ঈদসংখ্যার গল্প।। ছেড়ে আসা।। ইউসুফ শরীফ

লোকালয় ঝড়ের গতিতে ছুটছে পেছনে- গাছপালা-ক্ষেতখলা-কাজকরা মানুষজন- ঘরবাড়ি সবশুদ্ধ মুহূর্তে দৃষ্টির আড়াল। জানালায় চোখ রেখে মনে হয়- ছুটেচলা সব কিছু একাকার- একটা ম- দূরন্ত ঘূর্ণিতে পাক খেয়ে পেছনে ছুটে যাচ্ছে। গাছপালা থেকে ক্ষেত-খলা- ক্ষেতখলা থেকে কাজকরা মানুষ- মানুষ থেকে ঘরবাড়ি কোনটাই আর আলাদা নেই। এই দ্রুত ছাড়িয়ে যাওয়া জনপদ- গতির উত্তেজনায় আবিষ্ট করে। এই যাওয়া যদি শেষ না হয়- এই ট্রেন শেষ স্টেশন পার হয়ে
উর্ধে উঠে বাতাস কেটে যদি পুরো আকাশ চক্কর দেয়-
তারপর?
হাসুর ভাবনা খেই হারায়- আকাশের বিশাল শূন্যতায় আর কোন লক্ষ্য স্থির করতে পারে না। আবার ফিরে আসে জনপদের পর জনপদ ছাড়িয়ে যাওয়া এবং যেতে থাকায়- তীব্র গতিতে চলমান থাকায়। তার সবচেয়ে প্রিয়- এই দৃশ্য থেকে দৃশ্যান্তরে পৌঁছে যাওয়া এবং ক্রমাগত যেতে থাকা।
আরও প্রিয় তার রেলের ক্যাফেটারিয়ার কাটলেট আর বোম্বে টোস্ট- একটু আগে দিয়ে গেছে ওয়েটার। কাটলেটে ছুরি বসাতে গিয়ে থেমে গেল হাত-
আমিনিয়ার কাটলেট-বোম্বে টোস্ট আর ফালুদা- আহা মুখ ভরে গেল রসে!
ভাল লাগে না কিছু- কিছুই ভাল লাগে না তার- অসংখ্য নাই-এর শূন্যতা তাকে কুরে কুরে অস্থির করে তুলেছে। যাদের ক্লাসে দেখে- বাড়ির পাশে মাঠে জাম্বুরা-বল খেলতে দেখে- মনে হয় ওরা শিশু- রবিনসন বার্লিখাওয়া। ওদের আঞ্চলিক উচ্চারণে গেঁয়ো কথাবার্তা আর ক্ষুদ্র স্বার্থের তাড়না- সর্বত্র গ্রাম্যতা ঠাসা। স্কুলে টীচারদেরও কী যেন নেই! সব কিছুই পীড়িত করে তাকে- বড় বেমানান লাগে নিজেকে এখানে।
হাসু তীব্র আকাক্সক্ষাতাড়িত ঘোরের মধ্যে সিরাজগঞ্জ বাজার স্টেশনে ট্রেনে উঠে বসেছিল। বাজার স্টেশন থেকে ট্রেন যায় ঘাট স্টেশনে- ইঞ্জিন সামনে থেকে পেছনে আসে- তারপর ঢঢং-ঢঢং ঢউং ঢউং ঘন্টা বাজে- ট্রেন চলতে শুরু করে।
এই ঘন্টাধ্বনি স্কুলের পিতলের ঘন্টাধ্বনির মত নয়। স্টেশন ঘরের বারান্দায় টাঙিয়ে রাখা রেলের কাটা টুকরায় লোহার দন্ড দিয়ে বাজায় যে ধ্বনি তা নরম ভেজা-ভেজা।
এতক্ষণ ছিল যাত্রীদের হৈচৈ ক্যাঁচম্যাচ। ঘাট স্টেশনে ট্রেন পৌঁছামাত্র জগন্নাথগঞ্জঘাট থেকে ফেরিতে পার হয়ে আসা অপেক্ষমাণ যাত্রীরা মাছির মত জেঁকে ধরল। হুড়মুড় করে একসঙ্গে উঠতে চাইছে সবাই- কে কোথায় পুটলা-পাটলি রাখছে- কোথায় বসছে বা দাঁড়াচ্ছে তা নিজেরাও বুঝতে পেরেছে ট্রেন ছাড়ার অনেক পরে।
একটা কাপড়ের পুটলা হাসুর উরুর উপর রেখে দেয় কেউ- সে ঠেলেও সরাতে পারে না। সরিয়ে রাখবার মত কোন ফাঁকা জায়গাও ছিল না ট্রেনের বগিতে- জায়গা অন্য কোনবগিতেও নেই। নিচে থেকে কেউ একজন তাকে বলল, খোকা একে একটু বসায়া দেওতো-কথা শেষ হওয়ার আগেই জানালা দিয়ে দেড়-দু’বছরের বাচ্চাটাকে ছুঁড়ে মারল ওর কোলের উপর। এখন কেঁদে ওঠায় দু’তিন জনের হাত বদল হয়ে দরজার কাছে ওর মায়ের কোলে গেল- এতক্ষণ বসেছিল বালিশের মত ঘাট স্টেশন থেকে বাজার স্টেশন ট্রেন বেশ আয়েশ করে ঢিমেতালে আসে- যেন কোনই তাড়া নেই। যমুনার অস্থির বালিতে ঘাট স্টেশনের রেললাইন নাজুক- এর উপর দিয়ে ট্রেন ইচ্ছা থাকলেও পূর্ণ গতিতে দৌঁড়াতে পারে না।
হাসু অস্থির হয়ে ওঠে- কেন দুরন্ত গতিতে চলছে না ট্রেন। বাজার স্টেশনে এসে একটু থেমে দম নেয়- তারপর রুদ্ধশ্বাসে চলতে থাকে মেইল ট্রেন।
কামরার ভেতর যাত্রীরা অনেকটা স্থিত- যারা সীটে জায়গা পাননি তাদের কেউ প্যাসেজে বাক্স-পেটারার উপর বসা এবং বাকিরা দাঁড়াবার আপাত স্থায়ী জায়গা
পেয়ে গেছেন। এটা ইন্টারক্লাশ না থার্ড ক্লাশ বোঝা যাচ্ছে না এখন আর।
তবে ভিড় যতই থাক- অল্পক্ষণের মধ্যেই সাড়াশব্দ কমে এসেছে। গোটা কম্পার্টমেন্টে গভীর নিঃস্তব্ধতা- কারও মুখে কোন কথা নেই- কোন শব্দ কিংবা ভাবান্তরও নেই। ট্রেনে এরকম কখনও দেখেনি হাসু। এত যাত্রী বোঝাই হতে পারে-এটাও তার জানার বাইরে। ট্রেনের কামরায় যাত্রীদের সাড়াশব্দ লেগেই থাকে- একমাত্র নিশুতি রাতে নিথর নিঃস্তব্ধতা নেমে আসে।
সবার চোখ ছলছলে- চোখের ভেতর কী জমাটবাধা হাহাকার! বছরখানেক আগে শিয়ালদহ থেকে মেইল ট্রেন ছাড়ার পরও যাত্রীদের মধ্যে সে এই রকম স্তব্ধতা দেখেছে।
সেদিন তার চোখও কী এমন বিষাদময় এবং ভেতরে থর বাধা হাহাকার ছিল?
হাসু অকস্মাৎ দূরাগত ফোঁপানোর শব্দ শোনে তাকায় চারপাশে। সবার মুখ একই রকম এবং বিষন্নতামাখা- বুঝতে পারে না কে ফুঁপিয়ে ওঠল- সে কান্না সইতে
পারে না- তারও কান্না পায় এবং কেঁদে ফেলে। আজ কাঁদতে পারল না- কেননা কোথাও কোন সশব্দ কান্না নেই।
আচমকা নিস্তব্ধতা ভেঙে চার-পাঁচ বছরের একটি ছেলে বুকচেরা কান্নায় ফেটে পড়ে, আমি বাড়ি যাইবাম মা- মাগো আমারে বাড়ি নিয়া যাও- হতবুদ্ধি মা তাকে কোলে তুলে নিয়ে পিঠ চাপড়ে জানালার দিকে মুখ ফিরিয়ে বললেন, বাবা ওই দেখ গাছপালা-ঘরবাড়ি ক্যামুন পাগলের লাহান ছুটতাছে- ছেলেটির কান্নাতুর কণ্ঠ, ক্যান ছুটতাছে গাছপালা-বাড়িঘর- আমগর ঘরবাড়ি কোনখানে গেছে- মা-মাগো আমি বাড়ি যাইবাম- আমারে বাড়িত নিয়া যাও- মা তাকে বুকে চেপে ধরে চাপাস্বরে বললেন, বাবা আমরা নতুন বাড়িতে যাইতাছি- আরও সুন্দর বাড়ি- নিজের বাড়ি-ছেলেটা হাত পা ছুঁড়ে কামরা ফাটিয়ে চিৎকার দিয়ে ওঠল, না আমি নতুন বাড়ি- সুন্দর বাড়ি কিচ্ছু চাই না- আমগর বাড়িত যাইবাম- পুকুর পাড়ে আমগাছ তলে খেলবাম- উত্তরের ঘরে ঘুমাইবাম- আমার ঘুম পাইতাছে-ঘুমাইবাম-এক সময় কান্নাতুর অবসন্ন ছেলেটা ঘুমিয়েই পড়ল। তার আকুলতার রেশ থমকে থাকল গোটা কামরায়- মা আঁচল চাপা দিয়ে মুখ নিচু করে নিজেকে লুকাতে চাইছেন। অন্যরাও প্রায় একই ভঙ্গিতে রৌদ্রকরোজ্জ্বল দিনটাকে চিড়ে দু’ফালি করে তীরবেগে এগিয়ে যাওয়া ট্রেনের কামরা থেকে নিজেদের সরিয়ে নিতে চাইছেন। বর্তমান থেকে ডুব দিয়ে নিরাপদ ভবিষ্যতে জেগে উঠার কামনা এখন একমাত্র সম্বল তাদের।
বারো ভাজাওয়ালা এল- পেছনে পান-বিড়িওয়ালা। তাদের দীর্ঘ লয়ের পা-ন-বি-ড়ি আর বা-রো-ভা-জা কম্পার্টমেন্টটাকে হতচকিত করে দিয়ে গেল। কেউ কেউ ওদের দিকে তাকালেও কোন সাড়া দিলেন না। ভেন্ডাররা চকিত দৃষ্টিপাতে বুঝল- এখানে বেশি সময় ব্যয় নিস্ফল। তাদের চলে যাওয়ার পরও অনেকক্ষণ চিকন টানা শব্দ ঝুলে থাকল ঘরের
ভেতর দীর্ঘদিন আগে টাঙিয়ে রাখা রঙিন কাগজের ফুল হয়ে।
ট্রেনের চলার শব্দও অদ্ভুত- যে যে রকম মনে করে শব্দটা অবিকল সেই রকম হয়ে ওঠে।
কোন নির্দিষ্ট শব্দ নয়- আসলে শব্দটা কী ট্রেনের নাকি শব্দটা যারা শোনে তাদেরই গোপন আর্তির। হাসু শব্দটা শুনছে : ছেড়ে যাচ্ছি-ছেড়ে যাচ্ছি-ছেড়ে যাচ্ছি-যা-চ্ছি-যা-চ্ছি-যা-চ্ছি-তার তন্দ্রা পেল- ঘুম নয়- ঘুমের কাছাকাছি- সে দেখল সাদা মেঘমালার পরতে পরতে এই কম্পার্টমেন্টটা এঁকেবেঁকে ঢুকে যাচ্ছে- ট্রেনটাও এলোমেলো ভঙ্গিতে ধূসর হয়ে এক সময় নাই হয়ে গেল। সবকিছু ছাপিয়ে ধীরে জেগে উঠল একটা সুন্দর দোতলা বাড়ি- তার চিলেকোঠা- চিলেকোঠার উপর নিচু প্যারাপিট-ঘেরা ছাদ- পাশে লোহার ঘুরান সিঁড়ি- সে তর তর করে উপরে উঠছে-প্রতিদিনের অভ্যাস- উপরে উঠে দেখল বিশাল আকাশ- অজস্র ময়ূরপুচ্ছে ঢাকা আকাশ- কোথাও কোন মলিনতা নেই- নেই কোন আড়াল- সে লাফ দিয়ে আকাশটাকে ছুঁয়ে ফেলল- ছুঁয়ে ছুঁয়ে সারা আকাশ হেঁটে বেড়াতে লাগল- আকাশ টাল খেল না- কাত হল না- আচমকা কেউ তাকে ধরে ফেলল- আহা পড়ে যাবে তো- সামনে ফাটল দেখছ না-
দু’ফালি হয়ে গেছে ময়ূরপুচ্ছে ঢাকা তোমার আকাশ।
দেখল সেই ছেলের মা তার মাথাটা সিটের কোণে ঠেকিয়ে রাখছেন। শরীর ঝাঁকি দিয়ে ওঠে- হাসু ধড়মড়িয়ে সোজা হয়ে বসল।
চোখ পড়ল উল্টোদিকে বেঞ্চের কোণে চুপচাপ মেয়েটার চোখে। সে কী কিছু দেখছে! না তার চোখ জোড়ায় ছাদে ঠেস দেয়া দৃষ্টি ভাষাহীন-নিথর। সে কী
কিছু শুনছে! না তার অভিব্যক্তিতে কোন আলোড়ন নেই- সে কী এই কম্পার্টমেন্টে থেকেও নেই!
পাশের মহিলা যাতে অন্যের কানে না পৌঁছে এমন চাপা কণ্ঠে জিজ্ঞেস করেন ওর মাকে, দিদি কি হইছে আপনার মেয়ের?
ওর মা মৃদুস্বরে প্রশ্নটা এড়িয়ে যেতে চান, কিছু হয় নাই দিদি- পাশের মহিলা বললেন, বুঝবার পারতাছি- মনখান খারাপ- খারাপই হওনের কথা- ছাইড়া যাওনখান কী সহজ!
মহিলার প্রশ্ন শোনার সঙ্গে সঙ্গে মেয়েটা এমনভাবে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে যেন নিজের মধ্যেই নিজেকে লুকাতে চাইছে।
হাসু তাকাল ভাল করে মেয়েটার দিকে- তার করুণ মুখে বিষন্ন চোখের ভেতর- একেবারে ভেতরটা দেখে সে- ছেড়ে যাওয়ার বেদনা থরে থরে সাজিয়ে রাখা- কোনটা পুকুর পাড়ে আম গাছটার জন্য- কোনটা পুঁইনের পাশে রক্তজবা গাছটির জন্য- অত লাল রক্তজবা কি ওখানে ফোটে? কোনটা পাশের বাড়ির সুফির জন্য- তাকে বলেনি যে ওরা চলে যাচ্ছে- বলতে পারেনি- এই ক’দিন তাকে রীতিমত চোখে চোখে রেখেছেন মা। কোনটা আবার তমাল গাছের ছায়ার জন্য- জোছনারাতে লুকোচুরি খেলতে গিয়ে যে গভীর ছায়াটায় লুকাত সে। কোনটা ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে স্কুলের সেই মাঠের জন্য- কোনটা সেই চড়–ই পাখিটির জন্য যে চালের বাতায় বসে কিচিরমিচির করত- কোনটা সেই ঘুঘুটির জন্য যে অলস দুপুরের নিস্তব্ধতা ভাঙতে গিয়ে পালানে ভাললাগার সুবাস ছড়াত। তার কৈশোর ও সদ্য যৌবনের আরও বহু বহু মনকাড়া দৃশ্য কী সুন্দর থরে থরে গুছিয়ে রাখা! তার হৃদয় এই সব ছেড়ে আসার বেদনা-ভারে ক্লান্ত-চুপসে যাওয়া-

দুই.

একটা ছোট ফ্ল্যাগ স্টেশন পার হয়ে ট্রেন বিরাণ এক মাঠের বুক চিরে চলছে। দু’পাশে ধূ ধূ করছে মরীচিকা- মনে হয় জলপ্রপাত। বাইরে খরসূর্য-তাপে মাঠের ঘাস-মাটি পুড়ে-ফেটে-ঝলসে চৌচির। জানালায় বারি খেয়ে ভেতরে ঢুকছে গরম বাতাস- ঝিমধরা নিস্তব্ধতা থমকে আছে গোটা কম্পার্টমেন্টে- গরমে ক্লান্তিতে অসার প্রায় সবাই ঢুলছেন তন্দ্রায়। এর মধ্যে আচমকা বারোবাজাওয়ালার টিনের কৌটার শব্দে চমকে চোখ খুলছেন অনেকেই।
হাসু জানালায় হাতের কনুই রেখে উপুড় হয়ে জনপদের পর জনপদ পেছনে হারিয়ে যাওয়ার দৃশ্যে মগ্ন। এর মধ্যে দু’ তিন হাত ঘুরে ঘুরে তরফা বিড়িটা উৎকট গন্ধমাখা ঝাঁঝালো দলা দলা ধোঁয়া ছড়াতে থাকল। এক সময় হাসু পেছনে গদিতে মাথা ঠেকিয়ে তন্দ্রায় ঢুলতে থাকে।
ছোট ছেলেটা এতক্ষণ চুপচাপই ছিল। ক্লান্তিতে নেতিয়ে ছিল ক্ষুধায় অবশ তার শরীর।
মা বাড়ি যাইবাম- বাড়ি নিয়া যাও- আবার তার দাবীর জানান দিয়ে নিস্তব্ধতা ভাঙল। তার কান্নাতুর কণ্ঠ ট্রেনের চলার শব্দে প্রবাহিত হতে থাকল- বাড়ি যাইবাম- বা ড়ি যা ই বা ম- বা ড়ি…. ওর অসহ্য মা এবার জোরে একটা থাপ্পড় মারলেন। ট্রেনের শব্দে ঘসটানি খেয়ে থাপ্পড়ের শব্দটা ছিটকে পড়ল ক্রমাগত পেছনে ছুটে যাওয়া দৃশ্যের বগল ঘেঁষে। সামনের সীটে বসা চিত্তরঞ্জন মিলের আকাশি রঙ শাড়িপরা মহিলা বললেন, দিদি মারবেন না- ক্যান মারবেন ওরে- এই যে আমারে দেখতাছেন অতক্ষণ চুপচাপ ঝিম মেরে ছিলাম- এইভাবে বেশিক্ষণ থাকলে ওর মতন আমিও হাউমাউ করে কেঁদে ওঠব। ও ছোট মানুষ ওর স্মৃতিতে আর কত জ্বালা- চোখে আর কত কান্না- এই কামরায়- এই ট্রেনে আমরা যারা যাইতাছি তাদের বুকের মধ্যে তো কান্নার পাহাড়- জীবনের কত অমূল্য স্মৃতি ছেড়ে আসছি চিরজনমের মত- মহিলা আঁচলে মুখ ঢাকলেন- ঢেকে থাকলেন- মিলের শাড়ির আকাশি আঁচল ভেদ করে ভেজা কান্না ফুটে ওঠছে-

তিন.

সীমান্ত স্টেশন দর্শনায় পৌঁছে ট্রেন হাত-পা ছেড়ে শুয়ে পড়ল- তাই মনে হল হাসুর। ছে-ড়ে- যা-চ্ছি শব্দটা ততক্ষণে হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। এখন মনেই হয় না এরকম একটা শব্দ সারাক্ষণ ট্রেনের উপর গা এলিয়ে ছিল।
লোকজন সমেত গোটা কলকাতা মেইল পড়ে আছে মরা বৃশ্চিকের মত অসাড়- একদম সাড়া-শব্দহীন। কম্পার্টমেন্টের ভেতরও অসহ্য নীরবতা- কেউ কোন কথা বলছেন না- সবাই নত মুখ- চোখে বোবা দৃষ্টি যাতে কোন কিছুই স্পষ্ট দেখা যায় না।
ইঞ্জিনটা পাশের লাইন ধরে ভোঁস ভোঁস করে ধূঁয়া ছাড়তে ছাড়তে পেছনের দিকে গেল।
একজন চাপা স্বরে বললেন, ইঞ্জিন কয়লা নেবে-পানি নেবে। ইঞ্জিনেরও আহার-বিহার দরকার।
টিকেট চেকার এলেন- তার প্যান্ট-শার্ট-কোট-হ্যাট সব ধবধবে সাদা। এই মুহূর্তে তাকেই মনে হল একমাত্র জীবন্ত। তিনি নীরবে টিকেট চেক করছেন- সবাই টিকেট বাড়িয়ে দিচ্ছেন কিন্তু তাকাচ্ছেন না কেউ। হাসুও টিকেট বাড়িয়ে দিল।
চেকার টিকেটটা হাতে নিয়ে আশেপাশে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কোথায় যাবে?
হাসু বলল, কলকাতা।
চেকার তীক্ষ্ন দৃষ্টিতে তাকালেন, তোমার সঙ্গে কেউ নেই- তুমি একা কেন!
হাসু জবাব দিল, আমি চিনি তো-
চেকার উৎসুক, কি চেন?
হাসু নির্বিকার, আমাদের বাড়ি- তেতাল্লিশ বাই তিন ধর্মতলা স্ট্রিট- সাদা দোতলা বাড়ি- বারান্দায় খাঁচায় আমার মুনিয়া- চিলেকোঠার উপর ছাদে রেলিংঘেরা- ওখানে দাঁড়ালে নীল আকাশ- পেছনে দু’টা কামিনী গাছ- সারা রাত কী মিষ্টি ঘ্রাণ ছড়ায়- ঘুমিয়েও মনে হয় সারাটা ঘর ঘ্রাণের মধে সেঁধিয়ে আছে। আপনি গেলে আসতেই চাইবেন না- চেকার ওর হাতে টিকেট ফিরিয়ে দিয়ে বললেন, তুমি এখানেই বসে থাক খোকা- বগি থেকে নামবে না।

এরপর এলেন ব্যাটন হাতে পুলিশ- কম্পার্টমেন্টের সর্বত্র দৃষ্টি বুলিয়ে- বাক্স- পেটারার কোন কোনটায় ব্যাটনের খোঁচা মেরে নেমে গেলেন। এরপর কাঁধে রাইফেল ঝুলান সীমান্তরক্ষী বাহিনী উঠে এলেন। কম্পার্টমেন্টের সব কিছুর উপর শ্যেন দৃষ্টি- হাবভাবে স্পষ্ট মনে হয় কিছু খুঁজছেন তারা। সেটা কি- হাসু বুঝতে পারছে না।
হাসুর কাছে এসে একজন বললেন, খোকা তুমি নেমে এস।
হাসু বলল, আমি তো কলকাতা যাব-
লোকটা বললেন, এখন এস পরে তোমাকে ট্রেনে তুলে দেব-
হাসু নেমে যাবার পর সবাই মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছেন। তাদের মনেও প্রশ্ন জাগল- ছেলেটা একা কেন- কেন কলকাতায় যেতে চেয়েছিল- কার ছেলে? এতক্ষণ তারা কেউ খেয়ালই করেননি- ছেলেটা যে একা! আসলে কেউ কাউকে খেয়াল করছেন না- নিজেকে নিয়ে- নিজের নিশ্চিত অতীত আর অনিশ্চিত ভবিষ্যত নিয়ে ঘোরের মধ্যে ট্রেনের গতির ওপর নিজেদের ছেড়ে দিয়ে আছেন- সীমান্তরক্ষী বাহিনীর লোক হাসুকে তাদের অফিসে নিয়ে এলেন।
অফিসে যিনি বসেছিলেন- তাকে বললেন, স্যার এই ছেলেটা একা- সাথে কেউ নেই।
অফিসার জিজ্ঞেস করলেন, খোকা তুমি কোথা থেকে এসেছ?
হাসু বলল, সিরাজগঞ্জ থেকে-
অফিসার জিজ্ঞেস করলেন, কেন?
হাসুর সরল জবাব, কলকাতা যাব- আমাদের বাড়িতে-
অফিসার বললেন, ঠিক আছে- তুমি তো কিছু খাওনি- ওর সাথে যাও- কিছু খাবে-
হাসু বলল, আমি কিচ্ছু খাব না- ট্রেন ছেড়ে যাবে আমাকে তুলে দিন-
অফিসার বললেন, এটা বর্ডার স্টেশন- ট্রেন অনেকক্ষণ থামবে- চিন্তা নেই। তুমি যাও-
যিনি ট্রেন থেকে নামিয়ে এনেছেন তিনিই তাকে নিয়ে বের হলেন। হিন্দু হোটেল আর মুসলিম হোটেল পাশাপাশি। হিন্দু হোটেলে খুব ভিড়- অনেকে দাঁড়িয়েও আছেন খাবার অপেক্ষায়। মুসলিম হোটেল ফাঁকা- শুধু একজন লোক খাচ্ছেন। লোকটা তাকে নিয়ে মুসলিম হোটেলে ঢোকে- জোর করেও কিছু খাওয়াতে পারলেন না।
আবার তাকে এনে বসিয়ে রাখলেন অফিসে- ট্রেন আসার সাথে সাথে যে সরগরম অবস্থা ছিল স্টেশনে- তা অনেকটা থিতিয়ে এসেছে। সময় যত পার হচ্ছে হাসুর অস্থিরতা তত বাড়ছে। সে বারবার ঘাড় ঘুরিয়ে প্ল্যাটফর্মে ঝিম মেরে থাকা ট্রেনটা নজরে রাখছে।
কতক্ষণ পর ঢঢং-ঢঢং- ঢউং-ঢউং করে ট্রেন ছাড়ার ঘন্টা বাজল। হুইসেল মেরে জেগে ওঠল ইঞ্জিন- ট্রেন চলতে শুরু করেছে। হাসু অস্থির হয়ে উঠে দাঁড়াতেই তার হাত ধরে ফেললেন একজন। কিন্তু থামাতে পারলেন না তাকে। হাসু এক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে নিয়ে প্ল্যাটফর্ম ধরে দৌঁড়াচ্ছে- দৌঁড়াচ্ছে ট্রেনের শরীর ছুঁয়ে ছুঁয়ে-
হাসু স্পষ্ট শুনল- তোমাকে ছেড়ে যাচ্ছি আমি- ছে-ড়ে- যা-চ্ছি- ছে-ড়ে- যা-চ্ছি শব্দটা যত ব্যাপ্ত হচ্ছে হাসুর শরীরে তত জোর ছড়িয়ে পড়ছে-
দৌঁড়ে লাফ দিয়ে উঠে পড়ল একটা বগিতে। দু’তিনটা বগি পার হয়ে আগের জায়গায় এল। বুড়ো মহিলা একটু সরে ওকে বসতে দিলেন।

চার.

সীমান্ত পেরিয়ে ট্রেন থামল ওপারের স্টেশন গেদে-তে। ওপারের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর লোকজন ট্রেনে উঠে এলেন- আগের মতই প্রত্যেকটা বগির সর্বত্র তীক্ষ্ন দৃষ্টি বুলালেন। সন্ধ্যা নেমে আসছে বাইরে- টিমটিমে বাতি জ্বলে ওঠলেও কামারার এখানে-সেখানে জমতে থাকা অন্ধকার দূর করতে পারছে না। সীমান্তরক্ষীরা টর্চ মেরে মেরে দেখলেন।
সীমান্ত স্টেশন থেকে ট্রেন ছাড়ার আগেই এই কামরার যাত্রীরা সব গা ঝাড়া দিয়ে উঠেছেন। চোখ খুলে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়েছেন জানালায়। বাইরে ঘনায়মান অন্ধকারে একই রকম শস্যক্ষেত-গাছপালা-বাড়িঘর পেছনে ফেলে যাচ্ছে কলকাতা মেইল।

‘আমি আজ সব হারানো বাস্তুহারার দলে
স্বদেশে বিদেশী হনু দেশ বিভাগের ফলে
শিবের মত ছিলেন স্বামী চাঁদের মত ছেলে
গোয়াল ভরা গরু ছিল গোলা ভরা ধান
পুকুর ভরা মাছ ছিল বাড়ি ভরা স্বজন
সব ফেলে আসতে হল বিফল আঁখিজলে…’

কোমল চিকন নারী কণ্ঠের এই বেদন-ধ্বনি সচকিত করে সবাইকে। ‘পয়ষট্টি জন বসিবেক’ লেখা এই কম্পার্টমেন্টে কম করে হলেও একশ’ আটষট্টি জন যাত্রী! তার মধ্যে তিন ভাগের এক ভাগই হবে নারী। তাদের কারও কণ্ঠ থেকে শব্দে শব্দে এই বেদনা ছড়িয়ে পড়ছে সবার হৃদয়ে- হৃদয় মথিত-করা বেদনা এই কম্পার্টমেন্ট- এই মেইল ট্রেন চূঁইয়ে চূঁইয়ে তরল ধারায় মিশছে বাইরের অন্ধকারে- অনেকক্ষণ পুরো কামরা কান্নাতুর এই কুয়াশায় ঢাকা পড়ে থাকল। কার এ কণ্ঠে এই বেদনাভার- শনাক্ত করতে পারল না হাসু। প্রতিটি নারীমুখ দেখে মনে হয়- তারই কণ্ঠ বেয়ে নেমেছে এই তরল বেদনা।
এতক্ষণ প্যাসেজে বসে-থাকা সাদা শাড়িপরা এক মাঝবয়েসি নারী উঠে দাঁড়ালেন।
তার চোখভরা অশ্রু গড়িয়ে পড়ার অপেক্ষায়- অধরোষ্ঠ কাঁপছে। হাসুর মনে হল- এই অধরোষ্ঠ থেকেই বেরিয়েছে ওই তরল কান্না। তিনি হাত পাতেননি কিন্তু এ হাত ও হাত হয়ে শুধু কানা পয়সা নয় দুয়েকটি আনিও জমা হতে লাগল তার হাতে।
অনেকক্ষণ পর চিত্তরঞ্জন মিলের ছাপা শাড়িপরা মহিলা মুক্তকণ্ঠে কথা বলে উঠলেন, বাপ-ঠাকুর্দার চৌদ্দ পুরুষের ভিটেমাটি ছেড়ে আসা কোন সহজ সাধারণ বিষয় নয়- মোটেই নয়। বহু বহু বছর আগে মানুষ যখন শিকারের সন্ধানে-খাদ্যের সন্ধানে এক জায়গা ছেড়ে আরেক জায়গায় যেত তখনও ছেড়ে যাওয়ার যন্ত্রণা তাকে বিদ্ধ করত- কাতর করত। কারণ মাটির টান- বড়কঠিন এই মাটির টান। মাটিও আমাদের মা। জানেন- ঠাকুর্দা বলতেন- বড় হলে বুঝবি মা আমাদের গর্ভে ধারণ করেন-

জন্ম দেন- কিন্তু আমাদের ফল-ফসল দেন কে- কে বাঁচিয়ে রাখেন? এই মাটি-
মাটিও মায়ের মতন- আমাদের মা-

সবাই গভীর আগ্রহে শুনছেন যেমন শোনেন পুরাণের গল্প। তাদের সবার স্মৃতি এখন রাম-রাবণের গল্প- পুরাণের গল্পের মত। পুরাণের গল্প শোনার মধ্যে পূণ্য আছে। তারা ঘরবাড়ি- মাটি ছেড়ে যেতে যেতে পূণ্য সঞ্চয় করতে চান- যে পূণ্য হৃদয়ের জ্বালা উপশম করে- শূন্যতা ভরিয়ে দেয়- দিতে পারে- মহিলা বললেন, আমাদের এত বছরের জীবন- স্মৃতির সঞ্চয় তো আর কম নয়- বাঁধা কপির মত পরতে পরতে সাজান আছে সব। একটা মজার ঘটনা বলি- আমরা পুকুরে ডুবে হাতড়ে হাতড়ে আম কুড়াতাম- মাছ ধরার মত আর কী! দীঘির পাড়ে একটা ফজলি আমের গাছ- দীঘির অপর পাড়ে- পূব পাড়ে অনেকটা জায়গা জুড়ে ফুলের বাগান- সারা গ্রামের পূজা-আহ্নিকের ফুল যোগাত- গভীর রাতে ঘুম ভাঙিয়ে দিত মনমাতাল করা ফুলের ঘ্রাণ- কত রকমের ফুলের সুবাস যে দীঘির পানিতে ভিজে ভিজে খিড়কি দিয়ে ঢুকত! ভোরবেলা আমরা দল বেঁধে আম কুড়াতে দীঘিতে নামতাম- মনে হত ফুলের সুবাসে ডুবাচ্ছি- সুবাস হাতড়ে হাতড়ে আম কুড়াচ্ছি- সে আমও যাহাতাহা নয়- দু’সেরের কম হবে না একেকটা- একা খেয়ে শেষ করতে পারতাম না কেউ- আর কী স্বাদ- অমৃতের মত এ আমের জাত মালদা থেকে এনেছিলেন আমার ঠাকুরদার পিতৃদেব- রাতভর গাছ থেকে পুকুরে আম ঝরে পড়ার ঝুপঝাপ শুনতাম- ঘুম আসত না- জেগে জেগে ওই শব্দ গুণতাম আমরা বোনেরা-ভাইয়েরা- দিদিমা বলতেন- নিশি রাতে দীঘির পাড় ধরে চলাচল করে ব্রহ্মদৈত্য- তার এক পা থাকে এই দীঘির পাড়ের আমগাছে আর এক পা থাকে পাঁচ মাইল দূরে ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে- ব্রহ্মদৈত্যের কান্ডকীর্তির কত বৃত্তান্ত- ছোটবেলায় শুনতে শুনতে গায়ে কাঁটা দিয়েছে- দিদিমা’র কোলের কাছে সিঁটিয়ে থেকেছি- সেই সব কিছুই ছেড়ে যাচ্ছি-

গভীর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মহিলা আবার শুরু করলেন, ঠাকুরদার নিষেধ ছিল- গাছ থেকে বোঁটা খসিয়ে আম পাড়া যাবে না- তাঁর পিতৃদেব ছিলেন মন্ত্রসিদ্ধ পুরুষ আমের মওসুমে গাছটিকে মন্ত্রশাসিত করে রেখে থাকবেন- একবার দুই চোর হানা দিয়েছিল- রাতভর বোঁটা থেকে আম খসাবার ব্যর্থ চেষ্টা করল- এক সময় প্রভাত হয়ে গেল- ধরা পড়ল বিফল দুই চোর। এরপর আর কখনও এ গাছের বোঁটা থেকে আম খসাবার সাহস কেউ দেখায়নি। ঠাকুরদা বলতেন- আম পাকবে-বোঁটা নরম হবে তারপর খসে পড়বে নিচে দীঘিতে- ওখান থেকে কুড়িয়ে খাবে। বলতেন-
আম্রফলের আরেক নাম চ্যুতফল-বোঁটা বিচ্যুত না হওয়া পর্যন্ত মানুষের খাদ্য নয়।
কী অদ্ভুত কথা তাই না- অদ্ভুত কিন্তু যৌক্তিক- আর এ যুক্তি প্রকৃতির পরতে-বিন্যাসে মানুষের মানিয়ে চলার- অথচ শুধু প্রকৃতির সাথে নয়- মানুষের সাথেও কি মানিয়ে চলতে পারছে মানুষ?
মহিলার কণ্ঠ বার বার জড়িয়ে যাচ্ছে- থেমে যাচ্ছেন- মুখে আঁচল চেপে কান্না লুকাচ্ছেন। কিন্তু কান্নার প্রবহমান শীতল স্রোতেভেজা কণ্ঠ কী করে লুকাবেন!
একটু থেমে তিনি বললেন, পারছে না- পারছেই না- মানুষকে ভিটেমাটি থেকে- মানুষের বোঁটা থেকে বিচ্যুত হতে হচ্ছে- এখানে প্রকৃতি নেই- প্রকৃতির শিক্ষা অর্থহীন- ঠাকুরদা এই সময়টা দেখলে কে জানে বলতেন কী না-
আমরা সবাই এই মাটি আর প্রকৃতির সন্তান!
ফুঁপিয়ে ওঠলেন মহিলা। এই ফুঁপিয়েওঠা ছোঁয়াচে- কম্পার্টমেন্টের সবাই সংক্রমিত হলেন।

মহিলা একটু স্থির হয়ে বলতে শুরু করলেন, ঠাকুরদা সত্যই মাটি আর প্রকৃতির সন্তান ছিলেন- জীবনে কোনদিন সাবান ব্যবহার করেননি- দীঘির পাড়ের চিকনা মাটি নিয়ে গায়ে লেপে রোদে বসে থেকে ডুবিয়ে চান করতেন- কোনদিন ওষুধ খাননি- জ্বর হলে পঞ্চপাতার পাচন খেতেন এবং ঠিক ভাল হয়ে যেতেন- আগেরদিন যিনি জ্বরে নরহরিকম্প- পরদিন সকালে উঠে দেখতাম সেই ঠাকুরদা হাফহাতা কুরা গেঞ্জি আর ধুতিটা লুঙ্গির মত পরে উল্টে নিয়ে ক্ষেতখলা দেখে ফিরছেন। আমার একবার জ্বর হলে ঠাকুরদা পাচন খাওয়ালেন- জ্বর সারল না-
মা বললেন, এসব টোটকায় কী আর জ্বর সারে মিকচার না খাওয়ালে!
পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় কথাটা শোনে ঠাকুরদা বললেন, সারে বৌমা- আমার সারে তবে তোমার মেয়ের সারবে না- কেন বুঝতে পার- আমি মা’র বুকের দুধ খেয়েছি-লাল গাই’র দুধ খেয়েছি- কালো ছাগলের দুধ খেয়েছি আর তোমার মেয়ে রবিনসন বার্লি খেয়েছে- বৌমা তোমার কথা ঠিক ওর জ্বর সারাতে মিকচার লাগবে- তোমরা প্রকৃতি থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়েছ- এইজন্য খুব চড়া-দাম দিতে হবে-
মহিলা থেমে গিয়ে চুপ করে থাকলেন। অনেকক্ষণ নীরবতায় ঢাকা পড়ে থাকে কম্পার্টমেন্ট। শুধু শোনা যাচ্ছে কলকাতা মেইলের- ছেড়ে যাচ্ছি…ছেড়ে…যাচ্ছি… ছে…ড়ে…ছেড়ে…যা…চ্ছি…

ফুঁপিয়ে ওঠলেন মহিলা, ঠাকুরদার এই সেই উচ্চ-মূল্য কী না জানি না- কিন্তু গাছপালা-দীঘি-বাগান-ক্ষেতখলা বার্মা থেকে আনা শালকাঠের দোতলা ঘর- করোগেট টিনের চকমিলান বাড়ি এসবের মধ্যেই তো মিশে ছিলে তুমি আমি- এই সব কিছুই ফেলে যাচ্ছি- ঠাকুরদা তোমাকেও ছেড়ে যাচ্ছি। কলকাতা থেকে বাবার চিঠি- বাবার টেলিগ্রাম ঃ এখানে সবাই বলাবলি করছে- ওখানে থাকা যাবে না- কিছুতেই থাকা যাবে না- বহু পরিবার চলে এসেছে- আমি স্বস্তি বোধ করছি না তোমাদের পূর্ববঙ্গে রেখে-

কিন্তু ঠাকুরদা আমি কী করে স্বস্তি বোধ করি- তোমার চিরকালের এই মাটি-
যাকে স্মৃতি-সত্তা-ভবিষ্যত জেনেছি সেই মাটি ছেড়ে আসতে-
মহিলা ঢুকরে কেঁদে ওঠলেন। দু’তিন সারি পর থেকে ভিড় ঠেলে এগিয়ে এলেন এক ভদ্রলোক।
দু’হাতে মহিলার মুখ তুলে ধরে বললেন, আহা ধরিত্রী সেন্টিমেন্টাল হবে না- হুঁশে আস- শোন- প্রণব বলল- বাবা- মা কি কাঁদছেন- মা’র গলার শব্দ শুনছি-
মহিলা এক নিঃশ্বাসে কান্না মুছে ফেলে বললেন, প্রণবকে পাঠিয়ে দাও এখানে- ভদ্রলোক বললেন, ওখানে তো ওকে বসাবার একটু জায়গা পেয়েছি- এখানে- মহিলা বললেন, ও আমার কোলে বসবে- আমার বুকে থাকবে- আমাদের পরেও অনেক বছর ও-ই তো ছেড়ে যাওয়া পূর্ববঙ্গের এই মাটির স্মৃতি বহন করবে- ভদ্রলোক চলে গেলেন।
এতক্ষণ ঝিম মেরে থাকা বুড়োমতন লোকটা এবার গা ঝাড়া দিয়ে বলে ওঠলেন, ঠাকুরদার কথায় কোন খাদ ছিল না- একদম খাঁটি কথা- আমরা মাটির সন্তান
আমাদের এই দেহ মাটির তৈরি- মাটিই আমাদের বাঁচিয়ে রাখে ফল-ফসল দিয়ে।
ব্রহ্মপুত্র তীরে উর্বরা মাটির সন্তান এই আমি- আমরা- হর সন বন্যা হয় ব্রহ্মপুত্রে- কুনু কুনু সনে ধানপাট ভাসায়া নিছে- কিন্তুক যে পলি পড়ছে তাইতে কালাই-তিল-তিষি-সরিষা-পেঁয়াজ-মরিচ ফলছে অঢেল- পরের মওসুমে ধানপাটের ফলনও বাড়ছে- যা নিছে তারচেয়ে অনেক বেশি দিছে ব্রহ্মপুত্র- রুই মাছের পেটির লাহান সেই মাটি- কী ধান- কী পাট আহা! পরাণ ভইরা গেছে- সেই মাটি ছাইড়া আসছি- এই রকম সোনার মাটি আর ফিইরা পাব কী না জানি না- আমরা কেউ কিচ্ছু জানি না- ছাইড়া যাইতাছি- ছাইড়া আসছি- এটুকুই জানি-
অনেকক্ষণ নিশ্চুপ থেকে বুড়ো নিজেকেই প্রশ্ন করলেন, কিন্তু কেন যাচ্ছি?
মহিলা বললেন, শংকা-শংকায়- আমার বাবা কলকাতায় বসে এই শংকায় ভুগছেন।
আমি ময়মনসিংহে শংকায় ভুগছিলাম। শহরে বিদ্যাময়ী স্কুলে শিক্ষিকা আমি- আমার ছাত্রীদের কাছেও আমাকে ছোট করে দিল এই শংকা- নীরবতা সেলাই করছে সময়কে। শংকা শব্দটার রেশ মিলিয়ে গেছে। ইঞ্জিনের শব্দ- মাঝেমধ্যে দীর্ঘ হুইসেল- উগলে দেয়া ধোঁয়ার ঢেউ বাতাসে ছিঁড়ে ছিঁড়ে যাচ্ছে- ট্রেনের ছেড়ে যাচ্ছি- ছে-ড়ে- যা-চ্ছি- শব্দের সাথে ধোঁয়ার এই ছিঁড়ে যাওয়া মিলেমিশে সন্ধ্যারাতের আকাশে কী রকম ছিন্নভিন্ন চিত্র হয়ে যাচ্ছে দেখতে পারছে না হাসু।
হঠাৎ ওই বুড়োমতন লোকটা খুব মৃদু স্বরে আপন মনে ফের প্রশ্ন করলেন, কিসের শংকা- কেন শংকা!
প্রশ্নটা ট্রেনের শব্দ ছাপিয়ে অনেকক্ষণ ঘুরপাক খেল। যারা ট্রেনের ঢুলুনিতে তন্দ্রালস হয়ে পড়েছিলেন তারা এ প্রশ্নে কিছুটা সচকিত হয়ে বসলেন- সে মুহূর্তের জন্য- ধীরে ধীরে তন্দ্রায় সমর্পিত হলেন যাত্রীরা।
হঠাৎ মহিলা বলে ওঠলেন, সন্দেহ- সন্দেহ! দেশটা দু’ভাগ হয়ে যাওয়ার সাথে সাথে সন্দেহের তীর এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিল আমাদের নিশ্চিন্ত আকাশটাকে। আর আমরা সন্দেহ-অবিশ্বাসের দোলায় দুলতে লাগলাম- দুলতে দুলতে সন্দেহ-অবিশ্বাস শংকা হয়ে ওঠল!
বুড়োমতন লোকটা কতক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, যুক্তি-বুদ্ধি কোথায়?
অনেকক্ষণ পর মহিলা বললেন, নেই- নেই!

পাঁচ.

প্রণব নামের ছেলেটিকে ওর মা কোলে বসিয়ে বুকে রাখতে চেয়েছিলেন। হাসু প্রথম ভেবেছে বাড়ি যাওয়ার জন্য কাঁদছে যে ছেলেটি ওর মতই হবে। বার-তের বছরের নাদুস-নুদুস প্রণব যখন ভিড় ডিঙিয়ে ওর মা’র সামনে এসে দাঁড়াল তখন সে বুঝল মুখে যাই বলুন না কেন ক্ষীণাঙ্গিনী মা ওকে কিছুতেই কোলে বসাতে পারবেন না।
হাসু পাশে চেপে যতটা সম্ভব সরে বসে বলল, প্রণব তুমি এখানে বস─ ওর মা বললেন, না- না তুমি বস─  তোমার কষ্ট হবে খোকা─ সে বলল, মোটেই কষ্ট হবে না আমরা তো দুজনেই সমান─  চাপাচাপি করে বসা যাবে─ প্রণব বসতে বসতে জিজ্ঞেস করল, তুমি আমার নাম─ হাসু বলল, শুনেছি─ তুমি ওপাশে ছিলে তো, তোমার বাবা এসে বললেন তোমার কথা─ তখনই ভেবেছি তুমি এলে এখানে বসবে─

প্রণব বলল, তোমার নাম কি?
সে বলল, আমি হাসু─

প্রণব বলল, হাসু তুমি খুব ভাল─ তোমার মত আমার একটা বন্ধু─ ওর নাম আমিন─ আমাদের পাশে দাসবাবুদের বাড়িতে ওরা ভাড়া থাকে─ ওকে খুব মনে পড়ছে। আমি তো কলকাতা চলে যাচ্ছি─ মা বলেছেন ওর সাথে আর দেখা হবে না। ও যখন এসে দেখবে আমাদের বাড়িতে আমি নেই─ আমরা কেউ নেই তখন ওর খুব কষ্ট লাগবে। তোমার কী মনে হয় আমিন আমার জন্য কেঁদে ফেলবে না─ খুব কাঁদবে না!

হাসুর মনের আকাশ কালো মেঘের ছায়ায় ঢাকা পড়ে গেল─ এই একটা বছর প্রতিদিন কি রুদ্র এসে তাকে খুঁজছে আর মন খারাপ করে ফিরে যাচ্ছে─ কষ্ট পাচ্ছে! রুদ্রও তো ওর ভাল বন্ধু ছিল─ কত স্মৃতি ওর সাথে গা ঘেঁষাঘেঁসি করে আছে। একবার ওদের দুই পরিবার এক সাথে হাজারিবাগ বেড়াতে  গিয়েছিল। একদিন ভোরে উঠে দু’জন ঘুরতে বেরিয়েছে। রুদ্র একটা প্রজাপতি ধরার জন্য উদগ্রীব─ এদিকে হাসু একটা পাখির পিছু নেয়। যখন হুঁশ ফিরে এল তখন একজন হারিয়ে ফেলেছে আরেকজনকে─ একটা দেহাতি লোক হাসুকে বাংলোয় পৌঁছে দিয়েছিল। রুদ্রকে হারিয়ে সে একা ফিরতে চায়নি─ দেহাতি লোকটা জোর করে ওকে নিয়ে আসে। রুদ্র হাসুকে খুঁজতে খুঁজতে কয়েক মাইল দূরে চলে গিয়েছিল। লোকজন যখন ওকে খুঁজে বের করে তখন সে কিছুতেই হাসুকে ছাড়া ফিরতে চায়নি। সে বিশ্বাসই করেনি─ বাংলোয় ফিরে গেছে হাসু! সেই রুদ্র নিশ্চয়ই তাকে প্রতিদিন এসে খুঁজছে। সেও তো আসার সময় রুদ্রকে বলে আসতে পারেনি। তার বুকের ভেতরটা যেন কেমন করতে থাকে। কী করবে হাসু!
এই এক বছরে সে তো বাবাকে অনেকবার বলেছে, বাবা ধর্মতলার বাড়িতে যাব- কলকাতা যাব─ এখানে একদম ভাল্লাগছে না আমার─
বাবা বলেছেন, আমরা তো সব ছেড়ে এসেছি─ ওখানে আর যাব না─  হাসু অবাক হয়েছে, আমাদের বাড়িতে আমরা যাব না─ কেন  যাব না!

বাবা বলেছেন, আমরা একেবারে চলে এসেছি─ এভাবে ছেড়ে এলে আর যাওয়া যায় না─ হাসু প্রশ্ন করেছে, কেন আমাদের বাড়িঘর ছেড়ে এভাবে চলে এলে? তুমি তো বলেছিলে আমরা গ্রামের বাড়ি যাচ্ছি─ বেড়াতে যাচ্ছি─ ক’দিন পরই ফিরে আসব। আমার টমিটাকেও তুমি নিতে দিলে না─ বললে─ টমিকে নেয়া যাবে না─ এখানেই থাক। কার কাছে আছে─ কে ওকে দেখাশোনা করবে? রুদ্রর সাথেও দেখা করতে পারলাম না─ ও কী আমাকে প্রতিদিন খেলার সময় খুঁজতে আসছে না!
বাবা বলেছেন, তুমি আমার সাথে চল, সামনের বাড়িগুলোতে অনেক ডগি আছে─ তোমার পছন্দমত সুন্দর দেখে নিয়ে আসবে।
হাসু বলেছে, আমি দেখেছি পাশের বাড়ির ছেলেটার একটা ডগি আছে─ ওতো গেঁয়ো─ ছাল উঠে গেছে─ কেমন বিশ্রীভাবে ডাকে─ বাবা বলেছেন, আদর করলে ছাল গজাবে─ শিখিয়ে নিলে ভালভাবে ডাকবে─ তুমি শিখিয়ে নেবে।

হাসু বলেছে, না ডগিটগি কিচ্ছু চাইনে তুমি আমাকে পাঠিয়ে দাও আমাদের বাড়িতে─ মোটেই ভাল্লাগছে না এখানে আমার। বাবা বললেন, আস্তে আস্তে দেখবে ভাল্লাগবে─ সব ভাল্লাগবে─ হাসু আর কিছু বলেনি─ তবে ভেতরে ভেতরে তৈরি হয়েছে─ কলকাতা যাবে─ ধর্মতলা স্ট্রিটে ওদের বাড়িতে যাবে সে─ দোতলা বাড়ির তিন-তলায় চিলেকোঠার পাশে মাটির বিশাল টবে দু’টা কামিনী গাছ মেঘের মত ডালপালা বিস্তার করে আকাশ ছুঁই ছুঁই করছে─ চাঁদনী রাতে জোছনাভেজা কামিনীর ঘ্রাণ সারা ছাদে লুটোপুটি করে। চিলেকোঠার উপরটা রেলিংঘেরা─ বিকেলে কাঠের সিঁড়ি বেয়ে ওখানে উঠলেই─ ময়ূরপুচ্ছের মত নীল আকাশ─ অনাবিল আকাশ─ ময়লা পাতলুন-শার্ট-টাই-ছেঁড়া কোটপরা লোকটা আচমকা উঠে দাঁড়ালেন─ মাঝবয়েসি লম্বা সুদর্শন ভদ্রলোকের চোখজোড়া ফোলা ফোলা─ এখন মনেই হয় না এতক্ষণ গুটিশুটি মেরে ঝিমিয়েছেন কিংবা ঘুমিয়েছেন।

স্পষ্ট ঝরঝরে উচ্চারণে বলতে শুরু করলেন, আই ওয়াজ এ্যা রেলওয়ে অফিসার বাট আই হ্যাভ লস্ট মাই জব─ বিকজ আই’য়্যাম এ্যা কাস্ট হিন্ডু─ উয়িথ সিক্স মাইনর অফস্প্রিং এন্ড মাই ওয়াইফ নাউ আই এ্যাম ইন দ্য স্ট্রিট─ উড ইউ প্লীজ হেল্প মি উইথ সাম কয়েনস এরকম কাঁচা-পাকা খোঁচা দাড়ি-সমেত সৌম্যকান্তি ভদ্রলোক কতটা অসহায় অবস্থায় পড়লে সাহায্য চাইতে পারেন─ হাসুও বুঝতে পারছে। সে দু’টি আনি বের করে তার হাতে তুলে দিল। মাথা ঝুঁকিয়ে থ্যাঙ্কয়ূ বলে─ নিতে নিতে ভদ্রলোক তাকালেন ওর দিকে─ ঢুলু ঢুলু চোখে অস্বাভাবিক তীক্ষ্ন দৃষ্টি─  এতক্ষণ যারা ঝিম মেরে বসেছিলেন─ বেচারার কষ্টের কথা শুনে তাদের অনেকের চোখ টলমল করে ওঠে─ অনেকের কোচর থেকে-পকেট থেকে এক আনি-দু’আনি বেরুতে লাগল। ভদ্রলোক একই ভঙ্গিতে মাথা ঝুঁকিয়ে আগেই খুলে নেয়া হ্যাট উপুড় করে বাড়িয়ে দিয়ে তাতে পয়সা নিচ্ছেন। পয়সা হ্যাটে পড়ার সময় ঝনাৎ করে শব্দ হচ্ছে। দেখতে দেখতে হ্যাট ভারী হয়ে যাওয়ায় ওখান থেকে কোটের পকেটে রাখছেন─  অল্পক্ষণেই পকেট গোল হয়ে গেল পয়সার ভারে। ভদ্রলোক মাথা ঝুঁকিয়ে থাঙ্কয়ূ─  বলতে বলতে এগিয়ে গেলেন পাশের কামরায়।
বুড়োমতন লোকটা বললেন, আহা বেচারা!
সেই শিক্ষিকা মহিলা বললেন, যে শংকার কথা আমরা বলছিলাম─ ভদ্রলোকের বেলায় তা আর শংকা থাকেনি বাস্তবে পরিণত হয়েছে!
বুড়া বললেন, মনে হয়─ কোন কায়স্থপুত্র! এ গুরুতর অধর্ম─ কী করবে এখন বেচারা!  যে বুড়ি বমি করেছিলেন, তিনি বললেন, ভগবানই ভাল জানেন!

ছয়.

শিয়ালদহ পৌঁছার আগেই কামরাটা ফাঁকা হয়ে গেল─ রাণাঘাটে কিছু লোক নেমেছেন─ দমদমে নেমে গেছেন বেশি লোক। যে ক’জন আছেন─ তাদের মধ্যে প্রণব আর ওর মা আছেন─ ওর বাবাও চলে এসেছেন এখানে। হাসুর সঙ্গে কথা বলে তিনি বুঝলেন ছেলেটি মাত্রাতিরিক্ত আবেগে আক্রান্ত─ এ আবেগ অস্বাভাবিক না হলেও এই ছেলেটির ক্ষেত্রে মারাত্মক হয়ে ওঠতে পারে─ তার পক্ষে কলকাতায় হারিয়ে যাওয়া খুবই সম্ভব। এখানে তো তার আর কেউ নেই─ তাকে ফিরে যেতে হবে আর এই ট্রেনই এখন ওর পরিচয়ের যোগসূত্র
তখনও ভোর হয়নি। শিয়ালদহে রাতদিন সমান─ ট্রেন আসছে─ ট্রেন যাচ্ছে। যাত্রী-কুলি-রেলের লোকজনে সরগরম বিশাল স্টেশন। ভোর হবার পর প্রণবরা প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে গেল। 
যাবার আগে প্রণবের মা জানতে চাইলেন, তুমি কোথায় যাবে খোকা?
প্রণবের বাবা বললেন,  একা একা তুমি এভাবে চলে এসেছ─ এটা ঠিক হয়নি। তোমার বাবা-মা অস্থির হবেন। এই ট্রেন আজ রাতে আবার ফিরে যাবে─ তুমি এই প্ল্যাটফরমে থাকবে─ বাইরে যাবে না─ এখান থেকেই ট্রেনে উঠে যাবে─ ময়লা কোট-প্যান্টপরা ওই ভদ্রলোক এগিয়ে এলেন, আপনারা ভাববেন না─ আমি ওকে পৌঁছে দেবার ব্যবস্থা করব।

প্রণবের বাবা-মা বললেন, দয়াকরে দেখবেন─ না হলে ছেলেটা খুব সমস্যায় পড়ে যাবে─ ভদ্রলোক বললেন, মোটেই চিন্তা  করবেন না─ আমি আছি─ হাসুকে স্টেশন থেকে বের হতে দিতে চাননি ভদ্রলোক। এক সময় হাসুর জেদের কাছে হেরে গিয়ে স্টেশনের হিন্দু টি-স্টলে নাশতা সেরে ওকে নিয়ে বের হলেন।

ধর্মতলা স্ট্রিটের বাড়ি এক বছরের মধ্যেই ভাঙচুর হয়ে অনেকটা নতুন রূপ পেলেও হাসু ঠিক ঠিক খুঁজে বের করল। পেছনের কামিনী গাছটা তাকে সাহায্য করল─ কেন করবে না─ ওই কামিনী গাছটার গোড়ায় কত পানি ঢেলেছে! মনের ভেতর গত একটি বছরের রুদ্ধ কামনা উথলে ওঠল─ হাসু ভেবেছিল এক দৌঁড়ে কাঠের সিঁড়ি ভেঙে ছাদে উঠে যাবে─ ঝালিকাটা প্যারাপিটে বুক ঠেকিয়ে নিচে বাড়ির পেছনের কামিনী গাছের দুয়েকটা পাতা ছুঁইবে। তারপর এক চক্কর লাগিয়ে ছাদ থেকে নেমে বৈঠকখানা ঘরে ঢোকে ডিভানে শুয়ে আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে দাঁড়ান আচকান-পাজামা-রুমিটুপিতে জমকালো তার বাবার ছবিটা দেখবে।

তাদের বাড়িতে ছাদের উপর শুকাতে দেয়া কাদের জামা-কাপড় বাতাসে উড়ছে¬? ছাদের এক কোণে বেশ কিছু জিনিসপত্র জড়ো করা─ তার বইয়ের রেকটা কাত হয়ে আছে─ ওরা যাবার সময় বাবা বাড়িতে তালা লাগিয়েছিলেন─ সবকিছু যেমন থাকার তেমন ছিল─ মাত্র তিনটা সুটকেস আর বড় ট্রাঙ্কটা বাবা দাঁড়িয়ে থেকে ট্রেনের পেছনে গার্ডের ডাব্বার লাগোয়া মালগাড়িতে তুলিয়েছিলেন কুলিদের দিয়ে। বুকের ভেতরটা তার ছাৎ করে ওঠল─ খালি বাড়িতে এরা কারা!

দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে পড়তে যাবে তখনই উঠানের ওপারে বারান্দায় দাঁড়ান এক মহিলা বলে ওঠলেন, দারওয়ান দরজা বন্ধ র্ক দো─ সঙ্গে সঙ্গে পাকানো মোছওয়ালা ষন্ডামার্কা ভোজপুরি দারওয়ান খেঁকিয়ে ওঠলেন, তুম কৌন হো─  আভি বাহার নিকাল যাও─ বলতে বলতে ওকে ধাক্কা দিয়ে বের করে মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দিলেন। 

হাসু কাঠের বড় দরজায় মাথা কুটল─ পিঠ ঠেকিয়ে ধাক্কাধাক্কি করল─ কত কাকুতি-মিনতি করল দরজাটা একটুখানি খোলার জন্য─ কেউ শুনলেন না─ দরজাও খুললেন না─ দারওয়ান বা যারা বাড়িতে আছেন তারা কেউ কি শুনতে পাচ্ছেন না? হাসু ভেবে পেল না কেন তারা কোন সাড়া দিচ্ছেন না─ তাদের বাড়ি─ নিজেদের বাড়ি─ ওই লোকগুলো কেন এমন করছেন? তারা কেন হাসুকে নিজেদের বাড়িতে ঢুকতে দিচ্ছেন না─ ছোট্ট কচি মনটার ভেতর আঁতিপাতি করে খুঁজেও সে কোন জবাব পায় না─ শুধু অবিরল চোখের জলে ঝাঁপসা হয়ে ওঠে স্মৃতিমাখা অতিচেনা সবকিছু─ অস্পষ্ট সেই দৃশ্যের মাঝ বরাবর দেখল─ তার কান্নার ঢেউয়ে যেন মাটি দুলে ওঠছে─ আকাশ কাত হয়ে নিচে নেমে আসছে─ আর এরমধ্যেই আচমকা বাড়িটা উবু হয়ে তাকে আঁকড়ে ধরল─ কতক্ষণ এভাবে ছিল ঠাহর করতে পারেনি।

ভদ্রলোক তাকে টেনে তুলে মাথায় হাত বুলিয়ে চোখ মুছিয়ে দিয়ে বললেন, খোকা এখন বাড়িটাতে ওরা থাকে তো─ তুমি কিছু মনে কর না─ চল আমরা স্টেশনে ফিরে যাই─ ফিরতি গাড়িতে তুমি তোমাদের বাড়িতে যাবে─ হাসু বলল, না─ না এটাই আমাদের বাড়ি─ আমি কোথাও যাব না─ ওরা এক সময় না এক সময় দরজা খুলবেনই─ তখনই আমি ঢুকে পড়ব─ ভদ্রলোক বললেন, আচ্ছা খোকা তুমি বল দেখি─ এখানে তোমার বাবা-মা আর ভাই-বোন নেই কেন─ নেই এজন্য যে সবাই এখন ওই বাড়িতে চলে গেছেন─ এখন সিরাজগঞ্জেই তোমাদের বাড়ি─ বুঝতে পারছ─

বুঝিয়ে-সুজিয়ে তিনি হাসুকে নিয়ে সামনে পা বাড়ালেন। বদ্ধ দরজার ভেতর তাদের বাড়িটা ফেলে আসতে গিয়ে হাসু বারবার পেছন ফিরে তাকাচ্ছে─ ভেঙে-চুরে যাচ্ছে বুকের ভেতরটা। বাড়ির দরজায় কড়া নাড়ার আগেও সে ভাবেনি বাড়িটা আর ওদের নেই! কিভাবে জলজ্যান্ত বাড়িটা হাসুর জন্য নাই─ হয়ে গেল!
আশেপাশে যে দুয়েকটা বাড়ি পরিচিত মনে হল─ সেখানকার কেউ তাকে চিনতে পারলেন না। সে ভেবে পেল না চেনা মানুষগুলো কোথায় হারিয়ে গেছেন─ কেন হারিয়ে গেছেন রুদ্রদের বাড়ি থেকে যে মহিলা বের হলেন তিনি বললেন, খোকা আমরা বছরখানেক আছি─ আগে যারা ছিলেন─ শুনেছি তারা বদলি হয়ে দিল্লী চলে গেছেন।
চেনা মানুষ যখন নাই হয়ে যায়─ চেনা দৃশ্য যখন অচেনা হয়ে পড়ে তখন সেই দৃশ্য সামনে নিয়ে বেশিক্ষণ থাকা যায় না─ দম বন্ধ হয়ে আসে─ হাসুও শ্বাস নিতে পারছে না। ভদ্রলোক তাকে সঙ্গে করে বেরিয়ে এলেন ওই পাড়া থেকে।
দুপুর গড়িয়ে গেছে─ এই শহরের দুপুরের যে ছবি হাসুর বুকের মাঝখানে গাঁথা─ তার সঙ্গে কোথায় যে অমিল ঠিক বুঝতে পারছে না। কেন এমন মনে হচ্ছে─ তার চেনা সবকিছুই যেন অলীক! কী ভেবে ট্রেনে উঠে বসেছিল─ না─ সে আর ভাবতে পারে না─ খুব কষ্ট হচ্ছে─ এত কষ্ট যা তার ছোট্ট মনটা ধরে রাখতে পারছে না─

শিয়ালদহ স্টেশনে ঢোকার আগে তারা খাবার খেয়েছে এক রেস্টুরেন্টে। মনে পড়ছে─ বাবা মাঝেমধ্যেই তাদের সবাইকে নিয়ে যেতেন আমিনিয়া হোটেলে─ ওখানকার কাটলেট আর ফালুদা তার জিভে লেগে আছে─ প্ল্যাটফরমের এককোণে একটা থাম ঠেস দিয়ে হাসু চুপ মেরে আছে─ অবশ শরীরের ভেতর অসহায় রাগ-ক্ষোভ গজরাচ্ছে। সে বুঝতে পারছে না তাদের বাড়িতে তারা কারা─ কেন এত খারাপ ব্যবহার করলেন!

ভদ্রলোক একটা সিগ্রেট ধরিয়ে বললেন, খোকা তোমার খারাপ লাগছে─ লাগবেই─ তবে আরেকটু বড় হলে তুমি ঠিক বুঝবে─ এটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। তুমি ভেব না─ রাত বারটায় ট্রেন ছাড়বে─ তার আগে আমরা কিছু খেয়ে নেব। এখন আমি একটু ঘুমাব─ তুমিও ঘুমিয়ে নাও─ কথা বলতে বলতে প্ল্যাটফর্মের বেঞ্চে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়লেন ময়লা কোট-টাইপরা ভদ্রলোক।

চোখ বন্ধ রেখেই আবার বললেন, ঘুমাও খোকা─ আমি তোমাকে কাল ঠিক নামিয়ে দেব সিরাজগঞ্জ বাজার স্টেশনে─ চাইলে তোমাদের বাসায় পৌঁছে দেব─ কোন চিন্তা নেই তোমার।
তারপর অনেকক্ষণ সাড়াশব্দ নেই। ধীরে ধীরে নাক ডাকার শব্দ ওঠছে। হাসু বুঝল ভদ্রলোক ঘুমিয়েছেন।
আচমকা ঘুম জড়ান স্তিমিত কণ্ঠে তিনি বললেন, চাকরি আমার যায়নি─ কিন্তু যেতে কতক্ষণ! আর চাকরি নেই একথাই তো সহজে বিশ্বাস করছে লোকজন─ যে যা বিশ্বাস করে তাকে তো তাই বলতে হয়─ কী ঠিক না খোকা?

হাসু ঠিক বুঝতে পারল না তিনি কি বলছেন─ এর অর্থইবা কি। সে চোখ বন্ধ করে ঝিম মেরে থাকল─ তার ভেতর প্রচন্ড ক্ষোভ-অভিমান উথালপাতাল করছে। ক্ষোভটা কি তাদের বাড়িতে জেঁকেবসা লোকগুলোর ওপর না অন্য কারও ওপর─ ঠিক ঠাহর করতে পারছে না। এই প্রথমবার  মা’র কথা মনে পড়ল─ বাবার কথা মনে পড়ল─ মনে পড়ল ভাই-বোনেদের কথাও। সকাল বেলায়ই বাড়িতে হৈচৈ পড়ে গেছে─ মা খুব কাঁদছেন─ সবাই তাকে খুঁজে খুঁজে হয়রান হচ্ছেন─ এই দৃশ্যগুলো সে স্পষ্ট দেখল। মনটা আরও খারাপ হয়ে গেল। বাবা-মা আর ভাই-বোনেদের কথা মনে করে তার কান্না পাচ্ছে─ ভীষণ কান্না পাচ্ছে। সে নিঃশব্দে কাঁদল─ কাঁদতে কাঁদতে ক্লান্ত হয়ে পড়ল। ক্লান্তিতে এক সময় চোখের পাতা ভারী হয়ে এল।

ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে হাসু কথা বলল বাবার সাথে─ বলল, বাবা আমাদের ধর্মতলার বাড়িতে এরা কারা? আমাকে চিনল না─ ঢুকতেই দিল না ওরা!

বাবা বললেন, তুমি বুঝতে পারছ না ওটা আর এখন আমাদের বাড়ি নয়─ আমরা ছেড়ে এসেছি─ সব ছেড়ে এসেছি─ হাসু বলল, কিন্তু আমাদের বাড়ি─ আমাদের সব কিছুই তো রয়ে গেছে─ বাবা বললেন, বাড়ি-মাটি এসব কেউ নিয়ে আসতে পারে না─ ছেড়ে আসতে হয়─ ঘুমের ভেতর হাসু বাড়ির পেছনের ওই কামিনী গাছের ফুলের সুবাস পেল─ নীল আকাশ থেকে পাহাড়ি ঢলের মত নেমে আসা জোছনায় থই থই ছাদ─ দুধের মত ধবল অঢেল সেই জোছনা গায়ে মাখতে মাখতে নিজেকে হারিয়ে ফেলল হাসু─ সন্ধ্যায় ঘুম ভেঙে হঠাৎ বুঝতে পারল না সে কোথায় আছে─ পরক্ষণেই মানুষজনের সাড়াশব্দ-হল্লা তাকে ফিরিয়ে আনল শিয়ালদহ স্টেশনে। বিশাল স্টেশন─ কত কত ট্রেন আসছে-যাচ্ছে─ যাত্রীরা উঠছে-নামছে─ কারও দিকে তাকাবার ফুরসত নেই তাদের। হঠাৎ তার মনে প্রশ্ন জাগল─ ধর্মতলার ওই বাড়িটা কী এরকম ট্রেন একটা─ তারা নেমে গেছে─ অচেনা লোকজন উঠে পড়েছে এবং বাড়িটা এখন ওই লোকেদের! না─ সে কিছুতে মানতে পারল না─ বাড়ি ট্রেনের মত হতে পারে না─ বাড়ি মানুষের আবাস─ মানুষ আবাসছাড়া হবে কেন!

ভদ্রলোক বললেন, খোকা বামদিকে রেস্টরুমে হাতমুখ ধোয়ার জায়গা আছে যাও─ চোখেমুখে ভাল করে জলের ঝাপটা দেবে─ টয়লেটে ঢোকার মুখে হাসু কাঠের ফ্রেমে বাধানো আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে পড়ল। অনেকক্ষণ ধরে দেখল─ এরকম একটা আয়না ওদের ধর্মতলা স্ট্রিটের বাড়িতে ছিল─ ওরা সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়েছে─ এখনও কী আয়নাটা দক্ষিণের ঘরেই রয়েছে! আয়নায় চোখমুখ আজ এত শুকনা─ এত ক্লান্ত দেখাচ্ছে─ প্রশ্ন জাগল─  এ চোখমুখ কার! নিজেকে কী সে চিনতে পারছে না─  আচমকা আয়নাটায় ওই ক্লান্ত-শ্রান্ত চোখমুখ ভেঙেচুরে কিমাকার─  মনে হচ্ছে টুকরাগুলো কখনও একসঙ্গে মিশে আস্ত চোখমুখ আর হবে না!

ভদ্রলোক বাইরে থেকে ডাকলেন, খোকা বের হও─  আমরা খেতে যাব─  কিছু খাব─ খাওয়া শেষে হাসু পকেট থেকে পয়সা বের করলেও তাকে দিতে দিলেন না ভদ্রলোক। ক্যাশ কাউন্টারের পেছনে ঝুলানো আয়নায় তাকিয়ে হাসু আশ্বস্ত হল─  না চোখমুখ অন্য কারও নয়─  তারই─ এখানে দু’রকম নয় টি স্টল এক রকম─  ওখান থেকে বেরিয়ে হাসু দেখল স্টেশন শেডের লোহার পিলারে ঠেস দিয়ে বসে আছেন কালকের সেই মহিলা। তাকে দেখে মনে পড়ল গোটা ট্রেনের মানুষের হৃদয় নিষিক্তকরা করুণ সুরের সেই গীত-গান। প্রশ্ন জাগল─  সবাই তো চলে গেছেন─  মহিলা এখনও গেলেন না কেন?

প্ল্যাটফর্ম ধরে হাঁটতে গিয়ে হাসুর মনে হল─  যাক আরেকজন চেনা মানুষও আছেন─   
তখনই দূর থেকে ভদ্রলোক ডাকলেন, খোকা ওদিকে যাবে না─
কাছে আসার পর বললেন, এই প্ল্যাটফর্মেই আমাদের ট্রেন আসবে ঘন্টাখানেকের মধ্যে─  ট্রেনে উঠে একটা লম্বা ঘুম দেব─

সাত.

এত লোক কোথায় ছিল এই ট্রেনের অপেক্ষায়─  বুঝতে পারল না হাসু। ট্রেনে ঠাসাঠাসি ভিড় হওয়ার আগেই ভদ্রলাক ওকে নিয়ে জানালার পাশে বেঞ্চের কোণে বসে গেলেন। ইঞ্জিনের আচমকা হুইসেল─  ট্রেন চলতে শুরু করেছে। স্টেশন ছাড়িয়েও আলোময় শহর। হাসুর মনে হল আকাশভরা তারার মাঝখান দিয়ে ছুটছে ট্রেন। অনেকক্ষণ পর ট্রেন শহর ছাড়িয়ে অন্ধকারের উপর ছাইরঙ ধোঁয়া উড়িয়ে ভোঁস ভোঁস করে এগোতে লাগল।

প্যাসেজে পুটলা-পুটলির ওপরও বসেছেন লোকজন─  সবাই ক্লান্ত বিধ্বস্ত। পুরো কম্পার্টমেন্ট জুড়েই কালকের দৃশ্য─  সেই একই দৃশ্য। শুধু কালকের লোকগুলোর জায়গায় নতুন লোক। কোন শব্দ নেই─  সেই একই রকম নীরবতা জেঁকে বসে আছে গোটা কম্পার্টমেন্টে। প্রায় সবাই গা ছেড়ে বসে আছেন কালকের মতই─  অনেক ধকল গেছে তাদের। শিশু-কিশোর-বৃদ্ধ ক্লান্তি লুকাতে পারছেন না কেউ। মনে হচ্ছে─  অনেকদিন তারা কথা বলেন না। নীরব মানুষগুলোর কারও চোখে শূন্য দৃষ্টি─  আবার কারও দৃষ্টিতে উৎকন্ঠা আর অসহায়ত্বের ছায়া কাঁপছে─  কাঁপতে কাঁপতে ছায়াটা বড় হচ্ছে─  ছোট হচ্ছে তবে চোখমুখে কোন ভাবান্তর নেই।

কালকের─  আজকের মানুষগুলোর মুখ এত করুণ কেন? কেন তারা হাসিখুশি স্বাভাবিক হতে পারছেন না? হাসু এ প্রশ্নের স্রোতে অনেকক্ষণ ঘুরপাক খেতে থাকল─  বের হতে পারল না। বেশ ক’বারই তো বাবা-মার সঙ্গে ট্রেনে গ্রামের বাড়ি গেছে─  যাত্রীদের হৈ-হল্লা আর হাসি-আনন্দে ভরা থাকত ট্রেন। কতজনের কত কথায় মুখর থাকত─  এখন গোটা ট্রেন নীরব─  যেন ঘুমের মধ্যে গড়িয়ে চলেছে─  এই শব্দ ছাড়া কোথাও আর কিছু নেই─   

হাসু বাইরে তাকিয়ে থাকতে পারল না। কমপার্টমেন্টের ভেতর টিমটিমে আলোয় সবকিছু থমথমে─  মহিলারা শাড়ির আঁচল কিংবা ওড়নায় ভাল করে মুখ-মাথা ঢেকে আছেন আর পুরুষদের মুখে লেপ্টে রয়েছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। 

এক এক করে সে সবার মুখে দৃষ্টি বুলাতে গিয়ে দেখল তার সামনের বেঞ্চিতে চুপচাপ বসা মহিলাটির চোখে নীরব আর্তি-আকুলতা। এই একই রকম আর্তি-আকুলতা সবার মুখে আসন্ন কান্না-মেঘের ছায়া ফেলেছে। টিমটিমে আলো আর এই বেদনাতুর চোখমুখ─  সবকিছু সেই কালকের মত ক্রন্দনে ভারাক্রান্ত─  একই রকম করুণ করে তুলেছে পরিবেশ।

গেদে স্টেশনে পৌঁছার পর হাসুর ঘুম ভাঙল। যথারীতি সীমান্তরক্ষীদের চেকিং শুরু হল। কয়েকজন নারী-পুরুষকে পুটলাসহ নামিয়ে নেয়া হল─  অনেকক্ষণ পরও তারা যখন ফিরলেন না সাথের লোকেরা অস্থির হয়ে দরজায় তাকিয়ে আছেন। হাসুর মনেও প্রশ্ন জাগল─  কোথায় গেলেন তারা─  ফিরে আসবেন কখন?

অনেকক্ষণ পর ফিরে এলেন─  চোখ স্থির─  মুখ রক্তহীন ফ্যাকাসে─

হাসুর হঠাৎ মনে পড়ে গেল─  ঠিক একই রকম দৃশ্য যাবার সময় দর্শনাতেও দেখেছে─  এভাবেই পুটলা-পুটলিসহ কাউকে কাউকে নিয়ে যাবার পর করুণ চোখ আর রক্তহীন ফ্যাকাসে মুখ নিয়ে তারা ফিরে আসেন। গেদেতেও একই রকম ঘটল─  লোকগুলোর চোখ-মুখে যতটুকু প্রাণস্পন্দনের ছাপ ছিল তা-ও যেন রেখে যেতে হচ্ছে─  গতকালও এমনটাই দেখেছে। হাসু আরও অনেক কিছুর মত ভেবে পেল না কেন এমনটা হচ্ছে!

এপারে দর্শনায় চেকিংয়ের সময়ও রক্তশূন্য নির্বাক মানুষগুলো নিয়ে ট্রেনটা মরা অজগরের মত পড়ে থাকল। শেষ পর্যন্ত সকালবেলা ট্রেন ছাড়ল─  অল্পক্ষণ পরে দরজার কাছ থেকে কেউ ফুঁপিয়ে ওঠল। হাসু এক এক করে সবার মুখ দেখল─  দুই দরজার মাঝখানে বসে থাকা মহিলার ভাবলেশহীন চোখমুখে গভীর কম্পনে তার দৃষ্টি আটকে গেল। আর তখনই ওই ফুঁপানো শব্দ আরও কয়েক জায়গা থেকে গুমরে-ওঠা কান্না হয়ে একসঙ্গে ফেটে পড়ল। হাসুর মনে পড়ল─  কাল যাবার সময়ও দর্শনা পার হয়ে গেদে থেকে ট্রেন ছাড়ার পর একইভাবে প্রথমে ফুঁপানো তারপর যখন গুমরে-ওঠা কান্না হয়ে ওঠল তখন মাত্র একজন মহিলা কান্না থামিয়ে আচমকা বলে ওঠেছিলেন─  সব নিয়ে গেছে─  আমার সব গেছে─  এরপর ঢলে পড়েছিলেন আরেক মহিলার গায়ে। আজকেও ঠিক একই রকম কান্নাভেজা কণ্ঠ ভেসে এল─  সব গেছে আমার─  সব কেড়ে  নিয়ে গেছে─  আজ কথা বলেওঠা মহিলা ঢলে পড়লেন না─  পেছনে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করলেন। গাল বেয়ে নেমেআসা চোখের জল শুকিয়ে ঘোলা বালির মত কড়কড়ে হয়ে আছে─  বালির কথাটা কেন তার মনে পড়ল─  অনেক ভেবেও হাসু ঠিক বুঝতে পারল না। তবে দেখল─  শুধু ওই মহিলার নয় যাদের নামিয়ে নেয়া হয়েছিল তাদের সবার শব্দ-নিঃশব্দ কান্না একইভাবে যাত্রীসহ পুরো ট্রেনটাকে ঘুণপোকার মত কুরে কুরে খাচ্ছে। জন্মভিটা ছেড়ে আসা আর সব হারাবার বেদনা একসঙ্গে মিলে গেলে কান্না কী এরকম ঘুণপোকায় কাটার মত হয়ে ওঠে? মানুষ কি শুকনা গাছ-কাঠ─  হাসু জানে না। তার শুধু কষ্ট হচ্ছে এই মানুষগুলোর জন্য─  নিজের কষ্টও কী সে ভুলে যাচ্ছে! 

সামনের মহিলা বুকের কাছে একটা ছবির ফ্রেম আঁকড়ে আছেন─  মাঝে মাঝে চোখের সামনে মেলে ধরে ছবিটা দেখছেন আবার বুকে চেপে রাখছেন─  কখনও ওড়নার আঁচল দিয়ে যত্ন করে মুছে নিচ্ছেন ছবিটা। জমাটবাধা নীরব কান্না যে কতটা হৃদয় বিদারক হতে পারে হাসু দেখল এই মহিলার চোখে।
পাশের মহিলা বললেন, আপা ট্রেনে উঠার পর থেকেই দেখছি ছবিটা বুকে ধরে আছেন। এতক্ষণ জিজ্ঞেস করার সাহস পাইনি─  ওটা কার ছবি আপা?
মহিলা উল্টোদিকের জানালায় উদাস দৃষ্টি মেলে দিয়ে বললেন, ছেলে¬─  আমার ছেলে─  পাশের মহিলা জিজ্ঞেস করলেন, কোথায় আপনার ছেলে?

মহিলা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, নেই─
পাশের মহিলা বললেন, নেই মানে─

মহিলা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বুকের ভেতর উথলে-ওঠা কান্না দমিয়ে বললেন, কলকাতায় দাঙ্গার সময়─  ওর আব্বার ইন্তেকালের পর কলেজ ছাড়িয়ে ওকে হোটেলটা দেখতে দিয়েছিলুম─  নইলে হয়ত ওকে হারাতুম না। কিছু করার ছিল না─  হোটেল চালাবার আর কেউ ছিল না তো। ওর আব্বা বলতেন─  এই ব্যবসা বড় খ্যাচরা─  নানাদিক সামলে করতে হয়। ব্যবসায় বসাব না ছেলেকে─  ও পারবে না। অথচ এই আমি জোর করে বসালাম ওকে─  আর এই খ্যাচরা ব্যবসাই আমার ছেলেটাকে খেয়ে ফেলল।

মহিলা ওড়নায় চোখ মুছে বললেন, আমাদের চার পুরুষের ক্যালকাটা-বাস। জীবনে একদিনের জন্যও ক্যালকাটা ছেড়ে  বাইরে যাইনি─  এখন সব ছেড়ে এসছি─  আমার ভাইরা ঢাকা চলে এসছে─  দেখুন প্রাণের মায়া কত! স্বামী হারালুম─  একমাত্র সন্তান─  পুত্রও হারালুম─  আমি একা─  ভাইরা চিঠি লিখছেন─  কে দেখবে তোকে─  কার কাছে থাকবি─  একা থাকতে পারবিনে চলে আয়─  চলে এসছি─  কিছু আনতে পারিনে─  কিছু না─  সব ছেড়ে এসছি─  একেবারে রিক্ত-নিঃস্ব যাকে বলে─  তাই─  কিন্তু কেন─  কেন এটা হোল জানিনে─  জানিনে─  ছেলের স্মৃতি─  ওর আব্বার স্মৃতি─  চার পুরুষের স্মৃতি─  সব ছেড়ে─

মহিলা ওড়নায় মুখ ঢাকলেন─  শরীর ফুলে ফুলে উঠছে। পাশের মহিলা স্তব্ধ হয়ে গেলেন সব শোনে─  আমবাগানটা ভাল দামে বিক্রি করা যায়নি─  এই নিয়ে স্বামীকে একটু আগেও মনে মনে দোষারোপ করেছেন। অথচ স্বামী-সন্তান নিয়ে আসতে পেরেছেন। দু’বছরের ঘুমন্ত ছেলেকে অজান্তেই বুকে আঁকড়ে ধরলেন।
বারভাজাওয়ালা চেঁচিয়ে ওঠল, বা-রো- বা-জা─  সামনের বেঞ্চে যে কিশোর ছেলে শূন্য দৃষ্টি মেলে এতক্ষণ তাকিয়েছিল─  চেঁচানো শব্দ শুনেই আঁতকে ওঠল। আ-ব্বা-আ-ব্বা বলে চিৎকার দিয়ে আঁকড়ে ধরল তার বাবাকে। সবাই সচকিত হয়ে ফিরে তাকালেন─  ভয়ে-আতংকে তার চোখ এতটাই বিস্ফারিত যে হাসুও আঁতকে ওঠল।
ছেলেটা আস্তে আস্তে নেতিয়ে পড়ল। ওর মা’র বাড়িয়ে দেয়া বদনা থেকে পানি নিয়ে বাবা চোখেমুখে ছিটিয়ে দিলেন─  দু’হাতে মুখটা ধরে নাড়া দিতে থাকলেন। অনেকক্ষণ পর একটু নড়ে ওঠল এবং চোখের পলক পড়ল─  ওর বাবা-মা হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। যারা এতক্ষণ উৎকণ্ঠিত দৃষ্টিতে দেখছিলেন তারাও স্বস্তি বোধ করলেন।
সীটে বসে নামাজ আদায় করে যিনি তসবীহ গুণছিলেন তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ভাই কি হয়েছে আপনার ছেলের? শিয়ালদা থেকে ট্রেন ছাড়ার পর একবার দেখলুম এরকমটা হোল! বুঝতেই পারছেন তখন জিজ্ঞেস করতে পারিনি─

ওর বাবা বললেন, এরকম হয়─  জোরে কোন শব্দ শুনলেই হয়─
ভদ্রলোক জানতে চাইলেন, কিন্তু কেন?

ওর বাবা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়লেন, কী বলব ভাইজান সবই কপালের গর্দিশ। সারা গ্রামে আমরা ছিলুম মাত্র কয়েক ঘর─  ভয়ে আতংকে ভুগে ভুগে সিদ্ধান্ত নিলুম ছেড়েই আসব। মাঠের জায়গা বিক্রি করে দিলুম কোন সমস্যা হল না─  কিন্তু বাড়ির পেছনে একটা বেশ বড় দিঘি ছিল কয়েক পুরুষ আগের─  ওই দিঘিতে মাছ খুব দ্রুত বাড়ত─  প্রতি বছর যা বিক্রি হত─  তাতে সারা বছরের খায়-খরচা চলে আসত। আমার দাদা বলতেন, দিঘিটার যত্ন নিস─  পারলুম না। তিনটা পার্টি একসাথে এগিয়ে এল দিঘি কেনার জন্য─  কাউকেই কথা দিতে পারলুম না। মাইল পাঁচেক দূরে একটা স্কুলে শিক্ষকতা করতুম। বাইসাইকেলে যেতুম─  একদিন সন্ধ্যের আগে আগে স্কুল থেকে ফিরছিলুম। আরেকটা বাইসাইকেল ধাক্কা দিল─  পেছনে ছিল একটা জীপ─  চালিয়ে দিলে এই পায়ের উপর দিয়ে। লোকজন হসপিটালে নিয়ে গেলে─  ওখানে কেটে ফেলতে হল পা’টা। ক্রাচে ভর দিয়ে মা’র সামনে এস দাঁড়ালুম। মা কাঁদলেন না─  মন খারাপ করলেন না। বললেন─  পা গেছে─  ভাল─  জানটা আছে─  আর নয়─  চল─  চলে যাই। আমার ছেলেটা আমাকে ওই অবস্থায়─  সাদা ব্যান্ডেজ-করা কিম্ভুত কাটা পা দেখে ভয়ে-আতংকে চিৎকার দিয়ে ওঠল। ওই থেকেই এরকম মাঝেমধ্যে কলজে কাঁপিয়ে-তোলা চিৎকার করে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, শেষ পর্যন্ত দিঘিটা বিক্রি করতে পারলুম না─  বলতে পারেন এক প্রকার পালিয়েই এস্ছি।

বোঝাই যায়নি এতক্ষণ একটা পা নেই ভদ্রলোকের। ক্রাচে ভর দিয়ে অনেক কষ্টে তিনি টয়লেটে গেলেন।

ছেঁড়া কোট-টাইপরা ভদ্রলোক হাসুর পাশ থেকে আচমকা উঠে দাঁড়ালেন। চারদিকে তাকিয়ে নিয়ে বলতে শুরু করলেন, পার্ডন মি─  লেডিস এন্ড জেন্টেলম্যান─  ইউ আর অল টায়ার্ড বোথ ফিজিক্যালি এন্ড মেন্টালি─  আই অ্যাম অলসো ট্রাভেলিং উইথ ইউ ফ্রম ইন্ডিয়া। আই ওয়াজ এ্যান অফিসার ইন দ্য ওয়েস্ট বেঙ্গল রেলওয়ে─  বাট নাউ আই অ্যাম নোবডি─  বিকজ আই হ্যাভ লস্ট মাই জব। আই কেম ফ্রম এ্যা রেসপেক্টবল মুসলিম ফ্যামেলি। নাউ উইথ ফোর মাইনর চাইল্ড অ্যান্ড ওয়াইফ আই অ্যাম ইন গ্রেট ট্রাবল─  উইল ইউ প্লীজ হেল্প মি উইথ সাম কয়েনস─

এতক্ষণ যারা ঝিমুচ্ছিলেন এবং যাদের অসহায় দৃষ্টি ট্রেনের অব হোয়াইট ছাদে ঘুরপাক খাচ্ছিল─  তারা ভাল করে তাকালেন ভদ্রলোকের দিকে। সুদর্শন এই ভদ্রলোকের সারা মুখ জুড়ে খোঁচা খোঁচা কাচা-পাকা দাড়ি-জীর্ণ-শীর্ণ ময়লা জামা-কাপড় এই সব কিছুর মধ্যে তারা নিজেদের উপর আচমকা ছাপ-ফেলা চরম অসহায়ত্বকেই দেখলেন। অনেকেই আনি/দু’আনি বের করে তুলে দিচ্ছেন। থ্যাঙ্কূ─  থ্যাঙ্কূ বলে ভদ্রলোক মাথা ঝুঁকিয়ে উল্টো করে ধরা তার হ্যাটে পয়সা নিচ্ছেন─  ওখান থেকে নিয়ে পকেটে রাখছেন─  এক সময় কালকের মতই পয়সার ভারে গোল হয়ে উঠছে তার জীর্ণ ময়লা কোটের পকেট।

আট.

জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে হাসুর ভাল লাগল─  গা ঘেঁষাঘেঁষি ঘরবাড়ি-গাছপালা-ফসলের মাঠ সব ¯িœগ্ধ আলোয় ভর করে জেগে ওঠছে। তার মাঝ বরাবর ছুটছে মেইল ট্রেন─  যত সামনে এগোচ্ছে তত হাসুর মনে পড়ছে মা’র কথা-বাবার কথা-ভাইবোনেদের কথা এবং ইলিয়ট ব্রিজের পাশে সাদা দোতলা বাড়িটির কথা─  অন্ধকারেও যে বাড়ির সাদা রঙ এক প্রকার আলো ছড়ায়।
এক রাতে উল্লাপাড়ার গ্রামের বাড়ি থেকে জীপে করে আসার পর ওর ছোটভাই বলেছে, ভাইয়া দেখ-দেখ ওই আমাদের বাড়ি─  দেখা যাচ্ছে।
হাসু বিরক্ত হয়েছে ওর বোকামিতে। তাদের বাড়ি তো ধর্মতলা স্ট্রিটের ওই দোতলা বাড়ি─  রাতে কামিনী ফুলের ঘ্রাণ ঘন কুয়াশার চাদরের মত ঘিরে রাখে যে বাড়ি।
শিয়ালদহ থেকে যারা এসেছেন তাদের কারও চোখে ঘুম নেই। ছেড়ে আসার বেদনা আর অজানা ভবিষ্যত─  দ্বিমুখী এই আঘাতে তাদের চেতনা সটান। ভোরের স্বচ্ছ নিস্তব্ধতা ভেঙে ট্রেনের একটানা ছেড়ে আসছি─  ছেড়ে আসছি শব্দ হাসুর ক্লান্ত চোখে গভীর ঘুম নামিয়ে দেয়─  জানালার কোণে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে যায়─  কখন এবং কতক্ষণ ঘুমিয়েছে জানে না।

সিরাজগঞ্জ বাজার স্টেশনে ট্রেন পৌঁছার আগেই জীর্ণ কোট-টাইপরা ওই ভদ্রলোক এসে তাকে জাগিয়ে দেন।
স্টেশনে নেমে বললেন, খোকা একটু দাঁড়াও─  ওই বিসমিল্লাহ মুসলিম হোটেল থেকে আমি রাতের খাবারটা কিনে নিই─  ওরা পরোটা আর গরুর গোশতের ভুনাটা বেশ ভাল করে!
শালপাতায় মুড়িয়ে দেয়া খাবার হাসুর হাতে দিয়ে সিগারেট ধরালেন। স্টেশন থেকে বের হবার পর হাসু ভেবে ঠিক করতে পারছে না কোনপথ ধরে যাবে। এরকম সন্ধ্যা-লগ্নে কখনও সে স্টেশনে আসেনি। লোকটা তাকে তাড়া দিয়ে হাঁটতে শুরু করলেন।
বাজারের শেষ মাথায় একটা গলির মুখে এসে বললেন, খোকা আরেকটু অপেক্ষা কর─  আমি আসছি─  কিচ্ছু ভেব না─  আমি তোমাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে তারপর যাব─
হাসু দাঁড়িয়ে থেকে দেখল─  লোকটা দ্রæত পা চালিয়ে গলির ভেতর ঢুকছেন। কিছুক্ষণ পর কাগজে মোড়া বোতলের মত কিছু বগলে করে বেশ ফুরফুরে মেজাজে গলি থেকে বেরিয়ে আসেন─  তারপর ইলিয়ট ব্রিজ পার হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন। ব্রিজে উঠেই হাসু বুঝতে পেরেছে বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছে গেছে।

তিনি বললেন, খোকা দেখ তো কোনটা তোমাদের বাড়ি─  তুমি চিনতে পারলেই আমি তোমাকে পৌঁছে দেব─  
লোকটার কথা কেমন এলোমেলো─  এখন হাসুর যেন মনে হচ্ছে─  লোকটা আর ঠিক আগের মত নেই।
কিছু বুঝতে না পারলেও হাসু বলল, ওই যে─  ওটা─  আপনার কষ্ট করতে হবে না─  আমি একা যেতে পারব─
তিনি বললেন, যেতে পারবে তো─  পারলে তুমি যাও আমি এখানে দাঁড়াই─  
পারব─  বললেও হাসুর বুকের ভেতরটা আচমকা ধক্ করে ওঠল। আগের দিন সকালে কাছাকাছি পৌঁছেও স্কুলে না ঢোকে গেটে বাদামওয়ালার কাছে বইপত্র রেখে সোজা বাজার স্টেশনের পথ ধরার আগে হাফপ্যান্টের পকেটে হাত দিয়ে কয়েকদিনে জমানো টাকার অস্তিত্বটুকুই শুধু অনুভব করেছে। কলকাতার টিকেট কেটে স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে লোহার বেঞ্চিতে বেশিক্ষণ বসে থাকতে হয়নি─  ট্রেন আসামাত্র নিশ্চিন্ত মনে চেপে বসেছিল।
আজ বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াবার আগে একবারও মনে হয়নি─  তাকে এই বাড়িটাতেই আবার ফিরে আসতে হবে─  বাড়ি সামনে রেখে যে ভয়টা তাকে ঘিরে ধরেছে তখন এর কিছুই বোধ করেনি। বাবা-মা আর ভাইবোন কারও কথাই তার মনে পড়েনি─  কেন মনে পড়েনি এখন ভেবে শিউরে ওঠছে। বরাবর বাবাকে নয় ভয় তার মাকে─  মা আজ কী করবেন কে জানে! পরক্ষণেই মনে হল বাবাও বোধহয় আজ তাকে ছাড় দেবেন না।
হাসু বাড়ির গেট থেকে পেছন ফিরে দেখল─  রাস্তার মাঝখানে বাতিবিহীন একটা লাইটপোস্টের মত দাঁড়িয়ে আছেন ইংরেজি-বলা সাহেবি কেতার ওই ভদ্রলোক─  তার বগলে চেপে রাখা ওই বোতল আর হাতে ধরা শালপাতায় মোড়া খাবার─  পরোটা-গরুর গোশত!

রচনাকাল ঃ অক্টোবর ১৯৯৯

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *