ঈদসংখ্যার গল্প।। মানবী।। কাজী লাবণ্য
সুমিতা দেবী পুত্রবধূ নন্দিনীর কাঁধে আলতো হাত ছুঁয়ে, কিছুটা অনুরোধের সুরেই বললেন,
‘যাও মা পরনের শাড়ি ছেড়ে পরিষ্কার গরদ খানা পরে এসো’। নন্দিনি নত মুখে স্বামী শ্বশুরের সামনে দিয়ে চলে গেল নিজের ঘরে শাড়ি পাল্টাতে।
সকল আয়োজন সম্পন্ন। সব লাইট অফ করে বাড়ি অন্ধকার করে রাখা হয়েছে। তারপরও পাশের হাইরাইজ বিল্ডিং এর প্রতি ফ্লোরের কোনে কোনে লাগানো উজ্জ্বল এনার্জি লাইটের আলোক আভায় এক চিলতে উঠোন প্রায় পরিষ্কার দেখা যায়।
বারান্দার ইজিচেয়ারে বসে আছেন এ বাড়ির কর্তা পরান বন্দোপাধ্যায়, কিছু দূরে আরেকটা চেয়ারে বসে তাঁর ছেলে সুমিত ব্যানার্জি, মেয়ে সুনীতি বারান্দার পিলারে একবার হেলান দিয়ে, একবার সোজা হয়ে, আবার হাত দিয়ে পিলারটা জড়িয়ে ধরে অস্থির চঞ্চল হয়ে সবার মুখের দিকে তাকিয়ে, আবার উদাস হয়ে আকাশের দকে তাকিয়ে থাকে।
একটি মোড়ায় বসে আছেন পৃথুলা সুমিতা দেবী। মনে মনে মাকে ডাকছেন, ‘মা, উদ্ধার করো তোমার নামে পুজো দেব, উপোস দেব, তবু সংসারের এই বিপদ থেকে উদ্ধার করো মা’। পুরো ব্যাপারটা উনি নিজে পছন্দ করছেন না, আবার বদরাগী স্বামীর মতের বিপক্ষে কিছু বলার সাহসও পাচ্ছেন না।
বারান্দার খুব কাছেই ছোট্ট একটি তুলসি মঞ্চ। তুলসি গাছের গোড়াটি নিচের অংশে ইটের গাঁথুনির উপর গ্রীল দিয়ে ঘেরা এবং গ্রীলের মাথাগুলি বেশ চোখা চোখা ।
একচিলতে উঠোন, বারান্দা ঘিরে যেন একটা আলো আধারি, একটা ভৌতিক পরিবেশ। তুলসি মঞ্চের কাছেই একটি লৌহ পাত্রে কাঠকয়লার আগুন, কিছু কাঠের টুকরো জ্বলে জ্বলে গনগনে অঙ্গারে রূপ নিয়েছে, আর কিছু কাঠ ধিকি ধিকি জ্বলছে অঙ্গার হবার অপেক্ষায়। অঙ্গার যেন গনগনে থাকে সে জন্যে মাঝে মাঝেই সুন্দর করে ছোট ছোট টুকরো করে রাখা কাঠগুলি আগুনের মাঝে ফেলে দিচ্ছেন, বাড়ির কর্তা পরান বন্দ্যোপাধ্যায়।
রাগে, কষ্টে এবং এক ধরনের ভয়ে কলেজ ছাত্রী সুনীতির খুব অস্থির লাগছে। ওর মনে মনে খুব ইচ্ছে করছে এক লাথি মেরে আগুনের পাত্রটা উল্টে দিয়ে, এখান থেকে চলে যেতে। কিন্তু বাবার ভয়ে তা করার সাহস নেই। ওর বুকের ভেতরটা ঢিপ ঢিপ করছে। ও খুব পরিষ্কার ভাবে জানে- একটা অনুচিত, বর্বর, অন্যায় কাজ হতে যাচ্ছে। তাই ও দাদাকে বলেছিল,
‘দাদা এ অমানুষিক কাজ যে ভাবেই হোক বন্ধ কর, এসব আদিম যুগের বর্বর কাজ করা ঠিক নয়। আধুনিক যুগে এসব কেউ করে, কেউ মানে? আশ্চর্য! তুই কিরে দাদা’!
ওর দাদা উত্তরে নিরুত্তাপ কন্ঠে বলেছে-
‘তুই ছোট মানুষ চুপ করে থাক, বড়রা যা করেন তা জেনে বুঝে ভালোর জন্য করেন, মঙ্গলের জন্য করেন কাজেই কষ্ট হলেও তা মেনে নেয়াই আমাদের উচিত, বাবামার সিদ্ধান্ত মানাই আমাদের ধর্ম। এতে ভগবান প্রসন্ন থাকেন। দাদার নিরুত্তাপ কন্ঠ ও এমন উত্তরে রাগে প্রায় উম্মাদ হয়ে যায় সুনীতি, নিস্ফল ক্রোধে ছোটফট করতে থাকে।
এমন নিষ্ঠুর কাজে ভগবান কি মঙ্গল করবেন, প্রিয় বৌদিকে অপমান করা, বৌদির হাতে ঘা হওয়া ছাড়া কি মঙ্গল আছে, তা কিছুতেই বুঝে উঠতে না পেরে সুনীতি রাগে এক রকম মুখ ঝামটা দিয়ে পা দপদপিয়ে দাদার সামনে থেকে চলে যায়। নিজের ঘরে শুয়ে শুয়ে ভাবে কি ভাবে এসব মোস্ট ফালতু কাজ বন্ধ করা যায়! আজকাল টিভি, পত্র পত্রিকায় নারী নির্যাতনের কথা ফলাও করে বলা হয়, মাঝে মাঝে ঘোষণা করা হয়, নারী নির্যাতন, বাল্যবিবাহ, বা এই ধরনের অপরাধ মূলক কাজ দেখলে এই এই নম্বরে ফোন করুন- সেখানে কিছু নাম্বার দেয়া থাকে। কিন্তু এখন তো সেগুলি কিছুতেই মনে পড়ছে না। সুনীতি কি কোনোদিন ভেবেছিল, যে ওই নাম্বার গুলি কখনও প্রয়োজনে আসতে পারে। আচ্ছা এই ব্যাপারটি কি নারী নির্যাতনের পর্যায়ে পরে? ও ঠিক জানে না, তবে এটি যাই হোক অত্যন্ত অন্যায় তা নিশ্চিত জানে।
আচ্ছা, সুনীতির কি উচিত এই কথা গুলি ওর বন্ধুদেরকে বলা- ওরে বাবা! বাবা তাহলে পাশের বাসার ফাতেমাদের গরু কোরবানির ইয়া বড় ছুরি দিয়ে সুনীতিকে জবাই করে ফেলবে।
স্নিগ্ধ, পবিত্র, লাল পেড়ে গরদ শাড়িতে যেন মা দুর্গার মত রূপ নিয়ে নন্দিনী এসে দাঁড়ায় তুলসি মঞ্চের পাশে। এখন ওর শ্বশুর এক টুকরো রক্তিম কয়লা নন্দিনীর হাতে দিলে, সেটি মুঠোয় নিয়ে ও গোল তুলসি মঞ্চ প্রদক্ষিণ করে প্রমান দিবে সে সতী। সতীত্ব প্রমাণের অভিনব আয়োজন।
নন্দিনী প্রুস্তুত। সে অতি শান্তভাবে গভীর দৃঢ়তার সাথে এসে দাড়ায়। দুচোখ বন্ধ করে, বুক ভরে বাতাস টেনে নিয়ে মনঃসংযোগ স্থাপন করে। হ্যাঁ, এদের এই অদ্ভুত প্রক্রিয়ার ভিতর দিয়ে সে যাবে, এদের ব্যবস্থামত এই পরীক্ষা সে দিবে। যদিও সে নিজে এসবের কিছুই মানে না, বিশ্বাস করে না। তাতে কি! দেখাই যাক না এরা কতদূর যেতে পারে, বাকিটা তো নন্দিনীর হাতে রইলই। অঙ্গার হাতে নেবার জন্য যেই সে হাত বাড়াতে যায়-
‘ছুটকি! ছুটকি’!
কার কন্ঠ! কে ডাকে এই নামে! মা! এখানে মা এলো কোত্থেকে! মা কিভাবে আসবে!
মাতো ইলেকট্রিক চুল্লিতে নাই হয়ে গেছেন সেই কবে, মা এখানে এই পাঁঠাবলীর মঞ্চে আসবে কিভাবে? মানুষের আত্মা বলে যদি কিছু থেকেও থাকে, সে আত্মা কি রাতের আকাশের ছুটে যাওয়া তারা হয়ে বা অন্য কিছু হয়ে ওর কাছে এসেছে!
‘ছুটকি, তুই ওটা হাতে নিস না। না ছুটকি, তোকে কোন কিছুর প্রমান দিতে হবে না। আমি তোকে বিয়ের আগে বলেছিলাম, কখনও কোন অবস্থাতেই স্বামীর ঘরের চৌকাঠ ডিঙ্গাবি না, মান সম্মান, সমাজের কথা ভাববি সে কথা আমি তুলে নিচ্ছি মা। তুই এ কাজ করিস না, কোন অবস্থাতেই না। কার উপর তোর এত অভিমান মা! কার উপর! মা হয়ে তোর কাছে ক্ষমা চাইছি তুই একাজ করিস নারে মা, করিস না ওটা হাতে নিস না’…
হঠাত যেন একটা দমকা হাওয়া দেয়। এতক্ষণ বাতাসের অস্তিত্তও টের পাওয়া যাচ্ছিল না। প্রচণ্ড ধার্মিক, ইংরেজীতে সুপটু, কড়া হেড মাস্টার মশাই একটি চিমটাতে এক খন্ড আগুন নিয়ে অপেক্ষমাণ, আদরের পুত্রবধূর হাতে তুলে দিবেন বলে-
বেশ গরম পড়েছে। ঘামে নন্দিনীর মুখ, গলা, ব্লাউজ ভিজে গেছে। দমকা বাতাসের সাথে মায়ের কণ্ঠস্বর কোথায় যেন মিলিয়ে গেল। মায়ের কণ্ঠস্বর কি বলল, অভিমান! কার উপর ওর অভিমান! মৃতা মা! বাবা! দাদা! এদের উপর কি অভিমান করা যায়! নাকি অভিমান আসে! তবে কি পরমপতি সুমিত! আহ বিবমিষা!
তাহলে কি নন্দিনীর আকাশের সকল অভিমানী মেঘ ধেয়ে যায় রাজের দিকে! নন্দিনি একটু দম নেয়। জল তেষ্ঠায় গলা-বুক যেন একেবারে চৈত্রের দুপুর। চাইলেই জল পাওয়া যায়, কিন্তু জল চাইবে না নন্দিনী, জলের বদলে সে হাত পাতে, এবার সে ওই জ্বলন্ত অঙ্গার হাতে নেবে, নিয়ে তুলসি বেদী ঘুরে এলেই প্রমাণিত হবে সে সতী। কি প্রমাণিত হবে, না হবে তাতে আদৌ আগ্রহ নেই ওর, কিন্তু তারপরও সে এই অবাস্তব কূপমন্ডুকতার ভিতর দিয়ে যাবে। ওর স্বামী সুমিত সব জেনেও চুপ করেই থাকল, একটি টু শব্দও করল না। নিজের সকল অস্তিত্তের বিশ্বাস যার কাছে জমা রেখে নিজের ২৫ বছরের সব ছেঁড়ে ছুঁড়ে যার বুকে পরম নির্ভরতায় নিজেকে সঁপে দিয়েছিল এখানে এই বলিদানে তার কোন ভূমিকাই নাই! হায় স্বামী!
গেল সপ্তাহে বরের সাথে ঝগড়া শেষে, রাগ করে সে বাসার বাইরে ছিল তিন দিন। ‘চিড়া নয়, মুড়ি নয়, একেবারে ভাত, এযে অন্ন পাপ’। সেরকম এটা কোন ছোট খাট অপরাধ নয়, বাড়ির বাইরে তিন দিন কাটানো তাও আবার একা ‘মেয়েমানুষ’। কাজেই হেড মাষ্টার মশাই এর মত নীতিপরায়ন মানুষের বাড়িতে সতীত্বের প্রমান দিতেই এই অভিনব অগ্নি পরীক্ষার আয়োজন। অগ্নি স্নানে সূচি হোক বংশ ভিটা।
‘ওম জবা কুসুমসঙ্কাশ কাশ্যপেয়’… নিত্য দিন ছাত্র ঠ্যাঙ্গানো ঠনঠনে কন্ঠের এই উচ্চারণ, সূর্য ভোরে নিত্য নিত্য ডানা মেলে আকাশে। ডানা মেলে, কিন্তু ওড়ে কি? নাকি মেঘ বাতাসে ধাক্কা খেয়ে ফিরে আসে এইসব ভন্ড মানুষের আস্তাকুড়ে।
দাঁতে দাঁত চেপে, সমস্ত শরীরকে স্থির করে, সকল ইন্দ্রিয়কে সুদৃঢ় করে সে হাত বাড়ায়, অপেক্ষা করছে, এক্ষুনি তার নরম তালুতে টকটকে লাল টুকরোটা পড়বে-
ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলে-
‘নন্দিনী! আমার নন্দিনী! তুমি একি করছ! তুমি ঢাকা ভার্সিটির সর্বোচ্চ ডিগ্রি নেয়া মেয়ে, তুমি এই শতাব্দীর মেয়ে, তুমি এসব কিসের মধ্য দিয়ে যাচ্ছ’!
সে ভীষণ বিচলত হয়ে পড়ে, নিজের অজান্তে ডানে বায়ে তাকাতে যায়…
‘কে! এ কার কন্ঠ’!
এ কন্ঠ যে চির চেনা রাজর্ষীর ব্যাকুল কন্ঠ। রাজর্ষি এখানে কিভাবে এলো? এসব কি হচ্ছে?
-আহ! রাজ তুমি এতদিন কোথায় ছিলে?
‘আমিতো আমার জায়গাতেই আছি নন্দিনী। আজও তোমার জন্যই আছি সোনা। তুমিই তো আমার কাছ থেকে হারিয়ে গেলে, আর তো তুমি আমার রইলে না, সে সময় সব শুনে ছুটে এসেও তোমাকে পাইনি’।
‘তোমার পি এইচ ডিতে এত সময় লেগে গেল, হাজার হাজার মাইল দূরে তুমি রইলে, মা শূন্য সংসারে বাবা, দাদা আর অপেক্ষা করতে পারল না। শিক্ষিত, আদর্শবান পিতার উপযুক্ত পুত্রের সাথেই আমার গাঁটছড়া বেঁধে দিল। যদিও গাঁটছড়া বাঁধতে গিয়ে কর্পোরেটের উচ্চপদস্থ কর্তাকে ‘পণ’ দিতে হয়েছিল। যথেষ্ট পণ দিয়েই এই অফিসারের দরোজার প্রবেশপত্র আমি নিয়েছিলাম। কিন্তু, কিন্তু মায়ের কন্ঠের মত তুমিও কি মিলিয়ে যাবে? যেও না! যেও না রাজ! কেবল কণ্ঠস্বর নয়, রক্তমাংসের মানুষ হয়ে এসো, জলজ্যান্ত মানুষ হয়ে আমার সামনে এসে দাঁড়াও। আমি তোমার বুকে আছড়ে পড়তে চাই। তোমার বুকের ভেতরে একটু আশ্রয় নিতে চাই, প্লিজ রাজ আমার ভীষণ ভয় করছে’…
নন্দিনীর ভিতরটা যেন নরম, কোমল, দুর্বল হতে চায়…
আবার ঝট করে সে নিরেট বাস্তবতায় ফিরে আসে, আবার কঠোর হয়, শক্তি সঞ্চয় করে। নন্দিনী এসব কি ভাবছে, ওর ভার্চুয়াল মন ভয়াবহ পরিস্থিতিতে নিজের অজান্তেই এসব নানাবিধ আশ্রয় কি ওর জন্য তৈরি করছে!
তাই যদি হয়, হে আমার অবচেতন! তুমি আরো শক্তিশালী হও, রাজকে কেবল কণ্ঠস্বর নয়, মানুষ হিসেবে নিয়ে এসো। আমি বাঁচি।
রাজর্ষী এখানে নেই জেনেও যখন ওকে পাওয়ার ইচ্ছে প্রবল ভাবে মনের ভেতর ডানা ঝাপ্টাচ্ছিল ঠিক তখুনি- হেড মাষ্টার মশাই চিমটার মাথায় ধরা লাল গনগনে টুকরোটা ছেড়ে দিলেন। সেটি পড়ছে, পড়ছে, যেন অনন্তকাল ধরে সাত আসমানের উপর থেকে ধেয়ে আসছে এক জলন্ত অগ্নিকুন্ডু…
ত্রিকাল কাঁপানো এক আর্ত চিৎকার বহু কষ্টে গিলে খেয়ে নন্দিনী অঙ্গার সহ হাত সামনে নিয়ে এগিয়ে যেতে থাকে। প্রতি মুহুর্তে মনে হয় ছুঁড়ে ফেলে দেয় এই অর্থহীন অমানষিক যন্ত্রনা, কিন্তু নিজের প্রতিজ্ঞায় অটল থাকে সে। তুলসি গাছের বেদিটা খুব বড় বৃত্ত না হলেও ওর মনে হয় এ এক অনিঃশেষ জ্বলন্ত পথ। ঐটুকু পার হতেই নন্দিনির জীবন বের হয়ে যায়।
একেবারে শেষ পদক্ষেপে এসে মনে হয়, একবার ঘুরে দেখি না, এই ক’বছরের সুখ- দুঃখ, শরীর-মন, দিবা-রাত্রীর সঙ্গী কর্পোরেটের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা আমার সুমিতের সুদর্শন বদন খানা। প্রজ্বলন্ত হাতের তালু, কবজি, কনুই, বাহু, কাঁধ সর্বাঙ্গ স্থির ধরে রেখে ও মাথা ঘোরায়, স্বামীর মুখ দেখবে বলে- কিন্তু, কিন্তু ওই গরাদের ওপাশে-
কে? ও কার মুখ?
তুলসি মঞ্চের গ্রীল যেন কয়েদখানার গরাদ, সেই গরাদের ফাঁকে দৃপ্ত অবয়বে বিদ্রুপে ঝলসানো ‘শাস্তি’র সেই এলোকেশী ‘চন্দরা’র মুর্তি-
‘বউ গেলে বউ পাওয়া যায়, ভাই গেলে ভাই পাওয়া যায় না’ চির সত্য এই আপ্তবানী শুনে ‘চন্দরা’র সেই রাগ, দুঃখ, অভিমান, প্রেমে মাখামাখি হওয়া অদ্ভুত মুখ-
নন্দিনীর মাথা ঘোরানো দেখে চন্দরা বলে উঠল-
-‘আহ! মরণ’!
কতদিন আগে রাজর্ষির সাথে রবি ঠাকুরের ‘শাস্তি’ দেখেছিল। একবার দেখার পর আবার এবং আবার দেখেছিল, কেবল এই ‘চন্দরার’ জন্য। এই নিয়ে রাজ মাঝে মাঝেই মশকরা করে ওকে ‘চন্দরা’ বলে ডাকত।
বৃত্ত ঘোরা শেষ হতে না হতেই সুনীতি এক লাফে এসে বৌদির হাত ঝাঁকুনি দিয়ে সতীত্ব প্রমাণের কষ্টি পাথর ফেলে দিয়ে রাগান্বিত স্বরে হিস হিস করে বলে ওঠে- এনাফ বৌদি! এনাফ! যত্তসব…
পেছন থেকে বিদ্যাংকুর উচ্চবিদ্যালয়ের কঠোর আদর্শবান প্রধান শিক্ষক গলা খাঁকারি দিয়ে বলে ওঠেন- ‘সুমিতের মা, বৌমাকে ঘরে নিয়ে যাও’।
এতক্ষণে মা ঠাকরুণেরও স্বর ফোটে- তিনি বেশ উচ্চকিত স্বরেই বলে উঠেন-
‘বলেছিলাম না! আমি বলেছিলাম না! বৌমা সতী, আমার ঘরের লক্ষী প্রতিমা। দেখেছ, কেমন তার সতীপনার জোড়, তোমার সবেতেই বাড়াবাড়ি, শোন কালই আমার সতী লক্ষীর জন্য জামদানী শাড়ি আর একখানা গলার হার কিনে আনব। কিচ্ছুটি কইতে পারবা না কিন্তু হ্যাঁ- এই আমি বলে রাখলাম’
নন্দিনীর শ্বশুর ‘হুম’ জাতীয় একটি শব্দ করলেন।
বৈশাখের আকাশ বুঝি এতক্ষণে থম ধরা ভাবটা ছেড়ে বাতাস দিয়ে উঠল।
বৌমার কাঁধ জড়িয়ে ওর শাশুড়ি সস্নেহে বললেন-
‘চলো মা, ঘরে চলো, কইরে খোকা! বৌমাকে নিয়ে ঘরে যা। ওর হাতে একটা ক্রিম ট্রিম লাগানোর ব্যাবস্থা কর’…
নন্দিনী স্থির দাঁড়িয়ে সোজা তাকায় এই বাড়ির প্রবেশদ্বারের দিকে। প্রবেশ পথই তো প্রস্থানেরও পথ। পথ একই আসাও যায়, যাওয়াও যায়। এই এক চিলতে উঠোন দু কদমে পার হলেই চৌকাঠ, আর চোকাঠ ডিঙ্গালেই বাইরে সেই অবাধ পৃথিবী যেখানে সতী অসতী সবাই এঁটে যায়।