ঈদসংখ্যার ছোটগল্প আলো-আঁধারির খেলাঘর- জাকিয়া শিমু

আলো-আঁধারির খেলাঘর’ – জাকিয়া শিমু

সেন্ট অগাস্টিন, উত্তর আমেরিকার প্রাচীন এবং ইতিহাস প্রসিদ্ধ শহরে বন্ধুদের সাথে বেড়াতে এসেছি। নতুন স্থানে বেড়াতে গেলে যা হয় আর কী, কৌতূহলের সীমা ছুটে যায় আকাশ ফুঁড়ে। বয়সের হিসেবপত্তর, সময়জ্ঞান সমস্ত কিছু তাচ্ছিল্যের শিকেয় তুলে অযথা ছুটোছুটি, হৈ-হুল্লোর। শহরের এমুড়া-ওমুড়া, কোণাকাঞ্চিতে কোথায় কী আছে, সমস্ত খুঁটিনাটি অদেখা রয়ে গেলে মানবজন্ম যেন ষোলআনাই বৃথা হয়ে যাবে, যেন মরণের ডাক দুয়ারে ঘাড় মটকাতে বসে আছে – এমন আখেরি ব্যস্ততা ভর করেছে আমাদের !

হাতে আছে আর মাত্র একদিন বাকি! কাজেই আজকের ঘুরাঘুরির তালিকা বেশ লম্বা, ভারি এবং গত দু’দিনের প্রায় দ্বিগুণ! ভোরসকালে হোটেল থেকে সেই যে বেরিয়েছি, সারাদিন ঘুরেফিরে, বিকেলে বোট রাইড’র শেষমুহূর্তে টিকিট কেটে দেখা গেল, বোট (নামে বোট আদতে আজদেহা জাহাজ যেন!) ছাড়তে মাত্র মিনিটপাঁচেক বাকি আছে ! দলবেঁধে জাহাজ ধরতে প্রাণপণে ছুটছি ঘাটের দিকে! জাহাজের ভ্যাপু বাজিয়ে শেষ সিগন্যাল দেওয়া সারা! সমুদ্রপার ঘেঁষে পাটাতনের সাঁকো, তা পেরিয়ে বেশখানিকটা দূরত্বে আমাদের জাহাজঘাট! জাহাজ ছাড়ি ছাড়ি করলেও আমাদের জন্যে অপেক্ষা করতে বাধ্য হচ্ছে।

জাহাজের যাত্রীদের ভু’কুঞ্চিত-দৃষ্টি আমাদের দিকে! আমাদের যেন জগতের কারো হাবভাব দেখার দায় নেই, যত দ্রুত দৌড়াচ্ছি তার দ্বিগুণ বেগে হাসির তোরে ভাসছি। আমাদের ভাবখানা যেন জাহাজে বিলম্বে পৌঁছে, না জানি কী হাসির কাণ্ড বাঁধিয়ে জাহাজসুদ্ধলোকের বাড়তি বিনোদন জুগিয়েছি ! আমাদের দলের অতি উৎসাহী কেউ কেউ আচমকা পাটাতনের নিচে ফুটা দিয়ে জেলিফিসের প্যারাস্যুট নৃত্য দেখতে উপুর হয়ে বসে গেছে ! ওদিকে জাহাজ ছাড়ার সময় পার হয়েছে এবং জাহাজ ক্যাপ্টেন কপালের মিহিভাঁজ গোপন করতে মুখে জবরদস্তি হাসি ধরে রেখে আমাদের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছেন ! তাঁকে ওভাবেই সবসময় আমাদের মতো কিছু মানুষের অযাচিত, অনভিপ্রেত বালখিল্য আচরণ সয়ে যেতে হয়! শেষপর্যন্ত অবশ্য মিনিট দশেক দেরিতে হলেও- আমরা বাঙালি আমেজে হূলস্থুল বাঁধিয়ে, এ-ওকে ঠেলেঠুলে ভীষণ আমুদে মেজাজে জাহাজের উপর উঠে আসি !

জাহাজের মেঝেতে বেদানার রোয়ার মতো একটার গায়ে আরেকটা ছুঁয়েঘেঁষে থরে থরে চেয়ার সাঁজানো যাতে যাত্রীরা নির্ভারে বসে আনন্দযজ্ঞ উপভোগ করতে পারে। জাহাজের ওপরতলার চিত্রও একই যা ইতিমধ্যে যাত্রীপূর্ণ হয়েছে। জাহাজের ক্যাপ্টেন,জেমস, আমরা জাহাজে পা রাখতে সেসংবাদ দিয়ে নিচে বসার অনুরোধ করেছেন। বিধায় জাহাজের নিচতলা ছাড়া আমাদের গত্যন্তর নেই কিন্তু আমার বহুকালের স্বপ্ন-খোলা জাহাজে বসে আকাশ আর সমূদ্রের মধ্যিখানে রাজহংসের মতো ভেসে বেড়াব। জাহাজে প্রবেশ করতে আমরা ভিড়ের মাঝে দলছুট হই। দেরিতে পৌঁছার খেসারত বলা যায়- আমরা একত্রে বসার ব্যবস্থা পাই না তাই যে যেখানে জায়গা পাই সেটাকে দখলে নিতে তৎপর হই। ইতিমধ্যে জাহাজ ঘাট ছেড়েছে আমি নিচতলা হলেও সিঁড়ির কাছাকাছি যুতমতো বসার জায়গা পেয়ে যাই- যেখান থেকে খোলা নীল ঝকমকে আকাশটা মনেহয় যেন মাথার উপর ঝুলে আছে, নিচের দিকে তাকাতে অথৈ নীল জলরাশি। জাহাজ থেকে দূর দিগন্তে তাকাতে মনে হয় যেন আকাশ সমূদ্রের তলে ভালোবেসে ডুবে মরে নিজ অস্তিত্ব হারিয়েছে।

এতসব সৌন্দর্যে মগ্ন থেকেও জাহাজের ওপরতলায় বসার ইচ্ছেটা দমাতে পারি না- সেখানে স্বর্গছুঁয়া সুখ হাতছানি দিয়ে কেবলই ডাকে আমায়। আমি আমার চারিপাশে বুঁদ হয়ে থাকা চোখগুলোকে ফাঁকি দিয়ে আলগোছে চলে আসি সিঁড়ি বেঁয়ে ওপরে উঠার ধান্দায় কিন্তু মাঝসিঁড়িতে দাঁড়িয়ে ওপরতালায় সারসপাখির মতো গলা উঁচিয়ে উঁকি দিয়ে দেখি, বসার আসন তো দূরে থাক, দাঁড়ানোর জায়গাটুকুও নেই। নিরাশ হয়ে ঘুরে চলে আসতে, কে যেন পেছন থেকে আমার পিঠে মৃদু স্পর্শ করে। ঘুরে তাকিয়ে দেখি,- সুমিতা দিদি। আমি আবেগে উচ্ছ্বসিত হয়ে উচ্চস্বরে দিদি নামে চিৎকার দিয়ে উঠি, আশেপাশের মানুষগুলোর কথা বেমালুম ভুলে যাই! দিদি তাঁর ঠোঁটে আঙ্গুল চেপে ইশারায় আমাকে থামতে বলেন। 

এবং সহাস্যে এগিয়ে এসে হাত ধরে টেনে আমাকে জাহাজের ওপরতলায় তোলে নেন। এতদিন পর তাঁর মায়ায়-ভরা হাতের ছোঁয়া পেতে আমি সেই আগের মতো নির্ভরতায় আঁকশি গাছের মতো তাঁকে ঝাঁপটে ধরি। দিদির হাতটা সেই আগের মতো বরফ শীতল, দু’হাত ভর্তি সোনার চুড়ি- দু’পাশ থেকে হাতির দাঁতের একজোড়া দুধেলশাদা শাঁখা যা চুড়িগুলোকে সুনিপুণভাবে হাতের উপর গুছিয়ে রেখেছে। উজ্জ্বল-শ্যামবরণের গায়ে প্যাঁচানো আসমানি রঙের তাঁতের শাড়ি,রূপোর পায়েলে জড়ানো পা দু’খানা সিঁদুররঙের আলতা পরা; তাঁর সাঁজপোশাক, সুরতহাল সবকিছু সেই আগের মতোই আছে- সময় তাঁকে এতটুকু বিবর্ণ করতে পারেনি।

সমুদ্রঘেরা এ ছোট্ট শহরের ইতিহাস যেমন প্রসিদ্ধ, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের বর্ণনা সেরূপ কালি কলমে লিখে শেষ করা যাবে না। তারওপর আমি এই শহরে প্রথম এসেছি, ঘোর কাটতে এখনো সময় লাগবে ঢের। সুমিতাদি’ তাঁর কাঁধেরব্যাগ পেতে প্রাইমারিস্কুলের বন্ধুর জন্যে আসন ধরে রাখার দৌলতে আমার জন্যে  একটা সিট দখলে রেখেছেন। ওপরে ওঠতে পেরে আমি যারপরানই উদ্বেলিত হই এবং দুরন্ত খুকির মতো দু’হাত দু’পাশে মেলে মাথার উপর উড়ে বেড়ানো সাগরপাখিদের সাথে উচ্ছ্বাসে মেতে উঠি। তিনি শাসনের সুরে জোর করে টেনে ধরে সে-আসনে বসিয়ে দেন। জাহাজ ঘাট ছেড়ে অনেকখানি দূরে চলে এসেছে। ক্যাপ্টেন জেমস, আমাদের ট্যুর গাইডও বটে তিনি এই ছোট্ট শহরের ইতিহাস বিষয়ে অনবরত সারগর্ভ বর্ণনা দিয়ে যাচ্ছেন। আমি সুমিতাদি’র গল্পে মগ্ন হলেও ক্যাপ্টেনের যন্ত্রকথা কানে এসে লাগছিল।

তাজ্জব কথা বটে! আমাদের এই বোট ট্যুর কোম্পানির সময়ও নাকি শতবছর পেরিয়েছে, ক্যাপ্টেন তাই বলছিল! আমি সুমিতা দি’র দিকে প্রশ্নবোধক চোখে তাকাতে তিনি উচ্চস্বরে হেসে উঠেন, প্রশ্রয়ের কণ্ঠে বলেন – ‘তুই সেই আগের মতোই বোকাসোকা রয়ে গেছিস রে’।
-আমি লজ্জিত হলাম বটে কিন্তু তাঁর অভিমতের সাথে মাথা নাড়িয়ে সম্মতিও জানালাম এবং সঠিক ইতিহাস তাঁর কাছ থেকে শুনতে আবদারের সুরে চেপে ধরলাম। 

তিনি খানিকক্ষণ সময় নিয়ে বলতে শুরু করলেন- ‘সেই উনিশ শতকের শুরুর দিককার কথা। আমি আর দীপান্বিতা (দিদির মেয়ের নাম দীপান্বিতা) এ শহরে ঘুরতে আসি। শহর পত্তনের শুরুকালের গুটিকয় প্রাচীনচিহ্ন ছাড়া বর্তমানে চারপাশে যা দেখছিস এসবের কোন অস্তিত্বই ছিল না। সাগরপাড় ধু ধু করত, মানুষজন তো দূরে থাক কোন প্রাণীকুলের সাক্ষাৎ দুষ্প্রাপ্য ছিল। আমি বিস্ফোরিত-চোখে সুমিতা দি’র দিকে তাকাই ! কতোকাল পেছনকার সাক্ষী আমার সুমিতা দি’ ! আমাদের জাহাজ রাজহংসের ভঙ্গিতে ডানে-বাঁয়ে কতোশত প্রাচীন ইতিহাসের চিহ্ন পেরিয়ে ছুটে যায় দূর দিগন্ত ছুঁতে। মাথার উপর নীল আকাশে ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘেরা দল বেঁধে ভেসে বেড়াচ্ছে। সূর্যটা যাই যাই রবে পশ্চিমে হেলতে শুরু করেছে। সুমিতা দি’র গল্পভাণ্ডার শেষ হবার নয়, আমিও শতবর্ষীয় পেছনের গল্পে বুঁদ হয়ে থাকি। একসময় বৈকালি হাওয়ায় ভর করে দিব্যালোক স্তিমিত হয়ে আসে,পূবাকাশে ধুপের ধোঁয়ার মতো আঁধার জমে, অপরদিকে পশ্চিমে সিঁদুররঙ ছড়িয়ে সূর্য তার বিদায়ের শেষ ঘণ্টার জানান দিল বলে।

এমন ঘোরলাগা সময়ে নিশ্চুপ যাত্রীরা সহসা সমস্বরে সোরগোল করে উঠলে, আমাদের প্রকৃতিসান্নিধ্যের ধ্যানমগ্নতার বিভ্রাট ঘটে। জাহাজসুদ্ধলোকের চোখ সাগরজলে, সেখানে দলবেঁধে ডলফিন মনেরসুখে উলম্ব-নৃত্য করছে। পোষিত ডলফিনের শেখানো কসরত বহুবার দেখেছি কিন্তু বন্য ডলফিনের চিতকাতের লম্ফঝম্ফ নিজচোখে এই প্রথম দেখলাম। আমি উৎসাহের প্রাবল্যে ভেসে যেতে আমার ফোনটা সুমিতা দি’র দিকে এগিয়ে দিই এবং তিনি সাগ্রহে বেশকিছু ছবি তুলে দেন। এসুযোগে দিদিকে জড়িয়ে ধরে আমি কয়েকখানা সেলফিও ঝটপট ডলফিনকে সাথে নিয়ে তুলে নিই। ততক্ষণে সূর্য পুরোপুরি সাগরের বক্ষে আশ্রয় নিয়েছে। এসময়টা কেমন যেন ঘোরলাগা আবছায়া, হৃদয়ে অকারণ দুঃখ- ক্ষরণ শুরু হয়, বিষণ্ণতায় ঢেকে যায় সমস্ত সুখগুলো। বোধকরি সূর্য বিদায়ের ক্ষণে সবার মাঝেই এমনতরো বোধ জাগে। কোথা থেকে বুক ভরা বেদনা উথলে উঠে, কে জানে ! জাহাজের মানুষগুলোও কেমন আনমনা, নিস্তব্ধতার গহ্বরে ডুবে আছে- চোখগুলো পাটলরঙের আবেশে ঢেকে থাকা পশ্চিম আকাশের ওইপ্রান্তে আটকে আছে গভীর মনোনিবিশে। দিদিও অপলকচোখে চেয়ে আছে ওদিকটায় আর আমি পলকহীন চোখে দিদির জলে টলমলে দিঘির মতো চোখদু’টোর দিকে। এই ফাঁকে জাহাজ ফিরতি পথের দিকে ঘুরতে শুরু করে।

যাত্রার শুরুতে জাহাজে তড়িঘড়ি উঠার প্রবণতা যেমন ছিল নামারকালে দেখা গেল তার রেশমাত্র নেই। যাত্রীরা ধীরেসুস্থে আলগোছে আলতুপায়ে সিঁড়িভেঙ্গে নিচে নামছে। এদের বর্তমান সময়টা হাওয়া হয়ে গেছে,ভাবনাগুলো ডুব দিয়েছে কয়েকশত বছর পেছনের সময়ে- সেই সময়ের প্রকৃতি, মানুষজন এদের জীবনাচরণ সর্বোপরি কেমন দেখতে ছিল সেসময়টা। আমার মনের অবস্থাও তথৈবচ- এ ক’দিনে এস্থানে ঘুরে ঘুরে পেছন শতকের স্থিরচিত্র, স্থাপত্য দেখে মনের ভেতর সেই সময়কার যে চিত্রকল্প তৈরি হয়েছে তার ভিতর ডুবে আছি যেন। বুকটা শূন্যতায় জেঁকে ধরল, অসীম সৌন্দর্যের মাঝে ডুবে থেকেও যেন আশ মিটল না! এমনতরো ভাবনাজলে ডুবে ডুবে এবং মানুষের ঢলের স্রোতে ভেসে সিঁড়িভেঙ্গে কখন নিচে নেমে এসেছি, তাল-ই পাইনি। এসময় বন্ধুরা আমাকে চেঁচামেচি কলরবে গোল হয়ে ঘিরে ধরে- অনেকটা চঞ্চল বাচ্চা হারিয়ে গেলে তাকে ফিরে পেয়ে যেরূপ উচ্ছ্বাসের জোয়ারের ঠেলা সামলাতে অশ্রুবিলাপের তাণ্ডব শুরু হয়,সেরূপ আয়োজনে। আমার সম্বিৎ ফেরে, বিব্রত হই কারন যাত্রীরা তখনও সেরূপ দৃষ্টিতে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। কিন্তু আমার কোন বাধাই বন্ধুদের উদ্দম দমাতে পারে না। তারা পুরো জাহাজ তন্নতন্ন করে খোঁজেও নাকি আমার হদিস পায়নি এমনকি আমার ফোনও  বন্ধ পেয়েছে ! তারা ধরেই নিয়েছিল আমি বুঝি সাগরজলে তলিয়ে গেছি!

কে কতবার ফোন করেছে তার প্রমান হিসেবে সবার ফোন আমার চোখের সামনে মেলে ধরে। কিন্তু আমার ফোন পরখ করে দেখা গেল, একটি ফোন কলের অস্তিত্ব নেই! আমি তাদের আশ্বস্ত করতে সুমিতা দি’র কথা পাড়ি কিন্তু এমন অঢেল ভিড়ের ঠেলাঠেলিতে দিদির হাত শক্ত করে ধরেও কখন দিদিকে হারিয়ে ফেলেছি- এইমাত্র ওদের কথায় দিদির কথা মনে পড়লো! দিদির খোঁজ করি। আশেপাশে কোথাও সে নেই। বন্ধুরা আমার কথায় ভরসা করতে পারে না, এ-ওর দিকে অবিশ্বাসের চোখে তাকায়। আমি ওদের অযথা ভ্রান্তি কাটাতে অনেকটা জোরজবরদস্তিতে টেনে জাহাজের ওপরতালায় নিয়ে যাই- যেখানে দু’জনে জাহাজভ্রমণের পুরোসময়টা পাশাপাশি বসেছিলাম কিন্তু সেখানেও শূন্য চেয়ারগুলোতে নৈশব্দের হাতছানি ছাড়া কিছু নেই! কোথাও দিদি নেই! ভিড়ের মধ্যে তিনি তার শীতল-হাতে আমার হাতটা শক্তমুঠে আগলে ছিলেন, এতটুকু স্পষ্ট মনে আছে ! এরপর আমি আনমনা হয়ে পড়ি, সবাই যেমন জাহাজ থেকে নামারকালে পড়েছিল।

দিদিকে না পেয়ে হতাশ হই বটে তবে প্রমান হিসেবে কিছুক্ষণ আগে তাঁর সাথে তোলা আমাদের সেলফি বন্ধুদের অনেকটা বাহদুরি ভঙ্গিতে দেখাতে গেলে- চরম বিস্ময়ে লক্ষ করি একটা ছবিও আমার ফোনে নেই ! সেদিনের মতো দিদির সাথে আমার বন্ধুদের দেখা হয় না এবং তাদের চোখগুলো আমাকে নিয়ে দ্বিধাম্বিত হয় তা বুঝতে বাকি নেই। হোটেলে ফিরে অনেকক্ষণ একা চুপচাপ বসে থাকি এবং একটা সময় পর বন্ধুদের আমার সাথে সুমিতা দি’র প্রথম আলাপকালের গল্প বলি। তখন প্রাইমারী স্কুলে দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ি। আমাদের স্কুলের বিশাল মাঠটা পেরিয়ে একটু পূর্ব দিকে যেতে চোখ আটকে পড়ত – উঁচু পাহাড়ের শরীররে মতো প্রকাণ্ড এক ভবনে। এতটাই উঁচু যে সে ভবনের গা ছাপিয়ে পুবদিকের আকাশটা আমরা কখনো দেখতে পারতাম না। আমরা জানতাম, কার কাছে শুনেছি কে জানে, সুউচ্চ ভবনের চূড়ায় সিঁড়ি বেঁয়ে সহজেই নাকি সাত আসমানে উঠবার পথটা পাতা। একবার কোনমতে ভবনের চূড়ায় উঠতে পারলে, সাত আসমানে অনায়াসে ঘুরে আসা যায়! এতসব গল্প শোনে শোনে এই পোড়ো-ভবন নিয়ে আমাদের ছোটদের মনে যমের ভয়আতঙ্ক এবং সেইসাথে জটিল রহস্য তৈরি হয়েছিল! 

যদিও ইট-সুরকি পলেস্তেরা খসানো শতবর্ষী দাদুর শেষ-দাঁতটার মতন সুউচ্চ সেই দ্বিতলভবন নিয়ে বড়দের মাঝেও সত্যমিথ্যার মিশেল কিচ্ছাকাহিনীর অন্ত ছিল না। ইছামতী নদী ঘেঁষে শতক একর জায়গার উপর বাড়িটির অবস্থান এবং মূল ভবনটির সম্মুখভাগ ছিল নদীর দিকে মুখ করা, সে আমলে যেমনটা থাকত। ভবনটির চারপাশে বেশকিছু ছোট বড় একতলা ভবন, অনেকটা সূর্যমুখীফুলের পাপড়ির মতো ছড়িয়ে থেকে মূলভবনের স্থাপত্যসৌন্দর্য বহুগুণে বাড়িয়ে তুলেছিল। সেসব এক’ আধতলা পাপড়িসম ভবনগুলো কালেরতলে দেবেক্ষয়ে গেলেও এই হালেরকালেও অবশ্য তার কিয়দংশের সাক্ষী মেলে। বহুকালের পুরনো, প্রাচীন কম করে হলেও নাকি এভবনের বয়স দু’শ বছর হবে। আমরা গাঁয়ের বয়োবৃদ্ধদের কাছে সে-বাড়ির গল্প শুনতাম-তারা বলত- শরৎ বোসের বাড়ি, যার গল্প তারা তাদের বাপ-দাদা মুখে শুনেছে এবং বাপ-দাদারা তার দাদা কিংবা পরদাদার থেকে জেনেছে ! 

আমরা নিদেনপক্ষে আমাদের স্কুলের সীমানা ভেঙ্গে বের হতাম না, যদিও যেতাম নদীপাড়ে তাও কালেভদ্রে ! কারণ নদীরপাড় ঘেঁষে জঙ্গল ঝোপঝারের আড়ালে কাছিমের খোলের মতো অবোধ্য একটা মঠ চোখে পড়ত। মঠটির ঘন শ্যাতলা-পড়া কালো-সবুজ মুকুট-ভাঙ্গা মাথাটা বহুদূর থেকে দৃশ্যমান ছিল। আমরা ওপথে যেতে ভয়ে দু’হাতে চোখ ঢেকে পার হলেও আড়চোখে সেটা খানিক দেখার লোভ সামলাতে পারতাম না, যদিও তা চোখে পড়তে অন্তরাত্না কেঁপে উঠত। কারণ মঠের ভেতর বাস করত আমাদের সমবয়সী এক শিশুকন্যার-আত্না, যার চাপাকান্নার আওয়াজ মাঝরাতে তো বটেই দিনেদুপুরেও শোনা যেত! বহুলোক শুনেছে, আমরাও যে শুনিনি তা কিন্তু নয়।  প্রতি শনি-বৃহস্পতিবার দুপুরবেলায় ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা গোধূলি’ লঞ্চের ঢেউয়ের দোল খেতে আমরা স্কুল ফাঁকি দিয়ে নদীপাড়ে যেয়ে দাঁড়াতাম। নদীজলে পা ডুবিয়ে দাঁড়াতে, ঢেউ এসে আমাদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পাগুলো হাঁটু অবধি ভিজিয়ে দিত। সেই অনুভূতির তুলনা মেলা ভার। কিন্তু যেই লঞ্চটি লঞ্চঘাট ছেড়ে চলে যেত, লঞ্চের যাত্রীরা হুরমুড়িয়ে দ্রুত পায়ে বাড়িরপথ ধরত। সামান্য সময়ের ব্যবধিতে লঞ্চঘাটটা কেমন ফাঁকা জনশূন্য হয়ে পড়ত। আমাদের স্কুলে ফিরে যাওয়ার একমাত্র পথটা, মঠ-ঘেঁষা জঙ্গলপথ মাড়িয়ে। বিমর্ষ হয়ে কিছুক্ষণ বড়দের অপেক্ষা শেষে বাধ্য হয়ে পথ ধরতাম বটে! একপা দু’পা করে যেই মঠের কাছাকাছি আসতাম,চোখ বুজে দিতাম ভু দৌড়। তখন আমাদের মধ্যে কেউ একজন সেই কন্যাশিশুর গোমরে-ওঠা বিলাপ শুনতে পেত ! এবং একজন শুনলে বাকিরা না-শুনেও, শুনেছি এই  বোধে আচ্ছন্ন হতাম এবং তারপর বেশ ক’দিন সেপথ ভুলেও মাড়াতাম না এবং লঞ্চের রোমাঞ্চকর আনন্দ বহুকষ্ট ভুলে থাকার চেষ্টা করতাম। একসময় ভয় কিছুটা মিইয়ে এলে ভিরুপায়ে পুনরায় লঞ্চঘাটে যেয়ে দাঁড়াতাম। ফেরার বেলায় আবার সেই আতঙ্কের মুখোমুখি হওয়া। 

আমরা এবাড়ির পরনকথা শুনতে সুযোগমতো বড়োদের চেপে ধরতাম যদিও ভয় আমাদের জোঁকের মতো জেঁকে ধরত, তারপরও। বড়োরা কী কারণে, কে জানে- ফিসফিসিয়ে, অতিরিক্ত গোপিত ভঙ্গিতে সেসব দিনের কথা বলত, পাছে যেন এতকাল পরে ত্রিপুরার সেই রাজা হস্তিবল নিয়ে না এ অঞ্চল আক্রমণে আসে! ঘটনা এরকম- শরৎ বোস ত্রিপুরার কোন এক রাজ্যের প্রধান হিসাবরক্ষক। কার্যত রাজার যাবতীয় রাজ্যসম্পদ তার জিম্মায় থাকে। এবং মানুষ হিসেবে তার সত্যব্রত সতত লোকমুখে ত্রিপুরারাজ্য ছাড়িয়ে আশেপাশের রাজ্যেগুলোতে ছড়িয়ে পড়ে এবং রাজ্যের রাজকবি তার চরিত্রে মোহিত হয়ে তাকে নিয়ে নাকি পদও রচনা করেন। এমন গুণাবলী দৌলতে রাজা তাকে খুব কাছেরজন করে নেন। কিছুকাল পরে রাজার মৃত্যু হলে অবধারিতভাবে রাজার ছেলে রাজা হলে বিগত রাজার নির্দেশ মতো শরৎ বোসের মতো নিষ্ঠাবান রাজকর্মচারীর দায়িত্ব বর্ধিত হয় এবং একটা সময় পর দেখা যায়, নতুন রাজা তার জরুরি রাজ্যসিদ্ধান্তেও তাকে যুক্ত করে নেয়। এবং রাজ্যে বিভিন্ন গোলযোগে রাজাকে বিচক্ষণ শরৎ বোস বুদ্ধিপরামর্শ দিয়ে সমূহ নিদান কাটাতে অচিরেই রাজার বিশ্বস্ত সহযোগী বনে যায় এবং সেসুবাদে রাজার গোপনভাণ্ডারের সার্বক্ষণিক দেখভাল শরৎ বোসের ওপর ন্যস্ত হয়।   

রাজা বয়সে তরুণ এবং বিষয়বুদ্ধিতেও তদ্রুপ-এ সুযোগে পার্শ্ববর্তী রাজ্য তো বটেই রাজ্যের ভেতরেও গুরুতর গোলযোগের আশঙ্কা অমূলক নয়, এমন আশঙ্কা রাজ্যেসভার বয়োজ্যেষ্ঠ সদস্যরা তো বটেই পূর্বের রাজাও রোগশয্যায় থেকে এই ভাবনা জানিয়ে গেছেন এবং ছেলেকে সঠিক পথ দেখাতে সভাসদদের একরূপ ভারও দিয়ে গেছেন। তাঁরা নতুন রাজাকে এ বিষয়ে পরামর্শ দিয়ে সতর্ক করলে রাজা ক্ষিপ্ত হন এবং কয়েকজন বিচক্ষণ রাজপরামর্শককে বরখাস্ত করেন। এমন মোক্ষম সুযোগ চতুর শরৎ বোস হাতছাড়া করেন না। তিনি তার সমমনা বিশ্বস্ত কর্মচারিদের নিয়ে গোপন বৈঠক করেন। বৈঠকের সিদ্ধান্ত মতো সমস্ত আয়োজন তড়িঘড়ি সম্পূর্ণ হলেও কেউ তা ঘুণাক্ষরেও টের পায় না। এরপর পঞ্জিকার হিসেব ধরে অমাবস্যার ঘোর আঁধার রাতে শরৎ বোস গচ্ছিত সম্পদ এবং তার দলের কর্মচারীদের ছয়টি হাতির পিঠে তোলে নিয়ে রাজপ্রাসাদ ত্যাগ করেন। 
আমার সুমিতা দি’ যার কৈলিন নাম সুমিতা দেবী, এই শরৎ বোস এর-ই বাধ্যগত স্ত্রী।

তাদের দু’ছেলে এক মেয়ে। মেয়ের বয়স সাত মাস। সেও এই দলের সাথে স্বামীর আদেশ মতো সন্তানদের নিয়ে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়। রাতভর হাতিরদল বনজঙ্গল ঝোপঝারে ঢাকা কণ্টকাকীর্ণ বিস্তর পথ পেরিয়ে ভিন্ন রাজ্যের এক বিস্তীর্ণখোলা প্রান্তরে এসে পৌঁছে। ততক্ষণে রাতের সময় পেরিয়ে সূর্য কেবল জাগতে শুরু করছে। হাতির পিঠের নির্ঘুম- ক্লান্ত- ক্ষুধার্ত মানুষগুলোর মতো হাতিদের পায়ের জোরও কমে অবসন্ন হয়ে আসে এবং বিশ্রাম জরুরি হয়ে পড়ে। অবশ্য বিপদের সম্ভাবনাও অনেকটা কমে এসেছে, এতদূরে এবং ভিন্নরাজ্যে এসে ধরা পড়ার সুযোগ নেহাত কম। স্থানটি বিশ্রামের জন্যে উপযুক্ত বটে- দু’পাশটা বড় বড় বৃক্ষলতায় ঢাকা থাকলেও ভিন্নদিকে ধু ধু খোলামাঠ, বাকিদিকে বাঁশেরফালির মতো একচিলতে চকচকে নদী। নদীর পানি শুকিয়ে তলায় নেমেছে বলেই কেবল বালুচর চোখে ঠেকছে। মাঝনদীতে অবশ্য সামান্য হলেও পানির অস্তিত্ব দেখা যায়।

তারা সেস্থানে বিশ্রাম নিতে মনস্থির করে এবং তাদের মধ্যে কেউ কেউ রান্নার যোগারযন্ত্রে ব্যস্ত হয়ে চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে । সেসময়ে সুমিতা দি’র হৃদফাটা চিৎকার শোনা যায়-কোলের কন্যা তাঁর কোলে নেই, এতক্ষণ ধরে যাকে বুকে আগলে ছিলেন সেটা তাঁর পোষিত বিড়াল। বিড়ালটি বুকের ওমে পরম আরামে ঠিক তাঁর কন্যার মতো বুকে লেপটে ছিল। প্রকৃত ঘটনা টের পেতে বড্ড দেরি হয়ে গেছে এখন কোনক্রমেই ফিরে যাওয়া সম্ভব নয়! মেয়েকে ফিরে পাওয়ায় কিঞ্চিৎ আশাটুকুও যখন ফুরল, সুমিতা দি’ তো বটেই শরৎ বোসও যারপরান মুষড়ে পড়লেন। দু’দিন দু’রাত তারা সেস্থানে অবস্থান করেও কোন সিদ্ধান্তে আসতে পারলেন না। শরৎ বোসের সিদ্ধান্তে যারা তার সাথে পরিবারসহ পালিয়েছে তারাও স্বাভাবিকভাবে বিমর্ষ এবং কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে। মেয়েকে ফিরে পেতে হলে তাদের সেরাজ্যে ফিরে যেতে হবে, কিন্তু তাতে মেয়ে উদ্ধার হবে কি না বলা মুশকিল! তবে এদের একজনেরও মাথা ঘাড়ে থাকবে না সেবিষয়ে কারো অমত রইল না! 

উপায়ন্ত না পেয়ে দু’দিন পর সবার সিদ্ধান্তে হাতিরদলসহ এরা আরও দূরে সরে আসতে থাকল। এবং সারাদিন চলার পর নদীবেষ্টিত বিক্রমপুরের এঅঞ্চলে পৌঁছতে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলে তাবু টানিয়ে এখানেই রাত কাটানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হল। তখনও তারা তাদের স্থায়ী-গন্তব্য ঠিক করেনি তবে আরও দূরে সরে যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু ভোরবেলায় ঘটল আরেক চমকপ্রদ ঘটনা। শরৎ বোস- এর ঘুম ভাঙ্গে অচেনা এক ফুলের সুবাসে। তিনি রাজপ্রাসাদে হরেক রং-গন্ধের ফুল দেখেছেন কিন্তু এমন পাগলপারা মৃদু সুবাসে ভরপুর ফুলের সাথে তাদের তুলনা নেহায়েত চলে না। ভোরের আলো না- ফুটতে তিনি তাবু থেকে বেরিয়ে যান ঘ্রানের উৎস সন্ধানে। সুতো যেমন নকশীকাঁথার গায়ে ছড়ায় জড়ায় থাকে- এঅঞ্চল নদী- নালা-খাল তদ্রুপ ছেয়ে আছে এবং তারই ফাঁকফোকরে হাজারেবিজারে হিজল গাছ- ঝোপঝার আগাছার মতো অনাদরে বেড়ে উঠেছে। গাছ ভর্তি পুস্পদণ্ডে মালার মতো গেঁথে থাকা হালকা গোলাপিলাল রঙের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ফুল ঝুলে আছে। গাছেরতলে,বনবাদরে, জলের ছাদে সর্বত্র ছড়িয়ে আছে হিজলফুল। জলেভাসা হিজলফুলের রূপে তিনি এমন মোহিত হয়ে পড়েন যে, বেলা গড়িয়ে কখন সূর্য মধ্য আকাশে উঠে গেছে টেরই পাননি। কথিত আছে হিজলফুলের মাধুর্যে মুগ্ধ হয়ে তিনি এইঅঞ্চলে স্থায়ী হতে মনস্থির করেন এবং আজীবন থেকে যান। 

শরৎ বোস এ অঞ্চলে স্থায়ী হওয়ার বছরে এই প্রাসাদসম ভবনটি সেই তৈরি করেন এবং তার পরিকল্পনায় বাড়ির চারপাশে শত শত হিজল গাছ লাগিয়ে দেওয়া হয়। স্থানিয়দের কাছে এই বাড়িটি বোস বাড়ি নামে পরিচিত হলেও সাধারণ জনগণ যেন হিজল-বাড়ি বলতেই বেশি সবছন্দ ছিল, এখনো গাঁওবুড়োরা সে নামেই ডাকে। মেয়ের স্মৃতিরক্ষায় নদীপাড়ে গড়ে তুলেন একটি স্মৃতি-মন্দির,যেটাকে স্থানীয়রা বলে বোসের মঠ। মেয়ের শোকে ধীরে ধীরে সুমিতা দি’ মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। দেশের নামকরা সব হেকিম-কবিরাজ তাঁর রোগ সারাতে ব্যর্থ হয়। শেষেরদিকে বদ্ধ উন্মাদ হয়ে পথেঘাটে ঘুরে বেড়াতেন এবং রাত হলে স্বেচ্ছায় মঠের ভেতর ফেরত আসতেন। ভরা জোসনায় নদীরপাড়ে এবং বাড়ির আশেপাশে ঘুরঘুর করতেন এবং কল্পিত-মেয়ের সাথে গল্প করতেন। শরৎ বোসের নির্দেশে গোপনে দু’জন লোক দিনে-রাতে তাঁকে পাহারা দিত।

এখনো এতোবছর পর গভীর রাতে মঠের চারপাশে মেয়ের হাত ধরে তাঁকে হেঁটে বেড়াতে দেখা যায়। মাঝেমধ্যে নাকি মা-মেয়ের কথোপকথন, হাসিকান্না স্পষ্ট শোনা যায়- বহুলোক শুনেছে এমন সাক্ষীলোকের সংখ্যাও কম নয়! আমরা স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে হাইস্কুলের আসমান সমান মাঠে সহজে যেতাম না,যদিও যেতে বারণ ছিল না। হাইস্কুলের ছাত্ররা সেখানে নানা ধরনের খেলা খেলত। আমাদের সেমাঠে খেলার অনুমতি না থাকলেও সাদরে দেখার সুযোগ দেওয়া হত কিন্তু ওই যে ভবনটি,সেটি ডিঙ্গিয়ে তবেই মাঠে পৌঁছতে হত। আমাদের ভয় হত। তবে সে ভয়কে কোনমতে চেপেচুপে অজিতের দোকানের রসগোল্লা খাওয়ার লোভে আমি মঝেমধ্যে সেই দৈত্যাকার ভবনে যেয়ে উঠতাম! দুপুর হলে কান উঁচিয়ে অপেক্ষা করতাম কখন হাইস্কুলের টিফিন পিরিয়ডের ঘণ্টা বাজবে। আমাদের স্কুলঘরে টিনের চালা থাকলেও চারপাশের আব্রু বেড়ার বড়ো অভাব ছিল। চারপাশের বেড়াগুলো মেঝে থেকে বেশ উপরে ঝুলত তাতে আমাদের মতো ক্ষুদ্র দেহগুলো অনায়াসে স্কুলঘরের বাইরে বের হয়ে যেতে পারত। 

স্যার একদিকে যেই পড়ানো শুরু করত, পেছন বেড়ার ফাঁক দিয়ে দলবেঁধে আমরা ইচ্ছেমতো বেরিয়ে পড়তাম। মাঝেমধ্যে মাঝ দুপুরে ঘণ্টার আওয়াজ পেতে রসগোল্লার লোভে জিভে পানি চলে আসত। স্যারের চোখ ফাঁকি দিয়ে ধু ধু মরুভূমির মতো বিশালাকার অন্তত আমার কাছে সেবয়সে তাই মনে হত, মাঠটা পেরিয়ে হাইস্কুলের সীমানায় ঢুকে পড়তাম। অপাংক্তেয় দ্বিতল ভবনটির ওপরতলার শরৎ বোসের নাচঘরে এখন শিক্ষকদের বসার ব্যবস্থা। আমার বাবা সেই স্কুলের প্রধান শিক্ষক। টিফিন পিরিয়ডে শিক্ষকরা একত্রে চা- মিষ্টি- নিমকি খায়। সময়মতো পৌঁছতে পারলে আমাকেও বিশেষ আদরে আপ্যায়ন করা হয়। আমি আমার সমস্ত সাহস একত্র করে একপা দু’পা ফেলে ভবনটির পেছনের রাস্তা ধরে সিঁড়িঘরের কাছে পৌঁছে যেতাম। এবং চোখ বন্ধ করে লম্বাদম নিয়ে ওপরতলায় বাবার কাছে যেতে সাহস সঞ্চয় করতাম। ওপরে উঠার প্রাচীন লোহাকাঠের দু’কপাটের সরু দরজা,দেখতে মনে হতো গুহার মুখের মতো। নিচের তলাটা শীতকালের ঘন কুয়াশার মতো রহস্যময় আঁধারে ডুবে থাকত। অনেকগুলো তালাবদ্ধ ঘরের চৌকাঠ পেরিয়ে গেলে উপরে উঠার সিঁড়িঘর,তাও ঝাপসা, মোটেও পরিষ্কার নয়। তালাবদ্ধ কক্ষগুলোর ভেতর থেকে ভয় জাগানিয়া আওয়াজ ভেসে আসত। 

চোখবন্ধ করে দু’কানে হাত গুঁজে ঠাহরে ঠাহরে সিঁড়ি স্পর্শ করামাত্র ভয়ে জমে উঠতাম। সিঁড়ির নিচে কবরের অন্ধকার, সাপ বেজির মতো কোন প্রাণী যেন নড়েচড়ে উঠত। লোহার সিঁড়িগুলো খাড়া খাড়া,জং ধরে আধক্ষয়া হয়ে কোনমতে দাঁড়িয়ে আছে। পায়ের পাড়া পড়তে কেমন মচমচ করে উঠত, মনেহত যেনএই বুঝি ঝুরঝুরিয়ে ভেঙে পড়ল বলে। সিঁড়ির একপাশে ক্ষয়ে যাওয়া দেয়াল, দেয়ালের ইট সুরকি উধাও হয়ে বড়ো বড়ো ছিদ্র- বাইরের আলো ওই দিয়ে যা ঢুকছে তার উপর ভর করে উপরে উঠার ব্যবস্থা! তারপরও আলো আসবার একমাত্র পথ সেই ছিদ্রগুলোতেও চড়ুই, কবুতর বাসা বেঁধেছে। পায়ের আওয়াজ পেতে এরা পাখা ঝাঁপকে তাদের মালিকত্ব জানান দিত কিন্তু আমার অন্তরাত্না তাতে কেঁপে চুরমার হবার পালা। অন্যপাশে বোধহয় কাঠের হাতল ছিল তাও ক্ষয়ে পড়েছে কতোকাল আগে, কে জানে ! সামান্য পা ফসকালে রক্ষা নেই, কবরের নিস্তব্দ আঁধারে ডুবে মরা ছাড়া! 

পুরো ভবনের ওপরতলার সেই ভগ্নকক্ষে বহু বিপদের শঙ্কা মাথায় নিয়ে নিরুপায় শিক্ষকদের বসার ব্যবস্থা এবং বাকি কক্ষগুলো বহুবছর ধরে তালাবদ্ধ। অবশ্য সে-কক্ষে প্রকৃতিপ্রদত্ত আলো বাতাসের কমতি নেই। দেয়াল সমান ভগ্নপ্রায় জং-ধরা শিক নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা জানালাগুলো দিয়ে আলো যেমন সমানতালে ঢুকছে, এপাশটা উন্মুক্ত থাকায় ইছামতী নদীর বাঁধভাঙ্গা আরাম-বায়ু অনায়াসে ছুটে আসতে পারছে। কোনমতে একবার বাবার কক্ষে এসে পৌঁছলে সমস্ত সংশয় নদীর বাতাসের মতো কোথায় হাওয়া হয়ে যায়, টের-ই পাই না। আদুরী বিড়ালের মতো বাবার গায়ে খানিকক্ষণ ঘেঁষাঘেসি করার পর রসগোল্লার ডাক পেতাম। বাবার বুড়ো দপ্তরি আমাকে দু’চক্ষে দেখতে পারেন না, বেঁচে যাওয়া রসগোল্লায় ভাগ বসাই বলে! তা অবশ্য আমাকে সেবয়েসেও বলে বুঝাতে হয় না, আমি অবশ্য ওসবে পাত্তাই দিই না। এবং বাবার অগোচরে তার এই রক্তচক্ষুর তেজে আমার কাছে অজিতের দোকানের রসগোল্লার স্বাদ একফোঁটাও বদলে যায় না। আমি বরং বাবার কক্ষের সাথে ঝুলানো বারান্দায় জমিদারি কায়দায় পা ঝুলিয়ে রসগোল্লার অপার্থিব স্বাদ নিই।

ফেরারপথে অবশ্য আমার ভয়ের কারণ থাকে না। বুড়ো দপ্তরি-দাদু বাবার নির্দেশে হাসি হাসি মুখ করে যদিও বাবার আড়ালে তার খোলস পুরোটাই পাল্টে যায়, সিঁড়িঘর পার করে মাঠ পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে যায়। আমি নির্ভারে ক্লাসে ফিরে আসি। একদিন ভাদ্র কিংবা আশ্বিন মাস হবে- টিফিন পিরিয়ডের ঘণ্টা বাজতে শ্রেণিকক্ষের আব্রুবেড়ার ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে,একদৌড়ে মাঠ পেরিয়ে ভবনের দরজার কাছে এসে দাঁড়াই। আকাশ অন্ধকার করে মেঘ করেছে-অতটুকু পথ না পেরোতে ঝুম বৃষ্টি নামল। তুলকালাম বৃষ্টি,স্পষ্ট মনে আছে -আকাশ যেন ফেটেফুঁড়ে সমস্ত মেঘ ঘাড়ে নিয়ে ধরায় নেমে পড়ছে তারসাথে প্রচণ্ড আওয়াজে ঠাডা মানে বজ্রপাত। আমি দু’হাতে কান চেপে ভবনের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকি কারণ গুহার মুখের মতো দরজাটি বন্ধ আছে। ওদিকে ভিজে চুপচুপে হয়ে যাই। প্রবেশদ্বারটি সবসময় উন্মূক্ত থাকে অথচ এমন দুর্দিনে ভেতর থেকে খিল এঁটে দেওয়া! চারপাশ অন্ধকার করে আরও জোরে বৃষ্টি নামে। ফিরে যাবো সে পথও বন্ধ, খোলামাঠ তারওপর আকাশে বিজলিবাতি জ্বলে উঠার আগেই মনে হচ্ছে ঠাটা মাথার ওপর এসে পড়ছে। কী করব বুঝে উঠতে না পেরে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করে দিই! আমার চোখের গঙ্গাজল বৃষ্টির পানির সাথে মিলেমিশে একাকার! 

এমনসময় কে যেন দরজার কপাট আলগোছে খুলে দেয়। আমি সেপথে চেয়ে অপেক্ষা করি- কোন শিক্ষক হয়তো উপরতলা থেকে নেমে আসল কিন্তু না অনেকক্ষণ কেটে গেলেও কারো কোন দেখা নেই। এমন ঘোর বর্ষণে অবশ্য কারো বের হবার কথাও নয়। আমি দরজা খোলা পেতে দেহে যেন প্রাণ ফিরে পাই এবং হুট করে ভবনে ঢুকে পড়ি। ভেতরটা আদিম গুহার মতো ঘুটঘুটে অন্ধকার, একহাত দূরের কিছুও দৃষ্টিতে পড়ছিল না। নিঃশ্বাস নিতে বড্ড কষ্ট হচ্ছিল, মনেহলো যেন অন্ধকারে ডুবে থাকা কোন দোজখখানায় চলে এসেছি। একসময় দীর্ঘনিঃশ্বাস টেনে পা টিপে টিপে সিঁড়ির কাছে আসি তখনও সবসময়ের মতো চোখজোড়া বন্ধ করে আছি। এক দুই তিন করে করে সিঁড়ির ধাপ গুনি আর উপরে উঠি। মোট ত্রিশটা ধাপ পেরিয়ে ওপরতলা, আদ্দিনে তা মুখস্থ হয়ে গেছে। দশ নাম্বার সিঁড়ির ধাপে পৌঁছতে কানফাটা শব্দে ঠাডা পড়ে। তীব্র আওয়াজে প্রাচীন বয়োঃবৃদ্ধ ভবনটি বাঁশপাতার আদলে দোলে উঠে। এবং সঙ্গে সঙ্গে আমি সিঁড়িঘরের ঘুটঘুঁটে অন্ধকারে পড়ে যাই।

সুমিতা দি’ কোলের বাচ্চাকে খেলার ছলে শূন্যে ছুঁড়ে দিয়ে যেমন করে টুপ করে ধরে ফেলে তেমন করে আমাকে দু’হাতে আগলে নেন। আমি ভয়ে আঁকুশিগাছের মতো তাঁর শরীরে লেপটে থাকি। কতোক্ষণ এবং তারপর কী হল, জানি না- এরপরের কিছুই আমার মনে নেই! চোখ খুলতে স্মরণে আছে- সিঁড়ির পাশের তালাবদ্ধ কক্ষটিতে সুমিতা দি’র পাশে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছি। কক্ষটি চৈত্রপূর্ণিমার রূপালী আলোতে ঝলমল করছে। দিদির পরনে সেদিনও এই একই ঢাকাইয়া তাঁতের শাড়ি ছিল, হাত ভর্তি চুড়ি এবং আজকের মতো শঙ্খশাদা শাঁখাতে চুড়িগুলো গুছানো ছিল, যেন একগাছি চুড়ি এ-ওর পিঠে আঠা দিয়ে লাগানো আছে। তাঁর হাতটা আমার হাতের মুঠে ধরা এবং হাতটা অতিরিক্ত শীতল। মুখ ভর্তি নির্ভরতার হাসি আজকেও তার বিন্দুমাত্র কমতি ছিল না। দাঁতগুলো চাঁদের কিরণে হিরকখণ্ডের মতো ঝলমল করছিল যেমনটা তুষারের উপর চাঁদের কিরণ পড়লে হয়। দুর্গামূর্তির মতো দেখতে তাঁকে আমি মুগ্ধ হয়ে দেখছিলাম। 

কক্ষটি  বিশাল লম্বা অনেকটা জাদুঘরের মতো। চারপাশের দেয়াল ধবধবে শাদা যেন এইমাত্র চুনকাজ সারা হয়েছে। সুউচ্চ সিলিং। সিলিং-এর শীর্ষে লতাপাতার নকশাকাটা। ঘরের দেয়ালে থরে থরে সাঁজানো পূর্ব পুরুষ-মহিলাদের নিপুণ কোন শিল্পীর আঁকা প্রোট্রেট এবং সেসব সোনায় বাঁধানো ফটোফ্রেমে ঝুলছে।  আশ্বিনমাসের বিকেলের মতো হালকা কুয়াশায় ঢাকা সে কামরা থেকে সিঁদুর চন্দনের ঘ্রাণ ভেসে আসছিল। কক্ষের চারকোণে বেশ বড়সড় চারটি লণ্ঠন জ্বলছিল। দিদি আমাকে হাত ধরে টেনে নিয়ে দাঁড় করাল ছবিগুলোর পাশে এবং একজন একজন করে পরিচয় করিয়ে দিল। যাদের ছবি শাদা দেয়ালে আলো করে ঝুলছে তারা দিদির সময়ের আরও দু’একশ বছর পেছনের সময়কার- তাদের পোশাকপরিচ্ছদ উপযুক্ত প্রমান দেয়। শেষের সারিতে দিদির ছবিও আছে। আমি দিদিকে তাঁর ছবির পাশে দাঁড় করিয়ে সাদৃশ্য মিলিয়ে নিই। একদম দিদি, একরত্তি এদিক সেদিক নেই, এমন কী দিদির ডান কপোলের ঘনবাদামী তিলটাও ঠিকঠাক জায়গা মতো আছে। 

একদম শেষের ছবিটায় এসে দিদি স্থির-বিষণ্ণ চোখে চেয়ে থাকেন! তাঁর চোখে টলমল জল,গড়িয়ে পড়তে নিজেকে সামলে নেন। আমারও মনটা কেমন বিষণ্ণ হয়ে উঠে। ছবিটা পরখ করে দেখি। আমার বয়সী একটি কন্যা শিশুর ছবি। কাজলপাড়া চোখদুটো অদ্ভুত মায়ার হাতছানি দিয়ে যায়। দেখতে অবিকল সুমিতা দি’র মতো। আমার ভিন্নরকম বোধ হয়, চোখদুটো আদ্র হয়ে ওঠে,গভীর মায়াচ্ছন্ন হয়ে ওর মুখে ভালোবাসার শিশির পরিয়ে দিই। দিদি তাঁর শাড়ির আঁচল টেনে ছবির উপর জমে থাকা ধুলো পরিষ্কারের ছলে ছবিটার গালে আলগা করে আদর মেখে দেন, যেন চোট না পায়, এরপর আনমনে তাকিয়ে থাকেন ছবিটার দিকে পলকহীন চোখে আরও কিছুক্ষণ। আমি এখনো পরিষ্কার নই, এটা কি দিদির ছেলেবেলার প্রোট্রেট নাকি অন্য কেউ ! প্রশ্নচোখে দিদির দিকে তাকাতে সে আমার মনকথা হয়তো পড়তে পারেন। তখন আমাকে হাত ধরে টেনে ভবনের বাইরে নিয়ে আসন।

ভবনের বাইরবাড়ি অতিরিক্ত ঝাঁটপাট পরিষ্কার সেখানে দাঁড়াতে যতদূর চোখ যায় অসুমার বিস্তীর্ণ সবুজে ঢাকা খোলামাঠ, অন্যপাশে সাগরসম পাড়হীন ইছামতী নদী- কুলকুল শব্দে বয়ে চলেছে। দ্বিতল ভবনটি ছাড়িয়ে বিস্তীর্ণপ্রান্তরের মধ্য দিয়ে মঠের দিকের পথটা লাল ইট-সুরকি বিছানো,দু’পাশে থরে থরে সাঁজানো গোছানো সুগন্ধি ফুলের গাছ। ফুলের সুবাস বাতাসে ছড়িয়ে চারপাশ ম ম করছে। 

তিনি আমাকে প্রায় টেনে হেঁচড়ে দ্রুত পায়ে এতটা পথ পেরিয়ে মঠটির অর্ধবৃত্তাকার প্রবেশদ্বারের সামনে দাঁড় করালেন, পাছে কেউ যেন দেখতে না পায়। মঠটির কপাট ভারিশক্ত লোহাকাঠের এবং খিল ভেতর থেকে বন্ধ রয়েছে। তিনি পোক্ত জাদুকরের মতো সোনাচুড়ি মোড়ানো হাতটি একটু উপরদিকে তুলে ফণাধরা সাপের মতো দু’তিন বার বৃত্তাকারে ঘুরালেন। এসময় আমার চোখেরমণি তাঁর হাতের সাথে মগ্ন হয়ে উঠানামা করছিল। এরপর বদ্ধ কপাটটি খটশব্দে খুলে গেল। আমি সুমিতা দি’র নির্দেশ মতো নিঃশব্দে তাঁর পিছু নিই। দরজা আলগোছে নিজে থেকে বন্ধ হয়ে যায়। মঠের ভেতর অতিরিক্ত পরিষ্কার শ্বেতপাথরের মেঝে, বিভিন্ন ফুলপাখির নকশা আঁকা যাদুঘরের দেয়ালের মতো সেখানে আমার ধুলো-জড়ানো নগ্ন পা ফেলতে বড়ো অস্বস্তি লাগছিল! দিদি বিষয়টা টের পেয়ে প্রশ্রয়ের ভঙ্গিতে হাতের ইশারায় ভেতরে আসতে বলেন আমি অস্বস্তি নিয়ে হলেও ভেতরে ঢুকি। ঘরের এককোণে ওপরে উঠার প্যাঁচানো সিঁড়ি। সিঁড়ি বেঁয়ে উপরে উঠতে চমকে উঠি, সেই শিশুটি- অঘোরে ঘুমুচ্ছে ! আমি দাঁড়িয়ে পড়ি, কিছু একটা বলতে যাবো, দিদি আমার ঠোঁটে তাঁর আঙ্গুল চেপে ধরেন। ফিসফিসিয়ে বলেন,” কোনভাবেই দীপান্বিতার ঘুম ভাঙ্গানো চলবে না, তাহলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। মাত্র দু’বেলা তাকে বিশেষ উপায়ে ঘুম ভাঙ্গানো হয়। সকাল এবং ভরসন্ধ্যায় !

অর্থাৎ ছবির মেয়েটির নাম দীপান্বিতা, সেটা অবশ্যই দিদি নন। আমার গল্পে পড়া সোনার কাঠি, রুপোর কাঠির কথা মনে পড়ল। কিন্তু শব্দ করে জিজ্ঞেস করার সাহস হল না আর। আমি দীপান্বিতার মাথা ও পায়ের কাছে সেরকম কোন কাঠি অবশ্য খোঁজে পেলাম না। দিদির পিছু পিছু ভিন্ন একটি কামরায় ঢুকলাম। এ-কামরাটিও বেশ গোছানো। ঘুমন্ত মেয়েটির সাঁজগোঁজ পোশাকেআশাকের-ঘর তা বেশ বোঝা গেল।  ঘরের এককোণে দু’খানা কারুকাজ খচিত হাতলচেয়ার পাতা। যাদুঘর ছাড়া এত ভারি কাঠের ছেদ করা কারুকাজের আসবাব অহরহ চোখে পড়ে না। দিদি হাতের ইশারায় আমাকে চেয়ারে বসতে বললেন এবং পাশের চেয়ারে নিজে বসলেন। তিনি বেশ কিছুক্ষণ চুপ হয়ে আছেন, আমি প্রশ্নচোখে তাঁর দিকে তাকিয়ে আছি। লক্ষ করি দিদির চোখেরকোণে শীতের ভোরে দূর্বাডগায় জমে থাকা শিশির বিন্দুর মতো অশ্রুকণা চিকচিক করছে। এরপর দিদি তাঁর স্বভাবসুলভ নরম-কণ্ঠে বলতে শুরু করেন,- “আমার একমাত্র কন্যা দীপান্বিতাকে, ত্রিপুরার রাজবাড়িতে ভুল করে ফেলে এঅঞ্চলে চলে আসি। এরপর প্রায় দশ বছর কেটে যায় কিন্তু মেয়েকে ভুলতে পারি না। একদিন রাতের অন্ধকারে এই প্রাসাদ থেকে পালিয়ে চলে যাই। এবং ভিখারী সেজে ত্রিপুরার সে-রাজ্যে ঢুকে পড়ি। মেয়েকে উদ্ধার করে এই বাড়িতে ফিরেও আসি। কিন্তু, ততদিনে প্রায় শতাব্দী চলে গেছে! আপনজন কাউকে আর খোঁজে পাই না, সবাই কোথায় হারিয়ে গেছে! আমি আর দীপান্বিতা কিন্তু আজঅবধি এখানেই রয়ে গেছি !

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *