ঈদসংখ্যার ছোটগল্প মুক্তি- আজাদ মণ্ডল
মুক্তি/ আজাদ মণ্ডল।
আমি তার প্রশ্নের উত্তর সরাসরি দিলাম না। মনের মধ্য তাকে নিয়ে যে সন্দেহের সুনামী তান্ডব চলছে সেই লন্ডভন্ডের সমাধান শুধুমাত্র প্রশ্ন-উত্তরে শান্ত হবে না। আমাকে সময় দিতে হবে। জানতে হবে কী মহার্ঘ মাহার্ত্য আছে তার মধ্য। পুরোনো চৌচালা ঘরে অর্ধেক পার্টিশন দিয়ে ফার্মেসির দোকান। তিনদিকে কাঠের তাক, ওষুধপত্রও বেশি না। এক তাকে বেশকিছু বই। সামনের দিকে একটি টেবিল তার পিছনে কাঠের চেয়ার হাতে বই, আমি আসার আগ পর্যন্ত সে পড়তেছিল। এসেছি প্রায় চল্লিশ মিনিট হল এর মধ্য ফার্মেসিতে একজন মাত্র কিশোরী ক্রেতা দেখলাম। তাকে দেখতে তেমন আহমরিও না, সংসারের টানপোড়নের ছাপ চেহারায় স্পষ্ট। চোখের চশমাটা প্রয়োজনের তুলনায় বড়, মাথার চুল বড় এবং উসকো খুসকো, গায়ের জামার উপর দিকের একটি বোতাম নাই, পড়নে লুঙ্গী, সবমিলিয়ে প্রান্তিক জনজীবনের অবয়ব। এইসবের হিসেবে আমার মনে কিছুটা স্বস্তি এল। এই স্বস্তি তার তুলনায় আমি অধিক উপযুক্ত সেই হিসেবের।
আবার, আমি কল্পশান্তির তৃপ্তির ঢেকুরে সুম্পর্ণরূপে তৃপ্ত হতে পারলাম না। তার সম্পর্কে যতটা জেনে এসেছি তাতে করে ফার্মেসি দোকানের করুণ দশা আর চেহারাসজ্জার অবয়ব দেখে স্বস্তির নিঃস্বাসে আমার ভাটা পড়ল। দ্বিধায় পড়লাম, আপাতত দৃষ্টিতে তার বাহ্যিক দৈন্যদশার হিসেব-নিকেষ আমি যত সহজে নিরূপণ করলাম সেটায় হয়ত বেশ গরল আছে কিংবা আমি হয়ত মুদ্রার একপিঠ দেখছি। ইউনিভার্সিটি পড়ুয়া, বড় চাকরিও করতো, সে গ্রামে এসে ফার্মেসির দোকান দিবে কেন? গায়ের জামার উপরের দিকের একটি বোতাম নাই থাকবে কেন? মূলত, এসব সমীকরণ যোগ-বিয়োগে আমার নিঃস্বাস বিষাদের ভার ক্রমাগত বেড়ে চলল। রাতের ঘুম হারাম হওয়ার আমার নিজেস্ব অনুমান সত্য বলে মনে হলো। আমি নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করলাম। আবারও ভাবলাম আমাকে সময় দিতে হবে। মুদ্রার অপর পিঠও আমাকে দেখতে হবে।
সে আবার প্রশ্ন করল-
-কারণ না বললেন। অন্তত নামটা বলুন। যাতে কথাবার্তা বলতে সুবিধা হয়।
-আমার নাম হুমায়ুন বাদশা।
নাম শুনে আমার দিকে সে চোখের চমশা খুলে তাকাল। বেশ বড় চোখ । তাতে রাজ্যের কৌতূহল। এই কৌতূহলের বিস্তৃতি মনে হল অসীম থেকে অসীমে। আমি সেই সীমানাহীন বিস্তৃতিতে ধুঁয়াশার মতো দেখতে পেলাম আরাধ্য বস্তুর বিরহে প্রান্তিকবাসী হওয়া কল্পের বিস্ফোরিত মুখ আর আমাকে খুঁজে পেলাম সেই বস্তুর স্পর্শকার হিসেবে। আমার মনোকোণে আবার পূর্বের অস্বস্তির জোয়ার বইতে শুরু করল। আমি জোয়ার জলে ডুবে যাওয়ার পূর্বে নাকমুখ উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলাম-
-চিনছেন তবে? আমি সে!
-না, চিনি নাই।
-মানে? চিনেন নাই, তবে অমন চিলচক্ষুর মতোন চেয়ে আছেন ক্যান?
-সম্প্রতি, মোগল সম্রাট হুমায়ুনের উপর একটি বই পড়েছি। আপনার নাম শুনে তাঁর কথা মনে পড়ল। আপনি হুমায়ুন বাদশা আর সে ছিলো সম্রাট হুমায়ুন, ইন্টারেষ্টিং। আপনার ‘চিলচক্ষু’ শব্দটাও বেশ লাগল।
-তাই?
-হ্যাঁ।
সে আমাকে আবার মনোসাগরের জোয়ার জল থেকে ভাসিয়ে তীরের দিকে উগরে দিল। আমি প্রশান্তির একটা মৃদু বাতাসের দোলা পেলাম। এই শান্ততা সে আমাকে চিনে নাই সেজন্য নয়, সম্রাট হুমায়ুন আর চিলচক্ষু শব্দের জন্য হয়ত। আসলে আমি তার মুখোমুখি হয়েছি পরাজয়ের প্রান্ত থেকে। যদিও ব্যাপারটা এখন পর্যন্ত আমার অনুমান নির্ভর। কিন্তু অনুমানটা দীর্ঘদিনের। ফলে অনুমান ঘুণের সত্য মিথ্যার দোলাচলে আমার অবচেতনে অনুমান সত্য জয়ের পাল্লা ভারি হচ্ছে। আমার গ্লানি বাড়ছে। আর্থিক সামাজিক আমার অবস্থান হেতু তার সামনে নিজেকে প্রকাশ করতে অহংবোধে বাঁধছে। আমি অসহায়বোধ করছি। আবার, সামান্য কথার্বাতা এবং দীর্ঘক্ষণ সামনে বসে আমার পর্যবেক্ষণ চোখে তাকে অনন্য ব্যক্তিত্বের অধিকারী মনে হচ্ছে। আমি সদূর ঢাকা থেকে এসেছি কিন্তু আসার কারণ স্পষ্ট করছি না, এতে তার যে উত্তেজনা বা আশ্চর্য হওয়ার কথা সে তা হচ্ছে না। সে অপেক্ষাকৃত ধীর এবং শান্ত।
-আপনি কী দ্রুত চলে যাবেন, নাকি কিছু সময় বসবেন?
সে, আবার শান্ত স্বরে প্রশ্ন করল। আমি উত্তর দিলাম-
-কত সময় বসবো সেটা বলতে পারছি না। পাঁচ মিনিটও বসতে পারি আবার সারাদিনও থাকতে পারি। তবে রাত থাকব না নিশ্চিত।
-বেশ বেশ। আপনি আমার নাম ধরে কথাবার্তা চালিয়ে যেতে পারেন। আমরা সমবয়সি। সমবয়সি মামা-ভাগনাও বন্ধু হয়। আমার নাম মনে হয় আপনি জানেন।
-হ্যাঁ জানি। আসাদ মীর। কিন্তু, শীঘ্রই নাম ধরে ডাকতে পারব না।
-তাইলে, আমিই শুরু করি, সম্রাট হুমায়ুন প্রথমে আপনি আপনার গলা থেকে টাই খুলে শার্টের উপরের দিকের দুটো বোতাম খুলে দিন।
-হা হা হা…
-হ্যাঁ, এইটা এসি ঘর না, উপরের ফ্যান ঠিক মতো বাতাস দিচ্ছে না, আপনি ঘেমে যাচ্ছেন।
-তা, ঠিক আছে। কিন্তু, আপনি আমাকে সম্রাট হুমায়ুন বলছেন কেন?
-বলছি আপনাকে হাসানোর জন্য, তাছাড়া আপনার চেহারাসুরত ঐ লেবেলেরই।
তার কথায়, আমার অন্তকোণের পুকুরে মৃদু একটা ঢিল পড়ল তাতে যে ঢেউয়ের তরঙ্গ সৃষ্টি হল, সেই তরঙ্গে আমার মনোকষ্টের গ্লানি অনেকখানি দূর হল। আমাকেও চাকরির প্রকারে নানা মতের মানুষের সাথে কাজ করতে হয়। সেই আলোকে বুঝতে পারলাম, সে সাধ্যমতো তার প্রতি আমাকে সহজ করার চেষ্টা করছে। এই কাজটা সমগোত্রীয়দের বা বন্ধুভাবাপন্ন দুজনের জন্য সহজ হয়। নিঃসন্দেহে এই প্রক্রিয়ায় সে অনেকখানি সফল হয়েছেও। তার সাথে থাকার সময় আমার বাড়ছে। তার কাছে আসার উদ্দেশ্যের মূলে যাওয়া আমার জন্য সহজ হচ্ছে। আমি গলা থেকে টাই এবং শার্টের দুটো বোতাম খুলে, আবেদন করলাম-
-আমি কি এক কাপ চা পেতে পারি
-অবশ্যই । আমিও আপনাকে চায়ের অফার করবো বলে ভাবছিলাম। কিন্তু, করিনি। বাজারের চা খাবেন কি না সেই দ্বিধায়।
-দ্বিধার কিছু নাই। কলেজ ভার্সিটিতে পড়ার সময় প্রচুর খেয়েছি। তবে এটা ঠিক এখন খাই না।
পাশের টং দোকান থেকে চা আসল। চায়ে চুমুক দিতে দিতে আমি আবার প্রশ্ন করলাম-
-আপনি ঢাকা ছেড়েছেন কেন?
প্রশ্ন শুনে সে আবার চশমা পড়ে আমার দিকে তাকাল। সেই দৃষ্টিভেদ করল আমার অন্তরস্থল। বুঝতে পারলাম, তার প্রতি আমার যে সহজভাব চলে এসেছিল সেটা ক্রমে দূরে সরে যাচ্ছে। মনে হল প্রশ্নের উত্তরে যা শুনব তাতে আমার দীর্ঘদিনের সন্দেহের মূল সত্য হবে। আমি চিরদিনের মতো আত্মগ্লানির মহাসমুদ্রে ডুবে যাব।
-আপনার প্রশ্নের উত্তর ব্যাপক। সংক্ষেপে যদি বলি, স্বীয় মুক্তি আর দায়বদ্ধতা থেকে।
এইবারও আমি বেঁচে গেলাম। তবে, তার উত্তরের সারগর্ভ ঠিক আন্দাজ করতে পারলাম না।
-ঠিক বুঝলাম না।
-দেখুন, ঢাকায় আমি এক কর্পোরেট অফিসে চাকরি করতাম। আপনার মতো ওয়েল ড্রেসও পড়তাম। কিন্তু, কিছুদিনের মধ্যে বুঝতে পারলাম আমার মেজাজের সাথে অফিসের কর্মপরিধি সাংঘর্ষিক। আমি দেশের সর্বোচ্চ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করেছি। কিন্তু, দেশ নিয়ে, সমাজ নিয়ে এমনকি আমি যে গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছি সেই গ্রামের মানুষ নিয়ে সামান্য চিন্তা করতে পারছি না। আমার চিন্তা চেতনা আবেগ অনুভূতি সব কেড়ে নিচ্ছে কর্পোরেট অফিস। আমার নিজেস্বতা বলতে কিছুই নেই, বই পড়তে পারছি না, সৃজনশীল কোনো কাজ করতে পারছি না। সারাদিন কাজ সারারাত ঘুম, আমি রোবট কিসিমের হয়ে যাচ্ছি। পোষা টিঁয়া পাখির মতো আমি কর্পোরেট খাঁচায় ঢুকছি আর বের হচ্ছি। আমি হাঁপিয়ে উঠেছিলাম। ঢাকায় আমার চিন্তা ছিল কেবল আমাকেই নিয়েই। চিন্তা ভাবনায় যদি সার্বিক না থাকে অন্তত জন্মগ্রামের মানুষকে যদি সামান্য হলেও আর্থিক, মানসিক, রাজনৈতিকভাবে আলোকিত না করতে না পারি তাহলে আমার উচ্চ শিক্ষার সার্থকতা কী? তারপর চিন্তা করলাম আমার অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য গ্রামের জমি আছে, পুকুর আছে, গ্রামের মানুষ আছে সেটাই তো এনাফ। মনস্থির করলাম বন্দিদশা আর না। গ্রামে চলে এলাম,আসার আগে মেডিসিনের উপর একটা ছোট কোর্স করে এলাম। অবশ্য, এই ফার্মেসির দোকান করে জীবিকা নির্বাহ আমার মূল না, এইটা মূলত আমার পড়ালেখার ঘর। আমার ইকোনোমিক বেইজ কৃষিকাজ, মাছচাষ, গরু পালন ইত্যাদি এবং তা সমবায়ভিত্তিক।
আসাদ মীর কথা থামালেন। কিছুক্ষণের জন্য আমি একটি ঘোরের মধ্যে চলে গেছিলাম। সেই ঘোরে ছিলো কোনো নাটক সিনেমার দৃশ্যকল্প। তার আদর্শিক বয়ানে আমি বিস্মিত হলাম। ভাবাবেগ নিয়ে প্রশ্ন করলাম-
-আপনার মুক্তির চেতনা কি মানুষের মাঝে ছড়াতে পেরেছেন?
-আধুনিক বিশ্বে বাস করলেও, আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে বিশেষ করে গ্রাম্যজীবনে এর ঢেউ খুব করে যে দোলা দিয়েছে সেটা বলা যাবেনা। গ্রামের মানুষের মনোজগত এখনো ব্যাপক হারে কুসংস্কারপূর্ণ । আমি চেষ্টা করছি অন্তত আমাদের গ্রামকে নিয়ে। তবে, কাজটা সহজ নয়। কিছুক্ষণ আগে একটি কিশোরী মেয়ে স্যানেটারি ন্যাপকিন নিয়ে গেল খেয়াল করেছেন? গ্রামের একটি কিশোরী মেয়ের পিরিয়ড শুরু হওয়ার আগে নিজে দোকানে এসে নিঃসঙ্কোচে প্যাড কিনে পরিস্থিতি মোকাবেলার প্রিপারেশন নিচ্ছে, এই চিন্তা তো এক প্রকার মুক্তি-ই। তাই না?
কিশোরীর স্যানেটারি ন্যাপকিন সংগ্রহ করাটা আমি খেয়াল করিনি। ব্যাপারটা অবশ্যই বড়। আসাদ মীর মুদ্রার অপর পিঠের মুক্তির আর্দশগত বিশাল চিন্তাচেতনায় শুধু বিস্মিত নয় মোহিতও হলাম। তার কাছে আসার হেতু আমাকে হাতড়াতে হল, এরচেয়ে কর্পোরেট চক্রে ক্ষুদ্র জীবনের সুবিশাল এবং সুন্দর চিন্তা চেতনাবোধ যে আমার একেবারেই সংকুচিত হয়ে পড়েছে সেই দুঃখে মন ভরাক্রান্ত হল। আমি নত মুখে বললাম।
-আমি আজ উঠি। সে স্বভাবগত শান্তস্বরেই বললেন-
-আপনি বাশের বাঁশির সুর শেষ কবে শুনছেন?
তার বাঁশির সুরের কথায় আমি আর অবাক হলাম না। মানুষের অবাক হওয়ার একটা সীমা থাকে, আমি মনে হয় সেই সীমা অতিক্রম করেছি।
-কেন?
-দুপুরে বাঁশি বাজানোর প্রতিযোগিতা সাথে খাবারদাবারের ব্যবস্থা আছে। গ্রামের মানুষজন থাকবে। আপনি ইচ্ছে করলে দুপুরে আমাদের সাথে খেয়ে যেতে পারেন। আমি সবিনয় বললাম, না ভাই সাহেব আরেকদিন। আমাকে সন্ধ্যার আগে ঢাকায় ফিরতে হবে।
-আপনি কি গাড়ি নিয়ে এসেছেন?
-হ্যাঁ
-গাড়ি কোথায়?
-শহরে এক পেট্রোল পাম্পে রেখেছি।
-রিক্স নাই তো?
-না, ড্রাইভার আছে।
আসাদ মীর হো হো করে হেসে উঠল। তারপর বলল-
-আপনিতো দেখি সম্রাট হুমায়ুনের চেয়ে কোনো অংশে কম নন। অবশ্য সম্রাট হুমায়ুনের আফিমের নেশা ছিলো, আপনার বোধকরি তা নাই। যাইহোক, আপনি আমার কাছে এলেন কিন্তু কারণ বললেন না। আমার ধারনা, আপনি মনিকাদের কোনো ঘনিষ্ঠ আত্মীয়। মনিকার বাবা আর আমার বাবা চাকরিসূত্রে বন্ধু ছিল। মনিকার বাবা মহিবুল চাচা ঢাকায় সেটেলড হলেও, বাবা গ্রামে চলে এসেছিলেন। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তির প্রিপারেশন এবং ভর্তি হওয়ার পরেও মনিকাদের বাসায় বছরখানেক ছিলাম। মনিকাদের বাসা, বিশ্ববিদ্যালয় এবং চাকরিক্ষেত্রে জানামতে আমি এমন কোনো কাজ করি নাই যাতে করে আমি কারো অনুসন্ধানের কারণ হই। আমি সর্বদাই খুঁজেছি জীবনের সরলতম পথ, স্বীয় মুক্তির উপায়। আমার দর্শন হল, জীবনের জটিলতা যত কম তত ভালো। আমাকে যদি আপনার সামান্য কিছুও জিজ্ঞাসা থাকে ফোন করেও জানতে চাইবেন। সঠিক উত্তর দিব। আমি যে লাইফ লিড করি তাতে অসত্য নাই বললেই চলে। মনে দ্বিধা রাখবেন না। আপনি ভালো থাকবেন।
রিক্সা চলছে শহরের পেট্রোল পাম্পের দিকে, মনিকা আমার স্ত্রী। আমার মনোজগতে আসাদ মীরকে নিয়ে অস্বস্তিকর উন্মাদনা সৃষ্টি করেছে মূলত মনিকা। কর্পোরেট জোয়াল আমার কাঁধে যে সেট করা আছে, এই জোয়াল দিয়ে কোম্পানীর হালচাষ করতে হয় সমানে অপরের সাথে প্রতিযোগীতা করে । সুযোগ-সুবিধা ব্যাপক কিন্তু সেই সুযোগ-সুবিধা ভোগ করার মতো পর্যাপ্ত সময় কিংবা পরিবারকে নিয়ে চিন্তা করা, সেটার অভাব প্রচুর। মনিকা তাকে দেওয়া অপর্যাপ্ত সময়ের হেতুতে মাঝে মাঝেই বলে, এই চাকরির চেয়ে গ্রামে কোনো ফার্মেসির দোকান করা অনেক ভালো। প্রথম প্রথম ‘ফার্মেসির দোকান’ বিষয়টা আমলে নিই নাই। কিন্তু, একদিন হঠাৎ করেই বিষয়টা মাথায় ঢুকে পড়ে। মনিকা এতকিছু থাকতে ফার্মেসির দোকানের কথা বলে কেন? অনেক অনুসন্ধানের পর মনিকাদের বাসার এক পুরোনো কাজের লোকের মাধ্যমে আসাদ মীরের ব্যাপারে জানতে পারি। বিভিন্ন সময়ে ফার্মিসির দোকানের পক্ষে কথায় আমি আসাদ মীরের সাথে মনিকার গভীর প্রণয় সন্দেহের জটিলচক্রে নিমজ্জিত হই। আমার মন ভারি হতে থাকে। আসাদ মীরের কথা মনিকাকে সরাসরি জিজ্ঞেসও করতে পারি নাই কারণ স্ত্রী হিসেবে সে পারফেক্ট। কিন্তু, মনোজাগতিক সন্দেহের অতল জলে আমি তলিয়ে যেতে থাকি দিনে দিনে। বস্তুত, হিংসা থেকে আসাদ মীর সাথে তার ফার্মেসির দোকান নামক মাহার্ঘ বস্তু দেখতে ইচ্ছুক হই।
স্বল্প সময়ে আসাদ মীর নামক মুদ্রার দুই পিঠই আজ আমার দেখা হল। যা পেলাম, তাতে আমার দীর্ঘদিনের দীর্ঘশ্বাসের কারণ সমূলে উৎপাটিত হল। সে বিশাল বটবৃক্ষ সদৃশ। তার আদর্শকে কোড করে কেবল মনিকা না, সবাই কথা বলতে পারে এবং তাকে ভালোবাসার অধিকার সবার সাথে মনিকারও আছে। আসাদ মীরের মুক্তির স্বাদ আমি হয়ত কোনোদিনও পাবো না। তার মতো সাহস, বুদ্ধি, জ্ঞান আমার নাই । অসাধারণ থেকে সাধারণ পর্যায় নামা যায় কিন্তু সাধারণ থেকে নামার আর কোন স্তর নাই। আমি সাধারণ, আমাকে ঘাড় শক্ত করে কর্পোরেটের জোয়াল টানতেই হবে। তবে, এই মুহূর্তে নিজেকে আকাশের পাখিরদের মতো মনে হচ্ছে। দীর্ঘদিনের মনঃপীড়ার কুটিলচক্র থেকে আজ চিরতরে মুক্তি পেয়েছি। এই মুক্তির আনন্দ আসাদ মীরের সাথে তুলনা হয়ত করা যাবে না। কিন্তু তার কথায় সম্রাট হুমায়ূন হারানো সিংহাসন উদ্ধারের পর যে আনন্দ পেয়েছিলেন তার চেয়ে বোধকরি কোনো অংশে কম নয়…