয় পায় না, কিন্তু ভরসা হয় না। যদিও সংসার ভয় দিয়ে গড়া যায় না। ভরসা ছাড়া সংসার হয় না।
ইরতিজার সঙ্গে ওর আলাপ হওয়ার কোনো কারণও ছিল না। বেলোরা ব্যাংকে চাকরি করত। ক্যাশে বসত। তাও মিরপুর পল্লবীর ওই ব্যাংকের শাখায়। বড় অংকের একটা চেক ভাঙানোর ঝামেলার জন্য ইরতিজাকে সেখানে যেতে হয়েছিল।
যে—মিরপুরে দশ বছরেও একবার যাওয়া পড়ে না মালিবাগে থাকা ইরতিজার, বেলোরার জন্য কত বিকাল সন্ধ্যা, ছুটির দিন সে মিরপুরে গেছে─তার কোনো হিসাব ছিল না। বেলোরা স্বামী লোকটা খুব ঝামেলার ছিল। আসলে পুরুষ মানেই ঝামেলার। কেবল এই এক পিস দেখলাম তোমাকে।─ তার মতে, ইরতিজা সাত চড়ে রা করে না, কিন্তু পুরুষালি তেজটা সবসময় তার একশোর ওপরে দুশোতে থাকে। ফুঁসে উঠলে ভয়াবহ হয়। তবে সবই তলে তলে। কোনোভাবেই সেটি বাইরে দেখায় না। সেদিনও সবেমাত্র লণ্ডভণ্ড করা একটা সময় কাটিয়ে আবার এই কথা শুনেই সঙ্গে সঙ্গে আবার তার বাঘের খাঁচা ফুলে উঠছিল।─হায়, আমি প্রতিক্রিয়া দেখাই না বলে, এটাই হলো আমার জীবনসার? তাহলে শরীরে এত প্রতিক্রিয়া কেন! বেলোরার কথাটা ইরতিজার মনে প্রতিধ্বনি হয়ে বাজতে থাকে।
আজ অনেক দিন পর তুমি আসলে কী ও কেমন, তোমাকে বুঝতে পারি না─ এসব কথা শুনে বেলোরার সঙ্গে কাটানো দিনগুলে মনের ভেতরে বার বার ফিরে ফিরে আসছিল।
জীবনে কত কিছু ঘটে, এসময় যার কথা এক মুহূর্তের জন্য ভুলে থাকা সম্ভব ছিল না, এখন তার কথা ভুলেও এক মুহূর্তের জন্যও মনে পড়ে না।
বেলোরাকে সে সুখী করেছিল, পূর্ণতা দিয়েছিল। হয়ত সে বেলোরাকে প্রস্তাব দিলে আজকে লোভা নয়, বেলোরাই চায়ের কথা বলত। কিন্তু এত বড় একটা ছেলের মাকে বিয়ে করাটা ঝুঁকি পূর্ণ। সে জেনেছিল, মেয়েরা মায়ের বিয়ে মেনে নেয়। আর ছেলেরা বাপের বিয়ে। কিন্তু ছেলেরা মায়ের বিয়ে মানতে পারে না। মেয়েরা বাপের বিয়ে মানতে পারে না।─ এসব ‘কথায় বলে’ কথাগুলিই কি ইরতিজাকে বেলোরার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে দেয় নি?
ইরতিজা বেলোরাকেই বলেছিল, নারী নরকের দ্বার নয়, নরই নরকের দ্বার। না—রী, ন—র। পরেরটা সঙ্গেই ‘ক’ দিলেই ‘নরক’। তাই না? নারী হলো বারি, বারিধারা, বৃষ্টি, আর শান্তি, শান্তির দ্বার। আর নিজে এখন টের পায়: নারী হলো নির্লিপ্ততার দ্বার। প্রচুর না হলেও, চারপাঁচটি নারীর নিবিড় সঙ্গ বা গভীর প্রেম, যেকোনো পুরুষকে এই জীবনটা সহজভাবে নিতে দারুণ সাহায্য করে। শান্তি ও নির্লিপ্ততা অর্জন করার জন্য হয় নারী, বা নারী সম্পর্কে শান্ত ও নির্লিপ্ত থাকাই আসলে শান্তি ও নির্লিপ্ততা পাওয়ার পথ।
আচ্ছা, নারীর দিক থেকেও কি পুরুষ এমন? মানে পুরুষের সম্পর্কে নির্লির্প্ত হওয়াই নারীর শান্ত জীবন পাওয়ার পথ? নারী ছাড়া পুরুষের চলে না, কিন্তু পুরুষ ছাড়াও নারী, দিব্যি চালিয়ে নিতে পারে তার জীবন।─ বেলোরার সঙ্গে এসব নিয়ে আলাপআড্ডা হয়েছে কত। জীবনে কোনো চড়াই উৎরাই থাকবে না─ এটা হতে পারে? সুখের সঙ্গে জীবন কখনোই সমান্তরালে যায় না।
বেলোরা খুব কথা বলতে ও আদর পেতে পছন্দ করত। বলত, আমার অভাব একটাই: কথা বলার ও আদর করার মানুষের। একটা তেমন মানুষের অভাবেই মনে হয় আমার জীবনটা শেষ হয়ে যাবে।
কেন আমি?
তুমি তো এখন। সারাজীবন তো আর থাকবে না। বলে, বেলোরা বিষণ্ণ হাসত।
বেলোরা অদ্ভুতভাবে চা একদম পছন্দ করত না। সুতপা ছিল চায়ের পাগল। কোথায় ভালো চা পাওয়া যায়─ নখের আয়নার দেখার ক্ষমতা ছিল। অনেক অনেক দিন পর ইরতিজার চা—বারের কথা মনে পড়ে। পাশের টেবিল থেকে তাদের চা—পর্ব শেষ হলে, সুতপা—ইরতিজা সেখানে ঢোকার কিছুক্ষণ পর উঠে চলে যাওয়া শাদাশাড়ি, মাটির গয়নাপরা অভিনেত্রীর কথা মনে পড়ে। তার আত্মহত্যার খবর মনে পড়ে। আর গবেষণার কাজগুলি দেখতে দেখতে বহু বহু দিন পর সন্ধ্যার শুরুতে ইরতিজার এক কাপ চা পেতে ইচ্ছা করে। কিন্তু সুতপা একেবারেই ভালো চা বানায় না। আর এখন কোথায় ভালো চা হয়, ইরতিজা একেবারেই জানে না। ফলে সে লোভাকে বলে, চা বানাই। তুমি খাবে?
চাপাতা তো নাই!
দুধ আছে?
তখন লোভা মাথাটা বুকের দিকে নামিয়ে, একবার ডান, আরেকবার বাম করে। করেই ইরতিজার দিকে তাকিয়ে দুই ভ্রম্ন উঁচিয়ে ইঙ্গিত করে।
ইরতিজা সঙ্গে সঙ্গে বলে, কী দুষ্টুরে বাবা!
দুজনে একসঙ্গে অনেক জোরে হেসে উঠে।
দুনিয়টাকে নিমেষে খুবই মজার ও সুখের জায়গা বলে মনে হয়। এখানে বেশিক্ষণ নির্লিপ্ততা ধরে রাখা যায় না। সে কি লোভাকে নিয়ে বা লোভা তাকে নিয়ে পুরোপুরি সুখী─ এই প্রশ্নটাও তখন ভুলে জেগে ওঠে না।