ঈদসংখ্যার গল্প।। অপিরিচিতা ও আমি।। নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীর
তিনি আজ গভীর রাতে আমার ঘরে এসে উপস্থিত হবেন আমি ভাবতে পারি নি। আমি আসলে কল্পনাও করতে পারি নি, কখনো এমনটা ঘটবে। আমি জেগেই ছিলাম। এমন অনেক রাতেই ঘুম না এলে পাশের ঘরে গিয়ে টেবিল বাতি জ্বালিয়ে লিখতে চেষ্টা করি। যাতে আর কারো ঘুমের ব্যাঘাত না হয়। তবুও কখনো কখনো আমার শয্যাসঙ্গীনি ঘুম থেকে জেগে ধমক দেয়, আস, বিছানায়। রাত জাগলে শরীর খারাপ করবে। আমি কথা না বাড়িয়ে সুবোধ বালকের মতো বিছানায় গিয়ে তার পাশে শুয়ে চুপ করে অন্ধকারে চোখ মেলে তাকিয়ে থাকি। অন্ধকার আমি উপভোগ করি। তখন কত কী যে চোখে ভাসে। আলোতে যা কখনো দেখি না আঁধারের পর্দায় সে সব ভেসে ওঠে। আমি দেখতে থাকি, স্তব্ধতার বুকে কান পেতে রাখি আর এ নগরের কোলাহলে হারিয়ে যাওয়া কথা সব কানে ডলবি থিয়েটারের শব্দের মতো কানে বাজতে থাকে। আমি যা দেখি, যা শুনি সিনেমাকে হার মানায়। দারুণ সময় কাটে তখন। সিনেমা থিয়েটারের অন্ধকারে যেমন করে নিজের অজান্তে সময় চলে যায় আলো ফুটে উঠলে কোলাহল শুরু হয় তেমন করেই যেন রাত শেষে বাইরে কোলাহল শুরু হয়। তখন ঘরের পর্দায় আলোর আভাস দেখা গেলে আঁধারের রূপ দেখা, এর গল্প শোনাও আমার থেমে যায়। আবার আমি নিত্যকার অভ্যস্ত দিনে ফিরে আসি। গতরাতটা এমন ছিল না। গতরাতে ঘুম আসছিল না বলে আমি চুপি চুপি বিছানা ছেড়ে ওঠে বসার ঘরে গিয়ে টেবিল বাতি জ্বালিয়ে বসেছিলাম। কম্পিউটার চালিয়ে নিয়ে একটা কিছু লিখব ভাবছিলাম। কিন্তু কিছুই মনে আসছিল না। তখন ফেইসবুক দেখছিলাম। ইদানীং ফেইসবুক চুপি চুপি দেখতে হয়। এতে আমার নেশা হয়ে গেছে বলে শয্যা সঙ্গীনি মনে করে। আমি একসময় আমি তার প্রেমের নেশায় পড়েছিলাম। তার প্রেমের পাগল ছিলাম, এখন ফেইসবুকের পাগল। নেশা ছিল সে। এখন ফেইসবুক আমার নেশা ও প্রেম। আমাকে সে পাহারা দিয়ে রাখে। যেন আমি পরকীয়া করি। সে এখন ঘুমিয়ে আছে, তবুও তার কথা মনে হতেই ফেইসবুক থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিলাম। তবে চোখ সরিয়ে নেবার আগে মেয়েটির ফটোটা আমার মনে ঢুকে পড়ল। হাসি হাসি একটা মুখ। আমি মনে মনে তাকে সমীহ করে দ্রুত চোখ সরিয়ে নিতে গেলে শিরোনামটায় চোখ আটকে গিয়েছিল।
তার সাথে আমার কখনো আগে দেখা হয় নি। আমি কেবল ফেইসবুকে তার ফটো দেখেছি। তাকে দেখে কিংবা তার সাথে একটা ছেলেকে দেখে আমি কোনো মন্তব্য করি নি। মন্তব্য করার প্রয়োজন আছে মনে হয় নি। তার সিদ্ধান্ত আমার পছন্দ হয়েছে। তাকে সাহসিনী মনে হয়েছিল। এমন নজির নতুন নয়। সাধুবাদ জানাতে গিয়ে জানাই নি যে ভালো করেছি। তা করলে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হতো সেটাও বুঝতে পারছি।
তিনি তার নিজের জীবন যাপনের যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন সেটা অবশ্যই ন্যায়সঙ্গত। এই নারী কোনো অন্যায় করেন নি। অথচ তাকে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছে। আমি মনে মনে তাকে স্বাগত জানিয়েছিলাম। আমি প্রসঙ্গটা মন থেকে মুছে ফেলার জন্য ফেইসবুক বন্ধ করে কিছু একটা লেখার জন্য কম্পিউটারের ওয়ার্ড ফাইল খুলে বসি। ভাবতে থাকি কী লিখব। কিন্তু মাথায় কিছু আসছে না, একসময় মনে হতে থাকে আজ মাথাই কাজ করছে না। কেবল মেয়েটির মুখটা কম্পিউটারের পর্দায় ভেসে উঠছে।
আমি তখন কম্পিউটার বন্ধ করে বসে থাকি। নতুন কিছু, অন্যকিছু ভাবতে চেষ্টা করি। একসময় ভাবি, যাই, বিছানায় গিয়েই গড়াগড়ি খাই। ওঠে যাব, আর তখন দরোজায় টোকা পড়ল। আমি ভেবেছিলাম, বাতাসে কড়া নড়েছে। অথবা কোনো রাতচড়া প্রাণি নড়েছে। আবার যখন কয়েকবার কড়া নড়ল তখনও বাতাস বলেই মনে করলাম। এর পর নিজের কানেই শুনলাম কারো গলা। দরোজার কাছে গিয়ে দাঁড়ালে চুড়ির ঝনাৎ শব্দে ঔৎসুক বেড়ে গেল। ফোকর দিয়ে দেখতে পেলাম চেনা একটা মুখ। অবাক হলাম এত রাতে আমাদের দরোজার সামনে কেন! দ্বিধা নিয়েও দরোজা খুলেই ফেলি।
একজন নারী কিছু না বলে ঘরে ঢুকে পড়লেন! আমি বিব্রত। কিন্তু তিনি তো ঘরে ঢুকেই পড়েছেন। আমি শোবার ঘরে যাবার উদ্যোগ নিতে তিনি হাত চেপে ধরেন, দোহাই, আপনার। যাবেন না। আর কাউকে জাগাবেন না।
কেন?
আমাকে কেউ সইতে পারে না।
ঘরে আমার স্ত্রী রয়েছে। তাকে ডাকি। সে…
না, না। তাকে ডাকবেন না। তিনিও আমাকে সহ্য করতে পারবেন না। আপনি তো তাকে চেনেন না। আর গভীর রাতে আমার কাছে আপনাকে দেখে সে তো আমাকে সন্দেহ করবে! আপনাকে কি এমনিতেও সন্দেহ করেন না? সন্দেহ না থাকলে কেউ কাছে রাখে না, থাকেও না। আপনি তার বিশ্বাসের মর্যাদা সবসময় দিয়ে যাচ্ছেন তবুও তিনি কি আপনাকে সেরকম বিশ্বাস করেন?
আমি উত্তর দিতে পারি না। চুপ করে থাকি।
দেখুন, বিশ্বাস একান্তই নিজের। আমরা প্রত্যেকেই বিশ্বাসের দাসত্ব করি আবার বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলায় দুলে দুলে জীবন কাটিয়ে দিই। কিছু বিষয় জন্মগতভাবে প্রমাণ ছাড়াই বিশ্বাস করি। কিছু বিষয়ে সংশয় জাগলেও সে সংশয়কে ধামাচাপা দিয়ে রাখি। আর কিছু বিষয় না জেনেই বিশ্বাস করি, আর কিছু বিষয় যে মিথ্যা তা জেনেশুনেও বিশ্বাস করি। কিছু বিষয় মিথ্যা জেনেও সত্য বলে প্রকাশ করি। এমন কিছু আছে যা অতীতে সত্য বলে লোকে বিশ্বাস করত, সেগুলো সত্য নয় জানার পরএখনো লোকে বিশ্বাস করে। আবার মিথ্যা জেনেও সেগুলোকে মিথ্যা বলে না, অভ্যাস অথবা ভয় কাজ করে মনে। মানুষ এমনই। ব্যক্তি আসলে জানতে পারে না সে কেন জন্ম নিয়েছে, কেন মৃত্যুকেও কাছে ডেকে নেয়। কী বিশ্বাস করবে, কেমন জীবন যাপন করবে সেটা তার ইচ্ছায় হয় না। যেমন আমার কথাই ধরুন, আমি কেমন জীবন চেয়েছিলাম সেটা সকলেই জেনে গেছে। কিন্তু সেটা তো হলো না। এতে আমার কোনো হাত নেই। জীবনানন্দ কেমন জীবন চেয়েছিলেন আপনিও জানেন। আমরা তাঁর অসম্পূর্ণ জীবনের জন্য আফসোস করি। আরও কত কত মহামানব-মহামানবী পৃথিবীতে এসেছিলেন। তাঁরা যে জীবন চেয়েছিলেন কেউ কি পেয়েছেন?
তিনি প্রশ্ন করে থামলেন। উত্তর আমার জানা নেই। চাইলে তর্কের জন্য তর্ক করা যায়। আমি সেটা চাই নি। আমি তার কথা অভিভূত হয়ে শুনে যাচ্ছিলাম। আরও কিছু বলবেন আন্দাজ করতে পারি। আমরা কেউ প্রশ্ন রেখে প্রসঙ্গ শেষ করি না। সাধ্যমতো নিজের সিদ্ধান্তে আসি।
একজন অচেনা নারী এমন সাবলীলভাবে আরেকজন অচেনা পুরুষের কাছে তার বিশ্বাস ও বোধের কথা বলতে পারেন এ অভিজ্ঞতা আমার ছিল না। তবু্ও আমি বিব্রতবোধ করতে থাকি। আমি মনে মনে চাই তিনি চলে যান, আবার আমার মন চায় তিনি আরও কিছু বলুন। তিনি আমার অজান্তেই নিঝুম রাতে আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেন। কিন্তু আমি মনে মনে ভয় পেতে থাকি। যদি আমার স্ত্রী জেগে ওঠে একজন নারীর সাথে গভীর রাতে আমাকে আড্ডা দিতে দেখে আমি কীভাবে সামলাব? এমন একটা পরিস্থিতি কী সামলানোর মতো? এমনিতেই জীবনের অনেক সময় অপচয় হয়ে গেছে কখনো ঠাণ্ডা যুদ্ধে, কখনো যুদ্ধের মহড়ায়। যাক ঘরের কথা না বলাই শ্রেয়। এ নারী আমার কোনো আত্মীয়া হলে যত রাতই হোক কথা ছিল না। নিদেন পক্ষে কোনো পরিচিতা। অথবা এই নারী যদি আমার স্ত্রীর পরিচিতাও হতো তাহলেও কোনো অজুহাত দেখানোর চেষ্টা করতে পারতাম।
আমি তাকে নিয়ে এখন এই নিস্তব্ধ রাতে কী করি! তাকে যদি জোর করে বের করে দিতে চাই তাহলে তিনি কি সহজে সেটা মেনে নেবেন? এই নারী আমার অনুমতি ছাড়া আমার ঘরে ঢুকে পড়েছেন, এসে আমার সামনে বসে এমনভাবে কথা বলছেন যেন তিনি আমার অনেকদিনের চেনা। অথচ তার সাথে আমার কখনো দেখা হয় নি। আর তিনি কথা বলছিলেন কোনো সম্পর্কমূলক সম্বোধন ছাড়াই।
আমি জানতে চাই, আমি কি আপনাকে কোনো ভাবে সাহায্য করতে পারি?
আমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে তিনি হাসলেন। তাকালেন বইয়ের তাকের দিকে। নীরবে হেঁটে গিয়ে হাতে তুলে নিলেন একটা বই। কাফকা রচনাসমগ্র। ওটা রেখে দিয়ে জীবনানন্দের কবিতাসমগ্র হাতে নিলেন। কিছুক্ষণ পর জীবনানন্দ রেখে দিয়ে আবার আন্না কারেনিনা হাতে নিলেন। ওটা খুলে মাঝখানের একপৃষ্ঠায় চোখ বুলিয়ে যাচ্ছেন।
আমি বুঝতে পারি এই নারীর বই পড়ার অভ্যাস আছে। আরও আন্দাজ করি, তিনি খুব ভালো পাঠক। আর কথার যুক্তিতে প্রজ্ঞার ঝিলিক তো আছেই। আমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে তিনি আমাকে উল্টো প্রশ্ন করেন,
এসব বই কেন তাকে সাজিয়ে রেখেছেন?
আমি এরকম প্রশ্ন আশা করি নি। একবার ভাবি, বলি আছে বলেই তো আপনি হাতে নিয়ে উলটে দেখছেন। কী কী বই ঘরে আছে আন্দাজ করতে পারছেন।
কিন্তু বই নিয়ে এমনটা বলা যায় না। বরং সহজ করে সহজ কথাটাই তাকে বলি,
আমি একসময় বই পড়তাম। এসব বই রেখেছিলাম পুনর্বার পড়ব বলেই। এখন আর সময় পাই না। বাসা বদলের সময় লাইব্রেরিতে দিয়ে দিতে চেয়েছিলাম। দেয়া হয় নি, সন্তানদের কথা ভেবে রেখে দিয়েছি। ওরা না পড়লেও পিতার স্মৃতি ধরে রাখবে ভেবেছি। তাই যত্ন করে রাখা আর কি।
আপনি কি জানেন না শেষ পর্যন্ত পৃথিবীর সকল জ্ঞান পোকার পেটে যায়?
জানি, তবুও মানুষই জ্ঞানের কদর করে।
সত্যি নয়।
কীসের কদর করে বলে আপনি মনে করেন?
যা হারিয়ে ফেলে কেবল তার কদর করে।
জীবনানন্দ আপনার প্রিয় কবি? আমি প্রশ্ন করি।
এ পৃথিবী একবার পায় তারে পায় নাকো আর।
সত্যিই তাই। তবুও মানুষ চিনতে পারে না তাকে।
আসলে কেউ কাউকে চিনতে পারে না। কেবল চেনার অভিনয় করে। যেমন কেউ কাউকে ভালোবাসে না, ভালোবাসার অভিনয় করে।
তাহলে একসঙ্গে জীবন যাপন, সংসার সন্তুতি ত্যাগ, শোক এসবকে কীসের বহিঃপ্রকাশ?
এসব হতে পারত ভালোবাসা আর অর্থবহ জীবনের অনুষঙ্গ। মানুষ ভাবতেও চায় সেরকম করে, বিশ্বাস করতেও চায়। তবু্ও যা বিশ্বাস করে সেটা তা নয়।
আমি আর কথা বাড়াতে চাই না। কিন্তু তাকে যেতেও বলতে পারি না। নিশুতিরাতে একজন নারীকে ঘর থেকে বের করে দিই কী করে? আবার তাকে ঘরে রাখিও কী করে! আমি উভয় সংকটে পড়ে গেছি।
আমি রাত জাগায় ক্লান্তি বোধ করছি। কিন্তু আপনার জন্য ঘুমাতে যেতে পারছি না।
আমি দুঃখিত। আমি আপনার ঘুম নষ্ট করে দিলাম। আর কিছুক্ষণ। এখনই অন্ধকার কেটে যাবে। আমি চলে যাব। আপনি, আপনারা আরাম করে ঘুমাতে পারবেন।
ভালো কথা, আপনার পরিচয় তো আমার জানা হলো না।
একজন নারীর পরিচয় জানা কি অত সহজ?
মানে?
কেবল অতটুকু জেনে রাখুন, আমি একজন নারী। খুবই সাধারণ নারী। যে আপনার জীবনের কিছুটা সময় নিয়ে চলে গেল।
শোবার ঘর থেকে একজন বেরিয়ে এসে বলে, সারারাত ঘুমাও নি! কী করে সারারাত কাটালে?
আমি তটস্থ হয়ে এদিক ওদিক তাকাই। কিন্তু ঘরের কোথাও আর কাউকে দেখতে পেলাম না। দরোজার সিটকিনি তো লাগানোই আছে। তাহলে?
আমার শয্যা সঙ্গীনির প্রশ্নের উত্তরও আমি দিতে পারি না, উত্তর দেয়া সম্ভবও নয়। আমার কথা বিশ্বাস করবে না। আমি জানি, তাকে রাতে ঘটে যাওয়া সব কিছু বললেও সে বলবে, যা বললে সেটা একটা আষাঢ়ে গল্প মাত্র। গতকাল যে নারী আত্মহত্যা করেছে, যার মরদেহ তার ঘরে পাওয়া গেছে সে আজ রাতে কী করে এসে তোমার সাথে কথা বলে! যতসব আজগুবি চিন্তাভাবনা। যাও, ঘুম না এলে ঘুমের ওষুধ খাও।