ছোটগল্প

ঈদসংখ্যার গল্প।। রূপকথার মতো।। বাসার তাসাউফ

`এটাই কি স্বর্গগ্রাম?’ জিজ্ঞেস করতেই সবুজ ঘাসের গালিচা বিছানো আলপথ ধরে হেঁটে আসা কিষান ফিরোজ মিয়া আমায় বলে, ‘ধানক্ষেতের সোনালি শীষের দোল খাওয়া দেখতে দেখতে নরম মাটির আলপথ ধরে হাঁটুন আর ভাবুন এটা স্বর্গগ্রাম কি-না…!’
স্বর্গগ্রামের লোকজন খুব সুন্দর করে কথা বলতে পারে। এই কিষান তার প্রমাণ। আমি এখানে আসার হওয়ার আগে যা শুনে এসেছি, তা মিলে যাচ্ছে।
এই গ্রামের কিষানেরা লাঙল চালিয়ে মাটির বুক ফালা ফালা করে ফসল ফলায়। ধান, গম, আঁখ, উচ্ছে, বেগুন, আলু থেকে শুরু করে প্রায় সব ফসলই ফলায় তারা সুনিপুন ও সুচারুরূপে। তাদের উদয়-অস্ত মাঠে
কাটে ফসল বুনে, ফসল তোলে। তাদের স্ত্রীরা শোলমাছের শুটকির ভর্তা আর বোয়ালমাছের মাথা দিয়ে ঝোল রান্না করে মাঠে যাওয়া স্বামীর অপেক্ষায় বসে থাকে, ভুল করেও স্বামীর আগে মুখে তুলে না, এমনকি লবণ দেখার ছলেও কিছু খায় না। তারা বিশ্বাস করে, বউদের আগে খাওয়া ঠিক না। পরিবারের সবার খাওয়া শেষ হলে হাঁড়ির তলানিতে পড়ে থাকা ছেঁচা ভাত ও তরকারির অবশিষ্ট ঝোল খেয়ে সন্তুষ্ট থেকে তারা পরের বেলার রান্নার আয়োজন নিয়ে ভাবে। ছেলেরা প্রাক-কৈশোরে বগলের তলে বই নিয়ে পাঠশালায় যায় আর মেয়েরা যুবতি হয়ে ওঠার আগে শেখে কীভাবে ধান মাড়াই করতে হয়? কীভাবে সিদ্ধ ধান রোদে শুকিয়ে চাল বানাতে হয়?
কোমড়ে গামছা বেঁধে কিষানেরা সারাদিন মাঠে ফসল ফলাতে ব্যস্ত থাকলেও অতিথি পেলে সানন্দে কাছে টেনে নিতে ভুলে না। এই যেমন ফিরোজ মিয়া আমাকে কত আপন করে কাছে টেনে নিয়েছে। আজ সারাদিন সে আমাকে নারীর মাথার সিঁথির মতো সরু আলপথটি ধরে হাঁটতে হাঁটতে স্বর্গগ্রামের আদ্যেপান্ত চিনিয়ে এর নিগূঢ় কিছু তথ্য জানিয়েছে।
কুমিল্লা জেলার হোমনা উপজেলার অন্তর্গত অনন্তপুর নামের এই গ্রামটিতে অনন্তকাল ধরে যে সব মানুষ বসবাস করছে, তাদের কাছে গ্রামটি স্বর্গের মতো সুন্দর ও প্রিয়। এজন্য মূূূল নামটি ভুলে গিয়ে গ্রামবাসী তো বটেই, আশপাশের পাঁচ-দশ গ্রামজুড়ে গ্রামটি ‘স্বর্গগ্রাম’ নামে খ্যাত হয়ে আছে।
স্বর্গগ্রামের রূপ-সৌন্দর্র্য সম্পর্কে ফিরোজ মিয়ার মুখে আমি যা শুনেছি তা লিখে বর্ণনা করা সম্ভব নয়।
যে সময়ের কথা বলছি, চল্লিশ বছরেরও বেশি সময় আগে অতীত হয়েছে। সেই যুগের স্মৃতি আছে; কিন্তু কোনো ছবি নেই ফিরোজ মিয়ার কাছে। ছবি থাকলে আপনাদেরও দেখিয়ে বোঝাতে পারতাম, একসময় এই গ্রামটি কী রকম সুন্দর ছিল!
ছবি না থাকুক, ফিরোজ মিয়া তো আছে। তার কাছে আমি যে রকম শুনেছি ঠিক সেরকমই বর্ণনা করছি।
আপনারা চাইলে আমার বর্ণনানুসারে পুরনো সেই গ্রামের ছবিটা কল্পনা করতে পারেন অথবা কল্পলোকে সাজিয়ে নিতে পারেন নিজের ইচ্ছেমতো। গ্রামের পূবপাশে জলশূন্য যে নদীটি আছে, সেটি এমন জলশূন্য, বিশীর্ণ ছিল না। ছিল জলপূর্ণ ও স্রোতস্বিনী। আপনি চাইলে নদীটিকে আবারও বিশীর্ণ কিংবা স্রোতস্বিনী বানিয়ে গ্রামের পশ্চিমে, উত্তরে কিংবা দক্ষিণে যে কোনো প্রান্তে বসাতে পারেন। গ্রামের মানুষ তাতে কোনো আপত্তি করবে না। নদীর তীরে কাশফুলের গাছ, জলে ভাসমান রঙিন পালের নৌকো, হালধরা মাঝির কণ্ঠে ভাটিয়ালি গান আর বৈঠার টানে জলের কলকল ধ্বনিতে আপনি মুগ্ধতা ছড়াতে পারেন। কতটা মুগ্ধতা ছড়াবেন সেটা আপনার রুচিবোধ ও মর্জির ওপর নির্ভর করে। মর্জি ভালো থাকলে আপনি সেখানে বক, গাঙ্চিল এবং মাছরাঙ্গাদের নিয়ে আসতে পারেন। যদি একসঙ্গে তিনটিকে ভালো না লাগে, দেন যে কোনো একটি ফেলে।
এখানেও কেউ আপত্তি করবে না।
গ্রামটিকে এবার বানিয়ে নিন সবুজ বৃক্ষের ছায়া ছায়া মায়াময় নিভৃত একটি ভূ-খণ্ড। সেই অনুপাতে আম, জাম, কাঁঠাল, লিচু, পেয়ারা, আতা, কতবেল, জামরুল, বকুল, মেহগনি, নীপ, কদম, তেঁতুল, শেওড়া- এসব গাছ তো আছেই, তেঁতুল যদি অপছন্দ হয় আর শেওড়াতে যদি ভূতের ভয় থাকে, তো বরই, কমলালেবু অথবা আমলকি-টামলকি কিছু একটা লাগিয়ে নিন।
গ্রামের অভ্যন্তরে এসে ঠিক করুন সেখানে কাদেরকে রাখবেন। লেখকরা যেভাবে গল্প-উপন্যাস কিংবা নাটকের প্লট সাজায়, যেসব কুশীলবে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে একটি কাহিনি- সেই সবই আছে এই গ্রামে। একটি প্রাইমারি স্কুল আছে। এটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল দেশ স্বাধীন হওয়ার কয়েকক বছর আগে। কয়েকটি মক্তব আগে ছিল, এখনও আছে। এই গ্রামের মুসলিম সব মানুষেরই ধর্মীয় শিক্ষার হাতেখড়ি হয় মক্তব থেকে। খুব ভোরে যখন ঘরের কোণের খোঁয়াড়ের ভেতর থেকে মোরগগুলো ডেকে ওঠে- তখন গ্রামের লোকজনের ঘুম ভাঙে। তখন বড়রা যায় কাজে আর ছোটরা যায় মক্তবে।
আপনার কল্পিত গ্রামে একটি প্রাইমারি স্কুল ও কয়েকটি মক্তব ছাড়াও একটি হাইস্কুল, একটি কলেজ, একটি মাদরাসা, একজন ধর্মশিক্ষক, একজন মৌলবী, একজন লজিংমাস্টার, একজন ঠাকুর, একজন মাতব্বর, একজন খুনী, দু-একজন পাগল, কিছু চোরচোট্টা ও একজন দুশ্চরিত্রা রাখতে পারেন।
মুক্তিযোদ্ধাদের কথা এখনই টেনে আনবেন না। আপাতত বাদ রাখুন রাজাকারদের কথাও। কারণ এই গল্পে তাদের কথা অবধারিতভাবে চলে আসবে। এ ছাড়াও গ্রামে যে সাধারণ জনতা আছে অযুত-নিযুত এবং যারা বাদ পড়ল তাদেরও সময়মতো বসিয়ে নেয়া যাবে।
এবার গ্রামের প্রকৃতিতে নজর দিন।
স্বর্গগ্রামে ছয়টি ঋতুতে ছয় রকমের রূপ দেখা যায়। বর্ষাকালে বিশীর্ণ সেই নদীর জল বেড়ে গিয়ে ফসলের মাঠ জলে সয়লাব হয়ে যায়। আবার চৈত্র-বৈশাখে হয়ে ওঠে শুকনো মরুভূমি। তখন লোকজন সেটিকে বলে পাথার। আপনি চাইলে নিধুয়া পাথারও বলতে পারেন। নদীর ওপারে আনতে পারেন আরও দু- একটা গ্রাম, স্বর্গগ্রামের মতোই। তবে স্বর্গগ্রামে আসা কিংবা এখান থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য কোনো সড়ক রাখা যাবে না। তখন পায়ে চলার জন্য জমির পাশ দিয়ে রমণীর মাথার সিঁথির মতো যে আলপথ ছিল, সবচেয়ে উঁচু ও চওড়া আলপথটাকে গ্রামের মানুষ জাঙ্গাল বলে জানত এবং সেটা ধরেই তারা চলাচল করত। এখন যেখানে যেখানে উঁচু ও চওড়া আলপথ দেখবেন গ্রামের মানুষের মতো আপনিও সেটিকে জাঙ্গাল বলে জানুন। খুব প্রয়োজন পড়লে কিংবা গ্রাম থেকে ধান ও পাটের বস্তাগুলো গঞ্জে বয়ে নিয়ে যেতে চাইলে জাঙ্গালের ওপর দিয়ে গরু-মহিষের গাড়িগুলো চলতে দিন। অবশ্য এজন্য আপনি সময় পাবেন মাস তিনেক- পৌষ, মাঘ আর ফাল্গুন। এ সময়ে মাঠে কোনো পানি বা ফসল থাকে না। বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ-আষাঢ়ে শুরু হয় ঝড়-বৃষ্টি। তখন গরু-মহিষের গাড়ি চলার কোনো উপায় থাকে না। তখন থেকে পরের বছর অগ্রহায়ণ, পৌষ ও মাঘ মাসের আগের সময়ে মানুষের চলাচলের জন্য উপায় হিসেবে নৌকো নিয়ে আসুন। ইঞ্জিনে চালিত ট্রলারও আনতে পারেন। তবে সেটি কেবল দূরের গাঁয়ে গমনের জন্য। মহিলা কিংবা নাইয়র যাওয়া বউদের জন্য ছই লাগিয়ে নিন সেই নৌকোয়, সঙ্গে লাগিয়ে নিন রঙিন একখানি পাল।
বাতাসে পাল উড়িয়ে যেতে যেতে যদি চোখে পড়ে পুরনো কোনো ব্রিজ এবং নৌকোটি সেই ব্রিজের তলে
দিয়ে যাবার সময় আপনি মুখে ‘তা, তা’ ধ্বনি করে প্রতিধ্বনি শুনতে পারেন। আপনি যদি এটিকে ছোট
বাচ্চাদের দুষ্টুমি ভেবে হেসে উঠেন, তাহলে আরেকটু সামনে এগিয়ে খুঁজে নিন বুকসমান জলে নেমে কাঁচি
দিয়ে পাট কেটে কেটে জাগ দিচ্ছে কি-না কোনো বুড়ো কিষান। যদি পেয়ে যান তেমন কাউকে, আগুন আছেনি
ভাই, একটা বিড়ি ধরামু বলে উচ্চকণ্ঠে হাঁক দিয়ে নৌকোটি ঘুরিয়ে সেই কিষানের কাছে গিয়ে থামুন।
কিষান কোমড়ে গুঁজে রাখা দিয়াশলাই থেকে একটি কাঠি জ্বেলে আপনার মুুখের সামনে ধরলে জলন্ত কাঠি
থেকে বিড়ি কিংবা সিগারেটে আগুন ধরিয়ে নিন-।
আপনার যদি এসব কথা শোনার আগ্রহ না থাকে অথবা আপনি যদি শুধু মূল গল্পটিই শুনতে চান কিংবা
যদি মনে করেন মূল গল্পটি শোনার আগে এসব কথা শুনে শুধু অকারণে সময় নষ্ট হচ্ছে এবং কতটুকু
সময় নষ্ট হচ্ছে সেটি হিসেব করতে চান— তাহলে স্বর্গগ্রাম থেকে আপনাকে ফিরে আসতে হবে। কারণ
সময় জানার জন্য স্বর্গগ্রামে কোনো ঘড়ি পাবেন না। ভুলে যাবেন না, আপনি এখন আছেন বায়ান্ন বছর
আগের পৃথিবীতে- যখন কম্পিউটার ছিল না, মোবাইলফোন ছিল না, সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং ছিল না,
এসএমএস, চ্যাট, ম্যাসেঞ্জার, ইমু, ভাইভার, হোয়াটসআপ, স্কাইপি- এসব কিচ্ছু ছিল না! তখন
স্বর্গগ্রামের মানুষেরা সূর্যকে ঘড়ি বানিয়ে হিসেব করত সময়ের। নামাযের সময় হয়েছে কি-না সেটি বুঝতে হলেও আকাশের দিকে তাকাতে হতো। আকাশে সূর্যের অবস্থান দেখে তারা বুঝে নিত সময়।
সূর্যঘড়িই ছিল সময় নির্ধারণের একমাত্র উপায়। তবে কখনও কখনও এভাবে সময় নির্ধারণ করাও সম্ভব হত না। বিশেষ করে বৃষ্টির দিনে, যখন সূর্যটা মেঘের আড়ালে ঢেকে থাকত কিংবা শীতকালে লুকিয়ে থাকত কুয়াশার গহিনে- তখন সঠিক সময় নির্ধারণ করা যেত না। বেশিরভাগ সময় রাতেই এমন হতো। রাতে তো সূর্য থাকে না। রাতের অন্ধকারের বুক চিরে পূব আকাশে একফালি আলোর রেখা দেখা দিলে যখন মোরগগুলো ডেকে উঠত- তখন গ্রামের মানুষেরা বুঝে নিত ভোর হয়েছে।
তখন স্বর্গগ্রামে বিদ্যুৎ ছিল না। গোধূলি লগনে পশ্চিম দিগন্তে সূর্যটা ডুবে গেলে গ্রামজুড়ে নেমে আসত অন্ধকার। সন্ধ্যেবেলায়ই কেরোসিনের কুপি কিংবা হারিকেনের আলোয় রাতের খাবার খেয়ে কারও না কারও খোলা উঠোনে জড়ো হয়ে কিচ্ছা-কাহিনি, মেয়েলি গীত কিংবা পুঁথি পাঠের আসর জমিয়ে হালকা বিনোদনে মেতে উঠত কর্মক্লান্ত মানুষগুলো। রাত গভীর হলে প্রকৃতিতে নেমে আসত রহস্যময়তা। অরণ্য আঁধারে প্রেতিনীর কান্না, শেওড়াগাছে ভূত অথবা অশরীরী আত্মার আনাগোনা আর কামরূপ-কামাক্ষ্যার ভয় ছিল রূপকথার মতো। কামরূপ-কামাক্ষ্যার সীমানার ভেতরে চলে গেলে কোনো পুরুষ জীবিত ফিরে আসতে পারত না। সেখানে ভেড়া বানিয়ে রেখে দিত। তাই এর ভয়ে দরজায় খিল এঁটে ঘুমিয়ে থাকত গ্রামের ছোট ছেলেমেয়েরা। কেউ একা একা বাইরে বের হত না। সন্ধ্যা হওয়ার পর পরই বিছানায় গিয়ে নাকে-মুখে কাঁথা মুড়ে মা ও বাবার মাঝখানে গিয়ে শুয়ে থাকত।
আরেকটি বিষয় জেনে রাখুন, বিষয়টি শুধু জেনে রাখলেই হবে না। আপনাকে স্মরণেও রাখতে হবে। কেননা গল্পটা মূলত সেই বিষয়টি ভিত্তি করেই রচিত হয়েছে। গ্রামের মানুষ কামরূপ-কামাক্ষ্যার চেয়ে বেশি
ভয় পেত পাকিস্তানি হানাদার বাহিনিকে। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে যখন মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছিল- তখন এই গ্রামের লোকজনের দিন ও রাতের প্রতিটি মুহূর্ত কাটত আতঙ্ক আর উৎকণ্ঠায়। গ্রামের সামনে দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীটির উৎসমূল ছিল কুমিল্লা শহরে। শহর থেকে পাকবাহিনি বেশিরভাগ সময় এই নদীটির জলে লঞ্চ কিংবা স্টিমারে চড়ে যাতায়াত করত। তাদের যাতায়াতের মাঝখানে গ্রামটি ছিল বলে লঞ্চ কিংবা স্টিমার থামিয়ে মাঝে-মধ্যে গ্রামের সাধারণ লোকজনের ওপর আক্রমণ করত। এজন্য গ্রামের লোকজন কামরূপ-কামাক্ষ্যার চেয়ে বেশি ভয় পেত পাকিবাহিনিকে। পাকিবাহিনি কামরূপ-কামাক্ষ্যার চেয়েও বেশি ভয় জাগিয়ে স্বর্গগ্রামটিকে নরকপুর বানিয়ে রেখেছিল। তখন দিন ও রাতের প্রতিটি মুহূর্তে গ্রামের লোকদের জীপন যাপিত হত অনিশ্চিতভাবে। এখনও যারা বেঁচে আছে- হত্যা, লুন্ঠন আর ধর্ষণ ছাপিয়ে সেই দুঃসহ স্মৃতি ভুলতে পারেনি। এখনও সেই বছরের কোনও কিছু বলতে গেলে তারা বছরটিকে ‘সেই যে সংগ্রামের বছর’বলে অভিহিত করে…।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *