ছোটোগল্প।। দেবশিশু।। নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীর

আমাকে একজন গাইড দিতে হোটেল কাউন্টারে বলে রেখেছিলাম। আমি সেই গাইডের জন্য অপেক্ষা করছি। ওর এতক্ষণে এসে পড়বার কথা। আর তখুনি ইন্টারকমে জানানো হলো, গাইড এসে গেছে। গাড়িও দাঁড়িয়ে আছে, আমি চাইলে এখনি বের হতে পারি। লবিতে যেতেই একটা তরুণ এগিয়ে এসে সালাম দেয়, আসসালামু আলাইকুম এন্ড গুড মনিং, স্যার। আই এম ইউর ট্যুরগাইড, রাসেল এব্রাহিম।

ওয়ালাইকুম সালাম।

আমি অবাক হয়ে ছেলেটির মুখের দিকে তাকাই। ওর চোখমুখ আমার কাছে আমেরিকান ঠেকে, তবে চুল এশিয়ান। উচ্চতাও ফিলিপিনোদের মতো নয়। সে মুসলিম রীতিতে সালাম দিল, কিন্তু ওর নাম থেকে সে যে মুসলিম এমনটা ভাবতে পারছি না। আমার মনে পড়ে, রাসেল নামটা ইউরোপ আমেরিকায়ও খুবই চলে। ভাবি, সে আমার সম্পর্কে কিছুটা খোঁজ খবর নিয়ে জেনে নিয়েছে আমি মুসলিম। তাই সালাম জানিয়েছে। টুরিস্ট গাইডদের প্রত্যুপন্নমতিতা খুব জরুরি। তা না হলে একজন বিদেশিকে তার মর্জিমাফিক সঙ্গ দেয়া খুব সহজ নয়। যা হোক, প্রথম দেখাতে ছেলেটাকে আমার ভালো লেগেছে। সে মুসলিম কি না এই প্রশ্ন করা আর সমীচীন মনে করি না।

ক্যান ইউ গিভ মি ইউর কার্ড প্লিজ?

ওহ, সিওর।

আমি একটা পরিচিতি কার্ড দিলে রাসেল সেটা খুতিয়ে খুতিয়ে দেখে। দুবার আমার নামটা আওড়ায়, প্রফেসর আলী। তার পর আমার সঙ্গে বের হওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। আমি ওকে সঙ্গে নিয়ে গাড়িতে উঠি। সে ড্রাইভারের পাশে সামনের সিটে বসে। গাড়ি চলতে থাকলে রাসেল আমাকে ম্যানিলা নগর সম্পর্কে, এর রাস্তাঘাট, যানজট, খাবারদাবার, দর্শনীয় স্থান সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত একটা ধারণা দেয়। ওর দক্ষ উপস্থাপনা আমার ভালো লাগে। সে বোধগম্য ইংরেজি বলে।
আমি ছেলেটাকে বলি, ইব্রাহিম, আমি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দু’একটা স্মৃতি আর একটা ভালো স্কুল দেখতে চাই।

ওকে, স্যার। আমরা আগে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের স্মৃতিগুলো দেখে আসি। আর সেমিট্রির কাছেই একটা ভালো মিশনারি স্কুল আছে। প্রকৃত পক্ষে ম্যানিলার ভালো স্কুল বলতে মিশনারি স্কুলই বোঝায়। আপনি বললে আমি সে স্কুলে আপনাকে নিয়ে যাব। আমিও ওখানেই পড়ালেখা করেছি। ফাদার আর শিক্ষকগণ আমার পরিচিত। আপনি তাদের সঙ্গে কথাও বলতে পারবেন।
ঠিক আছে। তাহলে তুমি তোমার অভিজ্ঞতার আলোকে যেখানে আগে যাওয়া ঠিক হবে মনে করো, সেখানেই নিয়ে চলো।

ম্যানিলা শহরেও অনেকটা ঢাকার মতো যানজট। আমি গাড়িতে বসে লোকজন আর শহরটাকে পর্যবেক্ষণ করি। বড় বড় ভবনের পাশে পুরোনো কালের জীর্ণ দালানও টিকে আছে। আমাদের ফার্মগেট আর গুলিস্তানের মতো ফুটপাতেও পণ্য নিয়ে বসেছে। লোকজন দাঁড়িয়ে কিনছে। গাড়ি চলতে থাকলে আমি উঁচু ভবনের দিকে তাকাই। আমেরিকা আর ইউরোপের বিভিন্ন ব্র্যান্ডের সাইনবোর্ড চোখে পড়ে। সব যানবাহনই ইঞ্জিনচালিত। দামী গাড়ি এমন কি মার্সিডিস বেঞ্জ আর আমেরিকান বিভিন্ন মডেল চোখে পড়ছে। ম্যাগডোনালস থেকে শুরু করে স্টারবাকও আছে। ঢাকার মতোই পথের পাশে ফলের দোকান দেখতে পাই। আম থেকে শুরু করে কাঁঠাল পর্যন্ত সাজিয়ে রাখা আছে। সেগুলোর সামনে দাঁড়িয়ে মানুষ ফল অথবা ফলের রস খাচ্ছে। দেখতে দেখতে আমরা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের স্মৃতি নিয়ে গড়ে তোলা ম্যানিলা ওয়র মিউজিয়ামে পৌঁছে যাই।

আমি বুঝতে পারি যুদ্ধের জাদুঘর সব দেশে একই রকম থাকে। ইউরোপীয়দের আসার আগপর্যন্ত এশিয়ার সব দেশেই হাতিয়ার প্রায় একই রকম ছিল, কেবল আকারে ভিন্নতা ছিল। মধ্যপ্রাচ্যের ছুরি আর দূরপ্রাচ্যের ছুরির মধ্যে যেমন তফাত। কোনো কোনো দেশে বল্লম আর বর্শা দীর্ঘ কোনো দেশে একটু খাটো। সেটা মানুষের দৈহিক গড়ন আর বাহনের কারণে এদিকওদিক হতো। যেমন হস্তিবাহী যোদ্ধা আর ঘোড়সওয়ারির বর্শা, বর্ম আর বল্লমে যেমন সামান্য পার্থক্য থাকে সেরকম। তবে ইউরোপীয়রা যে আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে বাংলা দখল করেছিল সেই একই অস্ত্র নিয়ে এশিয়ার অন্যান্য দেশও দখল করেছিল। আধুনিক কালের আগ্নেয়াস্ত্রও সবই একই রকম। আর তাই ধ্বংশের চিহ্নও সবখানে একই। কেবল ক্ষয়ক্ষতির তথ্যে হেরফের হয়। তাই এসবে এখন আর আমার তেমন আগ্রহ জাগে না। জাদুঘর দেখে আমি রওনা দিই সেমিট্রি দেখতে।

এখন গাড়িটা ম্যানিলার অভিজাত এলাকা দিয়ে যেতে থাকলে রূপসী ম্যানিলার রূপ দেখতে থাকি। এই এলাকায় অনেক অভিজাত হোটেল আর ক্যাসিনো দেখতে পাই। বে এর পাশ দিয়ে যাবার কালে ওখানে গাড়ি থামাতে বলি। দেখতে পাই ম্যানিলার রূপসীদের সঙ্গে করে পাশ্চাত্যের পর্যটক আমোদে মেতে আছে। ওদের দেখতে দেখতে এদেশের পারিবারিক জীবন কেমন সে কথা মনে আসে। আমি ভাবি, গাইড ছেলেটার কাছে এদেশের পরিবার আর সাধারণ মানুষের জীবন সম্পর্কে ধারণা নেয়া যায়। ওর পরিবার নিয়ে কথা বললেও হয়তো কিছুটা আন্দাজ করা যাবে।

ইব্রাহিম তোমার পরিবার সম্পর্কে বলো।

আমার পরিবার নেই।

তোমার বাবা মা?

না। নেই।

আমি মজা করে বলি, তোমার কোনো গার্লফ্রেন্ড নেই?

না। কোনো গার্লফ্রেন্ডও নেই। আমি আমার জীবনে একা।

রাসেল নিস্পৃহ শুষ্ক জবাব দেয়। আমি ভাবি, কেন এমন একটা প্রাণবন্ত যুবক একা থাকবে? আমি ওর সম্পর্কে কী বুঝব বুঝতে পারি না। ও আর কোনো কথা বলে না। ওকে নিয়ে ভাবতে ভাবতে ওয়র সেমিট্রিতে পৌঁছে যাই।
বিস্তীর্ণ প্রাঙ্গণ। গাড়িটা পার্কিং-এ রেখে আমরা খোলা প্রাঙ্গণের পথ ধরে হাটতে থাকি। পথের পাশের গাছে সাদা সাদা ফুল ফুটে আছে। দুএকটা কাঠগোলাপ জাতীয় গাছ চোখে পড়ছে। আর পুরো এলাকাটা সবুজঘাসে ছাওয়া। আর সবুজের বুকজুড়ে সারি সারি সমাধিচিহ্ন। ক্রুশচিহ্নগুলোকে মনে হচ্ছে শতসহ¯্র শ্বেতকপোতের মতো। আর নিরবতা ছেয়ে আছে সবখানে। যেন সামান্য শব্দে জেগে উঠবে তারা। একটা আকাশছোঁয়া স্মৃতিস্তম্ভ। এই প্রাঙ্গণে শায়িত সৈনিকদের নামের তালিকাসহ বিশ্ব শান্তির জন্য তাদের অবদান উল্লেখ রয়েছে। এর ব্যবস্থাপনার খরচ ও সব ব্যয় আমেরিকা বহন করে।

সেমিট্র দেখে আমরা গাড়িতে উঠি।

রাসেল এবার কথা বলে, এই সেমিট্র ফিলিপিনের অর্থনীতির জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ।

কী রকম?

আপনি লক্ষ্য করেছেন, মিত্রবাহিনীর যে সৈনিকরা এখানে সমাহিত আছে তারা এক দেশের নয়। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে তারা যুদ্ধ করতে এসেছিল। তবে আমেরিকা আর ইউরোপের বেশি ছিল। ওসব দেশ থেকে প্রতিবছর বলা যায় কয়েক লক্ষ পর্যটক এ সমাধি দেখতে আসে। তারা আসায় এদেশের প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয় হয়।

তুমি তো বেশ ভালো জানো।

তারা হোটেলে থাকে, ঘুরেবেড়ায়, খরচ করে, আমোদফুর্তি করে। কৃষির পর পর্যটনই তো এদেশের আয়ের প্রধান উৎস।

কিছুক্ষণের মধ্যেই একটা স্কুলগেটে গাড়ি থামল। রাসেল ফিলিপিনো ভাষায় আমার পরিচয় দিয়ে কিছু বলতেই গার্ড ফটক খুলে দেয়। গাড়ি বিশাল মাঠের পাশ দিয়ে এগিয়ে গিয়ে অফিসের সামনে থামে। সৌম্যদর্শন প্রিন্সিপাল বের হয়ে এসে আমাকে স্বাগত জানালেন।

মহোদয় আপনাকে স্বাগতম। আমি আপনার জন্য প্রতীক্ষা করছিলাম।

আমার জন্য!

রাসেল আপনার আসবার কথা আমাকে ফোনে বলেছিল।

আমি কি দেরি করে ফেলেছি?

না। সঠিক সময়ে এসেছেন। সে তো বলেছিল, আপনি বারোটায় আসবেন। তার আগেই তো এলেন। এখন টিফিন পিরিয়ড চলছে। বাচ্চারা দুপুরের খাবার খাচ্ছে। আর আধাঘণ্টা পর ওরা আবার ক্লাস শুরু হবে।

আপনার স্কুল সম্পর্কে জানতে চাই। সংক্ষেপে বলুন।

এই স্কুলটা চালু হয়েছিল এখন থেকে দুশ বছর আগে। মিশনারিদের দ্বারা। এটা একটা এতিমদের স্কুল। এখানে সেইসব শিশুরা পড়তে পারে যাদের কোনো পারিবারিক পরিচয় নেই। এদের সংখ্যা দিনকে দিন বাড়ছেই।

কেমন করে বাড়ছে?

এর একটা ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট আছে। ঔপনিবেশিক যুগেও এদেশে পিতৃপরিচয়হীন শিশু জন্ম নিত। তখনও ওসব শিশুদের লালনপালন এবং মানুষ করার দায়িত্ব নিত এই কাথলিক মিশন। তার পর প্রথম বিশ্বযুদ্ধ আর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অনেক শিশু তাদের মা বাবাকে হারায়। তাছাড়া অনেক যুদ্ধশিশু জন্ম গ্রহণ করে। কেবল দখলদার বাহিনীর সৈনিকদের দ্বারা ধর্ষিত হবার কারণেই নয়, ইউরোপ থেকে সৈনিকরা তো এদেশে আর পরিবার নিয়ে আসত না। সৈনিকদের পক্ষে প্রবাসে এসে ঘরবাঁধা সহজও ছিল না। তারা কোথাও না কোথাও মেলামেশা করত। তাদের ঔরসজাত শিশুরাও জন্ম নিত। এর পর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কথায় আসুন। সে সময় নারীদের কী রকম নির্যাতন ভোগ করতে হয়েছে ইতিহাসে সে সম্পর্কে সামান্যই লেখা হয়েছে। কিন্তু এদেশ ঔপনিবেশিক শাসনমুক্ত হলেও পিতৃপরিচয়হীন শিশুর জন্ম থেমে নেই।

আমি শুনতে থাকি আর প্রিন্সিপাল বলতে থাকেন, আপনি তো ওয়র সেমিট্রি ঘুরে এসেছেন। এই সেমিট্রিতে সমাহিতদের স্মরণ করতে প্রতিবছরই তাদের উত্তরপুরুষরা আসে, গবেষকরা আসে। আর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের স্মৃতিকে কেন্দ্র করেই ফিলিপিনের পর্যটন শিল্প গড়ে উঠেছে। পর্যটন শিল্পের বিকাশ হওয়ায় এখনও এদেশে প্রতিবছর শত শত পিতৃপরিচয়হীন শিশু জন্মগ্রহণ করে।

এসব শিশুরা কী ভাবে বড়ে ওঠে?

আমরা ওসব শিশুদের লালনপালন করি। সুশিক্ষা দিয়ে জীবনগড়ার ব্যবস্থা করি।

আমি প্রিন্সিপালের কথা শুনতে থাকি। আর দরোজার বাইরে মাঠে শিশুদের ছুটাছুটি খেলা দেখতে থাকি। রাসেল আমার সামনে চায়ের কাপ আর স্ন্যাকস রেখে চলে গেলে প্রিন্সিপাল হাতের ইশারায় আমাকে এসব গ্রহণ করবার জন্য অনুরোধ করেন। আমার মনে পড়ে রাসেল বলেছিল ওর কেউ নেই।

রাসেল ছেলেটি কি–

হ্যা। রাসেল এব্রাহিম। ও আমাদের কাছেই বড় হয়েছে।

এরা কোন পরিচয়ে বড় হয়?

মানুষ। মানুষ পরিচয়ে এরা বড় হয়।

ওদের মায়েরা সন্তানদের কাছে আসে?

এসব শিশুদের মায়েরা তো ওদের বাঁচিয়েই রাখতে চায় না। আগে তো অনেকেই ভ্রুণ হত্যা করে ফেলত। আমরা এখানকার সকল আবাসিক হোটেল আর যৌনপল্লিতেও বলে রেখেছি, কোনো নারী পিতৃপরিচয়হীন সন্তান ধারণ করলে হত্যা না করে আমাদের দিয়ে দিতে। পরিচয়হীন শিশুরা জন্মাবার পর আমরা গিয়ে নিয়ে আসি। ওরা আমাদের কাছে আদরযত্নে লালিতপালিত হয়। যেভাবেই হোক, ওরা তো মানবশিশু হয়ে পৃথিবীতে আসছে। আমরা এদের মানবশিশু নয়, বলি, দেবশিশু।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *